নভেম্বর

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

নভেম্বর নস্টালজিয়ার মাস। এবং নস্টালজিয়া অন্যান্য আবেগের মতোই ক্ষতিকারক। যা আমাকে এই ভর বিকেলবেলা হাওড়া স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। একটাই বাঁচোয়া, অফিসফেরত যাত্রীদের ভিড় এখনও শুরু হয়নি। ফাঁকা স্টেশনে ট্রেন আসাযাওয়ার ঘোষণাগুলো দৈববাণীর মতো গমগম করছে। চারটে চল্লিশের ব্যান্ডেল লোকাল চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসবে। গাড়িটা ঢুকছে। ছোটবেলায় সবুজ হলুদ বাঘের মুখের মতো লাগত। নভেম্বর মনে পড়িয়ে দিল।

কামরা ফাঁকা। জানালা দেখে বসলাম। হাওয়া লাগানো উচিত হবে না হয়তো। শনিবার বিকেলে মাথার পোকা নড়ানোর বিলাসিতা অ্যাফর্ড করা গেছে, সোমবার অফিস যেতে হবে। কিন্তু নভেম্বর এখনও জোরদার, কাজেই। রেলকোম্পানির লাল পাঁচিলে বাপি গেঞ্জির বিজ্ঞাপনে গুটখার ছোপ, তার ওপর বিকেলের রোদ তেরছা। পাঁচিলের ওপারে ঝিল, ঝিলের গায়ে মাঠ। সাদা গোলপোস্টের মাঝখানে খেলা জমেছে। একটা একতলা বাড়ি। পরিত্যক্ত। হয়তো আগে রেলের অফিস ছিল। হয়তো বৈদ্যুতিক সিগনাল আসার আগে ওই বাড়ির জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে লালসবুজ লণ্ঠন দেখাত কেউ।

মাংকুণ্ডু ধওবে? অ্যাঁ দাদা? মাংকুণ্ডু?

একটা গোলমুখো লোক। কষ বেয়ে পানের রস। নির্ঘাত ভুঁড়ি আছে, চটি ঘষটে হাঁটে। নো আইডিয়া। বললাম। লোকটা বিড়বিড় করতে করতে জানালা থেকে সরে গেল। লোকটার কর্কশ গলায় আমার ঘোর কেটে গেছে। চারটে চল্লিশ বাজেনি এখনও? সময় দেখার অছিলায় পকেট থেকে ফোন বার করলাম। নো নিউ মেসেজেস। জানতাম থাকবে না। তবুও মনটা দমে গেল। ভোঁ দিচ্ছে। ট্রেন ছেড়ে দিল। সামনের কামরা থেকে রানিং-এ নামা শরীর পেছনে হেলিয়ে ছুটন্ত ঝালমুড়িওয়ালাদের পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এখন। সঞ্জনার থেকে আমাকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।

দূরে যেতে চাই কি না সেটা নিয়ে আই অ্যাম স্টিল নট শিওর। গত তিন মাসের বারোটা স্যাটারডে নাইট সঞ্জনার সঙ্গে কাটিয়েছি। খুবই আনন্দে, স্বীকার করতে হবে। এতটা ভালো আমি আশা করিনি। আটত্রিশ বছর বয়সে ডেটিং খেলায় নতুন করে নামার উৎসাহ ছিল না আমার। বড়ুয়া বলেছিল, আটত্রিশটা কোনও বয়সই না। ডেটিং-এর বাজারে এখন মোস্ট সট আফটার পুরুষ হচ্ছে ফরটি অ্যান্ড অ্যাবাভ। ডার্টি আর ওল্ড দুটোরই সংজ্ঞা বদলাচ্ছে।

তাছাড়া তুই তো বিলো পঁচিশ সঙ্গীতজ্ঞা গৃহকর্মনিপুণা খুঁজছিস না। তুই খুঁজছিস লাইক মাইন্ডেড, ম্যাচিওর মহিলা।

টিন্ডারের অ্যাকাউন্টটা ও-ই ঝোলাঝুলি করে খুলিয়েছিল। দুয়েকটা যে গোড়াতে ক্লিক করছিল না তা নয়, কিন্তু ফ্র্যাংকলি, নট ওয়ার্থ ইট। চ্যাট, এসএমএস, প্রাইভেট মেসেজ, ইনবক্স, ফেসটাইম। অত খেলা আর খেলানোর সময় কিংবা এনার্জি আমার সত্যিই আর নেই। শেষেরটা তিনমাস চ্যাট আর বারদুয়েক দেখা হওয়ার পর কাটিয়ে হাঁফ ছেড়েছি এমন সময় এক স্যাটারডে নাইটে পাবে ঢুকতে দেখলাম বড়ুয়ার পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। রীতিমত অ্যাট্রাকটিভ। বড়ুয়ার ক্ষমতায় অবাক হচ্ছি এমন সময় সোৎসাহে ওই মেয়েটাকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিল। দিস ইজ মাই ভেরি গুড ফ্রেন্ড দীপ্ত অ্যান্ড দিস ইজ…

…’সঞ্জ্‌না।’ ঝকঝকে হেসে হাত বাড়িয়েছিল সঞ্জনা। হাস্কি গলা। আমার আজীবনের ফ্যান্টাসি।

ট্রেন ধীরে হচ্ছে। স্টেশন ঢুকছে। উঠল ক’জন। এক মোটা মহিলার হাত ধরে বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা মেয়ে। মহিলার গায়ে শাল, বাচ্চাটার মাথায় মাঙ্কিটুপি। কালো কাজলের টিপ ঘিরে ঘামের বিন্দু। আমার সামনের ফাঁকা সিটে এসে বসেছে। বাচ্চা মেয়েটা জানালার পাশে খুব আগ্রহ নিয়ে বসেছে, কিন্তু দেখছে আমার দিকেই। চোখে চোখ পড়াতে হাসলাম। লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

চালভাজা বাদাআআআম। চালভাজা বাদাআআম। এ জিনিসটা এখনও পাওয়া যায়? কিনলাম দু প্যাকেট। বাচ্চাটাকে দিলাম একটা। মায়ের গায়ে মুখ লুকোচ্ছে লজ্জা পেয়ে। মায়ের বয়স আমার থেকে অল্প কম। মৃদুস্বরে বলছেন, কাকু দিচ্ছেন নাও। থ্যাংক ইউ বলো।

সঞ্জনাকে সঙ্গে আনার কথা ভেবেছিলাম একবার। খুব একটা হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়াও তো নয়। আসব স্থির করেছিলাম আগের সপ্তাহেই। ফ্রাইডে নাইট টু বি প্রিসাইজ। সঞ্জনার সঙ্গে পাবে ছিলাম। আরও লোকজন ছিল, বড়ুয়া, যথারীতি মেকিং আ ফুল অফ হিমসেলফ। রিসেন্টলি কেপটাউন থেকে এসেছে, অ্যাকসেন্ট ভেঙিয়ে দেখাচ্ছিল। সঞ্জনা হাতে গ্লাস ধরে মাথা পেছনে হেলিয়ে হাসছিল। ধপধপে দাঁতের নিখুঁত সারি, সিলিং-এর ঘুরন্ত আলো কাঁধের ফরসা নিভাঁজ চামড়ায় পিছলে যাচ্ছিল। আমি ওর কাঁধ ঘিরে হাত রেখেছিলাম, সিল্কি ওয়েভি একঢাল চুল আমার হাত ঢেকে জলপ্রপাতের মতো পড়েছিল। সঞ্জনার দীর্ঘ আঙুল, ঘন উজ্জ্বল রঙের আমন্ড বাদামের মতো নখ আমার উরুর ওপর মেলা ছিল। এমন সময় হঠাৎ কী হল, মাথায় ভূত চাপলই বলা যেতে পারে, হাসতে গিয়েই, আমি একমুহূর্ত ওই মুহূর্ত থেকে, সঞ্জনার নখ, হাসি, বড়ুয়ার গোটি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে জানালার দিকে তাকালাম আর নভেম্বরের চোখে চোখ পড়ে গেল।

সঞ্জনা টেক্সট করেছিল। হোয়াট আর উই ডুয়িং দিস উইকেন্ড? বারোটি উইকেন্ডের পর এটা ধরে নেওয়া ওর পক্ষে স্বাভাবিক যে উই উইল ডু সামথিং টুগেদার। আমিও তা-ই চাই। সঞ্জনার সঙ্গে উইকেন্ড কাটাতে। সঞ্জনা ছাড়া এই মুহূর্তে আমি আমার উইকেন্ড আর কারও সঙ্গে কাটাতে চাই না।

কিন্তু নভেম্বর শুধু হিংসুটের মতো আমাকেই চায়, আমার চাওয়া না চাওয়ার প্রতি তার কোনও মায়াদয়া নেই। যে মুহূর্তে নভেম্বর তার সমস্ত বিষণ্ণতা নিয়ে জানালার বাইরে আমার উল্লাসে ছায়া ফেলে দাঁড়াল, আমার ফিরে যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। এমন একটা আমির কথা মনে পড়িয়ে গেল যেটাকে আমিও মাঝে মাঝে চিনতে পারি না, সঞ্জনার তো চেনার প্রশ্নই নেই।

এই যে অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে ইতিউতি হলুদ আলো, ছেঁড়া লেপের পুঁটলির ভেতর বাতিল মানুষের পাশে বাতিল কুকুর, শেডের নিচে প্রায় খালি বাক্সে দু’চারটে বেসাতি জ্বেলে অপেক্ষারত হকার, এই দৃশ্যে সঞ্জনাকে মানাত না।

আমাকে মানিয়ে যায়। আমার জীবনের প্রথম বারো বছর এই জগৎটার অংশ হয়ে কাটিয়েছি। মাত্র বারো। তবু ওই অল্প সময়ের ছায়া কেমন জীবন জুড়ে পড়ে, এ আমি অভিজ্ঞতা না করলে বিশ্বাস করতাম না। যত দূরে যাই, এই আবছা-আঁধারে ডোবা আধাশহর তত বেশি করে আমাকে জড়িয়ে ধরে। যত আলোর ছটার নিচে ঘুরিফিরি, তত বটের নিচের ঝুপসি ছায়া আমাকে ডুবিয়ে দেয়। যত লোভনীয় সঙ্গ দিয়ে নিজেকে মুড়ে রাখি তত জনহীন ল্যাম্পপোস্টহীন লম্বা রাস্তারা বুকের ভেতর দিয়ে চলে যায়।

নভেম্বর যখন আসে, আমার এদের কাছে ফিরতে ইচ্ছে করে। ফিরতেই হয়। একটা সন্ধে হলেও। আমাকে আমার নতুন আমির থেকে পালাতে হয়, আমার বারো বছরের এই পৃথিবীর কাছে, যে আমার ভেতর লুকিয়ে বসে থাকলেও আসলে আমার পুরোটা অধিকার করে রেখেছে।

সঞ্জনাকে বলেছিলাম, একটা কাজ আছে। নেক্সট উইকেন্ড উই উইল ডু সামথিং ফান, প্রমিস। সঞ্জনা, সম্পর্কের খেলার অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, জিজ্ঞাসা করেনি কাজটা কী। একবার ঠোঁটের কাছে এসেছিল, এক জায়গায় যাবে আমার সঙ্গে? ভাগ্যিস বলিনি। না হলে সঞ্জনাকে এই মুহূর্তে আমার মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় এই এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হাঁটতে হত। সঞ্জনা একবার বলেছিল, নিজের জুতো কেনার পয়সা আর্ন করতে শুরু করার পর মিনিমাম চার ইঞ্চি হিলের কম হিলের জুতো কিনে পরেনি কোনওদিন। এ রাস্তা ওর হাঁটার জন্য তৈরি নয়।

টেম্পারেচার ঝপ করে নেমে গেছে। কলারটা টেনে তুলে নিলাম। উইন্ডচিটারটা আনা উচিত ছিল। কারখানার পাঁচিল শেষ হয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে রাস্তাটাকে আমরা সিমলা রোড বলতাম। এখন মাঠে দু’চারটে বাড়ি উঠেছে। আঁটা জানালা থেকে চিলতে টিউবের আলো আসছে। উদ্দেশ্যহীন হাঁটছি। কোথাও যাওয়ার নেই। যে বাড়িতে আমার গোড়ার বারো বছর কেটেছিল সে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে বহুদিন। তবু ফিরতে হয়। নভেম্বর ফিরতে বাধ্য করে।

দাসপাড়ার মোড়ে পানের দোকানে আলো। পাশের সাইকেলের দোকানটা আছে এখনও। একটা রোগা মতো ছেলে একটা সাইকেল কাত করে চাকার ওপর ঝুঁকে আছে। বাবার সাইকেল হাফ প্যাডেলে চালিয়ে হাওয়া ভরাতে আসতাম এই দোকানে। পানের দোকানের সামনে একটা বাইক, দুটো সাইকেল। কাউকেই চিনি না, চেনার কথাও নয়। দুটো সিগারেট কিনলাম। আমি খাই না। রিসেন্টলি ডিটক্স একটা কোর্স চালু করেছি, হেলদি লাইফস্টাইল মেন্টেন করার চেষ্টা করছি। তবু এ শহরে জীবনের প্রথমবার সিগারেটে টান দিয়েছিলাম, সেই অনারে একটা ধরানোই যায়। তাছাড়া শীতটা কাটাতে হেল্পও করবে। ছেলেগুলো আমাকে দেখছে। আমার ফোনটা। ঘড়িটা। অফিসের সাজে এখানে চলে আসাটা উচিত হয়নি। একটা সিগারেটে তিনদিন আয়ু কমে যায় শুনেছি। চল্লিশের দিকে যত এগোচ্ছি তত মৃত্যুর প্রতি ভয় বাড়ছে। এই বাজারে তিনটে দিন কমিয়ে ফেলা যুক্তিযুক্ত হবে না। কিন্তু নভেম্বর কুযুক্তির মাস।

লাস্ট ট্রেন যায় সাড়ে এগারোটায়, তার আগে পর্যন্ত হেঁটে বেড়ানো যায়। বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরে মিনিট দশেক হাঁটলে আমাদের পুরনো বাড়ি। পিতৃপুরুষের ভিটে। এখন অন্য কেউ থাকে। সে বাড়ির জন্য আমার মনে কোনও মায়া থাকার কথা নয়। যতদিন ছিলাম, শরিকি ঝগড়া, বারোয়ারি বাথরুমের দুর্গন্ধই সব ছাপিয়ে ছিল। ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পাঁচ কাঠার ওপর অগোছালো বাগান আর ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ির পর শহরের ছিমছাম দু’কামরার ফ্ল্যাট স্বপ্নের মতো লেগেছিল। সবথেকে ভালো লেগেছিল কতটুকু কার সে নিয়ে সংশয়ের অবকাশ না থাকাটা। সবটুকুই আমাদের। আমার।

বছরকয়েক আগে নভেম্বরের পাল্লায় পড়ে একবার চলে গিয়েছিলাম ওই পথে। নিজের বাড়ি চিনতে লেগে গিয়েছিল তিরিশ সেকেন্ড। গোটা প্লটে তিনটে আলাদা আলাদা বাড়ি উঠেছে। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কোনও সংশয় নেই, কোনটা কার। অগোছালো অকাজের গাছের বাগান হাওয়া, এখন ওয়েল মেন্টেনড মরশুমি ফুলের গাছ সারি সারি টবে সাজানো। বড় গাছ যে দুয়েকটা আছে বাড়ি থেকে দূরে, যাতে পাতা থেকে জল বেয়ে দেওয়ালের দামি রং নষ্ট না করে।

অন্য রাস্তাটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। এদিকটায় ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি। বন্ধ দরজাজানালার ভেতর থেকে টিভির শব্দ। কোনও কোনও বাড়ির বারান্দায় খোলা বাল্বের হলুদ। হয়তো বাড়ির কেউ রাত করে ফেরে। দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্ট। আমার ছায়াটা পেছন থেকে সামনে, আবার সামনে থেকে পেছনে ঘুরছে। বাঁক নিয়ে মাঠটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। মাঠটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। আগের থেকে অনেক ছোট লাগে এখন। মাঠের গায়ে পুকুর। ঘাটের দু’ধারে বসার বাঁধানো বেদি। ঘাটের অনেকগুলো সিঁড়ি বেরিয়ে আছে। স্থির কালো জলে ইলেকট্রিক পোলের টঙের ল্যাম্পের আলো ঝিকমিক। বাতাসে ছাতিমের গন্ধ। পকেট থেকে দ্বিতীয় সিগারেটটা বার করে ধরালাম।

বড়ুয়া জিজ্ঞাসা করেছিল, আর ইউ সিরিয়াস অ্যাবাউট ইট?

সিরিয়াস না হওয়ার কোনও কারণ নেই। সঞ্জনা অ্যাট্রাকটিভ, ইনটেলিজেন্ট, আমার সঙ্গে সেক্সুয়ালি কমপ্যাটিবল। সঞ্জনার সঙ্গ আমার ভালো লাগে। সঞ্জনা আমার পাশে পাশে হাঁটার সময় আমার প্রতিযোগীদের আমার প্রতি সূক্ষ্ম ঈর্ষার আঁচ টের পাই, আরও বেশি ভালো লাগে। শি অলসো লাইকস্‌ মি। আমরা দুজনেই জীবনের সেই স্টেজটা পেরিয়ে এসেছি যখন জাস্ট ডেসপারেশনে বা সময় ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে আমরা আমাদের পছন্দের থেকে কম কিছুতে সেটল্‌ করব। স্রেফ একটা স্যাটারডে নাইট একলা না কাটাতে পারার অক্ষমতায়। উই আর আ পারফেক্ট ম্যাচ।

সঞ্জনা শুধু এই নভেম্বরের সঙ্গে বেমানান। এই বিষণ্ণ বিকেল আর ল্যাম্পপোস্টের ছায়া আর লাইনের ওপর চাকার আওয়াজ আর কুয়াশার ভেতর হেডলাইট আর পিতৃপুরুষের ভিটের ছবিটায় সঞ্জনা কোত্থাও নেই।

একটা হারমোনিয়াম বাজছে কোথাও। ছোট মেয়ের গলা। সন্ধের রেওয়াজ চলছে। এক দমক ঠান্ডা হাওয়ায় হাতের লোম খাড়া হয়ে উঠল। একটা ঝাপসা মুখ। আমারই বয়সী কিংবা আমার থেকে বছরখানেকের এপাশওপাশ। আমার প্রথম প্রেম। একঝলক দেখতে পাওয়ার সেই অসম্ভব চাওয়া। পুরো মুখটাও নয় হয়তো ফিরিয়ে থাকা মুখের আদল, পেনসিল ধরা আঙুলের ভাঁজ, কিংবা গান শিখে ফেরার পথে মোড় ঘোরার সময় ফ্রকের ঘেরটুকুর জন্য বুকের ভেতর অতখানি আন্দোলন এবং এত সব কিছুর পরেও কোনওদিন মুখে কিছু বলতে না পারা? ওইটাই আসল প্রেম। নিষ্পাপ প্রেম। তারপর যা যা হয় সেগুলো পাটিগণিত। সিঁড়িভাঙা। সঞ্জনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের মতো। যা আর যা-ই হোক না কেন, প্রেম নয়। হতে পারে না।

উঠে পড়লাম। কখনও কিছু মুখে বলতে পারিনি। প্রেমের ভাষা তখন জানা ছিল না, হয়তো ভাষা লাগেও না। যতদূর মনে পড়ছে, একটা চিঠি লিখেছিলাম। ওর গানের স্কুলের যাতায়াতের পথের ধারের গাছের গায়ে, পকেট নাইফ দিয়ে। রাস্তাটা এই পুকুরের গা দিয়েই। গাছটাও চিনতে পারা উচিত। সম্ভবত এটাই। মোবাইলটা বার করলাম। আঙুলগুলো জমে গেছে। আড়ষ্ট আঙুল বুলিয়ে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালাম। ফাটা, শুকনো কাণ্ডের একটা অংশ আলোকিত হল। কই, কিছু নেই তো। আমার বুকের মধ্যে উথালপাথাল। আমার প্রথম, জীবনের একটিমাত্র সত্যিকারের প্রেমকে লেখা চিঠিটুকুও কি সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে?

আলোটা খানিকটা নামাতেই কাণ্ডের গায়ে আঁচড়গুলো চোখে পড়ল। আমারই ভুল। চিঠি লেখার সময় আমি ছ’ফুট দুই ছিলাম না। হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালাম।

সংক্ষিপ্ত প্রেমপত্র। একটি উন্মুক্ত যোনি, এধার ওধার ফুঁড়ে ঢুকে গেছে উদ্ধত শক্তিশালী শিশ্ন। শিশ্নের সঙ্গে যুক্ত দুটি পুষ্ট অণ্ডকোষ। বাস্তবতার খাতিরে অণ্ডকোষের চারদিকে থেকে ইতস্তত চুল বিকীর্ণ হয়ে রয়েছে।

এ যে আমারই নিষ্পাপ বয়সের প্রেমপত্র তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সন্দেহ না রাখার জন্য আমিই পুরুষাঙ্গের ওপর নিজের আদ্যক্ষর এবং বিক্ষত যোনিটির ওপর উদ্দিষ্ট প্রেয়সীর নামের আদ্যক্ষর খোদাই করে রেখেছি।

*****

ট্রেন লেট। শীতে কাঁপতে কাঁপতে, মশার কামড় খেতে খেতে, অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সঞ্জনাকে ট্রাই করতে থাকলাম। দ্য পার্সন ইউ আর ট্রাইং টু কল ইজ আউট অফ রিচ।

(Graham Greene-এর ছোটগল্প The Innocent অবলম্বনে)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4820 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...