কাশ্মিরিয়ৎ

সাম্য সরকার

 

জাহাঙ্গিরের বয়স আঠারো। প্রত্যন্ত ইয়ুসমার্গের পাইনে ঘেরা দিগন্তবিস্তৃত সবুজ উপত্যকার মতো চোখজুড়ানো রূপ তারও। রূপে সে বলি, হলি যে-কোনও উডের নায়কদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আপাতত তার বয়সী অন্য অনেক কাশ্মিরি যুবকের মতো সে-ও তেরো-চোদ্দো বছর বয়স থেকেই ঘোড়ার সহিস। ইয়ুসমার্গে নাকি ছয়শো ঘোড়া আছে। একেকজনের দিন আসে সপ্তাহ দুয়েক পর পর। রোজগার আড়াই হাজার। তার থেকে বাদ যায় ঘোড়ার মালিক, সিন্ডিকেটের পয়সা। শীতের মরসুমে স্থানত্যাগ করে গ্রামে ফিরে যায় তারা। রোজগার বন্ধ। জীবন আর পেট চলতে থাকে।

কাশ্মির উপত্যকায় আর্দ্রতা গ্রীষ্মে, শীতে, বসন্তে সমানভাবে উপস্থিত। সেজন্যই এখানকার সবুজের এমন বাহার। পাহাড় গাছে ঘেরা, মাঠ ঘাসে ভরা। রুক্ষতার স্থান নেই প্রকৃতির কোথাও। দুই দিন যদি সূর্যদেব প্রখর হন, তৃতীয় দিনে বরুণদেব প্রকট হবেনই, আবহাওয়া এমনই আন্তরিক। আন্তরিক সেখানকার বাসিন্দারাও। সেটা টের পাওয়া যায় কাছে গেলে। আন্তরিকতা ব্যাপারটাই এমন, থাকলে প্রকাশ হয়ে পড়ে আপনিই। ধস নেমে রামবনে জম্মু-কাশ্মির হাইওয়ে নিখোঁজ। ইউপিআই ওয়ালেটে যথেষ্ট মজুত নেই। সময় বেরিয়ে যাচ্ছে হুড়হুড় করে। এগিয়ে এল ড্রাইভারভাই, মুস্তাক। “আপ সহি সলামত ঘর তো পহুঁছো, বাদ মে মুঝে পয়সা দেনা।” এমন অভিজ্ঞতা ভূভারতে আর কোথাও হয়নি। বিমানে বসে নিশ্চিন্তে চোখ বুজে ভাবছিলাম মুস্তাকের মতো পাতানো ভাই জীবনে আশীর্বাদ হয়ে না এলে কী হত আজ!

“সব কুছ খতম হো গয়া” বলে সেই মুস্তাকই ফোনের ওপার থেকে প্রায় কেঁদে ফেলল এপ্রিলের বাইশ তারিখ রাতে। একটা ভুল যেমন জন্ম দেয় অন্য ভবিষ্যতের তেমনি এক প্রজন্ম ভুল করে আর তার মাশুল চোকায় পরবর্তী প্রজন্ম। ভুলের সঙ্গে যখন জড়ায় রাজনীতি, তখন মাশুল চোকায় দেশ। দেখেছে পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব-পাকিস্তান। দেখছে কাশ্মির। অশুভ প্ররোচনায় বিপথগামী আবেগ যদি হাতে অস্ত্র তুলতে উসকায় তা শেষ হতে পারে সহস্র অভিশাপ কুড়িয়ে  কোনও এক পারের মাটির দু-হাত তলার কবরে, অর্ধবিধবাদের তালিকা আর একটু লম্বা করে উদ্দেশ্য সাধন না করেই— দেখেছে কাশ্মির। রাজনৈতিক স্বার্থে রোপণ করা অবিশ্বাস যখন ক্যান্সার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, মৃত্যু হয় গোটা শরীরের। সেই ছাই থেকে ফিনিক্স আবার উঠে দাঁড়াবে কিনা তা নির্ভর করে মানুষের শুভবুদ্ধির উপর। ইচ্ছে কতটা আন্তরিক তার ওপর। আমেরিকা-জাপান পেরেছে, দুই জার্মানি পেরেছে। আমরা পারিনি।

সামাজিক মাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় কেন। প্রেমের চেয়েও অপ্রেম, ভালোবাসার চেয়েও ঘৃণা বেশি দ্রুতগামী। অনেক কিছু না পাওয়া নিয়ে যাঁরা বেঁচে আছেন দিনরাত্রি, দ্বেষ-অপ্রেমের সহজ শিকার হন তাঁরাই— এমনটা ভাবা নেহাতই সরলীকরণ বোধহয়। শুভবুদ্ধিকে ক্রমাগত লালন করে চলতে হয় মনের ভেতর। অশুভ বুদ্ধি বুনো ঝোঁপ। একবার জন্মালে শিকড় ধরে টান না মারা পর্যন্ত থেকে যায়। কোনও মতিভ্রষ্ট মালি যদি সার, জল দেয় আগাছার গোড়ায় তখন সাধের বাগান হয় জঙ্গল। বাগানের আদি বাসিন্দারা মরে যদি না যায়, বেঁচে থাকে সংখ্যালঘু হয়ে। পহলগাঁও হামলায় নিহত কর্নেলের দেহের পাশে স্তব্ধ বসা কর্নেলজায়া হিমাংশির ছবি শোকের মুখ হয়ে উঠেছিল। বেশ সুবিধা হয়েছিল তাঁর সেই শোকস্তব্ধ ছবিকে পোস্টার করে মানুষের আবেগ আর বিদ্বেষ উস্কে দিতে। “কাশ্মিরি ও মুসলিম সমাজকে দায়ী করা উচিত নয়”, বলে যেই তিনি মন্তব্য করলেন অমনি রে রে করে মৌলবাদী রোষ তাঁর ওপরেই গিয়ে পড়ল। তাঁর দর্শন মৌলবাদী দর্শনের চেয়ে যে ভিন্ন।

জাহাঙ্গিরের সুন্দর মুখটা চোখে ভাসছে। দুধপোখরির রাস্তার পাশের ধাবার সেই চাচা যিনি রান্নার প্রশংসা শুনে তড়িঘড়ি আর এক বাটি নিয়ে আসেন— দাম নেন না; শুকনো ফলের পসার নিয়ে রাস্তার পাশে বসা প্রৌঢ়া— যাঁর ইচ্ছা নাতনি পড়াশোনা শিখে ডাক্তার হোক আর বড় হয়ে ভালো মানুষ হোক, ব্যস; কিংবা হোটেলে শাল বিক্রি করতে আসা সেই ভাই যে বোনের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে— এঁরা সবাই পৃথিবীর যে কোনও দেশের সাধারণ মানুষের মতো খেয়েপরে শুধু শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাওয়া মানুষ। পড়শি দেশেও এমন মা নিশ্চয়ই আছেন যিনি গান গেয়ে, ভূত, পরীর গল্প শুনিয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ান, নিজের ভাগের এক টুকরো মাংস সন্তানের জন্য তুলে রাখেন, এমন প্রেমিক আছে যে প্রেয়সীর দু-হাতের মধ্যে জীবন দেখতে পায়, অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীকে দেখে এমন অনেক শিশু আছে, হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজে এমন বহু বেকার যুবক-যুবতী আছেন। এমন মা, এমন প্রেমিক, এমন শিশু ও যুবক-যুবতীরা সব দেশে থাকেন। মসনদের রদবদলে যাঁদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয় না অথচ মিসাইল এসে পড়ে এঁদেরই মাথার উপর। ক্রোশ ক্রোশ পথ হাঁটেন, মাথা গোঁজেন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে এঁরাই। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মাতেন যাঁরা তাঁরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে রাতভর মিটিং করে সকালে বড়জোর একটা অ্যান্টাসিড খান আর ছক কষেন কীভাবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দেশপ্রেমের গণহিস্টিরিয়াকে কাজে লাগানো যায়।

এই মুহূর্তে সংখ্যাগুরু হয়ে বসে পড়েছেন যাঁরা ভারত আর ভারতীয়-র ধারণাটাই পাল্টে দিচ্ছেন খুব দ্রুত। অশোকস্তম্ভের শান্ত সৌম্য পশুরাজ আজ তেড়ে দাঁত খিঁচান। সাধারণ জনগণের অসহিষ্ণুতা রকেটে চড়ে ঊর্ধ্বগামী। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুর বাজা ভারতে আজ ভিন্নতা মানেই শত্রুতা। অপর মানেই শত্রু। অপরের পরিধি আজ আর সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত নেই। তার বিস্তারের মধ্যে এখন যুক্তিবাদী, সমাজ ও সাম্যবাদী, নাস্তিক, বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলের সমর্থক— সবই আছে। এই নির্মম ভারতবর্ষে আজ অশীতিপর পক্ষঘাতগ্রস্ত, খাইয়ে না দিলে নিজে থেকে খেতে পারেন না এমন বৃদ্ধকে সঙ্গীহীন অবস্থায় পাকিস্তানের বাসে তুলে দেওয়া হয়। সেই বাসেই তাঁর মৃত্যু হলে রাষ্ট্রযন্ত্র সে মৃত্যুর দায় নেয় না। নিজের দেশের নাগরিককে পে-লোডারে করে ছুড়ে ফেলা হয় প্রতিবেশী দেশে— নাগরিক সমাজ রা কাড়ে না। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে কিশোরীর নিস্পন্দ দেহ ঝুলতে থাকে কাঁটাতারে— মানবতা কোনও দায় নেয় না। দুধের সন্তানকে ছেড়ে, সংসার-পরিবার ছেড়ে মাকে, গৃহকর্ত্রীকে চলে যেতে হয় দাদার সংসারে আশ্রিত হতে। ঘর কাকে বলে, দেশ কোথায় থাকে— এ প্রশ্ন রাষ্ট্রকে করা অর্থহীন। রাষ্ট্রনেতা চাইলে বিনা আমন্ত্রণে প্রোটোকলের ধার না ধেরে, না জানিয়ে, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে পড়শি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে কোলাকুলি করতে পারেন। চাইলে আবার তাঁদেরই মাথায় বোমা ফেলতে পারেন। দেশের মানুষের চাওয়া, না-চাওয়া থাকতে পারে না। চেয়ারগুলিই ঠিক করে দেয় দেশের মানুষ কী চাইবে।

সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধবিমানচালক সোফিয়া কুরেশির বক্তব্য রেখে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা এক চমৎকার প্যাকেজিং ছিল। ভেতরের পাঁকপ্রবাহ একই আছে বোঝা যায় কাশ্মির, কাশ্মিরি ও মুসলিমবিদ্বেষ গণহিস্টিরিয়ার আকার নিলেও এতে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয় না, থামানোর সামান্যতম চেষ্টাও করা হয় না দেখে। কারণ এটাই কাম্য ছিল। এই হিংসা, এই বিদ্বেষের বিস্ফোরণটাই আসলে পুঁজি। এর তলায় অনেক কিছু চাপা দেওয়া যায়।

যেমন ভুলিয়ে দেওয়া যায় ঠিক এই মুহূর্তে খনিজ সম্পদ, আকরিক-অধ্যুষিত ছত্তিশগড়ে নিজের দেশের মানুষের (অবশ্য মানুষ নন, তাঁরা আদিবাসী) বিরুদ্ধে সেনা অভিযান চলছে। অবুঝমারে সাতাশজন আদিবাসী, ভারতের আদিম বাসিন্দা যাঁরা, দেশের জঙ্গল, পাহাড়ের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার যাঁদের তাঁরাই সংঘর্ষে মারা পড়েন। প্রাক্তন আইআইটি স্নাতক অসুস্থ বাসভরাজু মারা যান এনকাউন্টারে। কারেগুট্টা পাহাড়ের সংঘর্ষে যে বত্রিশজন মারা যান, তাঁদের মধ্যে ষোলোজনই ছিলেন মহিলা। কোন পরিস্থিতিতে দেশের মহিলারা হাতে অস্ত্র তুলে নেন?

মাওবাদী মুক্ত করার পর মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলিতে লৌহ আকরিক উত্তোলনের জন্য জঙ্গল কেটে ফেলার অনুমতি পায় লয়েড মেটাল অ্যান্ড এনার্জি। এই লেখাটা লেখবার সময় ঠিক একই ঘটনা ঘটছে ঝাড়খণ্ডে। যে দেশে মেয়েরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য হন সে দেশ আর যাই হোক মহান কিছুতেই নয়। তিলোত্তমার বিচার এখনও অধরা, সরকারি শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা দ্রুত লুপ্ত হচ্ছে, দেশের অর্থ মুষ্টিমেয় এক শতাংশের হাতে আর দেশের সম্পদ, দেশের জঙ্গল, পাহাড়, সমুদ্র, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর চলে যাচ্ছে দুইজন ব্যবসায়ীর হাতে। আসলে, ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভাবতে।

তিন বছরের মেয়াদকালে একটিও সাংবাদিক সম্মেলন না করা সর্বোচ্চ প্রশাসক আসলে ভয় পান। প্রশ্নকে। তাই থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রের দিকে ধেয়ে আসা যাবতীয় প্রশ্নমালা। বিকশিত এ ভারতে তিনিই রাষ্ট্র, তিনিই দেশ। উমর খালিদ, সিদ্দিকি কাপ্পান, অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদি, অধ্যাপক সোমা সেন, ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামী রাষ্ট্রের বক্তব্যে সহমত না হওয়ার, প্রশ্ন করবার ক্ষমতা রাখেন/রাখতেন। তাই এঁদের বিনা বিচারে কারাগারে আটকে রাখা যায়। যদিও এঁদের বেশিরভাগের ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিচিতি খেয়াল করবার মতো। নারীর জন্য, সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর রাম রহিম মেয়াদের অধিকাংশ সময়েই বাইরে কাটান প্যারোলে। বিলকিস বানোর ধর্ষকরা হয় বেকসুর খালাস। রাজকীয় অভ্যর্থনা অপেক্ষা করে থাকে তাদের জন্য।

রাষ্ট্রের চোখে আসলে তাঁরাই ভয়ঙ্কর যাঁরা প্রশ্ন করেন। এজন্য এখন সংস্কার হচ্ছে একেবারে গোড়াতে। যাতে গলদের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা না থাকে। শিশু, কিশোর কী শিখবে, কী পড়বে সেটা শিক্ষাবিদেরা নন, এখন রাজনীতিবিদেরা ঠিক করছেন। গোটা দেশের লক্ষ লক্ষ স্কুল এখন যন্তরমন্তর ঘর। রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের বাইরে কোনও কথা নাগরিকেরা শুনবেন না, কইবেন না, ভাববেন না।

মাথা যাঁদের চুলদানি নয় তাঁরা বিড়বিড় করছেন, পহলগাঁও হত্যাকাণ্ড ঘটল কীভাবে, সমন্বয়ের অভাব হলে বা গাফিলতি হয়ে থাকলে দায় কার, টেলিভিশনে প্রচারিত ঘটনার ধারাবিবরণী কতটা বিশ্বাসযোগ্য যেখানে সেই একই চ্যানেলগুলি কিছুদিন পর ভারতে বসে বসে লাহোর, করাচি দখল করে নেয়, দেড় ঘন্টা ধরে কেন নাগরিকদের রক্ত বয়ে যেতে দেওয়া হবে যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি জানাই থাকে— মৃত্যু, মোবাইল, স্যাটেলাইটের যুগে কেন স্থানীয় মানুষদের পিঠে চেপে নেমে আসতে হবে পর্যটকদেরকে, তিন মাস পরে ততোধিক নাটকীয় কায়দায় তিনজন জঙ্গি পাকিস্তানি দেশলাই, সচিত্র প্রমাণপত্র পকেটে নিয়ে নিকেশ হয় আধাসামরিক বাহিনীর হাতে, সেনাবাহিনী ও রাজ্য পুলিশকে অন্ধকারে রেখে, বিরানব্বইয়ের গণহত্যার দায় কাশ্মিরি মুসলমানদের ছিল কিন্তু কাশ্মিরি হিন্দুদের জীবনরক্ষা, উপযুক্ত পুনর্বাসন আর প্রত্যাবর্তনের দায় কার ছিল, নদী তো কোনও দেশের একার নয়— চাইলেই জল আটকে দুর্ভিক্ষ করব, ছেড়ে দিয়ে বন্যা, কাল চিন একই কায়দায় ব্রহ্মপুত্র নদকে নিয়ে ছেলেখেলা শুরু করলে ভারতের মুখ থাকবে তো প্রতিবাদ করার, হ্যারি পটারের উপন্যাসগুলিতে দেখা যায় হ্যারির বাৎসরিক পরীক্ষা হলে পরে ভল্ডেমর্ট আক্রমণ করত, ভারতেও বহিরাগত শত্রুর আক্রমণ কেন গণতন্ত্রের বাৎসরিক পরীক্ষার আগে আগে হয়? প্রশ্ন করে ফেললেই বিপদ। সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ। ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্র একটা মিথ।

দিবারাত্র দুর্নীতি, অপরিচ্ছন্নতায় অভ্যস্ত হয়ে বাঁচা জনগণের কাছে দেশ এখনও একটা মস্ত আবেগ। ছত্তিশগড়ি, মণিপুরি মানুষের মৃত্যুতে হেলদোল না হলেও মূল ভূখণ্ডের সুসভ্য পর্যটকের নিদারুণ মৃত্যুতে সঙ্গত কারণেই তারা জ্বলে ওঠে। বিশেষ স্থিতিতে ধর্মের কথা মনে পড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও আজ হিন্দু পরিচয়ে গৌরব প্রকাশ করেন। দেশপ্রেমকে কিভাবে ধর্মীয় আবেগে রূপান্তরিত করতে হয় বা ধর্মীয় মৌলবাদকে দেশপ্রেমের রূপ দিতে হয়, দেশ আর রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কীভাবে গুলিয়ে দিতে হয়, রাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডার বিরুদ্ধে থাকা যে কোনও স্বর বা ব্যক্তিকেই কীভাবে শত্রু হিসেবে দাগানো যায় তা বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে শিখতে হয়। কিন্তু মুশকিল হল এই বিদ্যায় পররাষ্ট্র আর বিদেশনীতি চলে না। যে আবেগী বক্তব্যে ভক্তকুল আহ্লাদিত হয়, বিদেশের মন্ত্রী, নেতারা তা শুনতেই পান না। তাই দেশে দেশে প্রতিনিধি পাঠাতে হয় আর শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে ভারত মিত্র হারাতে হারাতে আজ নিজ উপমহাদেশেও একঘরে হয়ে পড়েছে। সার্ক, কোয়াড, ব্রিকস সব জায়গায়তেই ভারত থেকেও নেই। ভারতকে বাদ দিয়েই ভারতের প্রতিবেশীরা জোট বাঁধছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ বাতিল করে মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক ছুটে যান রাজধানীতে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানকে আপ্যায়ন করতে। ব্যাপক বৈদেশিক ঋণ আদায় করে নেয় আমাদের প্রতিবেশী। তালিবান বিরোধী নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী পর্ষদের সহ চেয়ারম্যানও। সেদেশের কিছু মানুষ ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানায় পঁয়ষট্টি সালের পর আবার কাশ্মির নামটি বিশ্বমঞ্চে উচ্চারিত হতে দেওয়ার জন্য। স্বর্গের মতো সুন্দর কাশ্মিরের সেরা দুই-তৃতীয়াংশের দখল নিয়েও তারা সন্তুষ্ট নয়, পুরোটাই চাই।

আর এর মাঝে শাঁখের করাতে কাটছে কাশ্মির। তার শৈশব বিপন্ন, শিক্ষাহীন, তার বার্ধক্য অভাবী, সুরক্ষাহীন। গুলি যেদিক থেকেই আসুক না কেন এসে পড়ছে তারই শরীরে। তার সবুজ গালিচায় লাল ছোপ। চিনারের শীতল ছায়ায় মৃত্যু এসে দাঁড়ায়, বার বার। তাকে যেন ঘিরে ধরে মানবতা। বার বার। যেন জিতে যায় কাশ্মিরিয়ৎ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...