সুন্দরবনের বিপন্নতা ও বঞ্চনার খতিয়ান— প্রসঙ্গ, মৎস্যজীবীদের জীবিকার অধিকার

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 


সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য যাতে বিনষ্ট না হয়, জলবায়ু যাতে দূষিত না হয়— এই উদ্দেশ্য এবং ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা সুরক্ষার স্বার্থ আসলে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিশ্বজুড়েই দেখা যায়: যেখানে জল-জঙ্গল-মাছ টিকে থাকে, সেখানেই মৎস্যজীবীদের জীবিকা সুরক্ষিত থাকে; আর ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা রক্ষিত থাকলেই সেই জায়গার জল-জঙ্গল-মাছও টিকে থাকে, প্রকৃতি সুরক্ষিত থাকে। সুন্দরবনের ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা যুগের পর যুগ লোকজ প্রথা ও টেকসই পদ্ধতি অবলম্বন করেই নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া সংগ্রহ করেছেন— যাতে একই সঙ্গে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ হয়েছে এবং জল-জঙ্গল সুরক্ষিত থেকেছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থেকেছে। অথচ আজ তাঁদের অস্তিত্বই সংকটের মুখে

 

নদীরা যদি জীবিত সত্তা হত, তাহলে রায়মঙ্গল, বিদ্যা, দত্তা, মাতলা-রা সাক্ষী থাকত যে আধুনিক সংজ্ঞানে ‘অধিকার’ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই ধারণা সৃষ্টি হওয়ার অনেক আগেই সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলে মানুষ মাছ ধরে এসেছে। সেই ঐতিহ্য আক্ষরিক অর্থেই আজও বহমান, দুই দেশজোড়া সুন্দরবনের বাদাবন-কর্দমতটকে পাশে রেখে, ধুয়ে-মুছে তকতকে রাখা নোনাজলের (কিছু ক্ষেত্রে, আর অতীতে আরও অনেক ক্ষেত্রে মিঠাজলও) খাঁড়িগুলিতে হাতনৌকা-ডিঙিনৌকা নিয়ে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যান মৎস্যজীবীরা। প্রতি ‘গন’ শুরু হয় লোকজ তিথি অনুসারে একাদশীর দিন, এক-একটি নৌকায় তিন থেকে পাঁচজন সওয়ার হয়ে নদীপথে পাড়ি দেন তাঁরা। জোয়ার-ভাটার খেলা, উজান-ভাটির স্রোতের টান, পুরনো তটের ভাঙন, নতুন চর ও তটের গঠন-বিগঠন— আর আরও কত প্রাকৃত সূত্র মেনে তাঁদের মাছ-কাঁকড়া ধরা চলে কমবেশি বারো দিন থেকে মাস দেড়েক, কখনও বা তারও বেশি।

সুন্দরবনের নৌকায় বালি-২ দক্ষিণপাড়া গ্রামের একজন মৎস্যজীবী, ২০২২-২৩ সালে তোলা ফটো

 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ[1] অনুসারে ‘গন’ শব্দ কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্দেশ করে না। চর্যাপদের ‘গমনাগমন’ শব্দে লুকিয়ে আছে এই শব্দের প্রাচীন ব্যবহার, যা দেখা গিয়েছে ধর্মমঙ্গল ও মনসামঙ্গলের মতো দুই প্রধান মঙ্গলকাব্যেও। আজকের নাগরিক ভদ্রবিত্ত সমাজ যদিও এই শব্দকে পরিহার করে, কিন্তু দুই বাংলার সুন্দরবনের লাখখানেক সাধারণ মৎস্যজীবীর কাছে তা আজও জীবন-জীবিকার পথে নিত্যব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ধারণা হিসেবে রয়ে গিয়েছে।

তবে এখানে বলা প্রয়োজন, সুন্দরবনের আজকের সব মৎস্যজীবীই যে কেবল ‘গন’-এই মাছ ধরেন, তা নয়। অপেক্ষাকৃত অগভীর অরণ্যের মাঝ দিয়ে যে নদীগুলি বয়ে চলেছে, সেখানে প্রকৃতি অনুকূল হলে বহু মৎস্যজীবী দৈনন্দিন ভিত্তিতে মাছ ধরেন— সুন্দরবনের মানুষের ভাষায় যাকে বলে ‘নিত্যমারি’ বা ‘রোজমারি’। আবার অনেকে নিজেদের পুকুরে মাছের চাষ করেন, কেউ ভেরি করে মাছ ধরেন। অনেকে আবার কলকাতা-শিলিগুড়ির ব্যবসায়ীদের হাতে মাছ-কাঁকড়া, এমনকি ক্ষতিকারক ‘ভেনামি’ চিংড়ির চাষে উজার হয়ে যাওয়া আয়লা-আমফান-প্রভাবিত নোনাজমি থেকে সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে ইজারায় জমি দিয়ে দেন।

আমরা এই আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখব কেবল সেইসব সুন্দরবন-সংলগ্ন অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার লড়াই নিয়ে, যাঁরা হাতনৌকায় নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরে আজও জীবিকা নির্বাহ করেন।

সুন্দরবনের জয়নগর ব্লকের গ্রাম থেকে সম্প্রতি পাওয়া গিয়েছে দেড় হাজার বছর প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন— দেবীপর ব্লক অঞ্চলে থেকে; সূত্র: এইসময় অনলাইন

 

হুগলি নদীর বর্তমান মূল খাতের পশ্চিমদিক থেকে দক্ষিণে সাগরদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহত্তর সুন্দরবন ব-দ্বীপের যে অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত, সেখানে দেবীপুর-দেউলবাটি, কুলপি, রাইদীঘি, গোবর্ধনপুর ইত্যাদি অঞ্চলে মধ্যযুগীয় প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু হুগলি নদীর আজকের মূল খাতের পূব থেকে উত্তরদিকে বিস্তৃত শ্বাপদসঙ্কুল ঘন বনাঞ্চল— আজকের ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবা, সন্দেশখালি বা হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক, যেখানে ‘সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ’ অবস্থিত— সেখানে তেমন প্রত্ননিদর্শন মেলেনি।

অথচ ছোট ছোট, অমেশিনীকৃত, ইঞ্জিনবিহীন, দাঁড়ে টানা হাতনৌকা বা ডিঙিনৌকায় চেপে গন-অনুসারে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যাওয়া— যুগের ওপার থেকে টিকে থাকা প্রকৃতিবান্ধব তথা প্রাকৃত এক ঐতিহ্য— তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিস্তৃত হুগলি নদীর মূল খাতের পূব থেকে উত্তরদিকের এলাকাতেই বেশি দেখা যায়। সুন্দরবনের এই পূর্বাঞ্চলের বিস্তার আজকের বাংলাদেশের বরিশাল জেলা ও ডিভিশনের বাখেরগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত। প্রত্ননিদর্শন না থাকলেও, জীবিকাগত আচার-ব্যবহারের দিক থেকে বোঝা যায়, বহু যুগ ও প্রজন্ম ধরে মানুষ সেখানে মাছ-কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে।

 

সুন্দরবনে রাজস্ব আদায়ের ঔপনিবেশিক প্রশাসন— উদ্ভব ও বিকাশ

এবার দেখা যাক, ‘অধিকার’, ‘আইন’ ও তদানুষঙ্গিক ধারণাগুলি সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবিকার অধিকারের ক্ষেত্রে কালের নিয়মে কীভাবে আজকের প্রাসঙ্গিক রূপ নিয়েছে। এ-জন্য ইংরেজ উপনিবেশ গঠনের গোড়ায় ফিরে যেতে হবে। খ্রিস্টীয় ১৭৬৫ সাল— বাংলায় ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি শাসনের সূচনা হল, কলকাতাকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু করে।

সেদিনের ছোট্ট আয়তনের নগর কলকাতার পূবদিকে, মোটামুটি সাত মাইলের মধ্যেই, শুরু হয়ে যেত সেই প্রকাণ্ড বাদাবনের উত্তরদিকের মাথাটা। লালদীঘি উৎখননের সময়ে সুন্দরীগাছের শিকড় পাওয়া নিয়ে অনলাইনে বেশ কিছু আলাপচারিতা রয়েছে। আবার বিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ কলকাতায় বসতি ঘন হতে থাকলে বাড়ির ভিত কাটার সময়ে বহু জায়গায় উঠে আসে বাদার স্মৃতি-মাখা শিকড়, মাটি, পাথর। ছোটবেলায় গল্প শুনেছি— উনুনে দিলে ভুস করে জ্বলে উঠত সেই তেলতেলে কাদামাটি।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বছর, অর্থাৎ ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে, ততদিনে কলকাতার আশেপাশের অঞ্চলকে ‘২৪ পরগনা’ নামে চিহ্নিত করা শুরু করে দিয়েছে কোম্পানি। সেই জেলার কালেক্টর জেনারেল ক্লাউদ রাসেল সেই বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে বিস্তীর্ণ বাদাবন সাফ করে ধানচাষ ও আবাদি পত্তনের জন্য ইজারা দেওয়া আরম্ভ করেন। প্রথম দফার ইজারাগুলির শর্ত অনুসারে, ইজারাধারী রায়ত প্রথম কয়েক বছর ভাড়া না দিয়েই চাষ করতে পারবেন, যতদিন না কৃষিকাজে কিছু উন্নতি দেখা দেয়। তারপর ইজারা বাবদ ধার্য ছিল কমিশন বা ভাড়া সর্বোচ্চ ১ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত। পরবর্তী চল্লিশ বছরে এই ইজারাপ্রাপ্ত অঞ্চল ও আশেপাশের জমিদারির জমিগুলি কৃষিতে উন্নতি করে। এর ফলে উত্তর-পূর্বে ক্যানিং থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষিনির্ভর আবাদি বসতি গড়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে, ১৭৮৫ সালে, তৎকালীন সুবে বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর অনুমতিক্রমে, যশোর জেলার জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট টিলম্যান হেঙ্কেল বাদা সাফ করে আবাদি পত্তন— কোম্পানির ভাষায়, আর আজকের প্রশাসনিক ভাষাতেও, ‘রিক্লেমেশন’-এর জন্য আরও ১৫০টি ইজারা বিতরণ করেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় দফার লিজগুলিকে ঘিরে আশেপাশের জমিদাররা আপত্তি জানায়। ফলে, ১৭৯২ সাল নাগাদ দেখা গেল এই ১৫০টির মধ্যে মাত্র ১৬টি লিজ অবশিষ্ট রয়েছে।

ঊনবিংশ শতকের সূচনা। কলকাতার বন্দরের নাব্যতা বাড়ানোর নানা পরিকল্পনা কষছে কোম্পানি-বাহাদুর। কখনও হাজিপুর মোহনা-তটে ডায়মন্ড হারবার গড়ে তোলার প্রস্তাব, তো কখনও সাগর দ্বীপে আবাদি বসতি গড়ার চিন্তা। এইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন অঞ্চলটির সমীক্ষা। এই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন দুই মরিসন ভ্রাতা— এক ভাই লেফটেন্যান্ট, অপর ভাই কাপ্তান। ১৮১৪ থেকে ১৮১৮ অবধি তাঁরা হুগলি থেকে পশ্চিমে পশুর নদী পর্যন্ত (সমুদ্রের মুখবর্তী অঞ্চল বাদে) সমগ্র সুন্দরবনের বাদাবন অঞ্চলের সার্ভে করেন।

ইতিমধ্যে, ১৮১৬ সাল আসতে না আসতেই কোম্পানি বুঝে গেল, কেবল চাষ-আবাদের লিজ দিয়েই সুন্দরবন থেকে পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়। তাই সেই বছর, কোম্পানির বাংলা সরকার Regulation No. 9 of 1816 পাশ করে সৃষ্টি করল ‘সুন্দরবন কমিশনার’ পদ। আইন অনুসারে এই আধিকারিক জেলা কালেক্টরের সমান ক্ষমতা ও দায়িত্বসম্পন্ন হবেন।

কিন্তু সেই কমিশনার দেখতে পেলেন, যাঁরা ইতিমধ্যেই সুন্দরবনে লিজ ও জমিদারি পেয়ে বাদাবন সাফ করে চাষাবাদ করছেন, তাঁরা রাজস্ব প্রদানের বিষয়ে নানা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। তাই রাখঢাক না রেখে, ১৮১৭ সালে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের আইনসভায় শ্বেতাঙ্গ ‘সভ্য’গণ Regulation No. 23 of 1817 পাশ করে ঘোষণা করল— সুন্দরবন রাষ্ট্রের, অর্থাৎ ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গঠিত রাষ্ট্রের, সম্পত্তি। ফলে, সেখান থেকে, এমনকি লিজধারী ও ভূস্বামীদের এস্টেট থেকেও, রাজস্ব আদায়ের পূর্ণ অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে।

 

প্রিন্সেপ, ড্যাম্পিয়ের ও হজেস— তিন ইংরেজ প্রশাসকের ভূমিকায় সুন্দরবনে জরিপ ও ‘লট’-ব্যবস্থার প্রসার

১৮২১ সালে কোম্পানির উঁচুতলার এক অফিসার, সেনাবাহিনীর Ensign পদাধিকারী জেমস প্রিন্সেপ দায়িত্ব পেলেন সুন্দরবনের জমির কোন অংশ রাষ্ট্রের অধিকৃত আর কোন অংশ ব্যক্তিগত এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত, তা নির্ধারণ করার। ভূস্বামীরা আবার বলে উঠলেন— সমুদ্র পর্যন্ত সমগ্র মেদিনী তাঁদেরই। তাই তাঁরা তাঁদের এস্টেটগুলির সীমানা সঠিকভাবে জরিপ করতে কোম্পানিকে সহায়তা করলেন না।

তবে, এর আগে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কোম্পানির দেওয়া ইজারায় যে জমিদারেরা চাষাবাদ করছিলেন, তাঁদের সহায়তায় কোম্পানি সরকার কিছুটা জরিপ করতে পারল— পূর্বদিকে যমুনা নদী থেকে পশ্চিমে হুগলি নদীর দক্ষিণে সমুদ্রতট পর্যন্ত বিস্তৃত সুন্দরবনের একাংশ। সেই জরিপ আর ১৮১৮ সালে মরিসন ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রকাশিত মানচিত্রের ভিত্তিতে সুন্দরবনের নদী-জলপথের ফাঁকে ফাঁকে স্থলভাগগুলোকে প্রথমে ‘ব্লক’, পরে ‘লট’ আকারে ইজারাবদ্ধ করার দীর্ঘমেয়াদি প্রয়াস শুরু হয়। এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধাপে ধাপে গড়ে তোলে সেকালের কোম্পানি, আর পরে ক্রাউনের অধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা।

এইভাবে, ১৮২৮ সালের মধ্যে তখনকার মতো ২৪ পরগনায় Reclamation বা Settlement— এক কথায়, রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে আবাদি পত্তন— সম্পন্ন করে কোম্পানি। সেই বছরের Regulation No. 3 of 1828 পাশ করে আবার ঘোষণা করা হয়—

“বসতিবিহীন যে অঞ্চলটি সুন্দরবন, তা সরকারের সম্পত্তি। এবং যে সকল অঞ্চলে আবাদি পত্তন হয়নি, লিজ দেওয়া হয়নি, কিংবা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুসারে কোনও জমিদারির অংশ হিসাবে গৃহীত হয়নি, সেসব অঞ্চলে গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিল তাঁর উপযুক্ত বিবেচনা ও প্রয়োজনে ইজারা, গ্র্যান্ট বা অ্যাসাইনমেন্ট আকারে বন সাফ করে কৃষি ও আবাদি-পত্তনের বন্দোবস্ত করতে পারেন।”

এনসাইন জেমস প্রিন্সেপ – ১৭৯৯-১৮৪০; সুন্দরবনে আবাদি-পত্তন বা সরকারি রাজস্ব আদায়ের ‘লট’-দারি বন্দোবস্তের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা

 

কোন অঞ্চলকে সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ধরা হবে— এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করা কোম্পানির পক্ষে জরুরি হয়ে উঠেছিল প্রজা-শাসন ও রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনে। জেমস প্রিন্সেপের অধীনে প্রথম জরিপে পশ্চিমে হুগলি থেকে পূর্বে যমুনা নদী পর্যন্ত, দক্ষিণে সমুদ্রতট অবধি অঞ্চলকে রাজস্ব-জরিপে আনা হয়। ১৮৩১ সালে খুলনা ও বাকেরগঞ্জের কমিশনার উইলিয়াম ড্যাম্পিয়ার এবং সার্ভেয়র লেফটেন্যান্ট হজেস যমুনা নদী থেকে পশুর নদী হয়ে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত সামগ্রিক সুন্দরবন অঞ্চলের সার্ভে সম্পন্ন করেন এবং মানচিত্র প্রকাশ করেন। এই মানচিত্র, এবং বিশেষত সুন্দরবনের সীমানা নির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে চিহ্নিত “ড্যাম্পিয়ার–হজেস লাইন”, আজও কার্যকর। এই রেখার দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকেই আধুনিক যুগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে Sundarbans Biosphere Reserve হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র হতে পারে। আপাতত আমরা রাজস্ব, আবাদি-পত্তন ও মৎস্যজীবীদের জীবিকার দিকেই মনোযোগ রাখি।

উইলিয়াম ড্যাম্পিয়ারের তত্ত্বাবধানে ড্যাম্পিয়ার-হজেস লাইনের দক্ষিণে অবস্থিত মোট ১৭,০২৪২০ একর জমি— তৎকালীন ২৪ পরগনা ও খুলনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত— ২৩৬টি লটে ভাগ করে ভূস্বামীদের ইজারায় দেওয়া শুরু হয়। এর পর বহু দশক ধরে এই পদ্ধতি অনুসারেই লট ইজারা চলতে থাকে। যেমন, ১৮৩০ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে ১১০টি লট জুড়ে প্রায় ৫,৫১৫২০ একর জমি ইজারায় তোলা হয়। ইজারার রাজস্ব বা ভাড়া ছিল সেই ১.৮০ টাকাই। শর্ত ছিল— প্রথম ২০ বছর ইজারাদারদের কোনও ভাড়া দিতে হবে না, তবে ৫ বছরের মধ্যে জমির অন্তত পাঁচভাগের একভাগ কৃষিযোগ্য করে তুলতে হবে; না হলে কোম্পানি জমি ক্রোক করে নেবে। এই ইজারা দেওয়ার প্রথা বহু দশক ধরে চললেও, ১৯৩০ সালের আগে পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক নিয়মাবলি বানানোর প্রয়োজন ইংরেজ সরকার বোধ করেনি।

এরই মধ্যে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যখন ড্যানিয়েল হ্যামিলটন গোসাবা অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম সুন্দরবনের কিছু অংশ জুড়ে তাঁর সমবায়িকা গঠনের উদ্যোগ নেন, তখন সেই অঞ্চলে বহু মানুষ বসতি স্থাপন করে ফেলেছেন। আর আজকের দিনে সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে যারা প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নদী–জলরাশি–কর্দমতটের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করেন, তাঁদের অনেকেই বিংশ শতাব্দীতে দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাস্তুচ্যুত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলেন।

আজকের পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপের ‘ডাম্পিয়ের-হজেস লাইন’-এর অবস্থান

 

উপনিবেশী প্রশাসকের চোখে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের অধিকারের স্বীকৃতি

সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের অধিকারের প্রসঙ্গ প্রথমবার উঠে আসে স্যার উইলিয়ম উইলসন (ডব্লিউডব্লিউ) হান্টারের লেখায়। ১৮৬০-এর দশকে তিনি সুন্দরবনের মাছ ধরার উপায়, পদ্ধতি ও প্রকরণ নিয়ে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি লেখেন— সুন্দরবনের নাব্য জলরাশিতে মাছ ধরার অধিকার জনসাধারণের, এ-নিয়ে সরকার কোনও রাজস্ব আদায় করে না।… সুন্দরবনের উত্তরের অংশের সমস্ত নদীতেই, এবং কিছু গভীর বনাঞ্চলের জলপথেও মাছ ধরা হয়। ১৮৬৬ সালে ইংরেজ সরকার এই অধিকার বেসরকারি কোম্পানির হাতে অকশন করে ইজারা দেওয়ার চেষ্টা করে। তা অনুসারে ক্যানিং পোর্ট কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি কিছু অংশ ইজারায় পেয়েওছিল। কিন্তু স্থানীয় মৎস্যজীবী ও স্বত্বাধিকারীদের বিরোধিতায় সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ফলত, সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে জোয়ার-ভাঁটা প্রভাবিত সুন্দরবনের প্রবহমান জলপথে মাছ ধরার অধিকার কোনও ব্যক্তি বা কোম্পানিকে ইজারায় দেওয়া সম্ভব নয়। কেবল, ইজারা-প্রাপ্ত জমির ভেতরে অবস্থিত পুকুর বা জলাশয় থেকে মাছ ধরার ক্ষেত্রে প্রজাদের থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারেন জমিদার বা ভূস্বামীরা।

হান্টারের লেখায় সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের পরিবেশ-বান্ধব প্রাকৃত পদ্ধতিগুলির বর্ণনাও পাওয়া যায়। যেমন— নৌকার দুই পাশে বাঁশের পোল ঝুলিয়ে ড্র্যাগনেট ফেলা; প্রশিক্ষিত ভোঁদড় ব্যবহার করে মাছ শিকার; জলের উপরে জন্মানো ‘ধাপ’ নামের উদ্ভিদের চারপাশে বাঁশের খাপ (‘স্টেক’) তৈরি করে মাছ ধরা; খাদ্য আহরণ করতে যে উদ্ভিদের নিচে মাছেরা জমা হয়— সেই কর্দমতটের কাছে গাছের কুটো দিয়ে চিংড়ি ধরা; আবার সেই চিংড়িকে টোপ বানিয়ে বড় মাছ ধরা; অগভীর জলে ‘দোনা’ নামের বাঁশের খাঁচা-ফাঁদ ব্যবহার— যা হান্টারের আমলে যেমন প্রচলিত ছিল, আজও তেমনই বহুলব্যবহৃত।

স্যার উইলিয়ম উইলসন হান্টার (১৮৪০-১৯০০)— যাঁর লেখায় প্রথমবার পাওয়ার যায় সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবিকার সর্বজনীন অধিকারের কথা, এবং সেখানে মাছ ধরার প্রচলিত, প্রকৃতি-বান্ধব রীতিপ্রথাগুলি

 

প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে তৎকালীন সুন্দরবন কমিশনার উইলিয়ম উইলসন হান্টারকে যা বলেছিলেন, তা আজও প্রযোজ্য— “সুন্দরবনের কতজন মানুষ মাছ ধরে, নৌকা চালায়, বা অন্য কোনও উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করে, তা সরকার জানে না; নির্ধারণ করার কোনও উপায়ও নেই।” এই অমোঘ বাণী আজও কী নিদারুণভাবে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবিকার সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা বোঝার জন্য দেখতে হবে কীভাবে উপনিবেশী সরকার অন্যান্য অঞ্চলের মতো সুন্দরবনের অরণ্যকেও তাদের তথাকথিত ‘শিল্পায়ন’ প্রকল্পে সামিল করেছিল।

হান্টারের সময়ে কিছু মানুষ সুন্দরবন থেকে কাঠ সংগ্রহ করতেন জীবিকা, জ্বালানি, ঘরনির্মাণ বা মেরামতির কাজে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে সেই অধিকার চিরতরে কেড়ে নেওয়া হল। ২০১৩ সাল থেকে তো এমনকি মাছ ধরার একটি ‘গন’ চলাকালীন মরা ডাল-শিকড়, কুটোটুকু জ্বালানি হিসাবে জঙ্গল থেকে আনার অধিকারও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে মাছ ধরার অনুমোদিত অঞ্চল সঙ্কুচিত হয়েছে, বেড়েছে কড়াকড়ি। বনদপ্তরের কর্মীদের দ্বারা অননুমোদিত অঞ্চলে মাছ ধরার অভিযোগে মৎস্যজীবীদের জাল-নৌকা বাজেয়াপ্ত, সংগৃহীত মাছ-কাঁকড়া নদীতে ফেলে দেওয়া, চড়া দাগের জরিমানা করা— এসব হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা।

ফলে, একটু একটু করে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষদের জীবিকা ও জীবন বিপন্ন করে দেওয়ার সেই সরকারি ট্র্যাডিশন সেই উপনিবেশের কাল থেকে আজও অব্যাহত।

 

বন সংরক্ষণ ও মৎস্যজীবী অধিকার— সুন্দরবনের পটভূমিকায়

এবার দেখা যাক, কীভাবে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা তাঁদের জীবন-জীবিকার অধিকার— জল-জঙ্গল-মৎস্যসম্পদের উপর অধিকার— থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছেন, এবং কীভাবে, এর ফলে, আজ তাঁরা মুখোমুখি হয়েছেন এক বিপুল অস্তিত্বসংকটের।

আবারও ফিরতে হবে ১৮৩০-এর দশকে। আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা যায় ‘বন প্রশাসন’— অর্থাৎ জঙ্গলকে শাসন করা, সেখান থেকে আহৃত সম্পদের রাজস্ব আদায়, সেই সম্পদের বণ্টন ও বিক্রির ব্যবস্থা, এবং তার কমিশন— এসবের ভেতর দিয়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘ফরেস্ট গভর্ন্যান্স’-এর যাত্রা শুরু। সেই সময় ভারত ও বর্মার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল কীভাবে ইংরেজ শাসকের আর্থিক স্বার্থে কাজে লাগানো যাবে, তা নিয়েই সরকারি আলোচনার সূত্রপাত। সরকারি মহলে দাবি ওঠে, পশ্চিমা বিজ্ঞানের আলোয় এবং প্রশিক্ষিত নবিশদের মাধ্যমে ‘ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর দিকগুলি কায়েম করতে হবে। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যেই এই চিন্তা আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ১৮৪৮ সালে কোম্পানি এবং ১৮৭৮ সালে ক্রাউন পাশ করল ভারতীয় বন আইন, যা পরে ১৯২৭ সালে নবায়িত হয়ে বর্তমান রূপ নেয়। কিন্তু তার আগেই, ১৮৭০-এর দশক থেকেই ‘বন সংরক্ষণ’-এর নামে সুন্দরবনের জঙ্গলের উপর রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়।

১৮৭২ সালে ডক্টর উইলহেল্ম শ্লিষ বাংলার প্রথম ফরেস্ট কনজারভেটর হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৮৭৫ সালে তিনি খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলের কিছু বাদাবন এলাকা সুন্দরীগাছ সংরক্ষণের জন্য চিহ্নিত করেন। ১৮৭৮ সালে চব্বিশ পরগনার নামখানা ও বসিরহাট অঞ্চলের বাদাবনকে ‘ফরেস্ট রেঞ্জ’ হিসেবে বনদপ্তরের আওতায় আনা হয়। তবে তখনও সেখানে ‘লট’-ভিত্তিক আবাদ-পত্তনের উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা আসেনি— জমিদারিব্যবস্থার স্বার্থ তখনও অক্ষুণ্ণই রইল।

১৯২০-র দশক থেকে সুন্দরবনের পূর্বদিক— অর্থাৎ ২৪ পরগনা জেলার নামখানা ও বসিরহাট রেঞ্জ— জুড়ে সরাসরি বন সংরক্ষণের আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে, ইতোমধ্যেই প্রাইভেট এস্টেট হিসেবে চিহ্নিত ‘লট’-গুলিতে সরকার তখনও বসতি উচ্ছেদ বা ইজারা খারিজের পথে হাঁটেনি। ১৯২৬ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে পরপর বেশ কিছু সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তার মাধ্যমে চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত সুন্দরবনের জঙ্গল ধাপে ধাপে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়।

দেশভাগ ও স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক দশকে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে একাধিক প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রথমে সরকার গঠন করে ‘রায়চৌধুরী কমিশন’, যার উত্তরাধিকারী হিসেবে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট বোর্ড— আজও যা খাতায়-কলমে সুন্দরবন বিষয়ক মন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। এর পরের ধাপে, ১৯৮৭ সালে সুন্দরবনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসেবে।

কিন্তু এর অনেক আগেই, আরও তীব্র অভিঘাত আসে ১৯৭৩ সালেই। সেই বছরই বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের নীতিকে সামনে রেখে, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৩-এ এক সরকারি আদেশে সুন্দরবনকে দেশের অন্যতম টাইগার রিজার্ভ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে মৎস্যজীবীদের ঐতিহ্যবাহী জীবিকার উপর সরাসরি চাপ নেমে আসে। এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল কেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৭২, যা বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল।

বিদ্যা নদীতে ফেরি-নৌকায় যাত্রী-চলাচল; বিরাজমণি ঘাটের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ২৫ আগস্ট, ২০২৩

 

সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ (এসটিআর)

এসটিআর আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নির্ধারিত হল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন বনাঞ্চলের ‘কোর’ ও ‘বাফার’ অঞ্চল। ১৯৭২ সালের কেন্দ্রীয় আইনকে ভিত্তি করে আরও কিছু অঞ্চল ঘোষিত হল ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবে— যেমন সজনেখালি, হ্যালিডে দ্বীপ, লোথিয়ান দ্বীপ ইত্যাদি।

কোর অঞ্চলে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি বাফার অঞ্চলেও চিহ্নিত অভয়ারণ্য এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ। বাফারের বাকি অংশে মাছ ধরতে গেলে মৎস্যজীবীদের জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়াল নানান লাইসেন্স ও পারমিট। এই কাগজপত্রগুলির প্রকৃতি কী, এবং সেগুলিকে কেন্দ্র করে বর্তমান পরিস্থিতি কোন দিকে গড়িয়েছে, তা-ই প্রকাশ করে দেয় কীভাবে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা ধীরে ধীরে তাঁদের প্রাচীন জল-জঙ্গল-নির্ভর জীবিকার অধিকার থেকে আরও বেশি করে বিচ্ছিন্ন ও বঞ্চিত হচ্ছেন।

অতএব, এই প্রেক্ষাপট বুঝতে গেলে আমাদের আবারও একবার ইতিহাসের ভেতর তাকাতে হবে।

 

বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি)-ব্যবস্থায় মৎস্যজীবীদের বঞ্চনা

আগস্ট ২, ১৯৪৮। ভারতীয় বন আইন ১৯২৭-এর ধারা ৭৬ অনুসারে পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তর ২৪ পরগনা ডিভিশনের আওতায় সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলের জন্য একটি নৌকা-মাপ ও রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি প্রবর্তন করে। সেই নিয়মে নৌকার মালিকদের তাদের নৌকার ওজন অনুসারে ফি জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হত, এবং সেই প্রক্রিয়ায় একটি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেওয়া হত।

এরও আগে, ১৯২৬ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে যখন আজকের ভারতের সুন্দরবন ধাপে ধাপে নামখানা ও বসিরহাট রেঞ্জে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল, তখন কিছু সার্ভে ও নৌকা নিবন্ধীকরণ হয়েছিল বলে জানা যায়— যেমনটা উল্লেখ করেছেন সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের এক প্রাক্তন ফিল্ড ডিরেক্টর তাঁর সাক্ষাৎকারে। কিন্তু ১৯৭৩ সালে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ (এসটিআর) গঠনের পর থেকে নিয়ম জারি হল— জঙ্গলে ঢুকে মাছ ধরতে হলে মৎস্যজীবীদের দলের জন্য একটি বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট আবশ্যক হল। পাশাপাশি লাগত একটি সাময়িক ফরেস্ট পারমিট। শুরুতে এই ফরেস্ট পারমিটের মেয়াদ থাকত ৪২ দিন, তারপর গত দশ বছরে এই মেয়াদ কমিয়ে আনা হয়েছে ২৮ দিনে।

১৯৪৮ সালের আইনি নিদান অনুসারে বনদপ্তরের দেওয়া সার্টিফিকেট অফ মেজারমেন্ট অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ বোটস, ওরফে বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, সংক্ষেপে বিএলসি

 

আজকের দিনে একেকটি ‘গন’ ২৮ দিনের বেশি বা কম স্থায়ী হতে পারে। তবে বাস্তবে, সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলে ক্রমশ হ্রাসমান মৎস্যসম্পদের কারণে খুব কম সংখ্যক ফিশিং টিমই এত দীর্ঘ সময় ধরে অভিযান চালিয়ে যেতে পারে।

শুরু থেকেই এসব নিয়ম ও বিধিনিষেধ একতরফাভাবে চাপিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে না বনদপ্তর, মৎস্যদপ্তর বা মেরিন মৎস্যদপ্তরের মতো “লাইন ডিপার্টমেন্ট”-কে অন্তর্ভুক্ত করেছে, না স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসেছে। ফলে, সবটাই বাস্তবায়িত হয়েছে বনবাহিনীর “বন্দুক ও পেশি-শক্তির আস্ফালন”-এর উপর নির্ভর করে।

এই একতরফা কায়েমির আইনি ভিত খুঁজলে বোঝা যায়— ১৯৭৩ সালে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প ঘোষিত হলেও, তা কেবল একটি প্রশাসনিক আদেশনামার উপর দাঁড়িয়ে ছিল। এর পেছনে কোনও আইনি সুরক্ষা বা বৈধ কাঠামো ছিল না। আসলে, প্রকল্পটি দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে (১৯৭৩-২০০৭) আইনবহির্ভূত এক শাসনকাঠামো হিসাবেই চলেছে। পরবর্তী সময়ে, ২০০৭ সালে বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইন সংশোধন হয়ে যখন ‘ক্রিটিকাল টাইগার হ্যাবিট্যাট (সিটিএইচ)’ ধারাটি যুক্ত হয়, তখনই প্রথমবারের মতো এসটিআর-এর আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পায়। অর্থাৎ, ‘সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প’ থেকে ‘সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ’-এ উত্তরণ ঘটে অনেক পরে, ২০০৭-এর সংশোধিত আইনের ভিত্তিতে।

বনদপ্তরের কায়েমি আধিপত্যের কারণে, দীর্ঘ দশক ধরে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবিকা বৈধভাবে বজায় রাখার জন্য সাময়িক ফরেস্ট পারমিট-এর চেয়ে বহুগুণ কঠিন ও কালান্তক হয়ে উঠেছে বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি)-এর জটিলতা। সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ (এসটিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের অধিকারের (RTI) আবেদনে জানানো হয়েছে যে, ১৯৭৩ সালে, এসটিআর গঠনের সময়, মোট ৯২৩ জন ব্যক্তিকে বিএলসি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সক্রিয় রয়েছে ৬৯২টি বিএলসি। কীভাবে প্রাথমিক ৯২৩ জনকে বিএলসি দেওয়া হয়েছিল এ-প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই এসটিআর কর্তৃপক্ষের কাছে।

বলা বাহুল্য, ১৯২০ থেকে ১৯৪০-এর দশকে, বা এমনকি ১৯৭৩ সালে এসটিআর গঠনের ঠিক আগে অবধি বনদপ্তরের নিবন্ধীকৃত হওয়া দাঁড় টানা ডিঙিনৌকার সুন্দরবনের নোনা জল, জলের স্রোত, ঢেউ, ঝড়-ঝঞ্ঝা আর আর্দ্র, লবণাক্ত আবহাওয়ার এখন অবধি সচল থাকা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব। অথচ, সেই নৌকার ভিত্তিতে জারি হওয়া বিএলসি আজও সক্রিয় থেকে গিয়েছে। সুন্দরবনের এসটিআর-এর আওতাধীন অঞ্চলে অন্তত লাখখানেক মৎস্যজীবী মাছ ধরেন বলেই নানান সেকেন্ডারি সূত্র ইঙ্গিত করছে। এই নিয়ে, যেমনটা ছিল ১৮৬০-এর দশকের ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের সময়ে, তেমনটা ঠিক আজও, কোনও সুনির্দিষ্ট সরকারি পরিসংখ্যান নেই। এক-একটি নৌকায় ৩ থেকে ৫ জন যেতে পারেন— সেই হিসাবে দেখলে সুন্দরবনের জলে আজও হাজার বিশ-ত্রিশেক ডিঙিনৌকার ব্যবহার হয়ে থাকে। অথচ বিএলসি রয়েছে ৬৯২টি— অর্থাৎ, সেই বিশ-ত্রিশ হাজার নৌকার মধ্যে কেবল ৬৯২টি নৌকা, এবং সেই প্রায় লাখখানেক মৎস্যজীবীর মধ্যে সাড়ে তিন হাজারেরও কম মৎস্যজীবী ‘বৈধভাবে’ মাছ ধরতে পারবেন এসটিআর-এর আওতাধীন নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলে। এই ‘বৈধতা’ যে ঠিক কীভাবে উদ্ভূত হল, তা বনদপ্তরের অবগত নয়, কিন্তু এই আরোপিত বৈধতার ফলেই রীতিমতো ‘কারেন্সি’ হয়ে উঠল জীবিকা-সুরক্ষার। বৈধভাবে, একটি বিএলসি হয়তো নৌকা-সহ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভাড়ায় খাটানো যায় না। অথচ, চাহিদা (২০-৩০ হাজার) ও জোগান (৬৯২)-এর এই অযৌক্তিক তারতম্যের ফলে, এই ভাড়ায় খাটানোর ব্যাপারটাই প্রচলিত হয়ে ওঠে। যে ৬৯২ জন বিএলসি-ধারক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে নিজে মাছ ধরেন নৌকায় উপস্থিত থেকে— এমন এসটিআর-সংলগ্ন সবকটি ব্লক অঞ্চলকে ধরলেও ২০০-র বেশি হবে না, যা এই প্রতিবেদক তাঁর কাজের অংশ হিসাবে ২০২৪-২৫ সাল জুড়ে এই বিষয়ে একাধিক তথ্য অনুসন্ধান বৈঠক করে অবগত হয়েছেন। বাকিরা ভাড়া দেন। প্রচলিত বিএলসি ‘ভাড়া’-র অঙ্ক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে বছরে এক লক্ষ টাকার কাছাকাছিতে এসে ঠেকেছিল ২০২৪ সালে।

যাঁরা হাতনৌকা নিয়ে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যাবেন, সেই ৩ থেকে ৫ জন সাধারণ মৎস্যজীবীর পক্ষে প্রতি বছর অতটা করে টাকা এমনকি একসঙ্গে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। তার সঙ্গে আছে জাল ও অন্যান্য সরঞ্জাম, বরফ, নুন, খাবার, জ্বালানি-র জন্য সিলিন্ডার ভাড়া নেওয়া, ইত্যাদির খরচ। পুরো টাকাটাই এক ধরনের আর্থ-সামাজিকভাবে প্রচলিত, অথচ আইনিভাবে অস্বীকৃত ‘দাদন’ অর্থাৎ ‘আর্নেস্ট মানি’ হিসাবে ‘ফ্রন্ট’ করেন নির্দিষ্ট আড়ৎদার, যাঁকে নির্দিষ্ট পরিমাণে বিক্রয়যোগ্য মাছ-কাঁকড়া বা সেই অনুসারে টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে দিতে হয়। ওয়াকিবহালমাত্রে জানবেন, বিশ্বের বিস্তীর্ণ উত্তর-ঔপনিবেশিক অঞ্চলজুড়ে কৃষিক্ষেত্রের মতো মৎস্যক্ষেত্রেও মধ্যযুগ বা হয়তো তার আগে থেকেই আড়ৎদারি বা সমগোত্রীয় প্রথা প্রকৃতির উপর সরাসরি ও প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল আঞ্চলিক জনগণের জীবিকার উপরে প্রভাব রেখেছে।

১৯৭৩ সাল থেকে টানা এই বিএলসি-ব্যবস্থা চালু থাকার ফল স্পষ্ট। বিএলসি-ধারক ও আড়ৎদাররা লাভবান হলেও, সুন্দরবনের হাজার হাজার সাধারণ মৎস্যজীবী তাঁদের জীবিকার অধিকার থেকে আইনি ও আর্থিকভাবে বঞ্চিতই রইলেন। ক্রমশ বেড়ে চলা বিএলসি-ভাড়ার বোঝা তাঁদের অর্থকষ্টকে আরও তীব্র করেছে, বাড়িয়েছে জীবিকার সংকট। ফলে আস্তে আস্তে খসে গেছে তাঁদের প্রথাগত জীবিকাগত আর্থিক নিরাপত্তার ভিত।

বেড়ে চলা জরিমানার অঙ্ক— জরিমানাগ্রস্ত মৎস্যজীবীর ব্যক্তিগত ডিটেল মুছে এই ছবি ভাগ করে নেওয়া হল

 

এরই মধ্যে, ২০১৭ সালে এসটিআর কর্তৃপক্ষ ‘নতুন বিএলসি’ জারির সম্ভাব্য প্রক্রিয়া হিসাবে রেঞ্জ ও ব্লক স্তরে জনশুনানির কথা ঘোষণা করল। পরবর্তী সময়ে, ২০১৯ সালে কলকাতা হাইকোর্টও এই প্রক্রিয়ার যুক্তিযুক্ততা স্বীকার করল। অথচ বাস্তবে কীভাবে এই পদ্ধতি কার্যকর হবে, সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ হিরণ্ময় নীরবতা বজায় রাখল। ফলত, কোথাও বিশেষ কোনও জনশুনানি হল না, আর নতুন কোনও বিএলসি-ও জারি হল না।

ঝড়খালি-নিবাসী স্বপন মাঝি এবং অন্যান্য কয়েকজন মৎস্যজীবীর বিএলসি-র আবেদনের ভিত্তিতে আনা রিট পিটিশন মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের আদেশ, তাং ১৪/১১/২০১৯

 

২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে এসটিআর কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে নতুন আদেশনামা জারি করল। নির্দেশ দেওয়া হল, বিএলসি-ধারকদের মাছ-কাঁকড়া ধরার সময় অবশ্যই সশরীরে নৌকায় উপস্থিত থাকতে হবে; অন্যথায় তদন্তসাপেক্ষে তাঁদের বিএলসি খারিজ করা হবে। ২০২৫ সালে তো কর্তৃপক্ষ আরও ঘোষণা করল, সাময়িক পারমিটের পাশাপাশি নতুন বিএলসি এবং তার সঙ্গে ফরেস্ট পারমিট দেওয়া হবে মৎস্যজীবীদের। কিন্তু বাস্তবে, এই ঘোষণার আড়ালে নতুন করে নানা প্রবল প্রতিবন্ধকতাই আরোপ করা হল।

২৪/০৬/২০২৪ তারিখে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সরকারি আদেশনামায় আরও একগুচ্ছ জীবিকার প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে দেওয়া হল প্রকৃত মৎস্যজীবীদের উপর

 

নানান ধরনের প্রচলিত ও পরিবেশবান্ধব জাল ও অন্যান্য মাছ ধরার সরঞ্জামের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল, একটি ছোট সিলিন্ডারের বেশি জ্বালানি নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হল, মাছ অথবা কাঁকড়া— যে-কোনও একটিই ধরতে বাধ্য করা হতে থাকল মৎস্যজীবী ও বিএলসি-ধারকদের। অথচ বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে, একসঙ্গে মাছ ও কাঁকড়া, এবং মূলত কাঁকড়া ধরলেই তবেই সুষ্ঠুভাবে মৎস্যজীবী হিসাবে জীবিকা নির্ধারণ করা সম্ভব আজকের দিনের সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলের মৎস্যজীবীদের পক্ষে। সুন্দরবনে প্রচলিতভাবে ধরা হয় এমন প্রায় ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে কেবলমাত্র ৫২টি প্রজাতি ধরার অনুমতি আরোপ করা হল— সবকিছুই চাপিয়ে দেওয়া হতে থাকল তাঁদের ওপর। না মানলে বনদপ্তরের কর্মীগণ প্রস্তুত থাকেন জাল–নৌকা–সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করতে, নুন-বরফ-মাছ ফেলে দিতে, এবং চড়া দাগের জরিমানা চাপানোর জন্য। অথচ একই সময়ে বহু হর্সপাওয়ারবিশিষ্ট ইঞ্জিনচালিত প্রাসাদোপম একতলা–দোতলা পর্যটনতরীর আনাগোনা আরও অবাধ করে দিল সরকার।

পর্যটনের অবাধ ছাড়পত্র— এখন ট্যুর অপারেটররা অনলাইনেই রেজিস্টার করতে পারেন, বনদপ্তরের সরকারি ব্যবস্থা ও বিজ্ঞপ্তিতে!

 

সুন্দরবনের ট্যুর অপারেটররা এখন অনলাইনে ছাড়পত্রের আবেদন করতে পারেন। সেই বিলাসবহুল পর্যটনতরীগুলোও পর্যটকদের নিয়ে বিচরণ করে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ ও অভয়ারণ্যের সেই জলরাশিতেই, যা আসলে মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অনুমিত অঞ্চল হিসাবে মোটামুটি অবশিষ্ট আছে। এমনকি এমন অঞ্চলও রয়েছে যেখানে মৎস্যজীবীদের ছোট আয়তনের, মেশিনবিহীন, দাঁড়টানা হাতনৌকা–ডিঙিনৌকার প্রবেশ নিষিদ্ধ, অথচ প্রকাণ্ড ট্যুরিস্ট ভেসেলগুলোর প্রবেশ অবাধ। এই বৈষম্য আরও ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় যে ট্যুরিস্ট ভেসেলগুলোর অবাধ চলাচল ও দূষণের ফলে যেটুকু অঞ্চলে মাছ-কাঁকড়া ধরা তথাকথিতভাবে ‘বৈধ’, সেই অঞ্চলেই মৎস্য তথা জলজ প্রাণীসম্পদ প্রবল হারে হ্রাস পেতে চলেছে।

 

সুন্দরবনে যুগ্ম বন-প্রবন্ধন— খাতায়কলমে বনাম বাস্তবে

এইখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে— তাহলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা, যাঁরা জীবিকার জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল, তাঁদের নিয়ে যৌথভাবে বন ব্যবস্থাপনার নিরিখে সরকার বা বনদপ্তর বা এসটিআর কি কিছুই করেনি? খাতায়কলমে দেখলে, করেছে। সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ প্রণীত টাইগার কনজারভেশন প্ল্যান, ২০১৭–২০২৭ অনুসারে, ২০১৪–১৫ সালের মধ্যেই সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের নিকটবর্তী ২৬টি গ্রামে যুগ্ম বন প্রবন্ধন সমিতি গঠিত হয়েছে। যদিও, তথ্যের অধিকার আইনের জবাবে এসটিআর কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে সেই সমিতিগুলির জন্য প্ল্যানে নির্দিষ্ট করা কোনও ‘মাইক্রো-প্ল্যান’ তাঁদের দপ্তরে সংরক্ষিত নেই।

আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে— কী এই যুগ্ম বন ব্যবস্থাপনা? কীভাবেই বা তা সুন্দরবনে প্রয়োগ হয়েছে? ১৯৯৫ সাল থেকেই এসটিআর-সংলগ্ন গ্রামগুলিতে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক-এর একটি প্রকল্প অনুসারে যুগ্ম বন ব্যবস্থাপনা সমিতি গঠন হতে থাকে— যেমনটা এসটিআর-এর প্রাক্তন ফিল্ড ডিরেক্টর প্রণবেশ সান্যাল তাঁর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। বনজ সম্পদ আহরণ ও বণ্টনের বিষয়টি গ্রামস্তরে দেখভাল করার জন্য এই যুগ্ম বন ব্যবস্থাপনার আওতায় গড়ে উঠতে থাকে ফরেস্ট প্রোটেকশন কমিটি (এফপিসি)। উল্লেখ্য, মাছ-কাঁকড়া ও মধুই আজ সুন্দরবন থেকে বৈধভাবে আহরণযোগ্য বনজ সম্পদ।

পাশাপাশি, অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান হিসাবে চিহ্নিত বনাঞ্চলের সংলগ্ন গ্রামগুলিতে গড়ে ওঠে ইকো-ডেভেলপমেন্ট কমিটি (ইডিসি)। ১৯৯৮ সালের মধ্যেই ২৪ পরগনা ফরেস্ট ডিভিশনে ২১টি এফপিসি গড়ে ওঠে, যেগুলির মধ্যে ১০টি ছিল এসটিআর-সংলগ্ন অঞ্চলে। একই সময়ে, গড়ে ওঠে ১২টি ইডিসি।

২০২৪-২৫ সালে একাধিক তথ্য অনুসন্ধান বৈঠক করে এই প্রতিবেদক জানতে পেরেছে যে, এক সময়ে সম্ভবত এফপিসি ও ইডিসি ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলের, বিশেষত এসটিআর-সংলগ্ন এলাকার গ্রামবাসীদের অরণ্যনির্ভর জীবিকায় কিছু ইতিবাচক ভূমিকা রাখত। যুগ্ম বন প্রবন্ধন-বিষয়ক বিশ্বব্যাঙ্ক প্রকল্পের মূল ভাবনা ছিল যে কোনও অঞ্চলের যুগ্ম বন প্রবন্ধন সমিতির কার্যক্রম থেকে সুবিধা পাওয়া উচিত সেই অঞ্চলের সকল অরণ্যনির্ভর মানুষের। কিন্তু সুন্দরবনের বাস্তবিক চিত্র অন্যরকম। দেখা গেছে, সুবিধা ভোগ করেছে কেবল কিছু নির্বাচিত ব্যক্তি, যাঁরা এফপিসি বা ইডিসির সদস্য হিসেবে নাম লেখাতে পেরেছিলেন। বিশেষত, যাঁরা ‘আহ্বায়ক’, ‘সভাপতি’, ‘সম্পাদক’, ‘ট্রেজারার’ প্রভৃতি পদ দখল করেছেন, তাঁদের হাতেই কেন্দ্রীভূত থেকেছে অধিকাংশ সুবিধা। বর্তমানে লোকমুখে ‘এফপিসি’ এবং ‘ইডিসি’ সমার্থক শব্দে পর্যবসিত হয়েছে।

এই মুহূর্তে, যুগ্ম বন প্রবন্ধনের নাম করে ‘এফপিসি’ ও ‘ইডিসি’-র পদাধিকারীবৃন্দ-সহ গড়ে ১০-১৫ জন সদস্য রয়েছে এমন ২৬টি গ্রাম পাওয়া যায় সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সংলগ্ন এলাকায়। কিন্তু বাস্তবে, পদাধিকারী কিংবা সাধারণ সদস্য হতে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা প্রায় অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে যাঁরা এইসব পদ বা সদস্যতার দখল নিয়েছেন, তাঁদের পূর্বসূরিদের অনেকেই হয়তো সত্যিই ছিলেন প্রকৃত মৎস্যজীবী— যাঁরা হাতনৌকা চেপে ন্দরবনের নদী-খাঁড়ি থেকে মাছ-কাঁকড়া সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন সপরিবারে, কিন্তু আজকের দিনে, তাঁদের মধ্যে প্রায় কেউ-ই আর সশরীরে সুন্দরবনের জলে নেমে মাছ ধরেন না, এমনকি দশকের পর দশক তাঁরা এ কাজে যুক্ত নেই। অর্থাৎ, তাঁরা আর প্রকৃত অর্থে সুন্দরবনের আরণ্যক বা সামুদ্রিক জীবিকানির্ভর মানুষ নন। তবুও, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয় ও প্রভাবের জোরে তাঁদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটেছে। কিন্তু সেই ক্ষমতায়ন ছিটেফোঁটাও পৌঁছায়নি সুন্দরবনের প্রকৃত সাধারণ মৎস্যজীবীদের কাছে।

খাতায়কলমে যুগ্ম বন প্রবন্ধন কমিটি গঠন হয়েছে, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ আধিকারিকের চিহ্নিত এমন ২৬টি গ্রাম, সুন্দরবনের বৃহত্তর ম্যাপে সবুজ বিন্দু হিসাবে দেখানো হয়েছে। সূত্র: উক্ত আধিকারিকের প্রণীত টাইগার কনজার্ভেশন প্ল্যান, ২০১৭-২০২৭

 

ঘটনাটি বনদপ্তরের অগোচরে ঘটেছে, এমনটা নয়। বরং বনদপ্তর তথা এসটিআর-ই নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসাবে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে যুগ্ম বন ব্যবস্থাপনাটি এই অবস্থাতেই সচল রেখেছে। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালের পর ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সাল জুড়ে একের পর এক আদেশনামা জারি করে মৎস্যজীবীদের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পাশাপাশি আরও শক্ত করার চেষ্টা করেছে যুগ্ম বন প্রবন্ধন— অথবা ইডিসি-এফপিসি-র নাম করে চালু থাকা সেই পদ্ধতিটিকে। অথচ তার বৈধতা এবং বাস্তবতার নিরিখে বহু ও বহুমুখী প্রশ্ন থেকেই যায়।

মৎস্যজীবীদের উপর একতরফাভাবে নানা বাধ্যতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে রাজ্য বনদপ্তর তথা সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ। যেমন, যুগ্ম বন প্রবন্ধন সমিতির সদস্য হওয়া এবং সেই সমিতি যেখানে তথাকথিতভাবে ‘গঠিত’ হয়েছে সেই গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার বাধ্যতা আরোপ করা হয়েছে মৎস্যজীবীদের উপর। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে— সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের নিকটবর্তী ২৬টি চিহ্নিত গ্রামের বাইরেও বহু গ্রাম আছে যেখান থেকে মৎস্যজীবীরা নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলে মাছ ধরতে যান। এমনকি ওই ২৬টি গ্রামেও অসংখ্য প্রকৃত মৎস্যজীবী রয়েছেন যাঁরা ইডিসি বা এফপিসির সদস্য নন। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, গত বছর এবং এই বছর ইডিসি/এফপিসির আহ্বায়ক প্রমুখ পদাধিকারীদের সঙ্গে এসটিআর কর্তৃপক্ষের বৈঠকে এমন প্রচেষ্টা জারি রয়েছে যাতে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সনাক্ত করার অযৌক্তিক ক্ষমতা এই তথাকথিত যুগ্ম বন ব্যবস্থাপনার নামে গঠিত ইডিসি/এফপিসি-গুলির হাতেই তুলে দেওয়া যায়।

 

কেন্দ্রীয় বনাধিকার আইন, ২০০৬ এবং বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইন, ১৯৭২ সংশোধনী, ২০০৭— আশার আলো জ্বলে উঠে নিভে যাওয়া

২০০৭ সালে এক ঝলক আশার আলো দেখা দিয়েছিল সুন্দরবন-ভাবিত অ্যাকটিভিস্টদের মনে। সেই বছর ভারতীয় পার্লামেন্ট বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইন, ১৯৭২-এ একটি সংশোধনী প্রণয়ন করে, যাতে আগের বছর প্রণীত বনাধিকার আইন, ২০০৬-কে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত এখানেই। সুন্দরবনের অধিকাংশ মৎস্যজীবী বনাধিকার আইন অনুসারে ‘অন্য পরম্পরাগত অরণ্য-নিবাসী’ হিসাবে চিহ্নিত হলেও, তাঁদের জীবিকা-নির্ভর অধিকার প্রমাণ করতে হলে দেখাতে হবে যে তাঁরা ১৯৩০ সাল বা তার আগে থেকেই, অথবা অন্ততপক্ষে তিন প্রজন্ম ধরে (২০০৫ সালের আগে), সুন্দরবনের জঙ্গল-নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

বাস্তবে এত পুরনো প্রমাণ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের কাছে নেই। তার উপর অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর আজও সুন্দরবনের দুই চব্বিশ পরগণাকে বনাধিকার আইনের প্রয়োগযোগ্য জেলা হিসেবে চিহ্নিতই করেনি; বরং তালিকাভুক্ত হয়েছে রাজ্যের অন্য ১১টি জেলা। ফলে, বনাধিকার আইন, ২০০৬ এবং ২০০৭ সালের সংশোধিত বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইন— দুটোই খাতায়কলমে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে সুন্দরবনের ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবনে।

 

বর্তমান সময়ে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের অধিকার যেভাবে বিপন্ন

আলোচনার এই অংশে এসে স্পষ্ট হয় যে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবিকার অধিকার ভারতীয় আইনে আজও সুরক্ষিত নয়। উল্টে বনদপ্তর একতরফাভাবে নানা হুকুমনামা চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। এই কায়েমি আধিপত্য আসলে ঔপনিবেশিক শাসনেরই ধারাবাহিকতা— যেখানে ‘বন সংরক্ষণ’ ও ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ’-এর নামে জীবিকার বিনাশ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার মৎস্যজীবী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনের অস্তিত্বের উপর।

এই বৈষম্যের ফলে বিএলসি-‘ভাড়া’-র বর্ধমান হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থিক সুবিধা ভোগ করছেন বিএলসি-র মালিক ও আড়ৎদারেরা। উল্লেখ্য, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ অঞ্চলের যে ৯২৩টি বিএলসি— বর্তমানে বহাল ৬৯২টি, যেগুলি লোকমুখে ‘টাইগার বিএলসি’ নামে পরিচিত— সেগুলি নিয়ে আলোচনা হলেও, এসটিআর-এর বাইরের রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকাতেও আরও প্রায় ৩৭০০ বিএলসি বহাল রয়েছে। সেগুলির মালিকেরাও ভাড়ায় তুলে উপার্জন করছেন, আর আড়ৎদারেরা পাচ্ছেন মোটা অঙ্কের লাভ এই বিস্তৃত ও অবৈধ বিএলসি-ভাড়া সংক্রান্ত দুর্নীতি থেকে।

একই সঙ্গে, বনদপ্তরের প্রত্যক্ষ মদতে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে যুগ্ম বন প্রবন্ধনের নামে গঠিত ইডিসি/এফপিসি-র সদস্য ও পদাধিকারীরা। এমনকি রাজ্য-স্তরে বনদপ্তর, বনবিভাগ, এসটিআর, পর্যটন বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় লাভবান।

যাঁরা পূর্ণত বঞ্চিত হচ্ছেন, তাঁরা হলেন সুন্দরবনের হাজার হাজার প্রকৃত মৎস্যজীবী— যাঁরা যুগ যুগ ধরে দাঁড়ে টানা হাতনৌকায় প্রতি গণে সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি ও জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যান, অথবা আজ জীবিকার চাপে প্রতিদিনের ‘নিত্যমারি’-তেই নিযুক্ত থাকেন।

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য যাতে বিনষ্ট না হয়, জলবায়ু যাতে দূষিত না হয়— এই উদ্দেশ্য এবং ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা সুরক্ষার স্বার্থ আসলে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিশ্বজুড়েই দেখা যায়: যেখানে জল-জঙ্গল-মাছ টিকে থাকে, সেখানেই মৎস্যজীবীদের জীবিকা সুরক্ষিত থাকে; আর ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা রক্ষিত থাকলেই সেই জায়গার জল-জঙ্গল-মাছও টিকে থাকে, প্রকৃতি সুরক্ষিত থাকে। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ডব্লিউডব্লিউ হান্টারের নথি থেকে শুরু করে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা আজ স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে যে, সুন্দরবনের ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা যুগের পর যুগ লোকজ প্রথা ও টেকসই পদ্ধতি অবলম্বন করেই নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া সংগ্রহ করেছেন— যাতে একই সঙ্গে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ হয়েছে এবং জল-জঙ্গল সুরক্ষিত থেকেছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থেকেছে।

আবার, একই সময় জুড়েই সুন্দরবনের জঙ্গল ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষার দোহাই দিয়ে সাধারণ মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার অধিকার সুরক্ষিত করার পরিবর্তে তা ক্রমাগত বিপন্ন করেছে বন প্রশাসন। তাঁদের আগাম না জানিয়ে, অনুমতি না নিয়ে একের পর এক অন্যায্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সবলে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হারে বাড়ানো হয়েছে জরিমানার অঙ্ক। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের নৌকা, জাল, সরঞ্জাম; ফেলে দেওয়া হয়েছে ধরা মাছ, বরফ, নুন, এমনকি পানীয় জলও— যা সেই লবণাক্ত জলরাশির মধ্যে পাওয়া শুধু দুষ্কর নয়, কার্যত অসম্ভব।

পৌনে দুই শতক ধরে বন প্রশাসনের মাধ্যমে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নামে চলে আসছে এই জুলুমবাজির ঐতিহ্য। এর ফলেই, এবং এর পাশাপাশি, আজও সমানতালে ক্ষমতার বলয়ে ক্ষমতাপুষ্ট হয়ে চলেছে মধ্যসত্ত্বভোগীদের দল— বিএলসি-ধারক, আড়ৎদার, যুগ্ম বন প্রবন্ধন সমিতির ‘ইডিসি’/‘এফপিসি’-র সদস্যবৃন্দ। ক্রমাগত জীবিকা হারাচ্ছেন সুন্দরবনের প্রকৃত মৎস্যজীবীরা। হারিয়ে যাচ্ছেন সুন্দরবনের প্রকৃত সংরক্ষকেরা।

পাশাপাশি, সরকার ‘ভারত–বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকল রুট’ গঠন করে অবাধ করেছে ক্ষতিকারক ফ্লাই-অ্যাশ-বাহী জাহাজের চলাচল। অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে আরও অবাধ করা হয়েছে পর্যটন ও পর্যটকবাহী অতিকায় যান্ত্রিক জলযানের চলাফেরা। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের পরোয়া না করে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে ক্ষতিকর বাঁধ নির্মাণ, এবং ঢালাও অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে পরিবেশবিধ্বংসী ‘ভেনামেই’ চিংড়ি চাষের।

ফলস্বরূপ, আজ সুন্দরবনের নদী-জঙ্গলের কাছাকাছি গ্রামগুলি— বিশেষ করে জেলেপাড়া ও মৎস্যজীবী পল্লীগুলি— দিনেদুপুরে ভারতের অন্যত্র হিন্দিভাষী অঞ্চলে পরিচিত ‘ভিরান গাঁও’-এর মতো জনশূন্য হয়ে পড়ছে। প্রতিটি ঘরে একাধিক সদস্য, যাঁরা এক দশক আগেও ছিলেন পেশাদার মৎস্যজীবী, তাঁরা আজ বাধ্য হচ্ছেন ভিন-রাজ্যে ও ভিন-জেলায় অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে পাড়ি জমাতে।

এই ক্রমাগত বঞ্চনার বিরুদ্ধে কি মৎস্যজীবীরা কখনও জোট বাঁধেননি, প্রতিবাদ করেননি? অবশ্যই করেছেন, এবং করে চলেছেন। তাঁদের সংগঠিত প্রতিরোধের ধারা ১৯৭০-এর দশক থেকে আজও বহমান। এই প্রতিরোধের ইতিহাস, সুন্দরবনের গ্রাম থেকে অভিবাসী শ্রমিকে পরিণত হওয়া মানুষদের জীবনসংগ্রাম, কিংবা মাছ ধরতে গিয়ে বন্যপ্রাণীর আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মৎস্যজীবীদের পরিবারের লড়াই— এসব নিয়ে আলাদা আলোচনা আবারও হতে পারে, অন্য কোনও সময়ে।

আপাতত এই আলোচনার ইতি টানা যাক এই আহ্বানটুকু জানিয়ে— সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবিকা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ান।

 

সূত্রসূচি:

  • অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দপ্তরের দেওয়া তথ্যের অধিকার আবেদনের জবাব, তাং ২১/০৩/২০১৬, আবেদনকারী— ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের ট্রেড ইউনিয়ন দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম (ডিএমএফ)।
  • ফিল্ড ডায়রেক্টর, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ-এর দেওয়া তথ্যের অধিকার আবেদনের জবাব, তাং ১৯/০৬/২০১২, আবেদনকারী – ডিএমএফ।
  • ফিল্ড ডায়রেক্টর, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ-এর দেওয়া তথ্যের অধিকার আবেদনের জবাব, তাং ১৩/০৫/২০২৫, আবেদনকারী – ডিএমএফ।
  • সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ প্রণীত সুন্দরবনে মৎস্যশিকার-বিষয়ক সরকারি আদেশনামা – ২০১৭, ২০২৪ এবং ২০২৫।
  • পশ্চিমবঙ্গ ফরেস্ট ম্যানুয়াল, পার্ট ১।
  • কলকাতা হাইকোর্টের আদেশ তাং ১৪/১১/২০১৯। রিট পিটিশন মামলা নং ২০৪২১ (ডব্লিউ)/২০১৯। স্বপন মাঝি এবং অন্যান্য বনাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এবং অন্যান্য। ২০১৯ এসসিসি অনলাইন ক্যাল ৮৪০৭।
  • বন্দোপাধ্যায়, হরিচরণ। বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড। সাহিত্য আকাদেমি। ১৯৭৮ পুনর্মুদ্রন সংস্করণ।
  • Chacraverti, Santanu. THE SUNDARBANS FISHERS: Coping in an Overly Stressed Mangrove Estuary. ICSF.
  • Raychaudhury, Bikash. The Moon And Net: Study of a Transient Community of Fishmen at Jambudwip. Anthropological Survey of India (Calcutta). 1980.
  • Mehtta, Megnaa. A ‘Licence’ to Kill in the Sundarbans. The India Forum. Nov 10, 2021.
  • Chakraborty, Atindriyo. On the imminent eviction of more than 1 lakh small-scale fishers of the Indian Sundarbans from their traditional livelihood. Counter Currents.org. Aug 5, 2024.
  • আলোচিত বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কর্মসূত্রে কৃত একাধিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক।

[1] খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭৭৬, প্রথম কলম, সাহিত্য আকাদেমি, ১৯৭৮ রিপ্রিন্ট সংস্করণ।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. জরুরি একটি প্রতিবেদন। সুন্দরবন সফরে তোলা বাঘের ছবি আর নদীবক্ষে বিহার- এতেই আমাদের পরিবেশভাবনা পুষ্ট হয়, মৎসজীবীদের নিয়ে আদপেই চর্চা দেখি না।এই রচনা পূর্বেতিহাসকে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক ও জরুরি করে তুলেছে। কতৃপক্ষের টনক নড়ানোর জন্য বিষয়টি নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে আলোচনা দরকার।

Leave a Reply to Swapan Bhattacharyya Cancel reply