জগ্‌গা জাসুস : অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান

অর্ঘ্য দীপ

“And now here is my secret, a very simple secret: It is only with the heart that one can see rightly; what is essential is invisible to the eye.” –Antoine de Saint-Exupéry, The Little Prince

শুধুমাত্র চোখ দিয়ে দেখে আর মস্তিষ্কের উর্বরতর কিছু কোষ দিয়ে যা কিছু দেখছেন সেই দৃশ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই যারা অনুরাগ বসু পরিচালিত “জগ্‌গা জাসুস” দেখবার কথা ভাবছেন, তাদের এইবেলা বলে রাখি, ছবিটা প্লিজ দেখবেন না। মানে ছবিটা দেখলে হয় আপনার খুব, খুব খারাপ লাগবে, বিচ্ছিরিরকম বোর হবেন, অথবা আংশিকভাবে কিছু উপাদান ভালো লাগলেও সার্বিকভাবে মনঃপুত হবে না কিছুতেই। কিন্তু দ্য লিটল প্রিন্সের ওই কোটেশনটার প্রতি যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, আপনি যদি সত্যিই মনে করেন যে শুধু চোখের দেখাতেই জীবনের সবটুকুকে প্রত্যক্ষ করা যায় না, তার জন্য মনের দৃষ্টিও দরকার হয় অনেকখানি, আর সাহায্য নিতে হয় কল্পনার… তবে জগ্‌গা জাসুস ছবিটা বোধহয় আপনার সাথে থেকে যাবে অনেক, অনেকদিন।

যেহেতু সিনেমাটা আদতে একটা থ্রিলার, তাই গল্পের ব্যাপারে বেশি কিছু না বলতে যাওয়াই শ্রেয়। তবু একটা আভাস হয়ত দিয়ে রাখাই যায়। জগ্‌গা একটা ছোট্ট ছেলে। তার মা নেই, বাবা নেই, অন্য কোনও আত্মীয়স্বজন নেই, এই পৃথিবীতে কেউ নেই তার। সে মানুষ হয়েছে ময়নাগুড়ির একটা হাসপাতালে। কথা বলতে গেলেই তোতলায় বলে সে বড় বেশি চুপচাপ। একদিন জগ্‌গার সাথে দেখা হয় অদ্ভুত একটা লোকের। যার নাম টুটি ফুটি। এমন উদ্ভট নাম কেন? এর কারণ লোকটার ছিল টুটি টাঙ্গ আর ফুটি কিসমত। এই লোকটাই জগ্‌গাকে শেখায় কীভাবে গান গেয়ে কথা বললে, শব্দগুলো আটকে যাবে না আর। আর শেখায় বাঁচার মতো করে বেঁচে থাকার নানান উপায়। এই লোকটা আসার পরে এই পৃথিবীতে জগ্‌গা আর একা থাকে না। কিন্তু আমাদের কারও জীবনই তো সরলরৈখিক নয়। তাই টুটি ফুটি যেমন হঠাৎ করে এসেছিল জগ্‌গার জীবনে, তেমন হঠাৎই একদিন হারিয়েও যায় তার জীবন থেকে। এরপর আবার কি তাদের দেখা হবে কখনও? জগ্‌গা কি কোনওদিনও খুঁজে পাবে টুটি ফুটিকে? সেই অনুসন্ধানের, সেই অপেক্ষারই গল্প বলে চলে বাকি সিনেমাটা…

জয় গোস্বামীর একটা কবিতা ছিল, “অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান”। আপাতভাবে একটা রূপকথার গল্পের আড়ালে, এই ছবিটা যেন সেই কবিতারই এক সার্থক রূপায়ণ। বেশ কিছু মজার সিক্যুয়েন্স, মন ভালো এবং মন খারাপ করে দেওয়া অনেকগুলো গান, গল্পের প্রয়োজনে নিরন্তর বুনে চলা রহস্য-রোমাঞ্চের জাল– এই সবকিছুকে ছাপিয়ে জগ্‌গা জাসুস আসলে তো একটাই বার্তা দেয়– সেটা শান্তির, সেটা ভালোবাসার। সেটা এই পৃথিবীর সব যুদ্ধ আর সমস্ত হানাহানির বিরুদ্ধে। ছবিটার এক জায়গাতে রয়েছে শুন্ডির রেফারেন্স। রয়েছে আকাশ থেকে নেমে আসা বাক্সবোঝাই কেক-পেস্ট্রির অব্যর্থ মেটাফর। শতকের পর শতক ধরে হাল্লা রাজার সেনাদের যুদ্ধ করে চলাটা কি সত্যিই খুব জরুরি? অনুরাগ বসু হয়ত সেই প্রশ্নটাই রেখে গেলেন আরেকবার।

জগ্‌গা জাসুসের অভিনেতারা অনবদ্য অভিনয় করেছেন প্রায় সকলেই। “প্রায়” শব্দটা ব্যবহার করলাম কেন তার কারণটা আশা করি সকলেই বুঝবেন। লেখাটার হিউমর কোশেন্ট বাড়াতে চাইলে, “নো ক্যাটরিনা কাইফ, নট ইউ!” গোছের কিছু হয়ত লিখতে পারতাম আমি। কিন্তু ওসব ওপরচালাকি করতে সত্যিই ইচ্ছে করছে না। জগ্‌গার চরিত্রে রণবীর কাপুর আশ্চর্যরকমের ভালো। এই প্রজন্মের অন্যান্য অভিনেতাদের থেকে তিনি যে অনেকখানি আলাদা, সেটা আবারও প্রমাণ করলেন এই ছবিতে। বাদল বাগচী ওরফে টুটি ফুটি হিসেবে মুগ্ধ করেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। সৌরভ শুক্লা, রজতাভ দত্ত এবং অন্যান্য অভিনেতারা নিজেদের চরিত্রে সকলেই যথাযথ।

সিনেমাটোগ্রাফার রভি ভর্মনের জন্য কোনও প্রশংসাই হয়ত যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে ছবির সেট ডিজাইন, লোকেশন নির্বাচন, স্পেশাল এফেক্টস ইত্যাদি সবকিছুই খুব সুন্দর। ফলে ভিজুয়ালি জগ্‌গা জাসুস অত্যন্ত নয়নাভিরাম এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে প্রতিটা দর্শকের কাছেই। তবে এই ছবিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছেন সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম এবং লিরিসিস্ট নীলেশ মিশ্র, অমিতাভ ভট্টাচার্য প্রমুখ। যেহেতু অধিকাংশ সংলাপই গান হিসেবে এসেছে ছবিটাতে, ফলে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব ছিল অনেকটাই বেশি। প্রত্যেকটা গান এবং নেপথ্য সঙ্গীতই ন্যারটিভের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে উঠতে পেরেছে এবং সেগুলো শুনতেও লাগে চমৎকার। সবশেষে পরিচালক হিসেবে অনুরাগ বসুকে কুর্ণিশ জানাতেই হয়, এমন একটা ছবির কথা ভাবার জন্য। ছবিটাতে যে কোনও ভুলভ্রান্তি, খামতি নেই এমন নয় কিন্তু। কথক ঠাকুরানি হিসেবে ক্যাটরিনার অসহ্য উচ্চারণ, অতিরিক্ত সাবপ্লটের ব্যবহার, পর্যাপ্ত এডিটিং-এর অভাবে দীর্ঘায়িত সময়সীমা– ভুল ধরতে চাইলে, ধরা যায় অনেকই হয়ত। কিন্তু ভাবনাটা আর পাঁচটা বলিউডি ছবির থেকে এতখানি আলাদা, এতটাই অভিনব যে ভুলগুলো ধরতে তেমন ইচ্ছে করে না।

শেষে একটা অন্য কথা বলি। জগ্‌গা জাসুস ছবিতে একটা বৌদ্ধিক দর্শনের কথা ফিরে ফিরে এসেছে অনেকবার। সেটা হল– এই পৃথিবীতে যার সাথে যার দেখা হওয়ার থাকে, তাদের দেখা হয় ঠিকই। একটা অদৃশ্য বৃত্ত আঁকা হয়ে যায় তাদেরকে ঘিরে। তারপর যদি তাদের পথগুলো আলাদাও হয়ে যায়, যদি তারা দূরে সরেও যায় একে অন্যের থেকে, তবুও তারা ওই বৃত্তের ভেতরেই থেকে যায় আজীবন।

“দুনিয়া ইয়ে থোড়ি থোড়ি হ্যায় ব্যহেতর ল্যগে

মিলকে খোনে কা ড্যর ল্যগে

যানা ভী তো, ফির সে আনা তু…”

আমাদের সাথেও তো কখনও কখনও দেখা হয়ে যায় এমন কিছু মানুষের। যারা আমাদের অনেক কিছু শেখায়, নতুন করে বাঁচার কথা বলে। তারপর হয়ত তারা একদিন চলেও যায় আমাদের ছেড়ে। হয়ত ফিরে আসে অথবা আসে না আর কোনওদিনই। সেই চলে যাওয়ার পথের দিকে তখন আমরা তাকিয়ে থাকি অনন্ত অপেক্ষা নিয়ে, আর আমাদের দু’চোখ ভরে আসে জলে। অনেক কিছু বলার থাকলেও বলা হয়ে ওঠে না কিছুই। মনে মনে শুধু বলি,

যাই বলতে নেই, বলো আসি..

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4646 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...