সুশোভন ধর
কেনিয়ায় জন্ম কিন্তু অধুনা লন্ডনবাসী লেখিকা ও শিক্ষাবিদ, সোমালি কবি ওয়ারসন শায়ার, তার ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রথম বইয়ে (Teaching My Mother How to Give Birth) বলেছিলেন যে “হাঙরের মুখে না পড়লে কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যায় না।” আমাদের মনে আছে বছর তিনেক আগে, সমুদ্রের পাড়ে বালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অ্যালান কুর্দি নামের এক শিশুর হাড়হিম করা ছবি। তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে সিরিয়ার তিন বছর বয়সী ওই শিশুর নিথর দেহ শরণার্থীর করুণ অবস্থার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সম্ভবত পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (UNHCR)-এর কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বিশ্বব্যাপী বর্তমান শরণার্থী সংকট সম্পর্কে ভয়াবহ সব বিবরণ ও তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সিরিয়ার শরণার্থীদের অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায়ও ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টার ছবি। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ফলে লাতিন আমেরিকার শিশুদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখা। কক্সবাজারের কুটুপালং-বালুখালি এলাকায় বৃষ্টি ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ক্যাম্পগুলি নোংরা ও আবর্জনার সাথে মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া। নৌকায় চেপে ইউরোপের তীরে পৌঁছানোর জন্য অগণিত সাব-সাহারান আফ্রিকানদের আকুতি ও আর্তির চিত্রগুলি যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের মনে গভীরভাবে দাগ কাটবে। উপরোক্ত প্রতিবেদনে এর থেকেও ভয়াবহ ঘটনার কথা আছে। কারণ এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রতি ১১০ জনের মধ্যে একজন মানুষ বাস্তুচ্যুত।
সাত কোটিতেও থেমে নেই…
বিশ্ব উদ্বাস্তু দিবসের একদিন আগে ১৯শে জুন তারিখে প্রকাশ হওয়া প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র আমাদের জীবনের এক লজ্জাজনক অধ্যায়ের কথা তুলে ধরেনি, এক গভীর শরণার্থী সংকটের দিকে ইঙ্গিত করেছে। অগণিত মানুষ প্রতিদিন “নিরাপদ” এবং একটু বেঁচে থাকার মতো আশ্রয়ের খোঁজে দেশের অন্যত্র বা দেশ ছেড়ে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। যদিও সেই আশ্রয় খুবই সাময়িক। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (UNHCR) ৭ কোটি ১৪ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এর অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। সশস্ত্র সংঘর্ষ, হিংসা, নিরাপত্তাহীনতা, নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে এদের নিজেদের বাসভূমি ছেড়ে যেতে হয়। এদের অধিকাংশ (৮৫ শতাংশ) নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশের মানুষ। এই বলপূর্বক উচ্ছেদের মূল কারণ হল যুদ্ধ এবং সঙ্ঘর্ষ, জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, ইত্যাদি। এবং সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট। আমরা এমন এক উদ্বাস্তু সঙ্কটের মুখোমুখি যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর পর্বের শরণার্থীর সংখ্যাকে হার মানায়। সেই সময় আনুমানিক ৪ থেকে ৬ কোটি মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন। আজ প্রতি দুই সেকেন্ডে একজনের উচ্ছেদ ঘটে এই গ্রহের কোন এক প্রান্তরে।
এই ট্র্যাজেডির শিরোভাগে সিরিয়রা। সেখানকার প্রায় ৬৩ লোক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং সমসংখ্যক মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে দেশের এ কোণা থেকে সে কোণায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সিরিয়া থেকে আসা অবিরাম উদ্বাস্তুর ঢলে ২০১৭ সালেই ২৬ লক্ষ নতুন মানুষ নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছেন। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সঙ্কটের কারণে আরও অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। রাখাইনের রোহিঙ্গারা বা কঙ্গোর পূর্বাংশে হিংসার ফলে ওই অঞ্চলগুলি থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ পালাতে বাধ্য হয়েছেন। দক্ষিণ সুদানের রাজনৈতিক সঙ্কট এক মানবিক সঙ্কটে রূপ নেওয়ার ফলে এই সমস্ত দেশগুলো শরণার্থী সূচকের উপরদিকে স্থান পেয়েছে। এই গ্রহের মোট উদ্বাস্তুর দুই তৃতীয়াংশ এসেছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, মায়ানমার, এবং সোমালিয়া থেকে।
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও এই মানবিক দুর্যোগ
সর্বহারা বিপ্লবের সামরিক কর্মসূচি শিরোনামের একটি লেখায় লেনিন মন্তব্য করেন যে পুঁজিবাদী সমাজে সবসময়ই বিরামহীন আতঙ্ক বিরাজ করে। বর্তমানের শরণার্থী সংকট তাঁর ওই ব্যখ্যার যথার্থ উদাহরণ। ২০০১ সাল থেকে শরণার্থী সঙ্কট ঘনীভূত হয়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি আফগানিস্তানে ৫০ লক্ষ শরণার্থী তৈরি করে, যার অর্ধেক এখনও তাদের দেশে ফিরতে পারেনি। এদের বেশিরভাগ মহিলা। সিরিয়ার সঙ্কটের আগে শরণার্থীদের প্রথম স্থান দখল করে ছিল আফগানরা। জার্মান-ফরাসি-বেলজিয়ান-ইতালীয়-ক্রোয়েশিয়ান-হাঙ্গেরীয়-চেক সহ ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলি ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বের অধীনে এই ধ্বংসলীলায় অংশগ্রহণ করেছিল।
আবার, ২০০৩ সালে ইঙ্গ-মার্কিন ইরাক আক্রমণের ফলে ২০ লাখ ইরাকি নাগরিককে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় এবং ১৭ লাখ মানুষ দেশের অভ্যন্তরেই শরণার্থী হিসাবে বসবাস করে। এছাড়া হাজার হাজার অসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। ২০১১ সালে লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে সেখান থেকে ৩ লাখ মানুষ শরণার্থী হন। লিবিয়ার স্বৈরাচারী শাসক গাদ্দাফিকে উৎখাত করার অভিযানের ফলে ওখানকার নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ উৎখাত হতে থাকেন। সাম্রাজ্যবাদের নিজস্ব স্বার্থরক্ষার অভিযানের ফলে এক বড় মাপের মানবিক বিপর্যয় ঘটে।
২০১১ সাল থেকে সিরিয়া একটি অভুতপূর্ব ট্র্যাজেডির মঞ্চে পরিণত হয়। একদিকে, বাহরাইন, কাতার, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো চামচাদের নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন জোট এবং অন্যদিকে রুশ-ইরানী জোট পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী স্থানীয় গোষ্ঠীকে মদত দিয়েছে এবং সশস্ত্র করেছে। এর ফলে ১২০ কোটি সিরিয় তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী স্বার্থরক্ষার লড়াইয়ের মাঝে সাধারণ সিরিয়দের জীবনের দাম খুবই কম।
এইভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী তৈরি হয়েছে এবং এই উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগ চিরকাল একই অবস্থায় থেকে যাচ্ছেন। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক কখনও কখনও প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কিন্তু এই বিশাল শরণার্থী সঙ্কট সমাধানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি তাদের দায়িত্ব স্বীকার করছে না।
ট্রাম্পের মতে কোনও শরণার্থী সঙ্কট নেই
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সঙ্কটের মাঝে একটি স্মার্ট সমাধান উপস্থিত করেন। তিনি শরণার্থীদের জন্য মার্কিন দরজা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে তিনি ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকে মুসলিমদের উপর মার্কিন দেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে নিজের মতামতের জানান দিয়েছিলেন। মার্কিন সামরিক কার্যকলাপই যে ওই অঞ্চলের বর্তমান সঙ্কটের মূল কারণ সে কথা একটি শিশুও জানে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেফিউজি অ্যাডমিশন প্রোগ্রামেকে উন্নত করার পরিবর্তে, মার্কিন প্রশাসন তাকে স্থগিত করেছে এবং শরণার্থীদের উপর চার মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। শরণার্থী এবং অভিবাসীদের সম্পর্কে ট্রাম্পে নিজে একটি অমানবিক, আক্রমণাত্মক এবং অসহিষ্ণু বক্তব্য রাখেন। তিনি ঘোষণা করেন যে মার্কিনদেশে সমস্ত অননুমোদিত প্রবেশকারীদের জেলে পোরা হবে। ফলত শরণার্থীদের অবস্থার কথা কোনওরকম বিবেচনা না করেই আশ্রয়প্রার্থীদের ওপর ফৌজদারি দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হচ্ছে। উপরন্তু, আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে শিশুদের আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে তাদের পরিবারের থেকে যার ফলে নানারকমের মানসিক এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক ফলাফল তৈরি হচ্ছে তাদের ওপর। আশ্রয়প্রার্থীরা অসম্ভব প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং ঝুঁকি ও বিপদের মধ্যে পড়ছেন যা অনেক ক্ষেত্রেই মার্কিন আইনি বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী।
ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী নীতির বিরোধী এমনকি তার প্রচারের দিনগুলিতেও, তিনি উদ্বাস্তুদের নিন্দা করেন বিশেষত মুসলিম দেশগুলির থেকে আগত মানুষদের। যদিও তার প্রচারে উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে যা যা বলেছিলেন তার সাথে বাস্তবের কোনও মিল নেই। তিনি উদ্বাস্তুদের নিয়ে বিপদের কথা অতিরঞ্জিত করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লখ্য যে সেদেশে প্রায় ৯ লাখ শরণার্থী আছেন এবং ৯/১১-র পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া হিংসাত্মক ঘটনাগুলিতে, তাদের কোনও যোগ পাওয়া যায়নি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বাস্তুদের জন্য দরজা বন্ধ করতে চায়
ব্রাসেলস-এ অভিবাসন সংক্রান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের চুক্তি সইয়ের সাম্প্রতিক বৈঠকে আলোচনার মূল অভিমুখ ছিল কীভাবে উদ্বাস্তু ঢোকা বন্ধ করা যায়। উদ্বাস্তুদের ঢোকা বিভিন্নভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ফলে এই মহাদেশেও তাদের আগমনের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। নর্দার্ন লিগ পরিচালিত ইতালির নতুন দক্ষিণপন্থী সরকারের নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি শিরোনামে আসেন উদ্বাস্তু ও অন্যান্যদের নিয়ে তাঁর হুঙ্কার প্রদর্শনের মাধ্যমে। তিনি জিপসিদের ও অন্যান্য যারা ইতালীয় নয়, তাদের তাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। উদ্বাস্তু নিয়ে আক্যুয়ারিস নামে যে জাহাজ এসেছিল তাকে ইতালির কোনও বন্দরে নোঙর করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ৬০০ আফ্রিকান নিয়ে ঐ জাহাজ দীর্ঘদিন ভূমধ্যসাগরে ইতস্তত ভেসে থাকার পরে স্পেনের বন্দরে দাঁড়ানোর অনুমতি পায়। এই ঘটনা ইঙ্গিত করে যে যে সমস্ত শরণার্থীরা নৌকায় চেপে ইউরোপ অভিমুখে আসবে তাদের কপালে অশেষ দুর্দশা নেমে আসছে। হাঙ্গেরিতে দক্ষিণপন্থীরা এমন এক আইন আনতে চান যার ফলে যারা যারা শরণার্থীদের সাহায্য করবেন তাদেরও শাস্তি পেতে হবে।
সামগ্রিকভাবে, পুরনো মহাদেশের শরণার্থী সঙ্কট নিরসন নিয়ে বিবাদ-বিতর্ক — যা সৃষ্ট ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকায় যুদ্ধ, গণহত্যা এবং গণতন্ত্র হত্যার কারণে — ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেষ দিনের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। বিগত দুই বছরে উদ্বাস্তু আগমনের সংখ্যা কমলেও সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে। উদ্বাস্তু সংখ্যা বিতরণ নিয়ে বিতর্কের মাঝে ফ্রান্স ও ইতালির মাঝে বচসা বেধেছে। ফরাসি সরকারের ইতালীয় ইমিগ্রেশন নীতির সমালোচনার জন্য মাত্তেও সালভিনি সে দেশের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে ফ্রান্স কীভাবে ইতালি থেকে তাদের দেশে শরণার্থী ঢুকতে দেয় না। অন্যদিকে Visegrad গ্রুপ (পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া) অভিবাসীদের কোনও কোটা নিতে অস্বীকার করেছে। এই সমস্ত ঝগড়া কাজিয়ার মাঝে ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বাস্তু নিয়ে অভিন্ন নীতি গ্রহণে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ।
জার্মানিতে খ্রিস্টিয়ান সোস্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ)-এর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরস্ট সেহফারের সাথে চ্যান্সেলর মর্কেল-এর সংঘর্ষের কারণে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়। সীমান্ত বন্ধ না করলে সিএসইউ তার সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি পর্যন্ত দেয়।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি এই মুহূর্তে সচেষ্ট কিছু নতুন বাফার স্টেট খুলে সেখানেই শরণার্থীদের আটকে রাখায়। ইতিমধ্যে ইউরোপ অভিমুখে অভিবাসীদের থামানোর জন্য তুরস্কের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চেষ্টা চলছে লিবিয়া, আলবেনিয়া এবং তিউনিসিয়ায় উদ্বাস্তুদের আটকে রাখার। সমস্য হল যে এর ফলে সঙ্কট কমবে না বরং আরও বাড়বে কারণ এই সমস্ত দেখগুলো ইউরোপের দেশগুলির দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে নিজেরাই আজ ধ্বংসের মুখে।
ভারত ও চিন কম যায় না
এদিকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চলমান মানবিক সঙ্কটের ফলে চিনের বিশেষ সুবিধা হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গার মারা যাওয়া বা ঐ অঞ্চলের লাখ লাখ লোকের পলায়নকে বেইজিং দক্ষতার সাথে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আরাকান অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ধীরে ধীরে চিন তাদের দখল বাড়িয়ে তুলতে চাইছে এবং সেই কারণেই ঐ অঞ্চল খালি হলে তাদের সুবিধা বৈকি। এই কারণেই বর্মী সেনাদের নিষ্ঠুর আচরণ ও জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের বিষয়ে সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠলেও চিন নীরবে মায়ানমারের সরকারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। এবং এ কথা হলপ করে বলা যায় যে চিনা সমর্থন ব্যতিরেকে এত বড় অন্যায় ঘটানোর বুকের পাটা ছিল না সেদেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর।
এ ব্যাপারে অবশ্য ভারত রাষ্ট্রও খুব একটা পিছিয়ে নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় গিয়ে রোহিঙ্গা বিষয়ে হাসিনাকে আশ্বস্ত করলেও রেঙ্গুনে গিয়ে বর্মী শাসকদের উলটো কথা বলে এসেছেন। হিমালয়ের দুই পাশে ভারত ও চিন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মহড়া দিলেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রায় একই সুরে রেঙ্গুনকে আশ্বস্ত করেছে। রাখাইন রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ ও ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করার লক্ষ্যে উভয় দেশই মায়ামারের অবৈধ শাসকদের সমর্থনে পিছিয়ে পড়তে চায় না। এই ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
ভারত সরকার প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা অভিবাসীকে বহিষ্কার করার হুমকি দিয়েছে। তাদের দাবি যে রোহিঙ্গারা এদেশে অবৈধভাবে আছে। এই মর্মে ও রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে সরকার একটা হলফনামা জমা দেয়। যদিও কোর্ট সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর ব্যাপারে স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
রাখাইনে ভারত ও চিনের প্রভূত অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকার ফলে লাখে লাখে সাধারণ রোহিঙ্গা আজ উদ্বাস্তু। রাষ্ট্রসংঘ সহ বিভিন্ন মহল এর তীব্র নিন্দা করলেও এই দুই রাষ্ট্র সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে আছে। এবং মায়ানমার থেকে কে কত বেশি বাণিজ্যিক ফয়দা তুলবে সেই প্রতিযোগিতায় মশগুল। রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের অভিযানের মধ্য দিয়েই আমাদের উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। আমরা দেখছি এবং সবকিছু নীরবে সয়ে যাচ্ছি। কেউ কেউ হয়ত মনে মনে আনন্দও পাচ্ছি। হাজার হোক রোহিঙ্গারা মুসলমান তো।