মাতৃভাষার অস্তিত্ব ও সংকট

সঞ্জীব দেবলস্কর

 

এক সাহিত্যসভায় আসামের কবি নবকান্ত বড়ুয়া বলেছিলেন, তাঁর মাতৃভাষা হল ‘কবিতা’। একেবারে চমকিত করে দেবার মতো কথা। আমাদের আরও চমকিত হতে হয় যখন জানি যে, ত্রিপুরার জনজাতিদের সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা ‘ককবরক’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘মানুষের ভাষা’। বরাক উপত্যকার কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী ভাষা নিয়ে হানাহানি, সংশয়, বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস প্রত্যক্ষ করে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবার আমি পণ করেছি আর কিছুতে নয়, ভাষাহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়।’

আমাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলে ভাষা হল সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার, মান অভিমান। কিন্তু এখানেই শেষ নয় এর পরবর্তী স্তরে এ ভাষা নিয়ে আমাদের ‘প্রেমহীন ভালোবাসা’ যা ‘ভেঙেছে সুখের ঘর’, যেমন গেয়েছেন সুধাকণ্ঠ ভূপেন হাজারিকা; ভাষার জন্য পুড়েছে গ্রামবস্তি, ঘরবাড়ি, ভাষার জন্যে রক্তাক্ত হয়েছে আমাদের মাটি। এটা বড় নির্মম সত্য, আমাদের ভাষিক অভিমান যতটা আছে ততটা ভাষাতত্ত্ব নেই, ভাষা নিয়ে আমাদের যতটা আবেগ আছে, ততটা নির্মোহ চিন্তা নেই, ভাষার জন্য যতটা উত্তাপ আছে আমাদের রক্তে, ততটা প্রেম কি আমাদের আছে?

আশির দশকে শক্তিপদ ব্রহ্মচারী লিখেছিলেন একটি অর্থবহ পঙক্তি, ‘মেখলা ও শাড়ি আজ পাশাপাশি হেঁটে যায় সালোয়ার পাঞ্জাবির দিকে’… দিল্লি দিসপুর থেকে পারমিটের বাবুরা নেমে আসে’ ইত্যাদি। সংহতির চৌকো বারান্দায় দাঁড়িয়ে কবি লক্ষ করেছিলেন ‘দিল্লি থেকে ইন্দিরাজি হিন্দি বিলান স্বস্তা দরে, কিলোখানেক তাও কিনেছি জাতীয় সংহতির ডরে।’ ভাষা, মাতৃভাষার সংকট প্রসঙ্গে এ কথাগুলো আপাতত এখানেই থাকুক।

এবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি এই সময়ের লেটেস্ট ট্র‍্যানড অর্থাৎ সর্বশেষ প্রবণতার দিকে। বলছি আমাদের মাতৃভাষাবিহীনতার কথা। পরিসংখ্যানবিদরা জানিয়েছেন, এখন নাকি সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন অনেকগুলো ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ভাষা ক্রমে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এবং অসংখ্য ভাষা, উপভাষা ইতিমধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

এ প্রবণতা মোকাবিলার জন্যেই একুশে ফেব্রুয়ারি হল বিশ্বমাতৃভাষা দিবস। সূচনায় যা ছিল পাকিস্তানি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিরোধ, তা’ই পরবর্তীতে রূপ নিল নিখিলবিশ্বে সমস্ত ভাষাভাষীর মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনের। এ প্রসঙ্গও আপাতত থাক, আমরা বলছি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী কথিত ‘ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়’ আজ আমাদের ঘরে ঘরে। হ্যাঁ, এই আসাম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক দুটো উপত্যকায়ও। এ রাজ্যে TET পাশ করা যুবকযুবতীদের বিশাল সংখ্যক যে ইংলন্ড, আমেরিকায় শিক্ষাকতার যোগ্যতা অর্জন করলেও আসাম রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোতে পড়ানোর ন্যূনতম যোগ্যতা যে অর্জন করা হয়ে ওঠেনি এদিকে লক্ষ করাই হয়নি আমাদের। এরা যে mother-tongue illeterate, মাতৃভাষাবিহীন। শুধু বাঙালি আর অসমিয়াই নন এদের দলে আরও অন্যান্য ভাষাভাষীরাও আছেন। কেউ কেউ হয়তো শিশুকাল থেকেই ইংরেজি ইশকুলে ইংরেজি শিখেছেন, হিন্দি ইশকুলে শিখেছেন হিন্দি। নিজের মাতৃভাষাটা আর শেখা হয়নি। আর যারা প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক স্তরে অসমিয়া বা বাংলা পড়েছিল এরা মাধ্যমিক, উচ্চতর মাধ্যমিক স্তরে এসেই অল্টারনেটিভ ইংরেজিতে নাম লিখিয়ে নিয়েছে। যারা একেবারে KG থেকেই ইংরেজি-হিন্দি পড়ছে, আর যারা ইংরেজি-হিন্দি পড়ছে মাধ্যমিক স্তর থেকে এদের নিয়েই আমাদের রাজ্যে (আমাদের দেশেও) একটা প্রজন্মের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে — এরা হল মাতৃভাষাবিহীন প্রজন্ম। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যখন বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গ্রাম শহরের দেশীয় স্কুলে পড়াতে যাবে বা যাচ্ছে — এরা কী করে বা এতদিন এরা কী করেছে — এর খবর আমরা রাখিনি, যারা রেখেছেন তারা আতঙ্কিত হয়েছেন। বাংলা অসমিয়া পাঠ্যবই হাতে ছাত্রছাত্রীদের কী ক্ষতিই না করে আসছে এরা এটা দেখার অবকাশ আমাদের হয়নি। দোষটা কার সে বিচার করার মানুষের অভাব হবে না। এই ভাষাহারা শিক্ষকদের অতি অবশ্যই কাজ চালানো দেশীভাষা বিদ্যা হয়তো আছে কিন্তু বিদ্যাচর্চার ভাষা ইংলিশ-হিন্দি মিডিয়ামের এসব স্যার ম্যাডামদের যে অনায়ত্ত এটা অস্বীকার করার জো নেই। vernacular school এর native পড়ুয়াদের মানসিক, বৌদ্ধিক বিকাশের গোড়াতেই এ কাণ্ড। এরপর রাজ্যের শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে আমাদের বিলাপ নিছক বৌদ্ধিক বিলাসিতা। এখানে এ কথাটিও বলা ভালো, ল্যাতিন মূলের ওই শব্দ, vernacular এর অর্থ হল ক্রীতদাসের ভাষা। আমাদের রাজ্যে এ স্কুলগুলো তো আক্ষরিক অর্থেই verna-র স্কুল। সাহেবরা আরেকটি অবহেলার শব্দ ব্যবহার করত, নেটিভ। এই নেটিভদের ভাষা-না-জানা একটা শ্রেণি যারা IAS বা অন্যান্য প্রশাসনিক পদাধিকারী — ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, হাকিম, পুলিশ, পরিকল্পনাকারী, দেশের ভাগ্য নিয়ন্তা — এরা যে জনগণের ভাষা না জেনেই জনগণের সেবায় নিযুক্ত! এখানেই আমাদের চরম সংকট। মাতৃভাষার প্রয়োজন যে কেবল নান্দনিক, সাংস্কৃতিক জীবনে — এর যে ব্যবহারিক কোনও প্রয়োজন নেই এ বোধের অভাবেই আমাদের সামনে সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সমস্যাটা আসামের তো বটেই, তবে সর্বভারতীয় সংকটও এটা।

‎এই মাতৃভাষাবিহীনতা প্রবণতার কাছে অসমিয়া, বাঙালি সহ অপরাপর সব ক’টি ভাষাই পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছে। রাজ্যের শিশু, কিশোর, যুবকরা বাংলা কিংবা অসমিয়া পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, দেশীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। এদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি ঐতিহ্য-পরম্পরা থেকে বিচ্যুত, শিকড়বিহীন একটি প্রজন্ম। এও এক বাস্তুচ্যুতি। নিজদেশে বাস্তুচ্যুতি।

মাদের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্র-নজরুল নিয়ে অহংকার করে, কিন্তু এদের কানে গোঁজা ইয়ার ফোনে অষ্টপ্রহর বাজে বিজাতীয় গান, রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পীদের সামনে গীতবিতান বা স্বরবিতান নয়, রোমান হরফে লেখা বাংলা লিরিক। যারা বৈদুতিন যন্ত্রসহযোগে মঞ্চে লোকগান গেয়ে বেড়ান, এদের উচ্চারণ ইংরেজি ঘেঁষা। এসম এস, হোয়াটস অ্যাপে এরা রোমান হরফে দেশীভাষায় বার্তা টেক্সট করে, এ ভাষা না ইংরেজি, না হিন্দি, না বাংলা না অসমিয়া। এক বিচিত্র না ভাষাই এদের ভাষা। এ ভাষানৈরাজ্য কেউ জোর করে এদের উপর চাপিয়ে দেয় নি, আমাদের নিজেদের দোষেই পরিস্থিতিটা আমরা এরকম করে দিয়েছি। আমরা কি সন্তানসন্ততিদের মাতৃভাষায় কথা বলায় অক্ষমতা দেখে আনন্দিত হই না, সদর্পে বলি না আমার সন্তানটি বাংলা বলতে পারে না, লিখতে পারে না! বাংলা বানান, বাংলা যুক্তাক্ষর, ণত্ববিধি-ষত্ববিধি এসব নিরতিশয় কঠিন জিনিস — এ আওয়াজ তুলে আলোকপ্রাপ্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রথম সুযোগেই মাতৃভাষার বইপত্র নদীতে বিসর্জন দিয়ে Alt-E র দলে গিয়ে ভিড় জমায়। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আগামী দশ বছরে স্বাভাবিকভাবেই মাতৃভাষার অপমৃত্যু ঘটবে। আমার ধারণা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পরিস্থিতি অন্যরকম নয়।

‎মাতৃভাষার একটি শক্তিশালী অবলম্বন ছিল আকাশবাণী। আকাশবাণী আমাদের ভাষা শিখিয়েছে, ভাষাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে মাতৃভাষার গান, শুনিয়েছে কবিতা, নাটক, কথিকা। গৌহাটি-কলকাতা-শিলচর-আগরতলা-ডিব্রুগড় কিংবা দেশবিদেশের বেতার তরঙ্গে বাংলা, অসমিয়া সহ আঞ্চলিক ভাষার অনুষ্ঠান আমাদের প্রতিনিয়ত শিক্ষিত করে তুলেছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজ নিজ মাতৃভাষায়। এখন আকাশবানীর কেন্দ্রগুলো তো পোড়োবাড়ি। আগে দিল্লী কেন্দ্র থেকে একটার পর একটা আঞ্চলিক ভাষায় সংবাদ পাঠ হতো আর তামাম ভারতবর্ষ অসমিয়া, বাংলা, ওড়িয়া সংবাদ শুনে শুনে শিখে নিত ভাষাগুলোর হেড লাইন। এখন আঞ্চলিক নিউজ ডিভিশন দিল্লি থেকে সরিয়ে নেওয়া হল (বলা চলে তাড়িয়ে দেওয়া হল), চোখের জল ফেলার মতো একটি প্রাণীও নেই। কেউ বুঝলই না বহুভাষিক এ দেশটির চরিত্রলক্ষণের উপর এ আঘাতের স্বরূপ। দশ মিনিটের জন্য আঞ্চলিকভাষার সংস্থান রাখা গেল না। কি জানি এ বুঝি One India, one language plan. তবে এ প্রসঙ্গও থাক।

‎সূচনায় বলেছিলাম, উত্তরপূর্বাঞ্চলের ভাষিক অভিমানের কথা। ভাষা নিয়ে আমরা অনেক বিবাদ করেছি – কোন্ ভাষার বৈধতা বেশি, কোন ভাষা আগ্রাসনের ভাষা, কোন্ ভাষা শ্রেষ্ঠ আর কোন্ ভাষা অন্যরকম ইত্যাদি। আর, অপর দিকে ভারতভাগ্যবিধাতা মুচকি হেসেছেন। এ মুহূর্তে বিপন্ন তো সব ক’টি ভাষাই। সেই যে শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর পঙক্তি – ‘মেখলা ও শাড়ি আজ পাশাপাশি হেঁটে যায় সালোয়ার পাঞ্জাবির দিকে’। এখন যে ভাষা আমাদের প্রদেশ কিংবা দেশ তথা উপমহাদেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এ ভাষা হিন্দির মতো, তবে হিন্দি নয়, ইংরেজির মতো তবে ইংরেজি নয়, এ ভাষা একান্তই মিডিয়া লেঙ্গুয়েজ। এ ভাষার বিজ্ঞাপন হয়, প্রকাশ হয় না, বিপণন হয়, সৃজন হয় না। এ ভাষাই আগ্রাসনের ভাষা। এ ভাষা আমাদের সংহতির পথে নিয়ে যায় না, নিয়ে যায় উদভ্রান্তির দিকে, বিচ্ছিন্নতার দিকে।

মাতৃভাষা তো নিছক কিছু শব্দ কিংবা বর্ণমালা নয়, নয় কিছু শুষ্ক পুঁথির বোঝা। মাতৃভাষা আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি – সেটা অসমিয়াই হোক, বাংলাই হোক হোক না বড়ো, কোচ, ডিমাসা, কার্বি, তাই আহোম, কুকি, মিজো, মার, নাগা, নেপালি কিংবা ভোজপুরি। আমাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সব ক’টি ভাষাই সংগীতের ভাষা, কবিতার ভাষা, প্রেমের ভাষা – আগ্রাসনের ভাষা নয় কোনোটিই। বর্তমানের বিপন্ন মুহূর্তে সব ক’টি ভাষার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধার মনোভাব জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের ইতিহাস, প্রাকৃতিক ভূগোল, নৃতত্ত্ব এবং ঐতিহ্য পরম্পরাই দাবি করছে, আমাদের পথচলা সবাইকে নিয়ে, একলা পথের পথিক আমরা নই। বহুভাষিকতা আমাদের স্বাভাবিক উত্তরাধিকার, আমাদের ইতিহাসনির্দিষ্ট ভবিতব্য।

ভাষিক বৈচিত্র্য আমাদের দুর্বলতা নয়, শক্তির উৎস। এ বোধ না জাগলে আমরা কালের প্রবহমান গতি এবং সামাজিক প্রবণতায় হয়ে পড়ব ভাষাহারা ছিন্নমূল, মূক, বধির। আমাদের সবার স্বার্থে প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষাই জাতীয় ভাষার দাবি হোক, প্রতিটি ভাষাই নিজের মতো করে বাঁচুক। বহুজনগোষ্ঠী সমন্বিত, বহুভাষার ঐকতানে মুখরিত আসামই পারে আগামীর ভারতবর্ষকে পথ দেখাতে, এবং এটা শুরু হতে পারে নিজেদের মাতৃভাষাকে ভালোবেসে, প্রতিবেশির মাতৃভাষাকে ভালোবেসে, নিজেদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে আত্মস্থ করে।

আমার শেষ কথাটি নাগরিক কবিয়ালবন্ধু কবীর সুমনের গানের কলিতে — 

আমি চাই সাঁতাল তাঁর ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে,

আমি চাই মহুল ফুটবে সৌখিনতার গোলাপকুঞ্জে,

আমি চাই নেপালি ছেলেটা গিটার হাতে,

আমি চাই তাঁর ভাষাতে গাইতে আসবে কলকাতাতে।

[১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ অসম সাহিত্যসভা, শিলচর]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. এটাই বাস্তব, দেখি, শুনি কিন্তু ঠিক যেন বুঝিনা।

Leave a Reply to Syamal Chakrabarti Cancel reply