পিরিয়ড ছুটি : একটি প্রতিবেদনের উত্তরে

অভিজিৎ রায়চৌধুরী

 

পিরিয়ডসে ছুটি চাই, আবার “লিঙ্গসাম্য”ও চাই?– এটাই গত সপ্তাহের ‘এই সময়’ কাগজের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম। সপ্তাহ কয়েক আগে মুম্বই-এর দু’টি সংস্থা তাদের মহিলা কর্মচারীদের পিরিয়ডের প্রথম দিন ছুটি দেওয়ার এক অভিনব ব্যবস্থা চালু করেছে। সেই প্রচেষ্টা নিয়েই লেখিকার এই সমালোচনামূলক প্রতিবেদন। তার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত রূপ করলে হয়, যে বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে রাখার নানা ধরনের সুপ্ত ফন্দি চলে, প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তারা দুর্বল। যেমন স্যালারি কম দেওয়া, কাজের উন্নতিকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা এবং সর্বোপরি উনি বলেছেন যে, গ্রামের মহিলারা যদি পিরিয়ডের সময় কাজ করতে পারে মাঠেঘাটে, তাহলে শহুরে মহিলাদের কাজ করতে অসুবিধা কোথায়। তাহলে সত্যিই এই ছুটি কতটা যুক্তিযুক্ত? লেখায় তিনি পিএমএস, মেন্টাল ট্রমা এই ধরনের নানা সম্ভাবনাকে ভিত্তিহীন বলছেন। সত্যিই কি এইরকম দৃষ্টিভঙ্গি শহুরে মেয়েদের পিছিয়ে দেয়?

১। লিঙ্গসাম্য

দেখুন লিঙ্গ কোনওদিন সমান হয় না, লড়াইটাও যদিও লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি, কিন্তু সমানাধিকারের নয়, সমবণ্টনের। যদি লিঙ্গের সমানাধিকার হয়, তাহলে ছেলেদেরও সেই মাসে একদিন অণ্ডকোষ ফাটিয়ে রক্ত বার করে (যেহেতু আলাদা কোনও উপায় আমার মাথায় আসছে না), হুইসপার পরিয়ে, পেটে অনবরত ঘিপঘাপ ঘুষি দিতে হবে। তারপর দুজনকে পাশাপাশি বসে সারাদিন অফিস করতে হবে।

অদ্ভুত তাই না? লড়াইটা এই কারণেই সমবন্টনের। লড়াইটা নারী-পুরুষের আলাদা দিকগুলোকে মুছে ফেলে, যেগুলো সমান সেগুলোকে নিয়ে মাপার। এখন পিরিয়ডের গুরুত্বকে সমান চোখে দেখা যায় না। আবার এই প্রসেসটিকে “মেয়েদের ন্যাকামো” বলে চালানো যায় না, কারণ এইটা একটা সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়া, মানে ছেলেদের মাসের একটি দিন যদি পাতলা হাগু হত, তাহলে তাদেরও ছুটি দেওয়া উচিত হত (গোমাতাকে ধন্যবাদ, তা হয় না)। নারীবাদ মানে লিঙ্গের ইগোগুলো মুছে ফেলে, মানুষ হিসেবে মেশা, মানুষদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া। এইটাই তো? আর কী? যারা পিরিয়ডকে অস্বীকার করে, তারা মাতৃত্বকেও অস্বীকার করে না কি?

মনে করুন ভারতের মতো একটি জনবসতিপূর্ণ দেশ, চাকরি রাখাই কঠিন, তার মধ্যে যখন একজন মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হতেন তখন ভারি শরীর নিয়ে চাকরি রাখাই হত মুশকিল, এখন তার জন্য ভারত সরকার মেটারনিটি লিভ ব্যবস্থা চালু করলে, তাতে বৃহৎ অংশে মহিলাদের কাজের উৎসাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আমি চাইলেও বাচ্চা ধারণ করতে পারব না, সেটা পারবে আমার বউ। আমি তাকে সেইটা ছেড়ে বাকি ব্যাপারগুলোতেই সমান হওয়ার কাজ করে যাব, আমাদের সাংসারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বললে আমার স্ত্রী রান্না করলে, আমিও বাসন মেজে, টেবিল পুঁছে তাকে রাতের খাওয়ার পরে বিশ্রাম দিতে পারি (অবশ্যই প্রেগনেন্সির সময় নয়)। মূল কথাটা হল, ফেমিনিজম স্ট্যান্ডস ফর ইকুইটি নট ইকুয়ালিটি। কারণ শারীরিক কারণে আমরা কেউই সমান নই। আমি একজন পুরুষ, আমার স্ত্রী একজন নারী। এটা বদল করা সম্ভব নয়।

২। পিএমএস, মেন্টাল ট্রমা ইত্যাদি

আপনি নিশ্চয়ই রিসার্চ করে লিখেছেন, সত্যিটা আমার জানা নেই, এবং এই নিয়ে বিরোধিতাও নেই, তবে আমি একটি ঘটনা শেয়ার করি, আমেরিকায় দুজন ছেলে ঠিক করেন, তারা কৃত্রিম উপায় পিরিয়ড পেইন সহ্য করবে, বান্ধবীদের সাথে। পেটের ওপরে বেল্ট আকৃতির এই বস্তুটি লাগিয়ে, সুইচ দিতে হয়। দুটি ছেলেই, ১০ মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান হারায় (ইউটিউব/গুগলে অসংখ্য ভিডিও লিঙ্ক আছে ঘটনাটির)।

ফলে এই যে অসহ্য ব্যথা, এবং যেটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত, জৈবিক তার জন্য একজন একদিন বেশি ছুটি নিলে, তাতে আলাদা করে “মেধার” বা “শক্তির” কোনও ক্ষতি হয় কি?

৩। গ্রামবাংলা ও শহর

প্রথম কথা, গ্রাম বাংলায় যেটা হয় সেটা সঠিক নয়, সেটা তো অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই? তাহলে একটি ভুলকে আরেকটি ভুল দিয়ে বিচার করা কেন? আর একদিন দমবন্ধ করা অবস্থায় চাকরি করেই বা কী প্রমাণিত হয়? আর প্রমাণটাই বা কাকে করবেন? পিরিয়ডে অফিস গিয়ে প্রেজেন্টেশন বানিয়ে জমা দিলেও, আপনি ক্লিভেজ দেখিয়েই প্রমোশন পেয়েছেন থিওরি নামবে। অন্তত গ্রামবাংলায় কোন কৃষক বেশি ধান কাটলে, তাকে ক্লিভেজ দেখিয়ে বেশি ধান কেটেছে, ধরনের অ্যাবসার্ড বক্তব্য শুনতে হয় না।

আসলে লড়াইটা মানসিকতার, যারা ভোগ্যদ্রব্যের বাইরে নারীদের আর কিছুই ভাবে না তাদের বিরুদ্ধে, লড়াইটা সেই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে যারা ভাবে পিরিয়ড হোক বা না হোক বাড়ির বউ কেন অফিস যাবে, লড়াইটা সেই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে যাদের ধারণা অফিসের রিসেপশনে সুন্দর মহিলা রাখলে ডিল পাক্কা হবে। লড়াইটা সেই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে যারা দায়িত্বগুলো এড়িয়ে যেতে চায়। লড়াইটা একটা প্রস্তরযুগের চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে। বিশ্বাস করুন, পিরিয়ড লিভ থাকুক বা না থাকুক, সেটা আলাদা করে প্রভাব ফেলে না।

যারা মহিলা কামরা নিয়ে ঝামেলা করে, তারাই জেনারেল কামরায় মহিলাদের পেছনে টাওয়ারের খোঁচা দিতে ছাড়ে না। লড়াইটা তাদের বিরুদ্ধে। পিরিয়ডের লিভ, একটি আদিম ট্যাবুকে আরও একটু খোলামেলা করে তুলে ধরার একটা উপায় মাত্র।

লেখাটির আগাগোড়া জুড়ে যে জিনিসটা প্রমাণ করার তাগিদের একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে, সেটাও বেশ অদ্ভুত। পিরিয়ড পেইন নিয়ে অফিসে নিজেকে প্রমাণ করো, সহকর্মীদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করো, এই সমাজব্যবস্থার কাছে প্রমাণ করো। কিন্তু কেন? একটি অতি কমন অকুপেশন্যাল হ্যাজার্ডের জন্য, কেন একজন মহিলাকেই তা অতিক্রম করার অমানবিক প্রমাণ দিয়ে যেতে হবে? মাসের একদিন বেশি ছুটিকে ত্যাগ করে, নিজের কষ্টের দিকটিকে জলাঞ্জলি দিয়ে, যন্ত্রণা দমিয়ে প্রমাণ করতে হবে? পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সেই বিখ্যাত সংলাপ “মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা” ধরনের সুপিয়রিটি দেখানোর আদৌ কি দরকার আছে? মেট্রোপলিট্যান সিটিগুলির অত্যাধুনিক কর্পোরেট জীবন যদি ৬০০ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া ট্যাবুগুলো থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারে, তাহলে তাদের জন্য একজন নারী কেন নিজের বেদনা সহ্য করে যাবে?

যদিও আমি এই লেখাটির পুরোপুরি বিরোধিতা করি না। সমাজব্যবস্থা অসমবন্টনের শিকার, এবং লিঙ্গবৈষম্যের ভিত্তিতে রোজ তা করা হচ্ছে, লেখিকার এই সংক্রান্ত প্রতিটা কথাকে আমি সমর্থন করছি। কিন্তু তার জন্য এইভাবে নিজের ন্যায্য প্রাপ্য না নিয়ে জবাব দেওয়ার কি দরকার সত্যিই আছে? এবং যদি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি, এই ধরনের পদক্ষেপ মহিলাদের এই কোম্পানিগুলিতে যোগ দিতে আরও বেশি করে উৎসাহ দেবে বলে আমার মনে হয়। ফেমিনিজমের প্রধান একটি অ্যাসপেক্টই তো কর্মসংস্থান, তাই এই ধরনের আধুনিক এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, একাধারে যেমন পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু ভাঙবে, সেরকমভাবেই আরও বেশি মহিলাদের কাজে যোগ দিতে উৎসাহ দেবে বলেই বিশ্বাস করি, যেমনভাবে মেটারনিটি লিভ দিয়েছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...