এই লড়াই ঘৃণার বিরুদ্ধে প্রেমের লড়াই, নিরাশাকে ডুবিয়ে আশার লড়াই

মহাশ্বেতা সমাজদার

 




লেখক সমাজকর্মী, 'ভ্রমণ' পত্রিকার সম্পাদক।

 

 

লেখার কথা ছিল ক্রোধ আর ঘৃণা। লিখতে ইচ্ছে করছে আশা আর প্রেম। প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বারবার মনে পড়ে যায় কী নিশ্চিন্ত উদাসীনতায় শৈশব থেকে কৈশোর হয়ে যৌবনে পৌঁছচ্ছিলাম। গ্র্যাজুয়েশনে পড়তে ঢুকেই আঘাত এল বাবরি মসজিদ আর নিশ্চিন্তিতে। বিস্ময়ের অভিঘাতে এতটাই বিমূঢ় হয়েছিলাম সেদিন, যে ঘৃণার বোধ জন্মানোর অবকাশ পায়নি। মনে হয়েছিল, হঠাৎ এত মানুষ এত রাগল যে একটা ঐতিহাসিক স্থাপত্য তছনছ করে ফেলতে হল? চূড়ান্ত বিচ্ছিন্ন এক ভয়ানক দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখেছিলাম তাকে।

ঘৃণায় নীল হয়ে যেতে আরও দশ বছর লাগল। তখন একটা পত্রিকার সম্পাদনা করি। যাতে পিটিআই সংবাদসংস্থার ওয়েবসাইট থেকে ছবি ডাউনলোড করতে হত। খবর পাচ্ছি গুজরাটের নানা জায়গা হিংসায় দীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এমনই একদিন পিটিআই-এর ওয়েবসাইট থেকে থাম্বনেল ইমেজ দেখে পছন্দ করে হাই রেজলিউশন ছবি নামাচ্ছি। হঠাৎ একটা থাম্বনেলে দেখি, রাস্তায় একটা কালো ভালুক ঘুমোচ্ছে নাকি?

কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বড় ছবিটা নামিয়ে একা একাই আর্তনাদ করে উঠেছিলাম। একটা মানুষ পুড়ে কাঠ হয়ে পড়ে আছে আমেদাবাদের শুনশান রাস্তায়। ভয়ক্রোধঘৃণার একটা সম্মিলিত চেতনাকে চিনেছি সেদিন।

এরপর আরও একযুগ পর এল ২০১৪। হিংসা দ্বেষ ঘৃণা ক্রোধ আর কষ্ট এইসব নিয়েই চলল পাঁচ-ছ বছর। ২০১৯ শেষ হচ্ছিল শুধু অসীম অতল হতাশা নিয়ে। ৪ অগাস্ট রাতে কাশ্মিরের বন্ধুরা যখন আতঙ্ক আর বিষাদের কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল আশা শুধু বইয়ের একটা শব্দ। সত্যিকারের আশা আর কোথাও নেই। আর কোথাও কোনওদিন থাকবে না। তারপর যখন সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হল সিএএ, ক্রোধঘৃণাহতাশা মিলেমিশে এক হয়ে গেল।

তারপর হঠাৎ। হঠাৎ দেখি পূবাকাশে আলোর রেখা। নির্ভীক ছাত্রদল বুকে সংবিধান আর কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে পথে নেমেছে।প্রশ্ন করছে অসীম ক্ষমতাধর শাসককে। আর যেই না মুসলমান ছাত্ররা মার খেলে বাকি ভারত মজা পাবে ভেবে দিল্লি পুলিশ আর উত্তরপ্রদেশ পুলিশ জামিয়া আর আলিগড়ের ছাত্রদের মারল অমনি যেন জাদুমন্ত্রে জুড়ে গেল গোটা দেশ।

কিছুদিন আগেই মনে হচ্ছিল, আমাদের ঘূণধরা শিক্ষাব্যবস্থা শুধু পড়া মুখস্থ করে উত্তর লিখতে শিখিয়েছে। এখন দেখছি তা তো নয়। এরা তো বজ্রকন্ঠে প্রশ্ন করছে।

ছাত্রদলের নেতৃত্বে কোনওদিন রাজনীতি না করা নাগরিকসমাজ চলে এসেছে মিছিলে। ১৯৪৭-এর পরে আর কোনওদিন এইভাবে গোটা দেশ শাসকের দিকে তর্জনী তোলেনি।

রক্ষণশীল মুসলমান ঘরের মা বৌরা, যাঁরা তাদের শ্বশুর ভাসুরকেই কোনওদিন গলা তুলে কথা বলেননি, শিশুকোলে সেই মায়েরাও নেমে এলেন রাস্তায়। শীতের রাতে শাসকের চোখে চোখ রেখে শাহীনবাগ ঘোষণা করছে, হাম দেখেঙ্গে। রাত জাগছে পার্ক সার্কাস ময়দানও। সেখানে মুসলমান গৃহবধূর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে হিন্দু কলেজছাত্রী। স্লোগান দিচ্ছে আপাদমস্তক বোরখা ঢাকা কোনও তেজি তরুণী।

এখনও জানি না এই লড়াই কতদিন চলবে। শুরুর দিকে শোনা যাচ্ছিল জেতা না গেলেও কোনও কোনও লড়াই লড়া জরুরি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যতক্ষণ না জয় আসবে এই লড়াই চলবেই। ঘৃণার বিরুদ্ধে এই প্রেমের লড়াই, নিরাশাকে ডুবিয়ে আশার লড়াই চলতেই থাকুক যতক্ষণ না জয় আসে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...