ফেসবুকের ফেস থেকে

অভিরূপ ঘোষ

 

আসল আর নকলের মূল পার্থক্যই আসলের ‘আসল’ সংজ্ঞায়। ‘আসলে’ শেষ কিছুদিন মাথাটা বেদম ঘুরছে। এতদিন শুধু বৌবাজারের সোনাপট্টির ‘আসল লক্ষী বাবুর দোকান’ আর দুর্গাপুর স্টেশনের বাইরের ‘আসল উদয়নের’ বেশি ভাবার ছিল না কিছু। কিন্তু এখন কে যে ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’, কে ‘সাচ্চা হিন্দু’ , কোনটা ‘আসল ফুটবল লীগ’ আর কে ‘আসল ডাক্তার’ ভাবতে ভাবতেই দিনের তেইশ ঘন্টা ছাপান্ন মিনিট শেষ। যেই ভাবছি বাকি মিনিট চারেকে একটা পোস্ট সাঁটাবো, অমনি ‘আসল ভূগোল’ মনে করিয়ে দিলো দিন ‘আসলে’ চব্বিশ ঘন্টার নয় – ওটার ‘আসল’ মান মিনিট চারেক কমই বটে। যাক পোস্ট না করলেও দিন কাটে, কিন্তু শরীর নামে মহাশয় হলেও কার্যক্ষেত্রে সব সয় না। রক্ষাকর্তা অগত্যা সেই মহাপুরুষ যিনি দেওয়ালে পোস্টার চিটিয়ে সবার সুস্থতা কামনা করেন ঠিকই, কিন্তু সবাই সুস্থ থাকলে তিনি আবার অনাহারের অসুস্থতায় স্বজাতির কাছে ছুটতে বাধ্য হবেন। তাই আপাতত এই পোস্টের আসল বিচার্য ‘আসল ডাক্তার’।

প্রথমেই বলে রাখি ‘জাল ডিগ্রিধারী’, ‘ভুয়ো’ আর ‘হাতুড়ে’ ডাক্তারের মধ্যে কিছু সংজ্ঞাগত মৌলিক পার্থক্য আছে, যা নিউজ চ্যানেলের সান্ধ্যকালীন বাকবিতন্ডার দৌলতে ধুয়ে মুছে সাফ। আপাতত এরা সবাই ‘নকল’, মিডিয়ার দৌলতে।

শনিবার রাত তখন পৌনে দশটা। হঠাৎ মায়ের পেটে খুব ব্যথা। কাছাকাছি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলতে মোরামের রাস্তা ঠেলে কিলোমিটার আষ্টেক। অগত্যা হাতের পাঁচ প্রবীর কাকু। ভদ্রলোক বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন নিজের চেম্বার কাম ওষুধের দোকান গুছিয়ে। হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ালাম। ওষুধ দিলেন, গ্যাসের ব্যথা। পরের দিন নিজের কুসন্তান হবার পরিচয় দিলাম। মাকে জিজ্ঞাসা করাই হলোনা আছে কেমন। আসলে মনের কোনে একটা বিশ্বাস আছে কাকুর ওষুধে কাজ হবে। মা সম্ভবত ভালোই আছে এখন।
তার দিন দুয়েক আগের কথা। স্ত্রীর শরীর বেশ খারাপ হল সকলেই। প্রবীর কাকু সেদিন আসেন নি। আর মনজিৎ কাকুর ওষুধ স্ত্রীর ভালো স্যুটও করে। এবারেও করলো। বিল সত্তর টাকা, ওষুধ সমেত। সম্ভবত সেদিন আর কোনো রোগীর অত বিল হয়নি। এমনিতে ২০-৩০ টাকা হয়। আর হ্যাঁ, উনি যখন গ্রামে প্রথম চেম্বার খুলে বসেন তখন পরিচয় ছিল চোখের ডাক্তার হিসাবে।
রঘুনাথ কাকু আর প্রদ্যুৎদা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার গ্রামে। আমার মাস দুয়েকের মেয়েটার ওনাদের ওষুধ খায় এখন। সমস্যা কিছু নেই যদিও একটু আধটু বমি আর পেট খারাপ বাদে। তাই হয়তো হোমিওপ্যাথি। কিন্তু যেদিন হঠাৎ খুব কান্নাকাটি করছিল, ওনারাই পাশে ছিলেন। শিশু ডাক্তার কিছু দূরের এক গ্রামে আসেন, সপ্তাহে একদিন – রবিবার।
ওনারা কোনো পোস্টার টাঙিয়ে দাবি করেন নি নিজেদের ডিগ্রি। তাই আমি ঠিক করে বলতে পারবো না ওনাদের ডিগ্রি কি, তবে প্রচলিত বড়োসড়ো ডিগ্রি ওনাদের নেই এটা নিশ্চিত। আর আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামে তবু ওনারাই ভগবান, অন্তত খুব বড়োসড়ো কিছু হবার আগে। আর ভগবানের টান একটু বেশি হলে ভরসা বলতে একটু দূরের গ্রামের ডক্টর প্রদীপ নন্দী ও ডক্টর দিলওয়ার হোসেন। এনারা এমবিবিএস (সাথে অন্য কিছু থাকলেও থাকতে পারে) বলে নেমপ্লেট দাবি করে। দাবি একশো শতাংশ ঠিক। তবে ঠিক না হলেও এলাকাবাসীর কিছু এসে যেত না। মানুষ সুস্থতা দাবি করে, ডিগ্রি নয়। যেখানে কাছাকাছি ভালো নার্সিংহোম চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, সেখানে ডাক্তারের ডিগ্রি জানা বা তার সত্যতা যাচাইয়ের ইচ্ছা বাতুলতা।
সরকার বাহাদুর ভুয়ো ডাক্তার ধরতে উঠে পড়ে লেগেছেন,ভুয়ো ডিগ্রি লিখে ব্যবসা ফেঁদে বসে থাকা ডাক্তারদের জন্য জাল ছুঁড়েছেন – খুব আশা এবং আনন্দের কথা। বিরোধিতা করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তার সাথে, বা বলা ভালো তার আগে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসার নূন্যতম সুবিধাটুকু পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন। শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ডিগ্রিহীন ডাক্তারদের জন্য আদর্শ বিচরণভূমি। গ্রামে গ্রামে যতদিন মানুষ চিকিৎসার অভাবে মরবে, যতদিন আম্বুলেন্স দাদাদের পদ্মশ্রী দিয়ে সম্মান জানাতে হবে ততদিন দুলাল চন্দ্র ভরের মিছরির পেকেটের লেখাটা চিকিৎসাক্ষেত্র থেকে মুছবে না। আর যেদেশে রাজনীতিই শেষ কথা বলে, সেখানে দাদাদের ছাতার তলায় শহুরে এলাকায় ব্যাঙেদের বেড়ে ওঠাটা অস্বাভাবিক নয় একদমই। মিডিয়া আজ স্বাদ পেয়েছে বলে দৌঁড়েছে, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বঙ্গ মিডিয়ার অর্ধেকটাও টিকবে তো যদি কোনোদিন মিডিয়ার লোকেদের ডিগ্রি খুঁজতে আরম্ভ করে সরকার! একবারও বলবো না সেটা করা উচিত। শুধু ভয় হয়, দেশ এখনও ১৯৭৫ ভোলেনি। স্বাধীনতার সত্তর বছর পেরিয়েও আমরা এখনও আসল নকল পার্থক্যই করতে শিখলাম না। নেতারা এখনও ক্রেতা, আমরা সচেতন বিক্রেতা। ব্যবসায়িক দায় তাই অল্প হলেও আমাদের থাকেই। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের কথা ভোটের পরে কেন, আগেও খুব কম বলা হয়। দেশের সব নকল ধরা পড়ুক সব ক্ষেত্রে, শুধু রাজনৈতিক কারবারিদের এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় দেশে ‘নকল’ রুগী থাকলে ‘নকল’ ডাক্তার থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়।

Be the first to comment

আপনার মতামত...