এক নাট্যকারের কিস্যা।

পিনাক বিশ্বাস

 

বিখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল ছিলেন শিবপুর বিই কলেজের ছাত্র কাম ছাত্র ইউনিয়নের ড্রামা সেক্রেটারি। বার্ষিক সোসালে হাসির নাটিকের চাহিদা বেশি। ব্যাপিকা বিদায়, অলীকবাবু এসব নাটক আর চলেনা। আগের বছর হয়ে গেছে মানময়ী গার্লস স্কুল। নারায়ণ সান্যাল নিজেই লিখে ফেললেন এক নাটক ‘মুশকিল আসান’। এটিই ছিল তার লেখা প্রথম নাটক।
তো সেই নাটক অভিনয় করা হবে। নোটিস বোর্ডে বার্তা লটকানো হল। নির্দিষ্ট দিনে চরিত্র বন্টন হবে। আগ্রহী ছাত্রেরা পরিচালক কাম লেখকের সাথে যেন দেখা করে।
নায়িকা পাওয়া যেতনা। সান্যাল লিখেছেন, ১৯৪৫ সালে গোটা কলেজে একজনও মেয়ে ছিলোনা ফলে বরাবরই ছেলেদের কাউকে মেয়ে সাজতে হতো।
এরকম সময় নারায়ণ সান্যালের আরেক সহপাঠী, স্কটিশের প্রাক্তনী সুধীন এসে ধরে পড়লেন
– এই নারান, আমায় একটা পার্ট দে।
সুধীন ওরফে সুধীন্দ্রনাথের উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ, টকটকে ফর্সা রঙ, ঠোঁট দুটোও টুকটুকে। নারায়ণ সান্যাল জানান
‘তোর গলার স্বর যে পুরুষের মত, তোকে তো ফিমেল পার্ট দেওয়া যাবেনা!’
সুধীন ধমকে ওঠে
“আমি কি বলেছি যে ফিমেল রোল করবো”
ড্রামা পরিচালক নিজেকে সামলে নেন। সুধীন তো আর এখন সহপাঠী নয়, চরিত্রপ্রার্থী প্রত্যাশিত কুশীলব, গাম্ভীর্য বজায় রেখে সান্যাল বললেন ‘বেশ এই জায়গাটা পড়ে শোনা’
সুধীন পড়লেন, বেশ বাগিয়েই পড়লেন কিন্তু পরিচালকের মনোমত হলোনা। মুখটাকে যতদুর সম্ভব দুঃখী দুঃখী করে তিনি জানালেন “সরি সুধীন তোর দ্বারা নাটক হবেনা, গলাটা বাধা না হলে একটা ফিমেল রোল দেওয়া….”
“এনাফ”
সুধীন মাঝপথে থামিয়ে দেয় ওনাকে এবং দরজার দিকে হাঁটা দেয়..
নারায়ন সান্যাল আবার বললেন ‘তুই ইচ্ছে করলে প্রম্পটার হতে পারিস কিন্তু’
দরজা পর্যন্ত চলেই গিয়েছিল সুধীন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে গভীর দৃঢ়তা আর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বলেছিল “তুই নাটক লিখে বা অভিনয় করে প্রতিষ্ঠা পাবি কিনা জানিনা। কিন্তু আমি পাব”
তারপর কেটে গেছে পাঁচ পাঁচটা দশক। লেখক হিসেবে খ্যাতির চুড়ায় উঠেছেন নারায়ন সান্যাল। গল্প, প্রবন্ধ বিজ্ঞান সাহিত্য, ঐতিহাসিক উপন্যাস, বাস্তুকারবিদ্যা, থ্রিলার বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় অবাধ বিচরন তার। কিন্তু সার্থক নাটক তিনি একটাও লিখে উঠতে পারেননি। মুক্তকণ্ঠ স্বীকার করেছেন, নাট্যকার হিসেবে কল্কে পাননি কোথাও।
আর সুধীন?
বাংলা বা ভারত নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী হয়েছিল সে।
ভারতীয় নাট্যজগতে বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, বিজয় তেন্ডুলকর, হাবিব তনভির বা সফদার হাশমির সাথে এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হয় তার নাম।
বি ই কলেজ রেজিস্টার মোতাবেক সুধীন্দ্রনাথ সরকার…
ওরফে বাদল সরকার। 🙂
‘থার্ড থিয়েটার’ নামক ভিন্ন এক নাট্য আঙ্গিক ও দর্শনের এর উদগাতা, নাট্যকার, সংগঠক। এতকাল যে থিয়েটার ছিল প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে আবদ্ধ তাকে শ্রমিকের কারখানায়, কৃষকের মাঠে ময়দানে, হাটে বাজারে জনতার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাদল সরকার। থিয়েটার বাজারি কারবার নয়, দেওয়াল ছাদ নয়, থিয়েটার খোলা আকাশ, থিয়েটার সর্বসাধারনের দেখিয়ে দিয়ে গেছিলেন বাদল সরকার।
আজ ১৩ মে। তাঁর মৃত্যুদিন।

1 Comment

আপনার মতামত...