লাহোর মাত্র তেইশ কিমি

দীপ্র মজুমদার

 

কয়েক মাস আগের কথা। তখনও ইন্দো-পাক সীমান্তে ‘বিটিং রিট্রিট’ বন্ধ হয়নি। তখনও রক্তে ভাসেনি পহেলগাঁও। তখনও লাল সিঁদুর ছিটকে পড়েনি সোনালি গোলাকার পাত্র থেকে। তখনও মিসাইলরা ঝাঁপিয়ে পড়েনি ‘আম আদমির’ ঘরে, বারান্দায়। তখনও নব্য ‘স্যামচাচা’ শান্তি-দৌত্যের কৃতিত্ব দাবি করেনি। তখনও বাইশ গজের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ব্যাট-বলের যুদ্ধ সেরে হাত মিলিয়ে ফিরত ড্রেসিংরুমে।

মাইলফলকের ঘোষণা, আত্তারি গ্রাম। আত্তারি আর ওয়াঘা পাশাপাশি দুটি গ্রাম। ভৌগোলিক দূরত্ব কমবেশি কিলোমিটার পাঁচেক। কিন্তু মধ্যেকার ফারাক সহস্র যোজনের অনতিগম্যতা। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বুক চিরে কড়া পাহারায় লালিত দুটি ভারী লোহার গেট নির্দিষ্ট করে আমরা-ওরা, হিন্দুস্তান-পাকিস্তান, কিংবা বন্দে মাতরম আর পাক সার জমিন।

আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্ত থেকে লাহোর মাত্র তেইশ কিলোমিটার দূরে। ইংরেজদের এবং বর্তমানে সর্বক্ষণ যুযুধান দুই রাষ্ট্রের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের কূটনৈতিক চালের বদান্যতায় লাহোর থেকে ‘এক চক্কর মেরে আসার’ পথ থাকলেও সে উপায় আর নেই। তাঁরা সাজিয়েছিলেন ঘুঁটি, সেঁকেছিলেন হাত রাজনৈতিক পালাবদলের আঁচে; সে এক জমজমাট পটবয়েলার— স্বাধীনতা, পার্টিশন। দাউ দাউ করে দু-দেশের পতাকা যেমন উঠল জ্বলে, ছাই হল ‘আম-আদমি’। হাজারে হাজারে এমন সব ছাই-এর পিণ্ড নাকি আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিল অন্য পারে, ‘আচ্ছে দিন’-এর আশায়। সে সব ইতিহাস।

এই মুহূর্তে ঐতিহাসিকের দায় স্বীকারে আমি অপারগ। ইতিহাস বর্ণনা করব না। তাই মাফ চেয়ে নিচ্ছি আগেভাগেই। এই অপারগতার কারণ অবশ্যই মনের মধ্যে ভিড় করে আসা কিছু অনুভূতি যা প্রকাশের পথ পেতে ব্যাকুল।

আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্তে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা সবে পেরিয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পতাকা অবনমনের সেই নাটকীয় অনুষ্ঠান। দলে দলে মানুষ— দুই দিকেই— এসেছে এই অনুষ্ঠানের অদ্ভুত (কিম্ভূত?) কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করতে। অধীর আগ্রহে জ্বলন্ত তাদের চোখ। কুচকাওয়াজ ক্ষেত্রের পাশের ভিআইপি চেয়ার দখল করে যখন বসলাম তখন সীমা সুরক্ষা বলের জওয়ানরা তাদের রাইফেল ঘোরানোর নিপুণ কৌশল প্রদর্শন করছে। আর একজন ঘুরে ঘুরে উৎসাহিত করছে দর্শকদের। দেশাত্মবোধক চিৎকারের মধ্যে থেকে বারংবার রব উঠছে ‘ভারতমাতা কী জয়’, ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’, ‘বন্দেমাতরম’।

ঠিক পাঁচটা বেজে তিরিশ মিনিটে সীমান্তের দুই দিক থেকে বেজে উঠল বিউগল। শুরু হল কুচকাওয়াজ। দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারণকারী গেট খুলল ক্রমে। পতাকা অবনমিত হল। দুই দেশের কুচকাওয়াজের কমান্ডারদ্বয় করমর্দন করে আবার গেট বন্ধ হল সহস্র যোজন অনতিগম্য দূরত্ব রক্ষার্থে। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকল জাতীয়তাবাদী উদ্দাম চীৎকার। এক তীব্র রাষ্ট্রবাদ যেন পরতে পরতে আচ্ছন্ন করে তুলছিল চেতনার পরিসর।

কুচকাওয়াজের অনবদ্য কৌশল এবং জওয়ানদের দক্ষ পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এই নাটকীয় অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ দর্শকের চোখেই লক্ষ করলাম প্রশংসাসূচক বিস্ময়, জাতীয়তাবাদী আবেগ, আর রাষ্ট্রবাদী আগ্রাসনের প্রতি সহমতি। কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলেছিল আমার সিনিক্যাল মাথায়। এই নাটকীয় আখ্যানের মধ্যে আমার এই দেশ কোথায়? কোথায়ই বা পড়শি? এ কোন রাষ্ট্র-গাঁথা যা কিনা দর্শকের দরবারে সমাদৃত?

উত্তর খুঁজতে গিয়ে অহেতুক ডুবে দিলাম নির্মিত দৃশ্যকল্পের বিশ্লেষণে। এই এক সমস্যা সিনিক্যাল মাথার। সহজে সেখানে গ্রাহ্য হয় না কিছুই। খালি তত্ত্ব, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত (না, ঠিক সিদ্ধান্ত নয়, বলা যায় প্রায়-সিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্তের মতো; কোনও এক বোধ হয়তো বা)। যাইহোক, ডুবেছি যখন, তখন জল তো মাপতেই হয়।

কুচকাওয়াজে জওয়ানদের অঙ্গসঞ্চালনার দিকে একটু দৃষ্টিপাত করি। কী অবলীলায় সেখানে স্থান পেল পেশি প্রসারণের এবং গোঁফে তা দেওয়ার ভঙ্গিমা। সেই সঙ্গে আস্ফালন। পুরুষের আস্ফালন। পড়শির প্রতি জিঘাংসা। এ যেন এক শক্তিমান, যুযুধান, স্পর্ধিত পুরুষের প্রদর্শন যাকে আমরা দেখলাম দেশের ছদ্মবেশে। আর সেই (মহা)পুরুষের আদর্শ এক বিভেদমূলক আগ্রাসী রাষ্ট্রবাদ, যা যে কোনও অছিলায় পিষে ফেলতে পারে পড়শিকে। দর্শকদের উদ্দীপিত করা জওয়ানের ক্রিকেটীয় ছক্কার ভঙ্গিই হোক বা কুচকাওয়াজের আগ্রাসী পদসঞ্চালনাই হোক, সবের মধ্যেই এই রাষ্ট্রবাদী পৌরুষের আস্ফালনই লক্ষণীয়ভাবে দৃশ্যমান।

দেশের এমন একখানি পুরুষতান্ত্রিক আখ্যান নির্মাণ করলে সিনিক্যাল মাথা প্রশ্ন করতেই পারে— দেশ কি তবে কেবল পুরুষের? নারীর স্থান এখানে কোথায়? নারীত্ব কি তবে কেবলমাত্র স্পর্ধিত-শক্তি জিঘাংসামত্ত পৌরুষের অপর?

কিন্তু কেমন হবে, যদি নারীত্বের প্রেম দিয়ে, সেবা দিয়ে, মমতা দিয়ে, মাতৃত্ব দিয়ে, দেশের এক ভিন্ন আখ্যান নির্মিত হয়? এক নারীবাদী নির্মাণ? সেই দেশের সীমান্তে প্রতিদিনের পতাকা অবনমন অনুষ্ঠান কেমন হবে? হয়তো স্নেহ, প্রেম, মমতা, পড়শির প্রতি বন্ধুতা, গান গেয়ে যত্নে ঘুম পাড়িয়ে দেবে সেই মারকুটে দস্যি ছেলেটাকে, দেশ বলে যাকে ভুল করেছি আমরা, ‘আম আদমি’।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...