হীনম্মন্যতা ও বঙ্গীয় অশ্বতরবৃন্দ

নিরুপম চক্রবর্তী

 

ঘৃণ্য শূদ্র যত শত হস্ত দূরে রেখে
গৌরবে পড়েছি গীতাশ্রীমদ্ভাগবত,
দুর্দান্ত যবনকালে সেজেছি বৈষ্ণব।
ভাগ্যক্রমে ইংরাজ এল; স্বাগতম!
পড়েছে মুসলমান, বন্দেমাতরম্ 
ধ্বনি ওঠে ঘটিরাম ডিপুটির ঘরে,
যবনদুর্যোগ শেষে আহামরি শ্বেতাঙ্গ সকাল!

  • আনন্দমঠ / সমর সেন

১।

পদ্যটি পাঠ করিতে করিতে ঘটিরাম ডিপুটি প্রথমে ভ্রুকুঞ্চন করিলেন, পর মুহূর্তে অট্ট অট্ট হাস্যে তাঁহার বপু দুলিয়া উঠিল, মস্তকে সযত্নে আঁটিয়া রাখা শামলা ভূলুণ্ঠিত, বিপুল প্রয়াসে হাস্য সম্বরণ করিয়া ঘটিরাম কহিলেন: এই বিচ্ছুটি কে? নাম শুনিয়া তো মোগল পাঠান বোধ হয় না। সে কী ইংরাজ এবং ইংরাজি ভাষা বিরোধী? প্রত্যুত্তরে আমি বিনীতভাবে কহিলাম: যতদূর শুনিয়াছি তিনি ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি বিভাগের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছিলেন; তাহা সম্ভবত এই লেখকের ইংরাজি ভাষা বিরোধিতার প্রমাণপত্র নহে! ঘটিরাম কহিলেন: ছোঁড়া বুদ্ধিমান! আমার ন্যায় গ্রেস মার্কস লইয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় নাই! ইংরাজ বিরোধিতা ও ইংরাজি বিরোধিতা এক বস্তু নহে, ইংরাজি বিরোধিতা কোনও কাজের কাজ নহে। প্রাণ ভরিয়া যদি ওয়াল্টার স্কটের লব এন্ড ওয়র পাঠ না করিতাম, তবে কোথায় থকিত আমার দুর্গেশনন্দিনী? একবার ভাবিয়া দেখিয়াছো তাহা? আমি বলিলাম: অবশ্যই, যে ভাষাকে একদা আপনি কূলপ্লাবী তটিনী সম প্রবাহিত করিয়াছিলেন, আজ তাহা বিশীর্ণা পয়ঃপ্রণালী সম; রক্তাল্পতায় জরজর, একরাশ অশ্বতরের লেখনী তথা কী বোর্ডের কৃপায় নিরন্তর ধর্ষিতা, আপনি ডিপুটি মানুষ এই প্রসঙ্গে আপনার নিদান যাচ্ঞা করি। ঘটিরাম উত্তর দিলেন না, সশব্দে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া অন্তর্হিত হইলেন। খেয়াল করি নাই, এই কথোপকথন কালে মাল্যবান কোথা হইতে একটি ডাব হস্তে আবির্ভূত হইয়া সাগ্রহে সবকিছু শুনিতেছিল। আমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সে অস্ফুটে কহিল: একবারও বললে না যে আমিও ইংরাজি সাহিত্যে এম এ পাশ করেছিলাম! বলিয়া সে ডাব হস্তে দেশপ্রিয় পার্কের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। আমি উচ্চৈঃস্বরে তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম: কোথা যাও? ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, চোখে আজ স্বপ্নের নেই নীল মদ্য, কাঠ ফাটা রোদ সেঁকে চামড়া’! বিষণ্ণ প্রত্যুত্তর আসিল: সে পদাতিক আমি নই, ‘পর্বতের পথে-পথে রৌদ্রে রক্তে অক্লান্ত শফরে, খচ্চরের পিঠে কারা চড়ে? পতঞ্জলি এসে ব’লে দেবে ….’!

হে পাঠক! মম নাম নিরুপম বঙ্গবাসী। এক শ্বাসরোধী তমিস্রায় আমি এ কথকতা লিখিতে বসিলাম।

২।

২০১৮ খৃস্টাব্দ। কলিকালের কলিকাতা শহর। বিদ্যালয়াভিমুখে জননী চলিতেছেন সন্তান সমেত। সন্তানের বয়ঃক্রম সাত। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় জননী ব্যাকুলা। বালকটির পৃষ্ঠে একটি সুবিশাল পেটিকা, জ্ঞানভারে অতীব স্ফীত। বিদ্যালয়ে ক্রীড়াঙ্গন নাই, বালকটির ভ্রূক্ষেপ নাই তাহাতে, তাহার পরিচিত জগতে যাহা সে কদাপি দ্যাখে নাই, অতি অবশ্যই সে প্রসঙ্গে তাহার অনুযোগ তথা অভাববোধ থাকিবার প্রশ্ন উঠে না। হে পাঠক! আশা রাখিব এই বালক একদা আমাদের বঙ্গ ভাষা ও সংস্কৃতির মুখ উজ্জ্বল করিবে! ইহা অতীব পরিচিত দৃশ্য: দুর্মর নারীবাদীবৃন্দ, ইহাকে একটি সমবয়সী বালিকার বিদ্যালয় যাত্রার রুদ্ধশ্বাস বিবরণে পরিবর্তিত করিয়া পাঠ করিতে পারো; আমার বক্তব্যের তাহাতে ইতরবিশেষ হইবে না।

বক্তব্যের উপক্রমণিকা তথা সমস্যাটির বিবরণ এইপ্রকার: ইদানীং অনুযোগ শুনিতেছি যে বাঙলা ভাষা বিলুপ্ত হইবার মুখে, এই বঙ্গের সন্তান সমুদয় কেবলই ইংরাজি ভাষা শিক্ষা করিতেছে, অধুনা হ্যারি পটার নামক জনৈক অর্বাচীন দুর্বৃত্তের আগমনে শুনিতেছি ঠাকুরমার ঝুলির প্রতিটি রাক্ষসের হাড্ডি পিলপিলাইয়া গিয়াছে! চিরকালীন আমোদগেঁড়ে বাঙ্গালী ‘জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না’ জাতীয় পদ্য রচনা করিয়া চতুর্দিকে জেলেপাড়ার সং এর নবজাগরণ ঘটাইতেছেন। যে তীব্র হীনম্মন্যতা এই সকল মনোভাবের জন্মদাত্রী, আইস পাঠক এই নিবন্ধে আমরা সেই অপদেবীর সন্ধান করি।

ক। একটি ভাষা শিক্ষা কদাপি দ্বিতীয় একটি ভাষা শিক্ষার অন্তরায় নহে। বাঙ্গালী নামক অশ্বতর জাতি সর্বাগ্রে এবং সোৎসাহে পরাধীনতা বরণ করিয়াছিল ইহা যেইরূপ ঐতিহাসিক সত্য, সেইরূপ ইহাও সত্য যে এই জাতি দ্বিশতাধিক বৎসরেরও পূর্বে প্লোম্যান চাষা, কুকুম্বার শসা ইত্যাদি শিক্ষা করিয়া ইংরাজি নামক ম্লেচ্ছ ভাষাটিকে কেবল কুক্ষিগত করে নাই, তাহার সহিত সিম্বায়োটিক সম্পর্কে জড়াইয়া পড়িয়াছিল। পূর্বের অনুচ্ছেদে ডিপুটিবাবু, বকাটে সমর তথা মাল্যবান বৃত্তান্তে তাহা প্রকটিত। ইংরাজির প্রভাবে এই গেল গেল রব এ জাতির সাম্প্রতিক অতীব দুঃখজনক স্থিতি। আমরা এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় যাইব।

খ। যৎসামান্য ব্যক্তিগত স্মৃতিকথন এই সূত্রে প্রাসঙ্গিক। সত্তর দশকের একটি বাংলা মাধ্যমের সরকারি বিদ্যায়তনে বর্তমান লেখক ইংরাজি শিক্ষা করিতেছেন। প্রথম শিক্ষক প্রয়াত হিমাংশু ভট্টাচার্য: মধ্যবয়স্ক, সামান্য পৃথুল, হ্রস্ব দৈর্ঘ্যের ধুতি পরিহিত, স্বল্প দৈর্ঘ্যের টিকিধারী, তাম্বুল রসিক, বলিতেছেন: এই দ্যাখ্‍ একে বলে প্যারানথেসিস ক্লস, লেখার সময় এর সামনে আর পেছনে কমা দিবি, এই অংশটা যদি সেন্টেন্স থেকে বার করে নিস তাতেও কিন্তু সেন্টেন্সটা ভেঙে পড়বে না! ওই বিদ্যায়তনের অপর শিক্ষক অসীম মুখোপাধ্যায়, যাঁহার কথা ইতিপূর্বে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে বলিয়াছি অদ্যাপি আমার ভাষাগত মননে প্রবাহিত হন। এইসব শিক্ষকবৃন্দ অক্সফোর্ড কিংবা বস্টন অ্যাকসেন্টে ইংরাজি কহিতেন না, ভাষাটি তাঁহারা জানিতেন অতি গভীরভাবে, আদ্যন্ত বাঙ্গালী এই সকল দ্বিভাষিক শিক্ষকেরা ইংরাজি ভাষাটিকে ভালোবাসিতেন আর তাঁহদের সম্ভ্রান্ত মাতৃভাষার উচ্চারণ অদ্যাবধি যেন স্মৃতিতে মন্ত্রোচ্চারণসম রণিত হয়। আমি তাঁহাদের প্রতিভার কণামাত্রের অধিকারী, তবু বলি, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে’। হ্যাঁ, আমি বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাপ্রাপ্ত, ঘটিরাম বাবুর প্রতিটি উপন্যাস শুধু বহুবার পাঠ করি নাই, প্রতিটি হ্যারি পটার গ্রন্থও সাগ্রহে পাঠ করিয়াছি!

গ। এই সকল বঙ্গীয় বিদ্যায়তনের অধুনা অতীব দৈন্যদশা। এ দৈন্য শুধু অর্থনৈতিক হইলে রক্ষা ছিল, ইদানীং ইহা মননের যক্ষ্মায় পর্যবসিত হইয়াছে। হিমাংশুবাবু, অসীমবাবুদের শূন্যস্থান পূর্ণ করিয়াছেন ট্যুইশনবাজ, পার্টিবাজেরা। মাতৃদুগ্ধসম মাতৃভাষার ন্যক্কারজনক নিরীক্ষার নামে ইংরাজি বিতাড়ন, এবং পরবর্তীকালে জলাঞ্জলি অধ্যয়ন একরাশ ভাষাজ্ঞানহীন নিয়ান্ডারথালের জন্ম দিয়াছে যাহারা ইংরাজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই সমভাবে জড়তাগ্রস্ত। তথাপি, বাংলা যেহেতু তাহাদের মাতৃভাষা, স্বাভাবিক আত্মসম্মান রক্ষার প্রবণতায় তাঁহারা ধরিয়া নেন যে সে ভাষায় তাঁহারা পারঙ্গম, এবং সমস্ত সর্বনাশের মূল হিসাবে ইংরাজি শিক্ষার দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করেন এবং পরিশেষে পটার নামক একটি হাতেমতাইকে শনাক্ত করেন। ইহা ভাষাজ্ঞানের অভাবজনিত হীনম্মন্যতার প্রদর্শনী, আর সে হীনম্মন্যতা এত সুগভীর যে এইসকল নব্য শিক্ষিতদিগের জিহ্বার জড়তা অধুনা এই শব্দটির বানানে একটি ‘ম’ অক্ষর বিসর্জন দিয়াছে!

হে পাঠক! এই ভাষাগত অবক্ষয় এই অশ্বতর জাতির এক বৃহত্তর সর্বাঙ্গীণ বিপর্যয়ের অংশ মাত্র। আইস আমরা তাহার অনুসন্ধানে যাই।

৩।

জিহ্বার জড়তা প্রসঙ্গ যখন উঠিলই তখন সে প্রসঙ্গে যৎকিঞ্চিত বাক্যালাপ করি। পাঠক কী একটি ভাষা সংক্রান্ত গভীর নিরীক্ষা চালাইতে সম্মত? বেশ, ইহার জন্য প্রয়োজন একটি কেবল অথবা ডিস সমন্বিত টেলিভিশান সেট, যাহাতে আপনি বিবিসি, সিএনএন ইত্যাদি বিদেশী চ্যানেলগুলির সহিত বঙ্গ ভাষা বাহিত তারানন্দ, ৪২ ঘণ্টা ইত্যাদি দেখিতে পারেন। জাতীয়তাবাদী ইংরাজি চ্যানেলের রাসভ চিৎকারকে এই মুহূর্তে আমরা নিরীক্ষার বাইরে রাখিতেছি। ম্লেচ্ছ চ্যানেলগুলির সাংবাদিকবৃন্দের যেকোনও একটি প্রতিবেদন শুনিয়া দেখুন। মৌখিক ভাষা যৎপরোনাস্তি পরিশীলিত, দেহভাষা আত্মবিশ্বাসের বার্তা বহন করে। ইহার পাশাপাশি নব্যবঙ্গীয় পিঙ্খাড়ু ছোকরা সাংবাদিকবৃন্দের প্রতিবেদন শ্রবণ করুন, সুললিত সুমন ইত্যাদি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত খবর ঘরের অধিবাসীদিগের কথা বলিতেছি না, যাহারা মাঠেঘাটে ভ্রমিয়া তথ্য প্রদানে রত, এই মুহূর্তে আমি তাহাদেরই বার্তা শ্রবণ করিতেছি। শরীরে অর্ধপুষ্টি, মানসিক পুষ্টি আরও কম। শব্দ ভাণ্ডারে অর্ধশতাধিকের বেশি শব্দ জমা রহিয়াছে বলিয়া প্রত্যয় হয় না, অর্ধসমাপ্ত বাক্য বলিতেছে, প্রায়শই কথা হাতড়াইতেছে এবং অপারগতায় মুখগহ্বর হইতে অঁ অঁ জাতীয় কিছু অর্থহীন অব্যয় ধ্বনি নির্গত হইতেছে। দেহ ভাষ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব ব্যতীত অন্যকিছু পরিলক্ষিত হয় না। ইহারা কালেজ শিক্ষিত এবং মাতৃভাষায় কথা বলিতেছে ইহা বিশ্বাস হইতে চাহে না!

আহা! গোরা সাহেবদিগের সহিত কী আমরা আঁটিয়া উঠিতে পারি! সত্য কথা! তবু কেন সহসা স্মরণে আসে ‘আকাশবাণী কোলকাতা, খবর পড়ছি নীলিমা সান্যাল’ শুনিয়া একদা হৃদয় দুলিয়া উঠিত, কী প্রবল বিক্রমে ইডেন উদ্যান হইতে অজয় বোসেরা মহাভারতস্য সঞ্জয়সম পারদর্শিতায় ক্রিকেট যুদ্ধের ধারাবিবরণী প্রাচীন রেডিও সেটের মাধ্যমে শ্রোতাদের মর্মে প্রবেশ করাইতেন। কেন যেন প্রত্যয় হইত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় একাকী একটি সমগ্র জাতিকে সম্মুখ সমরে পরিচালিত করিতেছেন! সমকালীন প্রবাদপ্রতিম ম্লেচ্ছ সংবাদ প্রতিনিধিরা, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল্টার ক্রঙ্কাইট কিংবা বারব্রা ওয়াল্টার্স প্রমুখ ইহাদের সমকক্ষ। আত্মবিশ্বাস শব্দটি বাঙ্গালীর অভিধান বহির্ভূত হইবার ঢের দেরী তখনও।

তথাপি অবক্ষয় আসিল। এবং সে অবক্ষয় সর্বাঙ্গীণ। বঙ্গভাষী বিদ্যালয়গুলি ক্রমশঃ আস্তাবলে রূপান্তরিত হইল, অলিতে গলিতে অনিয়ন্ত্রিত ছত্রাক সম অংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাসদনগুলি গজাইয়া উঠিল, তাহাদের দরজায় দরজায় যীশু ঝুলিতে লাগিলেন, বিপন্ন পিতামাতা সন্তানবৃন্দের হস্ত পাকড়াইয়া প্রবলবেগে সেই দিকে ধাবিত হইলেন। সন্তানেরা ‘কেন কী’ বাংলা আর ভার্ব, এ্যাডভার্ব, এ্যাডজেক্টিভ, প্রিপোজিশান, কনজাংশান বিহীন পিজন ইংরাজি শিখিল; তাহাদের কিচির মিচিরে জনক জননী মুগ্ধ! ইতিমধ্যে সস্তায় পুষ্টিকর কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলিও সম্ভ্রান্ত হইয়া উঠিল। কেন্দ্রীয় বোর্ডের আপত্তি না থাকা সত্ত্বেও, সুকৌশলে তাহার অধিকাংশে বাঙলা ভাষা শিক্ষার পথ রুদ্ধ করা হইল। পশ্চিমবঙ্গে জন্ম লইয়া এবং বসবাস করিয়া সহস্র সহস্র বঙ্গভাষী পিতামাতার সন্তান বাঙলার পরিবর্তে হিন্দী শিখিতে লাগিল এবং কালক্রমে এক নব্যবঙ্গ প্রজন্মের সৃষ্টি হইল যাহারা পাতি বাঙ্গালী অথচ বাঙলা ভাষা লিখিতে বা পড়িতে পারে না!

বিষবৃক্ষ শাখা প্রশাখা বিস্তার করে, লক লক করিয়া বাড়িয়া উঠে। আমাদের ইস্কুলগুলি ব্যাধিগ্রস্ত, সেক্ষেত্রে কালেজ ইত্যাদি বাঁচিবে কেমনে? এই প্রবল বিদ্যাভ্যাস শেষে আমাদের প্রাগুক্ত নব্যবিদ্যাসাগর বালকটির একটি প্রতিরূপ আইআইটি নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করিবার নিমিত্ত পরীক্ষা দিয়াছিল, কৃতকার্য হয় নাই। সংবাদে প্রকাশ, কেন্দ্রের বঞ্চনা তথা চক্রান্তে এই সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাত্রসংখ্যা এই রাজ্যে লক্ষণীয় ভাবে কম! সে আপাততঃ পদার্থবিদ্যায় বিএসসি অনার্স পাশ দিবে বলিয়া মনস্থ করিয়াছে। তাহার পর যে কী করিবে তাহা সে ভাবিয়া পায় না, কভু ভাবে আইএএস অপিসর হইবে, শুনা যায় যে সেইস্থানেও এই রাজ্য হইতে সাফল্যের হার অতীব নিরাশাজনক, পরিবর্তে সত্যেন বসু হইবার কথা ভাবে, কিন্তু ভাবিয়া পায় না বসু মহোদয়কে এইসকল কঠিন অঙ্ক কে বা কাহারা শিখাইয়াছিল, তাহার নিজ অধ্যাপকদের প্রতি তাহার ভরসা কম! ইতিমধ্যে তাহার এমিলি ডিকিন্সন সম প্রতিভাময়ী দিদিটি, সাহিত্যে এমএ পাশ দিয়াছে এবং যথারীতি জাতীয় স্তরের নেট নামক পরীক্ষায় ফেল মারিয়াছে। পাঠক! তুমি কী শঙ্খ ঘোষ, অমর্ত্য সেন আদির কালেজের প্রাক্তনী? নোংরা রঞ্জনের ইস্পিচ শুনিতে যাইতেছ? যাও, সমগ্র জাতি ভাসানে যাইতেছে, তুমিই বা বাদ থাকিবে কেন? আমি আমার বাঙ্গালীত্ব প্রত্যাহার করিলাম!

৪।

শেষ বাক্যটি লিখিবামাত্র কোথা হইতে মাল্যবান আবির্ভূত হইল। ‘বাঙ্গালীত্ব প্রত্যাহার করিবে? বলিলেই হইবে?’ প্রত্যুত্তরে বলিলাম ‘হ্যাঁ মনস্থির করিয়াছি! বাঁচিতে চাহিলে তুমিও করো, তোমার নামে হুলিয়া জারি হইয়াছে!’ শিহরিত মাল্যবান বলিল ‘সে কী! আমি তো কদাপি কাহাকে ব্যাম্বু প্রদান করি নাই!’ বলিলাম ‘তাহা করো নাই ঠিক, কিন্তু মুদ্রিত অক্ষরে সজ্ঞানে মিথ্যা লিখিয়াছ। তুমি ভালোই জানো বঙ্গভাষী সকলেই কবি, ওই দ্যাখো জল স্থল অন্তরীক্ষ বাঙ্গালা কবিতায় ছাইয়া গিয়াছে, কবিতার ভারে ধরিত্রী কম্পমানাঃ। ওই দ্যাখো দশকী কবিরা কবিতার আস্কে পিঠা, ঘাস্কে পিঠা, চাস্কে পিঠা নির্মাণ করিতেছেন। চতুর্দিকে কবিতার মাচা, মাচা কবিরা মাচা হইতে অবতরণ করিয়া মুখ পুস্তিকায় প্রতি ঘণ্টায় একটি করিয়া কবিতার পাঠ দিবেন!’ মাল্যবান বলিল ‘দারুণ দুঃস্বপ্ন গোইয়া অজানার নিপট সঞ্চয়… এ পদ্য আমার লেখা নহে, কিন্তু এই সকল দেখিয়া ইহাই মনে আসিতেছে!’ বলিলাম ‘তুমি কী জানো, ফরাসী দাদাবাদ বিলুপ্ত হইয়াছে কবে, কিন্তু এক নব্য দাদাবাদ এই স্থলে অদ্যাপি বিরাজমান; ওই দ্যাখো সহস্র সহস্র বালখিল্য কবি দাদা দাদা করিয়া চতুর্দিকে ব্যাকুলভাবে ছুটিতেছে, প্রত্যেকের হস্তে গুটিকয় স্বলিখিত ধারাপাত। ইহারা কবিতা লিখে এবং ছাপায়, ইহাদের কবিতা পড়া এবং বোঝা বারণ, স্বলিখিত কবিতার ক্ষেত্রেও একই বিধি!’ মাল্যবান বলিল ‘অবহিত আছি! শুনিয়াছি এই নব্য দাদাবাদের উদ্ভব কোনও এক সুনীল সাগরে!’ তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে সিংহ বিক্রমে ঘটিরাম ডিপুটি প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং গর্জন করিয়া বলিতে লাগিলেন ‘কে ওই ছোঁড়াটা? ওই তো বাঙলা গদ্যের ছিরি, আবার বঙ্কিম পুরস্কার নিতে এয়েচে! কাঁহা হো কমলকুমার, অমিয়ভূষণ? উসকো পকড়কে হামারা এজলাস মে লেকে আও!’ অতি কষ্টে বদরাগী ডিপুটিকে নিরস্ত করিলাম।

আমি আর মাল্যবান বাঙ্গালীত্ব বর্জন করিয়াছি। নির্বাসনে যাইব। আমি বলিলাম ‘আমরা প্রতীকহীন, হাতে কোনও পতাকা নিইনি, আমাদের সঙ্গে এক বাউলের বিধবা যাবেন। উষ্ণ বয়সিনী ওই বঙ্গনাম্নী বৈষ্ণবীটি ছাড়া তৃষ্ণার রাস্তায় আর অন্য কোন যুবতী যাবে না!’ আকর্ণবিস্তৃত হাস্য সমেত মাল্যবান কহিল ‘আল মাহমুদ! আমাগো ওদিগগার পোলা! কী সোন্দর ল্যাখতো দ্যাখো!’

ডিপুটিবাবু শামলা খুলিলেন, তাহার পরে বলিতে লাগিলেন ‘কেননা এখন তারা যেই দেশে যাবে তাকে উড়ো নদী বলে; সেইখানে হাড়হাভাতে ও হাড় এসে জলে মুখ দ্যাখে — যতদিন মুখ দেখা চলে।’

আমি আর মাল্যবান নিরুদ্দেশে চলিলাম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

7 Comments

  1. নিরুপমদা: কবে শেষ হবে এই অবক্ষয় ! আমাদের জীবদ্দশায় ! ‘তাসবে অবোধ আমি অবহেলা করি’. এর বেশি কিছু লিখতে গিয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে.

  2. এই অবক্ষয়কে শেষ কথা ভাববো কেন? মাল্যবান তো সেই কবে বলে গেছে: ‘ইতিহাসে ঘুরপথ ভুলপথ গ্লানি হিংসা অন্ধকার ভয়/ আরো ঢের আছে তবু মানুষকে সেতু থেকে সেতুলোক পার হতে হয়’। আমি নিজেও ঠিক তারই মতো আশাবাদী ! 🙂

  3. লেখাটি পড়লাম; এবং বলা বাহুল্য পড়ে বিহ্বল হলাম এবং বিচলিতও !

    কারণ অতি সহজবোধ্য; এই মন্তব্যকারের বয়স নিরুপম বঙ্গবাসী বাবুর থেকেও ৪/৫ বৎসর অধিক এবং তিনিও ষাট দশকের মধ্য/শেষ ভাগে উত্তর কলকাতার তৎকালীন প্রথিতযশা একটি মাতৃভাষা-মাধ্যমের বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন! দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দী পরে, প্রবাসী বাঙালি রূপে ঝাড়খণ্ডে বিখ্যাত ইস্পাত কারখানায় কর্মজীবন অতিবাহিত করে এই একই অনুভব তাঁরও। এবং এই বৃদ্ধের মাতৃভাষা এবং ম্লেচ্ছ ভাষায় সহজ বিচরণ যখন বর্তমান বা কিঞ্চিৎ অতীতের প্রজন্মের ঈর্ষার বিষয় হয়, তখন তাঁর লজ্জায় ও গ্লানিতে মাথা নত হয়ে আসে। তার সঙ্গে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় প্রয়াত সেই সব প্রবাদপ্রতিম শিক্ষকদের কথা মনে হয়েও; প্রায় অর্ধনগ্ন না হলেও সাদাসিধা ফকিরের বেশে যাঁরা পড়িয়েছেন শিখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন । ইচ্ছা শক্তির অভাব, আত্মবিশ্বাসের দৈন্য, অনুকরণের অন্ধ স্পৃহা, এবং ভয়ঙ্কর দিশাহীনতা আমাদের যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে, সেখান থেকে কোনো উত্তরণের আলো দেখতে পাইনা আর, তাই শ্রী বঙ্গবাসীর কাছে আমি মার্জনা-প্রার্থী!

  4. অনেক ধন্যবাদ! তবে লেখাটির এই প্রায় অলৌকিক ক্ষমতাটির কথা আমার নিজের জানা ছিলোনা! 🙂

আপনার মতামত...