চালে যখন কাক গলছে

চালে যখন কাক গলছে -- রাধানাথ মণ্ডল

রাধানাথ মণ্ডল

 

এই সংখ্যার স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে উজ্জ্বল উদ্ধার হিসেবে রইল বিস্মৃত গল্পকার প্রয়াত রাধানাথ মণ্ডল (জন্ম: ১/৪/১৯৫০, মৃত্যু: ২৫/১১/১৯৯৪)-এর একটি পূর্বপ্রকাশিত গল্প, 'চালে যখন কাক গলছে'। গল্পটি আমাদের পত্রিকার জন্য নিজের সংগ্রহ থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন শ্রী অমর মিত্র, সঙ্গে দিয়েছেন গল্পকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিটুকু:

রাধানাথ এই গল্প লিখেছিল শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। ১৯৮৬ হবে। প্রতিভাবান লেখক ছিল। অসম্ভব ভালো গল্প লিখত। 'আটঘরার মহিম হালদার' গল্পগ্রন্থে এই গল্প সংকলিত ছিল। বইটি ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। রাধানাথ ছিল অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার রামজীবনপুরের নিকটবর্তী এক গ্রামের ছেলে। ওর লেখায় ফেলে আসা গ্রামই ছায়া ফেলে রেখেছিল। বাংলাভাষায় এম.এ. রাধানাথ আনন্দবাজার পত্রিকায় কর্মরত অবস্থাতেই এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। রাধানাথের অন্য কয়েকটি গল্পের নাম— আটঘরার মহিম হালদার, শীতের মানচিত্র, বৃষ্টি ইত্যাদি।

আমাদের তখন খুবই দুঃসময়। বাড়ির অবস্থাটা হঠাৎই খুব খারাপ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আষাঢ় থেকে ভাদ্র, এই তিনটে মাস আর চলতে চায় না। আমি তিন বছর বি-এ পাস করে বসে আছি। কোনও চাকরি পাচ্ছি না। কুড়ি মাইলের মধ্যে যেসব ইস্কুল আছে তার প্রত্যেকটায় বারবার গিয়ে খবর নিয়ে এসেছি যদি কোনও সেকশন টিচারের পোস্টও খালি থাকে। কিন্তু সবাই ডোনেশন চায়। আট হাজার, দশ হাজার, কেউ বা পনেরো হাজার। এত টাকা আমি কখনও চোখে দেখিনি। ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে আজকাল বি-এড চায়, আমার কোনও ট্রেনিং নেই।

আমাদের বাড়িতে খাটবার লোকও নেই। বি-এ পরীক্ষা পর্যন্ত গঞ্জ শহরের আবহাওয়া আমাকে অলস করে দিয়েছে খুব। আমার বয়সী অন্যান্য ছেলেরা যখন লাঙল-জোয়াল কাঁধে মাঠে গিয়ে হাল চষেছে, আমি তখন রেডিওয় অনুরোধের আসর শুনেছি। বাবার বয়স হয়ে গেছে, এখন মাঠে ছাতা মাথায় আলের উপর বসে থাকে, টুকটাক নির্দেশ দেয় আর বাবার চেয়ে একটু কম বয়সী নিতাইকাকা যা পারে করে। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে বছর-বাঁধা মুনিশ হয়ে আসছে। আমাদের খুব যে ক্ষমতা আছে একজন বছর-বাঁধা মুনিশ রাখার, তা নয়। তবু নিতাইকাকাকে কখনও ছাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর নিতাইকা ছেড়ে গেলে যেটুকু-বা চাষবাস হয়, তাই বা কে করবে?

আমাদের গ্রামে যাদের অবস্থা ভালো, তারা ধান ধরে রাখতে পারে। ভাদ্রমাসে সবচেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়। আমরা তা পারি না। যেদিন ধান কাটা শেষ হয়, মানে নিতাইকাকা বা আমি মাথায় করে শেষ ধানের আঁটিটি নিয়ে আসি অর্থাৎ পৌষ ওঠে, তার পরের দিন বিশ্রাম। লক্ষ্মী ছুঁতে নেই। আমরা বড়জোর সেদিনটি অপেক্ষা করি। তারপরই ধান ঝেড়ে বিক্রি করতে থাকি। আলুও তাই। লোকেরা যখন কোল্ড স্টোরে আলু মজুত করে রাখে আমরা তখন মাটির দামে কিষ্টগঞ্জের গোলায় আলু ফেলে দিয়ে আসি। আর সেই আলুর টাকা ধারে কেনা পটাশ-গ্রোমোরের দাম মেটাতেই চলে যায়। সে বছর জষ্টি মাসে যেদিন বাবা আর নিতাইকাকা বিক্রির জন্য চার বস্তা ধান গরুর গাড়িতে তুলছে, মা বড়ালিতে করে বাকি ধান মেপে বলল, চার বস্তা নিয়ে গেলে খোরাকিতে টান পড়বে। আমরা কেউই মায়ের কথা শুনিনি। কারণ, ইউরিয়া কিনতে হবে, দোকানের জিনিস চাই, অনেক টাকার দরকার। ধান বিক্রি হল। কিন্তু মায়ের কথা ফলে গেল কদিন আগে। ধান সিদ্ধ করতে গিয়ে মা দেখল মাত্র দু-বড়ালি ধান পড়ে। এতে বড় জোর শ্রাবণ মাসের আধাআধি পর্যন্ত যেতে পারে তারপর ভাদ্র মাস পর্যন্ত কেনা ধানের গোনা ভাত।

তখন আমাদের খুবই দুঃসময়। বাড়িতে কোনও টাকা নেই। দুদিন পড়ে ধান কিনতে হবে মণ দুই। আমি পাশের গ্রামের ক্লাস এইট আর নাইনের দুটি ছেলেকে পড়াতে যাই। কুড়ি টাকা করে পাই মাসে। বাবা এখানে-ওখানে ঘুরে এল যদি কারও কাছে ধার পাওয়া যায়। কিন্তু বর্ষাকালে কেউই ধার-হাওলাত দিতে চায় না। দিতে চায় না ঠিক নয়, বর্ষাকালে অনেকেরই হাত খালি। দুপাঁচজন যারা বড়লোক, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই বিশেষ। শেষ পর্যন্ত বাবা বলল, তোর টিউশনি-ঘরে বলে দ্যাখ না, যদি দু-মাসের মাইনে আগাম দেয়। কুড়ি কুড়ি চল্লিশ টাকা, মানে এক মণ ধানের দাম। টিউশন-বাড়িতে কথাটা বলা খুবই লজ্জার কিন্তু এছাড়া যখন কোনও উপায় নেই তখন লজ্জার মাথা খেয়ে আমাকে কথাটা বলতেই হবে ভাবি। এমন সময় একদিন ঠাকুরপুরের গোপীনাথ ভটচাজ হঠাৎ দুজন লোক নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির।

তখন আমাদের দিনগুলি রেডিওর সময় ধরে চলে। সঙ্গীতাঞ্জলির সময় ঘুম ভাঙে, নটার খবরের সময় মুড়ি খাই, দেড়টার খবরের সময় ভাত। সন্ধেবেলা মজদুরমণ্ডলীর অনুষ্ঠানের সময় বেড়িয়ে ফিরি, রাত্রের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে ঘুমোই। আমাদের বাড়িতে একমাত্র সাচ্ছল্যের চিহ্ন এই রেডিও। আমার বেকার-জীবনের একমাত্র সঙ্গী। এই নিয়ে প্রায়ই বাবা বকাবকি করে। দিনরাত ব্যাটারি পুড়িয়ে রেডিও শোনার কোনও মানে হয়? আমি কান দিই না। টিউশনির মাইনে পেয়ে আর কিছু না হোক আমি ব্যাটারিটা কিনে আনি।

রেডিওর দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলে আমি প্রতিদিন যেমন দেপুকুরে চান করতে যাই, তেমনই যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি হটমট করে তিনটে লোক নাছদুয়ার ঠেলে একেবারে আমাদের উঠোনের মাঝখানে চলে এল। মা রান্না করছিল। বিরিকলাইয়ের ডাল সাঁতলাতে যাবে, তিন তিনটে লোক চোখে পড়তে তাকিয়ে থাকল অবাক হয়ে। আমাকে বলল, বাবা মহিম, দ্যাখ তো কারা। গোপীনাথ ভটচাজকে আমি চিনি। এ-অঞ্চলের নামকরা ঘটক। একসময় আমরা একই স্কুলে পড়েছি কিছুদিন। আমি যখন সন্ধিপুর শিক্ষাসদনে ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন গোপীনাথ দুবার ফেল করে সিক্সে পড়ছে। আমি ক্লাস সিক্সে গিয়ে গোপীদাকে ধরে ফেলি। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর প্রায়ই খাওয়াতে বলত আমাকে। গোপীনাথ ভটচাজ ব্রাহ্মণ, ওকে যত খাওয়াব তত পুণ্য হবে, এরকম একটা ধারণা আমাদের অনেকের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সে। ক্লাস সেভেনে উঠেই পড়া ছেড়ে দেয়, তারপর শুনেছি গোপীদা এখন ঘটকালি করে। নামও করেছে খুব। যেসব মেয়ের বিয়ে হবে, কেউ কখনও ভাবেনি, তাদেরও ভাগ্য নাকি ফিরে যায় গোপী ভটচাজের হাতে পড়লে। আর এই করতে গিয়ে দু-পয়সা রোজগারও করছে গোপী।

কিন্তু সেই গোপী আমাদের এখানে কেন? আমাদের বাড়িতে তো বিয়ের উপযুক্ত কোনও মেয়ে নেই। বাবা-মায়ের আমিই একমাত্র ছেলে। আর সেজন্যে মা-বাবার সমস্ত স্নেহ আমিই ভোগ করে এসেছি দীর্ঘকাল, কেউ তাতে কোনও ভাগ বসায়নি। আর সেইজন্যে ধান-জমি বিক্রি করেও বাবা আমাকে বি-এ পাশ করিয়েছে। আমার উপর অনেক আশা সকলের, যার কোনওটাই আমি পূরণ করতে পারিনি। কিন্তু গোপীনাথ ভটচাজ কেন?

আমি তেল মেখে কাঁধে গামছা ফেলে পুকুরে যাচ্ছিলাম, ফিরে দাঁড়াই। কী ব্যাপার, গোপীদা যে! গোপীদা আমার দিকে এগিয়ে আসে, তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। এই পাত্র শঙ্করবাবু। যেমন দেখতে, তেমনি স্বভাবচরিত্র, প্রতি ক্লাসে এক চান্সে প্রোমোশন। কী ছাত্র ছিল আমাদের ইস্কুলের। আঃ যেন চাবুক। মাস্টারমশাইরাও খুব ভালবাসত। নিজের চোখে দেখা শঙ্করবাবু। বি-এ পাশ। এক চান্সে বি-এ ডিস্টিংশন। তাই না মহিমভাই?

আমি হতভম্ব খেয়ে যাই? কী বলছে গোপীনাথ ভটচাজ? আমি পাত্র, মানে আমার বিয়ে? যে-গোপীনাথ আমাকে মহে বলে ছাড়া ডাকত না, সে আমাকে বলছে মহিমভাই? আমি ক্লাসে কখনও ভালো ছাত্র ছিলাম না। মাস্টারমশাইরা রোজ লাস্ট বেঞ্চে বসে-থাকা আমাকে চিনতই না ভাল করে। আর বি-এ-তে ডিস্টিংশন পাওয়া অনেক দূরের ব্যাপার, আমি পাশ করেছি কোনও রকমে।

শঙ্করবাবু আমার দিকে তাকালেন। ওঁর গায়ে সাদা হাফশার্ট আর ফুলপাড় ধুতি। বুক-পকেটে অনেক কাগজপত্র, কলম গোঁজা। ক্লিপ দেখে বোঝা যায় রাইটার পেন। সুন্দর ওলটানো চুল, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। বেশ সৌখিন ভদ্রলোক। ইনি নিশ্চয় মেয়ের বাবা। সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই আমার নিজের বাবার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কুঁচকোনো চামড়া, কপালে তিনটে স্পষ্ট ভাঁজ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এখন খালি গায়ে উত্তরের জমির আলে বসে আছে। শঙ্করবাবুর সঙ্গের ভদ্রলোক এতটা ফিটফাট নয়, আধময়লা জামা, খালি পা, হাতে বাঁশের বাঁটের ছাতা। সে-ই এগিয়ে আসে আমার দিকে। কী নাম বাবাজীবনের? মহিম, না-মানে ম-মহিম হালদার। আমি আচমকা দু-পা পিছিয়ে যাই। ইতিমধ্যে রান্নাশালের দিকে এগিয়ে গেছে গোপী। কই গো মা জননী, আপনার বেয়াই এসেছে মা, বসতে জায়গা দিন। আর মা, আপনি তো মহিমভাইয়ের মা, আমার মায়েরই মতন। আপনার হাতের রান্না যে কতদিন খাইনি। আজ অনেক দিন পরে আবার সেই সুযোগ হবে। আঃ কী অপূর্ব সেই স্বাদ, আমার জিভে এখনও লেগে আছে। আসুন আসুন শঙ্করবাবু, আপনার বেয়ানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। সুপুত্রের জননী আপনার বেয়ান। সংস্কৃতে কি সাধে বলেছে যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম।

তখনও খুব সংস্কৃত আওড়াত গোপীনাথ। মানে জানে না, কোথায় কী বলতে হয় জানে না, তবু কথায় কথায় সংস্কৃত বলত। হাসি পায় আমার। কিন্তু গোপীদা যে মাকে বলল, কতদিন যে আপনার হাতের রান্না খাইনি, সে তো আমাদের বাড়িতে এসে খায়নি কখনও!

আমার গা থেকে তিলতেলের গন্ধ বেরোচ্ছে। এই গন্ধটা আমি মোটেই পছন্দ করি না বলে আমার মাখবার মত সরষের তেল সব সময় বাড়িতে থাকে। কিন্তু অনেক দিন সরষের তেল ফুরিয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে তিল তেলই মাখতে হয়েছে আমাকে। আমাদের গ্রামে যারা পারে তারা তিল বিক্রি করে দিয়ে সরষের তেল কিনে আনে। আমরা তা পারি না। তাই ঘানিতে তিল মাড়িয়ে তেল বের করে আনি। সেই তিল তেলও শেষ হয়ে এসেছে। বানির অভাবে ঘানি চালাতে যেতে পারছে না। কলের ঘানি বসেছে কিষ্টগঞ্জে, তার বানি অনেক। শঙ্করবাবু নিশ্চয় গন্ধ পাবেন আমার গা থেকে, তাই চানটা করে আসি। মা মাদুর পেতে দেয়, আর আমি দ্রুত পুকুরের দিকে পা চালাই।

চান করতে যেতে যেতে গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন অসম্ভব আর অবাস্তব মনে হয়। আমার বিয়ে? মাঝে মাঝে আমি নানারকম কল্পনা করি। ভাবি বালিশের তলায় চার পাঁচখানা একশো টাকার নোট রেখে ঘুমোচ্ছি। কিংবা রেডিও খুললেই ভেসে আসছে আমার নিজের গলা, আকাশবাণী কলকাতা, এখন আধুনিক গান শুনবেন গ্রামাফোন রেকর্ডে, শিল্পী শ্রীমতী – মনে হয় আমি এখন কলকাতায় থাকি, চাকরি করি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। এমন কি যখন খুব ছোটখাটো কল্পনা করি তখন আমি নিজেকে দেখি রামজীবনপুর বাবুলাল ইন্সটিটিউশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার, অ্যাটেনড্যান্স রেজিস্টার হাতে ক্লাসে যাচ্ছি, বাঁ হাতে ধরা সেনগুপ্ত ধুতির কোঁচা। কিন্তু আমি কখনও বিয়ে করার কথা কল্পনা করিনি।

ভালো করে গামছা দিয়ে রগড়ে চান করতে থাকি আমি। এমন সময় নাইতে আসে আমাদের পাড়ার কানাই। কানাই আমার চেয়ে বসে ছোট। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে বছর দুই আগে। একটি ছেলেও হয়েছে। সে জলে নেমে আমার পাশে দাঁড়ায়। আমাকে বলে, মহিমদা, শুননু, তোমাকে নাকি দেখতে এসেছে গোবিন্দপুর থেকে?

আমি অবাক হয়ে যাই। দেখতে এসেছে? দেখতে তো মেয়েদের আসে। আমি কি মেয়ে নাকি? কোনও জবাব দিই না আমি। একমনে স্নান করতে থাকি। কানাই আমার পাশ দিয়ে একগলা জলে নেমে পড়ে। বলে, গোপে ভটচাজকে দেখনু কিনা তোমাদের ঘরের পানে যাচ্ছে। গোবিন্দপুরের শঙ্কর হাজরা খুব বড়লোক গো, মহিমদা, ধানভানা কল আছে। বেশ বড়লোক শ্বশুর হবে গো – বলতে বলতে কানাই সাঁতার কেটে দেপুকুরের ওপারে চলে যেতে থাকে। আমি লুঙ্গি খুলে গামছা পরি আর ভাবি, এত তাড়াতাড়ি এতসব খবর লোকেরা জানে কি করে। আমি তো শঙ্কর হাজরা আর তার ধানভানা কলের কথা শুনিইনি কখনও!

আমাকে দেখতে এসেছে? বাড়ি ফিরতে একটু লজ্জা লজ্জা করে আমার। ভালো করে গায়ে ভিজে লুঙ্গি জড়িয়ে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকি। দেখি মা জল এনে দিয়েছে গাড়ুতে সকলের পা ধোওয়ার জন্যে, উঠোনে সকলে পা ধুচ্ছে একে একে। আর গোপীনাথ বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছে আমাদের সকলের। কত বড় বংশ আমাদের? আটঘরার হালদারবাড়ি যাব বললে পাঁচ ক্রোশ দূর থেকে দেখিয়ে দেয়। আমি ঘরে ঢুকে গামছা ছাড়ি। লুঙ্গি পরে একটা গেঞ্জি গায়ে দিই। দেয়ালের জলুইয়ে ঝোলানো হাত-আরশিটা পেড়ে আনি। মুখটা দেখি ভাল করে। আমাকে দেখতে এসেছে? কেমন দেখতে আমি? আমি তন্নতন্ন করে দেখতে থাকি আমার বাইশ বছরের চেহারা। আমার চোখ, নাক, মুখ। কানের কাছে একটা আঁচিল, এখানে আঁচিল থাকলে কি ভালো লাগে? গলার কাছে হাড়দুটো উঠে আছে, এজন্যে বেশ রোগা দেখায় আমাকে। এ সপ্তাহে এখনও দাড়ি কামানো হয়নি বলে খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়ে আছে গালে। আমি ভালো করে টেরি কেটে চুল আঁচড়াই। তারপর একটা ব্লেড খুঁজে এনে দাড়ি কামাতে থাকি। মা ঘরে এসে ফিসফিস করে বলে, বাবা, যা না একবার জেলেপাড়ায়, যদি মাছটাছ কিছু পাস। না হলে অন্তত গোটা দুই ডিম।

আমি চমকে উঠি। তাই তো, এমন অসময়ে তিন তিনজন অতিথি বাড়িতে। আমাদের এখন তো একটাই তরকারি, বিরি-কলাইয়ের ডাল আর বাড়ির পোস্ত। এ দিয়ে কি এরকম অতিথিদের খেতে দেওয়া যায়! আমি তাড়াতাড়ি দাড়ি কেটে বেরিয়ে পড়ি। জেলেপাড়া এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

আমার কাছে একটাও পয়সা নেই। মাছ বা ডিম পেলে জেলে বউকে বলতে হবে বিকেলে মার কাছ থেকে দাম নিয়ে যেতে। মা যেভাবে পারে দাম মিটিয়ে দেবে। কিন্তু এখন দামের কথা নয়, এখন জিনিসটা পাওয়া দরকার। বাড়িতে অতিথি। যে-সে অতিথি নয়, আমার ভাবী শ্বশুর। বলা তো যায় না, যদি সত্যিসত্যিই বিয়েটা হয়, যদি সত্যিসত্যিই –

বেরোতে গিয়ে দেখি শঙ্করবাবু বাড়ির এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছেন। হঠাৎ আমার চোখের সামনে আমাদের বাড়ির চেহারাটা ফুটে ওঠে। একটু ছাড়া ছাড়া দু-খানা লতাপেড়ে ঘর। যে-ঘরটা বড় তাকে আমরা বড়ঘর বলি। খড়ের চাল, একদিকে রান্নাশাল, ছিটেবেড়ার রান্নাঘর। উঠোনটাই যা একটু বড়। চারদিকে পাঁচিল ঘেরা, দূর থেকে দেখলে মনে হবে সচ্ছল গৃহস্থের বাড়ি, ভিতরে না এলে ঠিক চেহারাটা বোঝা যায় না। শঙ্করবাবুর নিশ্চয় নজর এড়ায়নি। বড়ঘরের চাল এবারেই ছাওয়ানোর কথা ছিল, খড়ের অভাবে হয়নি। তার বদলে যেদিকে জল পড়ছিল, সেখানটা এবার ভেটিয়ে রাখা হয়েছে। পুরনো খড়ের গোটা চালে দু-তিন পোচ নতুন খড়ের তালি – বড়ঘরের চাল পর্যন্ত কি শঙ্করবাবুর চোখ পৌঁছবে?

আমাদের বাড়িটা যদি আর একটু ভালো হত! অন্তত গাঁয়ে অনেকের যেমন আছে, মাটির দোতলা কোঠাবাড়ি! কিন্তু আমাদের নাকি কোঠাবাড়ি করতে নেই। খড় ছাড়া টিন বা অ্যাসবেসটাসের ছাউনিও দিতে নেই। ছোটবেলা থেকে এসব কোঠা শুনে আসছি বাবার মুখে। বাবাও শুনেছে তার বাবার মুখ থেকে। গুরুর নাকি নিষেধ আছে আমাদের বংশে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না এসব। মনে হয় কোঠাবাড়ি তোলায় নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার জন্যেই এসব গুরুর দোহাই। হঠাৎ বেশ রাগ হয়ে যায় আমার। আমাদের বাড়িটা কি আর একটু ভাল হতে পারত না? এমন দীনদরিদ্রের বাড়িতে কি শঙ্করবাবুর মত মানুষ তাঁর মেয়েকে দেবেন?

জেলেপাড়ায় যেতে গেলে একটা মাঠ পেরোতে হয়। আলরাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ভাবি, এ আমি কী চিন্তা করছি? আমার বিয়ে? খাওয়াব কী? আমার নিজের রোজগার বলতে মাস গেলে কুড়ি টাকা ছেলে পড়িয়ে। আর বাড়ির অবস্থাটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। চাষে খাটার লোক নেই। আমি তো একেবারেই অপদার্থ, স্কুল-কলেজে পড়ে একটি মাকাল ফল তৈরি হয়েছি। সংসারের কুটোটি নাড়ার ক্ষমতা আমার নেই। এরকম অবস্থায়, যখন আমাদের দারিদ্রের ফুটো চাল দিয়ে কাক গলে যাচ্ছে অজস্র, তখন বিয়ের চিন্তাটা মনে স্থান দেওয়াই হাস্যকর। তবু কেন বারবার মনে হচ্ছে বিয়ের কথাটা? কেন মনে হচ্ছে আজ শঙ্করবাবুর সামনে কঠিন এক পরীক্ষায় বসেছি আমরা, আমাদের সব কিছু? এ পরীক্ষায় আমাদের পাশ করতে হবে। আমাদের গ্রামে আমার বয়সী একজনও অবিবাহিত নেই। যারা অন্যের বাড়িতে মুনিশ খাটে, তারাও বিয়ে করে ফেলেছে আমার চেয়ে অনেক কম বয়সে। শুধু আমিই আইবুড়ো থেকে যাব চিরকাল?

জেলেপাড়ায় আমি ঘুরতে থাকি একের পর এক বাড়িতে। কিছুই পাই না। জেলে-বউয়েরা চাটুনি জাল কাঁধে ঘরে ফিরে আসে। সবারই কোঁচর ফাঁকা। এখন ভর্তি পুকুর সব, মাছ পাওয়া যায় না। মাঠে মাছ উঠবে আরও এক দেড় মাস পরে। কী-যে করি! ডিমও পাই না। সকালবেলা এ-গাঁ ও-গাঁ ঘুরে ফড়েরা ডিম কিনে নিয়ে চলে যায়। আমি রোদের মধ্যে আধঘন্টা ঘোরাঘুরি করি। তারপর শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে আসি।

বাড়ি ফিরে দেখি বাবাকে খবর পাঠিয়ে আনানো হয়েছে একটু আগেই। বাবা শঙ্করবাবুদের কাছে একটা কম্বলের আসনে বসে আছে। আর গোপীনাথ নানা কথা বলে যাচ্ছে। বাবার তেমনই খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত তোলা ধুতি। বাবা কি একখানা গেঞ্জিও গলাতে পারত না গায়ে? আমার রাগ হয়। আমাকে দেখে সবাই একবার মুখ তুলে তাকায়। আমি তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ি। গোপীনাথের কথা আমার কানে ভেসে আসে। আর বলবেন না কাকাবাবু, এ মেয়ের কোনও জুড়ি নাই সাতখানা গাঁয়ে। যেমন দুধে আলতায় গোলা গায়ের রঙ, তেমনি কাজে-কম্মে একেবারে দশভুজা। গোটা সংসারের কাজ তো মেয়ে একাই করে। আঃ এমন গুণবতী মেয়েকেই সংস্কৃতে বলেছে, দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।

মা ঘরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী রে, কিছুই পাসনি? আমি ঘাড় নাড়ি। মাকে চিন্তিত দেখায়। কী দিয়ে তিন তিনটে লোককে ভাত বেড়ে দিই বল তো? তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলে, এক কাজ কর, মাঠে গিয়ে তোর নিতাইকাকাকাকে বল ঘরে চলে আসতে। একবার গাঁতিটা নিয়ে বেরোক। দুটো ঘুসো মাছও যদি পায়! ঘরে দুটো লবাত পর্যন্ত নাই যে লোকগুলোকে জল খেতে দুবো!

আমি আবার বেরোই। উত্তরের মাঠে দুটো সাদা হেলে গরু, দূর থেকে দেখেই চিনতে পারি নিতাইকাকা। আমি কাছে যাই। নিতাইকাকা সব শুনে বলে, তাহলে তো হাল ছেড়ে দিতে হবে। তুমি তো আবার কলেজে-পড়া বাবু, একবার যে লাঙ্গলের বোঁটাটা ধরবে সে আশা নাই! যখনই সুযোগ পায় নিতাইকাকা আমাকে কলেজে-পড়া বাবু বলে ঠাট্টা করে। আমি হাসি। বলি, কী যে তুমি বলো না নিতাইকাকা, আমাকে আজ গোবিন্দপুর থেকে দেখতে এসেছে আর আমি লাঙ্গল করব মাঠে! লোকে কী বলবে? নিতাইকাকাকা বলে, ঠিক আছে লাঙ্গল না ধরলে যদি দু-হাজার টাকা বেশি পাও তো ভাল। আমি হাল ছেড়ে দিয়েই যাচ্ছি। ভরাভত্তি পুকুর সব, কোথা যে মাছ পাব ভগমানই জানে!

টাকা! বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে ওঠে। টাকা পাব আমি বিয়ে করলে? তারপরই মনে পড়ে, হ্যাঁ, তাই তো! আমাদের গ্রামে এবং গোটা অঞ্চলে তাই নিয়ম! এখানে যে চার বিঘে ধান জমির মালিক তার ছেলেও পাঁচ-ছ হাজার টাকা বরপণ পায়। যারা অন্যের বাড়িতে মুনিশ থাকে, তারাও। আমার তো পাওয়ার কথা, কিন্তু নিতাইকাকা বলার আগে পর্যন্ত আমার টাকার কথা মনে হয়নি।

নিতাইকাকা লাঙ্গল জোয়াল খুলে ফেলে। ছেলে গরুগুলোর মুখে জালি পরিয়ে দিয়ে আমাদের বাড়ির রাস্তা ধরিয়ে দেয়। আমাকে বলে তুই চ, আমি ঘর থেকে চুনো জালিটা নিয়ে যাচ্ছি। নিতাইকাকার জাল বোনার খুব শখ। বড় টানা জাল, মাথা-ঘোরানো, চুনো জাল, নানা ধরনের জাল আছে বাড়িতে। আমাদের যখন মাছ ধরার দরকার হয় নিতাইকাকাকা নিজের হাতের জাল নিয়ে আসে।

আমি ফিরে আসি। দেখি বাবার সঙ্গে খুব সম্ভ্রম নিয়ে কথা বলছেন শঙ্করবাবু। আমি অবাক হই। মেয়ের বাপ বলে তাঁর মতো অভিজাত চেহারার মানুষকেও এমনভাবে কথা বলতে হবে? ঘরের মধ্যে ঢুকে আমি দরজা বন্ধ করে দিই। তবু কানটা খাড়া রাখি বাইরের দিকে। একটু পরে দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। দরজা খুলে দেখি গোপীনাথ ভটচাজ। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয় গোপীদা। বালিশে হেলান দিয়ে আমার বিছানার উপরে বসে পড়ে। বলে মহে, আগে একটা বিড়ি দে। আমি মনে মনে বেশ চটে আছি গোপীনাথের উপর। বলি, বিড়ি কোথায় পাব? আমি কি বিড়ি খাই?

–খাস না? গোপী আমাকে ধমকায়। তুই শালা তেমনি কিপটে আছিস। ব্রাহ্মণকে একটা বিড়ি দান করলে কত পুণ্যি হয় জানিস?
–হোক। পুণ্যে আমার দরকার নেই। কী বলবে বলো, আমি ঝাঁজিয়ে উঠি।

গোপীনাথ আমার দিকে এগিয়ে এসে বসে। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে, এভাবে বলে, এমন সম্বন্ধ তুই পাবি? তোর কী উপকার কচ্চি তুই এখন বুঝবিনি মহে, আগে বিয়েটা হোক তারপর এই ব্রাহ্মণের কদরটা বুঝবি।

–ছাড়ো তো, কে বিয়েটা করছে কে? চাকরি নাই, পয়সা রোজগার নাই, আর আমি বিয়ে করতে যাব? বলে নিজে পায় না খেতে মধু কোথা শুবি রে?
–শোবে আলবাত শোবে। ব্রাহ্মণের কথা কখনও মিথ্যে হয় দেখেছিস? মধু এসে এই বিসনাতেই শোবে।

গোপীনাথ এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়াল পর্যন্ত আমার তক্তপোশের বিছানাটা দেখায়। তারপর একটু হেসে বলে, আঃ কী রূপ! কী রঙ! সংস্কৃতে একেই বলেছে অস্তি গোদাবরীতীরে বিশাল শাল্মলী তরুঃ!

আমি হেসে ফেলি। বলি, গোপীদা তোমার সংস্কৃত থামাবে? মানে জানো না কিছুই না, খালি যেখানে সেখানে যা তা বলে যাচ্ছ।

গোপীদা বলে, কলেজে পড়ে তোর এই বুদ্ধি হয়েছে মহে? সংস্কৃতের আবার মানে কীরে? দেবভাষা, তা জানিস? এই যে এই সাবডিভিশনে একশো আঠারো জোড়া হাত এক কল্লুম, সে তো শুধু সংস্কৃতের জোরে! এই যে তুই দুদিন পরে ছাদনাতলায় বসবি, তোকে তো সংস্কৃতেই মন্ত্র বলতে হবে, না কি? সে যাকগে। তুই কবে মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস বল?

মেয়ে দেখতে? বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি শিরশির করে ওঠে। আমাদের স্কুল সন্ধিপুর শিক্ষাসদনে কোনও মেয়ে পড়ত না। কলেজে আমাদের ক্লাসে কয়েকজন মেয়ে পড়ত। প্রফেসার ঢোকার সঙ্গে ক্লাশে আসত, প্রফেসার বেরিয়ে গেলে বেরিয়ে যেত। আর গ্রামের ছেলে আমি সেইসব মেয়েদের সম্পর্কে কখনও কিছু কল্পনা করার সাহসই করিনি। এখন গোপীনাথ ভটচাজের কথা শুনে সম্পূর্ণ একটি মেয়ের চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার বাইশ বছরের জীবনে এই প্রথম নিজের মতো একটি মেয়েকে ভাবতে পারি। মনে মনে ভাবি, দেখতে যাব, অবশ্যই দেখতে যাব মেয়েটিকে। এবং যত তাড়াতাড়ি পারি।

আমি গোপীনাথকে জিজ্ঞেস করি, কত বয়স মেয়েটির?

গোপীনাথ বালিশে হেলান দিয়ে বসে। গম্ভীরভাবে বলে, উঁহু, আগে বিড়ি চাই। আমি উঠে গিয়ে খুঁজে পেতে কুলুঙ্গি থেকে একটা বিড়ি আর উনুন থেকে একটা আঙরা এনে গোপীদাকে দিই। গোপীদা বিড়িটা ধরিয়ে জুত করে একটা টান দেয়। বলে, ষোল। একেবারে প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রমিত্র বদাচরেৎ।

–রঙ?
–ফর্সা। যাকে বলে দুধে-আলতা।
–চুল?
–কোমর ছাপিয়ে যায় একেবারে।
–গান জানে?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, গান জানবে না? গান কে না জানে? ঘরে হারমনি, ডিগি তবলা, কী নাই? শঙ্কর হাজরা কত বড়লোক জানিস? ধানভানা কল আছে গোবিন্দপুরের বটতলায়। ওই যে সঙ্গে দেখছিস, ওই লোকটা ওর কর্মচারী। দেড়শো টাকা মাইনে পায় দেড় মাস গেলে। তোকেও দেবেথোবে ভাল।

দেবেথোবে ভাল, মানে কী দেবে? নগদ টাকা? কত? একটা সেকশন টিচারের পোস্টের জন্য যত ডোনেশান লাগে, সব? আমি মনে মনে একটু অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু গোপীনাথের কাছে গোপন করে বলি, আর মেয়েটির পড়াশুনো?

–সেদিক দিয়েও ফাসক্লাশ। গাঁয়ে কলেজ নাই, তাই। থাকলে দেখতিস। ইস্কুল ফাইনাল পর্যন্ত পড়েছে। আট কোশ দূরের ইস্কুলে সেনটার পড়েছিল বলে পরীক্ষা দিতে পাঠায়নি মেয়েকে। পরীক্ষা দিলে নিঘঘাত ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করত।

এত দূর বলে গোপীনাথ হঠাৎ আমার হাত দুটো ধরে ফেলে। মহিম ভাইটি, এই বিয়েতে অমত করিসনি। আমি বলছি তোর ভালো হবে। দেখিস, আমি ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের কথা কখনও মিথ্যে হয় না।

খুব বিব্রত বোধ করি আমি। তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নিই। আমার এক সময়কার সহপাঠী গোপীনাথ ভট্টাচার্যকে হঠাৎ খুব বয়স্ক মনে হয়। গায়ে মলিন একটা হাফশার্ট, দুটো তালি দেওয়া, রুক্ষু চুল, বোধহয় বহুদিন তেল পড়েনি। এই অসহায় ব্রাহ্মণটির প্রতি খুব মমতা হয় আমার। বলি, আমি অমত করার কে গোপীদা? আগে দ্যাখো শঙ্করবাবু তাঁর মেয়েকে আমাদের ঘরে দিতে চান কিনা।

–দেবে না মানে? আলবাত দেবে? হঠাৎ সোজা হয়ে বসে গোপীনাথ ভটচাজ, এমন বংশ পাবে? আটঘরার হালদার বংশ? দশ কোশ দূর থেকে লোকেরা দেখিয়ে দেয়। তুই এমন হীরের টুকরো ছেলে। আরও অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দরজায় ঠকাঠক শব্দ হয় আর বাবার গলা শুনতে পাই, বাবা মহিম, গোপীনাথবাবুকে ডেকে দাও, ভাত বাড়া হয়েছে।

বড়ঘরের মেঝেয় আসন পেতে দেওয়া হয়েছে সকলকে। ব্রাহ্মণ গোপীনাথের জন্যে কম্বল, অন্য দুজনকে দেওয়া হয়েছে মার হাতে তৈরি ফুলতোলা কাপড়ের আসন। মা কারও বাড়ি থেকে পটল এনেছে গোটা কয়েক, আর তরকারি আর ঘুসো মাছের পোস্ত। আমি রেডিওটা এনে খাবার ঘরের সামনে জোরে চালিয়ে দিই যাতে শঙ্করবাবু ভালো করে শুনতে পান। তাঁর সামনে ভাতের থালার ছবিটা রেডিও শুনিয়ে খানিকটা পুরিয়ে দিতে চাই।

বিকেলবেলা শঙ্করবাবু চলে গেলেন। সঙ্গে গেল তাঁর ধানভানা কলের কর্মচারী আর ঘটক গোপীনাথ ভটচাজ। ঠিক হল আমরা গোবিন্দপুরে মেয়ে দেখতে যাব সামনের হপ্তায়। বুধবার ভালো দিন আছে। যাবার সময় বারবার গোপীনাথ বলে গেল বাবাকে, আমরা যেন কিছুতেই দেরি না করি। কারণ সংস্কৃতে কথাই আছে, শুভস্য শ্রীঘ্রম। আমার ভালো লাগল যে, গোপীনাথ একবার অন্তত ঠিক কথাটা বলেছে সংস্কৃতে।

আমাদের তখন খুবই দুঃসময়। তবু বেশ কয়েকদিন আমাদের কাটল গোবিন্দপুর যাওয়া-আসায়। বাবা গেল দুবার, শঙ্করবাবু আবার একবার এলেন। দেওয়া-থোওয়া নিয়ে কথাবার্তা হল। আমাকে বারবার বলা হল মেয়ে দেখতে যেতে। কিন্তু আমি গেলাম না। আমি শুধু সারা বর্ষাকাল ভেবে ভেবে কাটালাম, আমাদের এই অভাবের সংসারে সেই দুধে-আলতা গায়ের রঙকে কোথায় রাখব।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...