চার নম্বর নিউজডেস্ক
প্রতিদিন ইনশা বশিরের দিন শুরু হয় সকাল ছটায়। বেরোনোর সময় হাতে নীল ব্যাগটার সঙ্গে সবসময় থাকে আলাদা আরেকটা ব্যাগ, যাতে ভরা থাকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, বাস্কেটবল।
‘কে বলতে পারে যদি পথে কোনও একটা বাস্কেটবল কোর্ট পড়ে, বা কেউ যদি আমায় খেলতে ডাকে,’ মুচকি হেসে জানান বশির।
একটা প্রাথমিক স্কুলে পড়ান বশির, স্কুলের শেষ ঘণ্টা বাজলেই তিনি চলে যান কাছের একটা বাস্কেটবল কোর্টে, আমেরিকায় অনুষ্ঠিতব্য স্পোর্টস ভিজিটর প্রোগ্রামের প্র্যাকটিস করতে। এই প্ৰথম তাঁর বিদেশ যাত্রা, কাজেই একটু বুক দুরদুর থাকলেও উৎসাহের মাত্রাই বেশি। প্র্যাকটিসের পরে হোস্টেলে ফিরে আবার বাচ্চা মেয়েদের কাউন্সেলিং, যারা তাঁরই মতো নিজের সমস্ত প্রতিকূলতাকে সরিয়ে রেখে তাঁর মতো খেলতে চায়। তাঁর দিন শেষ হয় সমস্ত প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে আর নিজেকে কালকের দিনটা আজকের থেকেও ভালো করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
ইনশা বশির জম্মু কাশ্মিরের প্রথম হুইলচেয়ার আবদ্ধ মহিলা বাস্কেটবল প্লেয়ার। আজ তিনি বহু মানুষের অনুপ্রেরণা, কিন্তু একদিন এমন গেছে যখন তিনি নিজের সামান্য কাজ করার অবস্থাতেও ছিলেন না। শুধুমাত্র তাঁর নাছোড় জেদ আর ইস্পাতকঠিন ইচ্ছাশক্তিই দায়ী তাঁর জীবনের এই চূড়ান্ত মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্য। জাতীয় পর্যায়ে খেলার পরে আজ তাঁর যাত্রা শুরু হতে চলেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। আসুন শুনি তাঁর অবিশ্বাস্য কাহিনী।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে বুদগাঁও গ্রামে নির্মীয়মান বাড়ির তিনতলা থেকে আকস্মিকভাবে পড়ে মেরুদণ্ডে চোট লাগে তাঁর। চোটের মাত্রা এতটাই ছিল ডাক্তারদের প্রতিশ্রুতি ও চেষ্টা সত্ত্বেও হুইলচেয়ার ছাড়া চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েন তিনি। তাঁরই কথাতে, ‘একটা পনেরো বছরের মেয়েকে এসে বলা যে সে আর সারা জীবন হাঁটতে পারবে না, ভীষণ কঠিন। আমার পরিবারের সদস্যদের মুখ থেকে যখন শুনলাম, আমি যেন শেষ হয়ে গেলাম। ব্যক্তিগত, পেশাগত জীবনে কত কিছু করার ছিল সে সব যেন সেকেন্ডের মধ্যে তছনছ হয়ে গেল।’
এই শারীরিক অবস্থা নিয়েই তিনি এমবিবিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমনকি কৃতকার্যও হয়েছিলেন। কিন্তু বার বার পাথুরে সমতল পেরিয়ে পরীক্ষা দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। পরিবারের উৎসাহে শেষ পর্যন্ত বিএ আর বিএড পাশ করলেন, কিন্তু একটা ঠিকঠাক চাকরি তবুও অধরা। এরই সঙ্গে চলত আত্মীয় পরিজনদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, এমনকি পরিবারের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হওয়ার জন্য ‘মরে গেলেই ভালো হত’ এই মন্তব্যও শুনতে হয়েছে তাঁকে। স্বাভাবিকভাবেই চরম হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলেন বশির।
কিন্তু এই যুদ্ধে একজন তাঁর সঙ্গে অবিচল ছিলেন, বশিরের বাবা। তাই এই নিরন্তর লড়াইয়ের মাঝে যখন সেই তিনিও পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত হলেন, বশিরের মনে হল এই সব শেষ। তবুও, নিজের জীবনের রাশ আলগা হতে দিলেন না বশির। খোঁজ খবর করে বের করলেন শ্রীনগরের শফকৎ রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার যেখানে তাঁর মতো শারীরিক অবস্থার মানুষদের ছ মাসের ফিজিওথেরাপি হয়।
সেখানে একা একা থাকার প্রস্তাব তাঁর বাবা মা মোটেই মেনে নিলেন না, অনেক সাধ্যসাধনার পর রাজি হলেন তবে এক শর্তে। বশিরের সঙ্গে তাঁর দুই বোনও যাবে সেখানে। এরপর কেউই আশা করেননি যে পরের দিনই বশির তাঁর বোনদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। তাঁর নিজের কথায় ‘আমি একা থাকার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, কিন্তু নিজেকে ওঠানোর জন্য আমার দরকার ছিল বার বার পড়ে যাওয়া। প্রথমদিকে ব্যাপারটা শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য হলেও, শেষ পর্যন্ত সেই প্রচেষ্টাই কাজ দেয় আমার।’

সেই ফিজিওথেরাপি ক্লাসেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ছেলেদের হুইলচেয়ার-আবদ্ধ বাস্কেটবল টিমের সঙ্গে, যাদের শারীরিক অবস্থা তাঁর চেয়েও শোচনীয়। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোর ভক্ত বশির তাদেরকে বলেন, খেলায় নিতে। সেখান থেকেই শুরু, পরবর্তী ছমাসে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তিনি তাঁর প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারলেন অবশেষে। ‘প্রথমবার যখন বলটা আমি জালে জড়িয়ে দিলাম, আমার সমস্ত নেগেটিভ চিন্তা যেন দূরে চলে যায়, আর যতবার আমি ড্রিবল করি আমার নিজেকে ভীষণ জীবিত মনে হয়।’
এর পর জম্মু কাশ্মিরের কোনও মহিলা বাস্কেটবল টিম না থাকায়, তিনি হায়দরাবাদে যান জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। যেখানে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারক ছিল দশে তিনবার পয়েন্ট নেবার, বশির সেখানে সাতবার লক্ষ্য ভেদ করলেন। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। যদিও এর পরে দিল্লি যাওয়া নিয়ে বাড়ির আপত্তি ছিল তবুও তাঁর জেদের সামনে সেসব টেঁকেনি।
এখন বশিরের সময় কাটে সারা ভারতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে, শিক্ষকতা করে। এরকমই একদিন মুম্বাই-এ এক ম্যাচে তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আমেরিকা থেকে খেলোয়াড় বিনিময় প্রোগ্রামে আসা একটি দল তাঁকে আমেরিকায় জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য তিনদিনের সচেতনতা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানায়।
এই প্রোজেক্টের পরে বশিরের লক্ষ্য জম্মু কাশ্মিরে হুইলচেয়ার-আবদ্ধ মহিলাদের জন্য বাস্কেটবল টিম গড়ে তোলা। তাঁর নিজের কথায় ‘এখানে প্রচুর বিশেষ শারীরিক চাহিদা সম্পন্ন মেয়েরা আছে, যারা নিজের একটা পরিচিতি চায়, আমি চাই তাদের সহায়তা করতে। আমি প্রতিবন্ধকতা যুক্ত মানুষদের জন্য যা যা সুযোগ আছে সে নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাই।’
জীবনের নানা চড়াই উৎরাই দেখেছেন ইনশা বশির, বার বার হেরেছেন, কেঁদেছেন কিন্তু জীবন শেষ পর্যন্ত মহানুভব শিক্ষকের মতোই তাঁকে শিখিয়েছে প্রতিবন্ধকতা জয় করার মন্ত্র। শাবাশ ইনশা, আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদেরও নিজের আগ্নেয় জেদ সম্বল করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগাক।

