সব চরিত্র কাল্পনিক

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

রাশিয়া। সাতের নভেম্বরের রাশিয়া না। আঠেরোর জুনের রাশিয়া। ভলগোগ্রাদ, সামারা, সারান্সক, সোশি, ইয়ারোস্লাভের রাশিয়া। এখানে বিপ্লব অ্যান্টিক মাত্র। পিটসবার্গের ফুলের তোড়ায় লড়াইয়ের গন্ধ লেখা থাকে না। রাশিয়া বদলে গেছে। আঠেরো। জুন থেকে জুলাই। বাইশ জোড়া পা। লুজনিকি স্টেডিয়ামে হোস্ট টিমের হাঁটা। আরবি গেরিলাদের করে দেওয়া হঠাৎ কিছু অঘটন? লোকটা জানে না। সে শুধু জানে ঘাম আর রক্তের দাম দিতে দিতে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে নামা। হার, হার, আবার হার। কিংবা জিতে শেষযুদ্ধে পৌঁছেও মায়াহীন পরিসমাপ্তি। সে শুধু জানে ইতিহাস ট্রফি দেখবে, ম্যাজিক না। সে জানে মস্কোর ওটক্রিটিয়ে অ্যারেনায় দুদিন পরে ঠাণ্ডা দেশের যুবকদের সঙ্গে দেখা হবে। আইসল্যান্ড। পানামার সঙ্গে যারা এবারেই প্রথম। লোকটার মনে পড়ে যাবে ইতালিয়া নব্বই। মনে পড়বে রজার মিল্লা, ওমাম বিয়িক, ক্যামেরুন আর সাতষট্টি মিনিটের অতিশীতলতা। লোকটার আইসল্যান্ড মনে হতেই ওই শীতলতাটা পেয়ে বসবে আবার। তখন তিন বছর বয়স, তখন ডোয়ারফিজম। তখন গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি। তবু লোকটার মনে পড়ে যাবে।

এদিকে সোশির ফিস্ট অলিম্পিক স্টেডিয়ামের খবর কী হল? ক্রিশ্চিয়ানোর দেশ। ইউরো। ব্যথা প্রচণ্ড। লোকটার তো কোপাও জোটেনি। ১০ মিনিটে কাঁদতে কাঁদতে বসে গেলে ইনজুরি অব্দি নিয়ে যেতে পারবে ডিমারিয়ারা? সম্ভব? সে ভাগ্য নিয়ে এসেছে নাকি লোকটা? ক্রিশ্চিয়ানোর আছে। লোকটা তাতে দোষের দেখছে না। শুধু খচখচানিটা বাড়ে, এই আর কী। ৫-৩ থেকে ৫-৫। খেলা ড্র। ব্যালন ডি অর একটা ঘটনা মাত্র না। একটা একা হয়ে যাওয়ার গল্পের সাক্ষীও। লোকটা তাতেও দোষের দেখছে না। আর সেই ক্রিশ্চিয়ানোর সামনে সহযোদ্ধা র‍্যামোজ। প্রিয় আন্দ্রেজ। বুস্কেটস। লোকটা জানে ক্রিশ্চিয়ানো ফাইনাল ফ্রন্টিয়ারে শেষ দেখে ছাড়বেই। আর এও জানে কোস্টারিকা, সার্বিয়া আর সুইশ ছেলেদের ফুটবলটা কেমন করে খেলতে হয় শেখাতে শেখাতে এগোতে থাকবে টিম ব্রাজিল। লোকটা জানে নেইমার জাতীয় স্তরে তাকে একদিন ছাপিয়ে যাবে। লোকটা প্রাণ থেকে সেদিন খুশি হবে। ছেলেটার গায়ের গন্ধ নিয়েছে সে। শিখিয়েছে, একে বলে ড্রিবল, আর একে নাটমেগ। সে ছেলে ট্রফি পেলে হিংসে করবে। লোকটা সে ধাতুর ছিল না কোনওদিন। হবেও না। শুধু একটা খচখচানি…।

যাই হোক, যে কথা হচ্ছিল। নিজনি নভগরদ। ক্রোয়েশিয়া। তখন ওর্তেগারা ছিল না? ওর পায়েও তো ম্যাজিক ছিল। ডানার মতো ছুটে আসত বাতিগোল। তখনকার ক্রোয়েশিয়া। ডাভর সুকুর। থার্ড। লোকটা জানে ক্রোয়েশিয়া ফিরে আসতে পারে। যেকোনও দিন, মুহূর্ত, সেকেন্ডে। লোকটা জানে মিরাকল, অঘটন আজও হয়। তাই সেনেগাল। তাই কোরিয়া বা ক্যামেরুন। লোকটার জার্মানির কথা মনে পড়বে। ০-৪, ০-১। কষ্টের একদিকে ব্র্যান্ডেনবার্গ দরজা। ভেঙে যাওয়া বার্লিনের মেমরিস হন্টিং…। গ্রুপ এফের মেক্সিকো, সুইডেন, কোরিয়া পেরোতে জার্মানির অল্প কিছু সেকেন্ড নষ্ট করতে হবে। যারা অন্তত সেমিফাইনালের আগে থামবে না। আর শেষমেশ নাইজেরিয়া। আফ্রিকা। লড়াই। কালো মানুষের গল্প। মেজাজ। সিংহ। ঈগল। খিদে। শরীর। ৩-১ এর অবিশ্বাস্য কুইটো এপিসোডের পর ফ্রেন্ডলি ম্যাচে যাদের কাছে ২-৪। গতবারে কোনওরকমে ৩-২। শেষ দুবারের একবার কষ্টসাধ্য ১-০, বাতিগোলের মাথা আর অন্যবার ০-১ থেকে পিছিয়ে শেষমেশ ২-১। ক্যানিজিয়া, দিয়েগো। লোকটা জানে, নাইজেরিয়া ম্যাচের জন্য ভাগ্য টিকিয়ে রাখার মানে মৃত্যু। লোকটা জানে প্রথম দু ম্যাচে ছ পয়েন্ট না পাওয়া মানে আবার সেই শীতলতা। যা আফ্রিকার গরম মানুষের সঙ্গে পেরে উঠবে না।

আসলে লোকটার কাছে চয়েস বলতে খুব সামান্য। গ্রুপ এ থেকে সুয়ারেজের উরুগুয়ে উঠুক। কিংবা গ্রুপ বি থেকে আন্দ্রেজদের স্পেন। বা সি থেকে পেরু। লোকটা রোজারিওর বাড়ির কথা মনে পড়বে। বুঝতে পারবে না, ফ্রান্সকে গ্রুপ সির টপে রাখলে দু নম্বরে কারা কম বিপজ্জনক? পেরু, ডেনমার্ক নাকি অস্ট্রেলিয়া? পেরু… পেরু … নাকি ডেনমার্ক। লোকটা জানে যেকোনো একটা গাঁট পাহাড়ের মতো। এই দল নিয়ে সমস্ত পাহাড়ই প্রচণ্ড খাড়াই। ওদিকে স্পেন, আর ক্রিশ্চিয়ানোর দেশ কোয়ার্টার ফাইনালে…লোকটা জানে সুয়ারেজ বাকিদের সাহায্য পাবে না। পারবে না পর্তুগালকে থামাতে। রাশিয়া লোকবল আর গ্যালারির রঙের ম্যাজিকেও খুব বেশী হলে প্রিকোয়ার্টার। ঠিক যেমন, মেক্সিকান মেয়েগুলো কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরবে সাম্বা ঝড় দেখতে দেখতে। নাকি সুইডিশ যুবকেরা? দুটো ক্ষেত্রেই উত্তর একই। পাওলিনহোদের রোখা যাবে না। অথবা সব ঠিকমত হলে শেষ ষোলোয় চলে আসবে লাল বেলজিয়ামের ছেলেরা। আর সেখানেই নেইমারদের সামনে। ব্রিটিশদের কতটা ধাক্কা দিতে পারবে কলম্বিয়া, বা সেনেগাল, বা পোল্যান্ড? লোকটা টিভিতে চোখ রাখবে। ৬ তারিখ নিজনি নভগরদে সম্ভবত বেঞ্জিমার সামনে ক্রিশ্চিয়ানো। এই ম্যাচের কোনও ফোরসি হয় না। লোকটা জানে যা খুশী হতে পারে। ১০৯ মিনিটে এডারের তিন কাঠির বদলা। ফরাসীরা একবার শেষ ঝাঁপাবেই। শেষ ষোলো। স্পেন। লা মাসিয়ায় যখন থেকে এসছে তখন থেকেই কাঁধে হাত রেখে থেকেছে আন্দ্রেজ। ফুটবলের কঠিনতম কাজ হল খেলাটাকে জলভাতের মত করে দেওয়া। আন্দ্রেজ পারত। আন্দ্রেজ পারে। ওর পায়ে সারাক্ষণ বল। মাঝে মাঝে মনে হত ও কিছুই করছে না বল নিয়েআসলে সারাক্ষণই কিছু না কিছু করে যাচ্ছে। ওই ইজিনেসটাই আন্দ্রেজ। দ্য আর্টিস্ট। তিকিতাকা। জরদি অ্যালবা। পিকে। বাত্রা। বুস্কেটস। নীল সাদাদের শেষ আটে পৌঁছতে যাদের থামাতে হবে। লোকটা জানে ফুটবলটা একার খেলা না। দেশের জার্সিতে শেষ খেলা? কাজান স্টেডিয়ামে? ৬ জুলাই? লোকটার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে? আগুয়েরো, দিমারিয়াদের একটু বোঝানো যায় না?


শেষ আট। লোকটা জানে না তখন তারা কোথায়? রাশিয়ায়? দশ তারিখ। সেন্ট পিটসবার্গ। স্পেন-পর্তুগাল। দ্বিতীয়বার। তবে এবার নক আউট। রোনাল্ডো জানে তাকে মুকুটহীন সম্রাট করে দেবে এই ম্যাচ। আন্দ্রেজ পেপেরা জানে দ্বিতীয়বার ট্রফি পেটে গেলে রুই প্যাট্রিসিওর হাতের ভরসার বাইরে জাল ছিঁড়তে হবে। ইউরোয় ফ্রান্স পারেনি? জাভি, দেলবস্ক নেই। এই স্পেন পারবে তো? আর তখনই লোকটার বুফোকে মনে পড়বে। জুভেন্টাস। তিক্ত মধুর। ২০১৭। বার্লিন। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনাল। আর তারপর সেদিনের অভিশপ্ত ০-৩। ফিরে আসাই যায়। পিএসজি মনে পড়ছে। কিন্তু সামনে যে বুফো। ওঁর বয়স। ওঁর চোখ। ওঁর অভিজ্ঞতা। হয়নি মিরাক্ল। সেই বুফো পারল না। সুইডেন উঠে গেল। লোকটার কমলা ঝড় মনে পড়বে। ১৪-র সেমিতে যা খুশী হতে পারত। রোমেরো ছিল। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা। লোকটা নিজেও ঠাণ্ডা মাথায় বল ঢুকিয়েছিল। নেদারল্যান্ড, ইতালি নেই। একে বিশ্বকাপ বলে? একটা বড় শ্বাস পড়ল। সেমিস। লুজনিকি। ১১ জুলাই। লোকটা জানে নেইমাররা আট তারিখকে ভোলে নি। ভোলা যায় না। আট জুলাই। ২০১৪। বেলো হরাইজন্টে। স্কুরি আর ক্রুজের দুটো। খেদিরা, ক্লোজে, মুলারের একটা করে। ৯০ মিনিটে অস্কারের একটা সান্ত্বনা। কেন ওই রেজাল্ট। প্রতিশোধ। কাঁটা দেওয়া, ছিঁড়ে খাওয়া একটা ম্যাচ। ব্রাজিল-জার্মানি। ওই জে বললাম, যা খুশী হতে পারে। ওপাশে যখন জার্মানি, তখন প্রতিশোধ চিন্তার চেয়ে ছক কষা, দম ধরে রাখা আর ডিফেন্স সাজানোর অভ্যেস বেশী করে করতে হয়। রিভেঞ্জ আসার হলে আসবে। আর তারপর মস্কোর লুজনিকিতেই ১৫ তারিখ। কারা হতে পারে? ব্রাজিল-স্পেন? ব্রাজিল-পর্তুগাল? নাকি জার্মানির সামনে ক্রিশ্চিয়ানো বা আন্দ্রেজরা? লোকটা জানে এর পর কোনও ফোরসি হয় না। সে দেখতে পায়, প্রথমবার বিশ্বজয় করে ব্রাসিলিয়া ফিরছে নেইমার। ১-৭ এর রাত থেকে ভুলে একটা বিরাট গরিব দেশ হাউ হাউ করে কাঁদছে। গরিবি ভুলে গেছে। সে দেখতে পাচ্ছে, একচ্ছত্রভাবে ডিয়েগো আর পেলের পাশাপাশি চলে এসছে ক্রিশ্চিয়ানো। ইউসেবিওর হেঁটে যাওয়া লিসবনের রাস্তায় সর্বশ্রেষ্ঠ পর্তুগীজ জলদস্যু। ফিগো এসে জড়িয়ে ধরছেন। ইউরো হল। এবার রাশিয়া আঠেরো। তাকে ছাড়িয়ে, কোথায় কতদুরে উঠে যাচ্ছে একটা পাহাড়? পাশে টিম। সহযোদ্ধা। একটু ফুটবলটা খেলতে জানে এমন কেউ কেউ…। এডার, কোয়ারেসমাদের মত উঠতি আলোদের পাশে ভরসা জাগানো পেপে, কারভালহোর রূপোলী আশ্বাস। তবে লোকটা জানে, স্ট্যামিনারও বিকল্প নেই। জার্মানির সঙ্গে এই ট্রফিটার গন্ধ লেগে থাকে। ফাইনালে উঠলে রোখা যাবে? দৌড় দৌড় আর দৌড়। লোকটা জানে ইতিহাস রিপিট হতেই পারে। তবে ওই যে কথা হল, ব্যক্তিগত সাফল্য খুশী হওয়ার মুহূর্ত তৈরি করে দিচ্ছে আন্দ্রেজ বুস্কেটসরা, লোকটা এই ছবিটাও দেখতে পাচ্ছে। আর একটা ছবি…। বুয়েন্স আয়ারস। ১৬ তারিখ। প্লেন থেকে নেমে…হাঁটা যাচ্ছে না। পৃথিবীর রঙ নীল সাদা। জনস্রোত। ভালোবাসার স্রোত। বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার স্রোত। দিয়েগোকে দেখা যাচ্ছে। রিকলমে, বাতিগোল, ক্যানিজিয়া সবাই। আরে, পেপ চলে এসছেন। রাইকার্ডও। এত দূর থেকে? প্রেস, প্রেস আর প্রেস। জর্জ, মারিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। কান্না। অ্যান্তোনেলার ঠোঁটের অশেষ উষ্ণতা। ছাড়তেই চাইছেনা ও। থিয়াগো, ম্যাটেও। অপত্য। আসলে ওরাই আজ বিশ্বজয়ী। ওদের পিতা শুধু বল ছুঁয়েছে মাত্র …

হোক, যা খুশী হোক। যে যা খুশী ভাবুক। হারা জেতা দুটো শব্দ মাত্র। আর থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট নিয়েও একের এক ম্যাজিকাল গোল? এক হাতে জার্সি ঋজু করা? গ্যালারি থেকে ডিয়েগোর জার্সি ঘোরানোর সার্বিয়া মন্টিনেগ্রো ম্যাচ? একা, একদম একা একটা দলকে একের পর এক ফাইনালে ওঠানো? অসম্ভব, অভাবনীয় গোল দিনের পর জাস্ট অভ্যেস করে নেওয়া? পাস, পাস আর পাস? জাভি আন্দ্রেজরা থাকা সত্ত্বেও গ্রহের সর্বকালের সেরা ক্লাব টিমের ধারাবাহিকভাবে এক নম্বর পাস বাড়ানোর ইতিহাস? লোকে দেখুক, জানুক না জানুক। লোকটা জানে, এসব কিছুই তাকে করে আসতে হয়েছে। করে যাবে। আর, সে তো জানে, ‘দেয়ার আর মোর ইম্পরট্যান্ট থিংগস ইন লাইফ দ্যান উইনিং অর লুসিং এ গেম’। আর ছোটবেলা বলতে আবার রোজারিও মনে পড়বে। সরু গলি। নীল সাদা পতাকা। একদম সেন্টারে একটা হলদে রঙের সূর্য – ‘সান অফ মে’। হৃদয়ের ভেতর একটাই দেশ। একটাই…।

ভামোস… ভামোস… আর্জেন্টিনা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...