জামলো মাকদম এবং কোয়ারেন্টিন ক্লাসরুম

শতাব্দী দাশ

 



লেখক শিক্ষক, গদ্যকার, সমাজকর্মী। লেখাতে ছবিগুলি এঁকেছেন লাবনী জঙ্গি।

 

 

 

সুপ্রভাত! কুশল তো? হেডফোন পরে নাও! এগিয়ে থাকার ক্লাসে স্বাগত। পিছিয়ে পড়া চলবে না। মাস দু-একেই খুলে যাবে ইস্কুল। করোনার পর কম্পিটিশন বাড়বে বৈ কমবে না! পড়াশুনো হচ্ছে কি ঠিকঠাক? দেখা যাক, কী আজকের পাঠ।

এই দ্যাখো, এই সূত্রে মনে পড়ল, কী আর কি কিন্তু এক নয়! লক্ষ করো।

‘পড়াশুনো হচ্ছে কি?’ হ্রস্ব ই।
অব্যয়।

আর—

‘কী আজকের পাঠ?’ দীর্ঘ ঈ।
সর্বনাম।

তেমনই আবার—

‘আমরা কী পড়ছি?’
বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক।

‘ওরা কি পড়ছে?’
না। যাদের মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভি নেই, তারা আজকাল পড়ছে না।

কিংবা—

‘আমরা কী খাচ্ছি?’
ভাত, ডাল, সবজি, ডিম, জোগান থাকলে মাছ-মাংসও…

এবার ‘আমরা’-র জায়গায় ‘ওরা’ করে দাও। আর ‘কী’-এর জায়গায় ‘কি’।

‘ওরা কি খাচ্ছে? খাচ্ছে আদৌ?’

দুম্ করে অর্থ বদলে যায়। অভিঘাত বদলে যায় নোটিসবিহীন।

এই যে আমি শিক্ষক, ইয়ে… বানান কঠিন? ‘শিক্ষক’-এর ওই ‘ক্ষ’, ওর মধ্যে আছে ক আর ষ। যুক্তাক্ষর। ‘যুক্তাক্ষর’ শব্দেও আছে দুইটি যুক্ত অক্ষর। মজার, না?  যুক্তাক্ষর দেখতে কেমন বলো দেখি? আড়াইশো মাইল পথ হেঁটে পার হবেই, পণ করেছে যে বাপ, আর সে বাপের কাঁধে চড়ে বসেছে যে শিশু, তাদের সম্মিলিত অবয়ব দেখেছ? যুক্তাক্ষর অমন দেখতে। এক অক্ষরের পিঠে আরেক অক্ষর চেপে বসে। এবার চ্যাট বক্সে গিয়ে ‘ক্ষ’ দিয়ে অন্য শব্দ লিখে পাঠাও দেখি! নিচে বাঁদিকে চ্যাট অপশন… এইতো.. রক্ষা… কক্ষ… বেশ তো! কক্ষে থাকলেই রক্ষে এখন। কিন্তু তুমি কী লিখলে সুবর্ণা? ‘ক্ষুধা’? বেশ বেশ৷ তাও হয়।

 

যা বলছিলাম, কী থেকে কি-এর অভিমুখে যাত্রাপথে হঠাৎ আলো নিবে যায়। অন্ধকার নামে। সে অন্ধকারের নাম জামলো মাকদম।

জামলো কি কিছু খেয়েছিল, নাকি খায়নি তিন দিন? তিন দিন মানে কয় ঘণ্টা? টোয়েন্টি ফোর ইন্টু থ্রি? অঙ্ক অভ্যাস করো দেখি… লিখে ফেলো চ্যাটবক্সে… সেভেন্টি টু আওয়ার্স। গুড! এইবার গুণের পর ভাগ… বলো, তিন দিনে একশো কিমি হাঁটতে গেলে দিনে কত কিমি অতিক্রম করতে হয় কচি পায়ে?

সেই তিনটি দিনের আগেই বা জামলো কী খেয়েছিল? কী? দীর্ঘ ঈ। খিদের রাতের মতো, তেলেঙ্গানা থেকে ছত্তিশগড়ের পথের মতো সুদীর্ঘ এক ঈ। শুনেছি জামলো-রা লঙ্কা খেত প্রচুর।

জামলো মাকদম৷ অদ্ভুত প্রপার নাউন। অমন নামের কোনও বন্ধু তোমাদের নেই। আদিবাসী মেয়ে। জামলোর যে জলজঙ্গলের জগত আর তোমাদের যে ফ্লুরোস্যান্ট পৃথিবী, তারা আলাদা আলাদা সরলরেখা বরাবর পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেছে ক্রমশ। কখনও মুহূর্তের কাটাকুটিও খেলেনি৷ জামলোর সঙ্গে তোমাদের তাই দেখা হওয়ার কথা ছিল না কোনওমতেই৷ নেহাত পাকে-চক্রে জামলো বিখ্যাত হল মরে গিয়ে! বারো বছুরের ছবিতে ছবিতে খবর-কাগজ ছয়লাপ… সেসব অলুক্ষুণে কথা থাক! এসো বরং রঙের খেলা খেলি। লাল লাল রংপেন্সিল দিয়ে কী আঁকা যায়? লাল বেলুন৷ লাল বল। টিয়াপাখির ঠোঁটটি লাল। কিংবা লাল লঙ্কা৷ ঘুরে ফিরে লঙ্কার কথা এসে পড়ে!

পাশের রাজ্য থেকে সীমানা পেরিয়ে এসে লঙ্কা খেতে গতর খাটাত মেয়ে। খেত থেকে টপাটপ তুলে ফেলত লঙ্কাদের। বোঁটা ছাড়াত। শুকোতে দিত৷ পেষাই করার সময় সে কী ঝাঁঝ! কাশির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠত খুদে শরীর। আর কাজের সময় ভুলেও যদি কচি হাত একবার চোখে চলে যায়… আহ, বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। জামলো তো ‘তুমি’ নও। ‘আমরা’ কখনওই ‘ওরা’ নই।

কিন্তু লঙ্কার অনেক গুণ! তেলেঙ্গানার নানহা মরিচ-শ্রমিকরা মজুরি পায় না৷ চায়ও না৷ বস্তা বস্তা লঙ্কা পেলেই চলে। বারোটি বস্তা লঙ্কায় বোঝাই করে দিলে এক বস্তা লঙ্কা উপার্জন৷ গরমের দুটো-তিনটে মাস লঙ্কা-খেতির সময়। চড়া রোদ, গনগনে হাওয়া… কিছুর তোয়াক্কা না করে জামলোরা খাটে, বস্তা দশ-পনেরো লঙ্কা নিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে। বচ্ছরকার খোরাক। খেতির পর বাপ-কাকারা শিশুর উপার্জন গোরুর গাড়িতে বা ভ্যানে বোঝাই করে ঘরে তোলে। জামলোরা সত্যিই সপরিবারে সকাল-বিকেল খায় লঙ্কার তরকারি, লঙ্কার চাটনি। লঙ্কা মুখে পড়লে জিহ্বার কোরকে কোরকে জ্বলুনি টের পেত না কি লঙ্কাখাগী, মরিচ-মজুর জামলো? জামলো মাকদম, যার রিয়াল বা ভার্চুয়াল কোনও ইস্কুল ছিল না৷ অন্য জগতের প্রাণ। সে লঙ্কার জ্বলুনি সাদরে গ্রহণ করত আরেক জ্বলুনি এড়াতে। যে জ্বলুনির নাম, ক্ষ দিয়ে ক্ষুধা!

ফেরার এত তাড়া ছিল কেন? ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে তোমাদের। অবমানবদেরও থাকে ঘরের টান? লঙ্কা বওয়ার পুরনো বস্তা আর দড়াদড়ি দিয়ে জামলোর বাপ বাড়ির পাশের কোনও গাছে তার জন্য হয়ত দোলনা বেঁধেছিল। কিংবা হয়ত বাঁধেনি। ওর কী কী খেলনা-পাতি ছিল? খড়ের পুতুল, রান্নাবাটি? ওর কি খেলনা-পাতি আদৌ ছিল কিছু? কোন পুতুল, কোন রান্নাবাটি, কোন দোলনার কাছে ফিরতে চাইছিল?

সার বেঁধে বিজাপুরের দলটি ফিরছিল। জামলোর মতো যারা আটকা-পড়া পরিযায়ী শ্রমিক। ‘শ্রমিক’-এও আছে একটি যুক্তাক্ষর। ওরা হাঁটছিল বোঝাবনত যুক্তাক্ষরের মতো। মাথায় বস্তা, কাঁখে শিশু। জামলোর সঙ্গে বাবা-মা নেই। সরল একটি একাকী শীর্ণ অক্ষর। পিছিয়ে পড়ছিল৷ সঙ্গীরা যৎকিঞ্চিৎ খাবার দিলেও, গিলতে পারছিল না। কখনও রাজপথ। কখনও জঙ্গল। জামলোর পেটে মোচড়। জামলোর হড়হড় বমি। ডিহাইড্রেশন। ইলেকট্রোলাইট ডিসব্যালেন্স। সামান্য খাবার আর জল, সামান্য ওআরএস আর আদর… সামান্য সামান্য সব জিনিস অধরা থেকে গেল বলে সে মরে গেল। মরাটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল। বাঁচার হলে এক বছর আগে মুজফফরপুরের লিচু-শ্রমিক বাচ্চারাও বেঁচে যেত না কি? ওআরএসটুকুও মেলেনি যাদের?

চাইল্ড হেল্পলাইনে ফোন করেনি জামলো? তোমরাও জানো ওই দশ-নয়-আট নম্বর।  টিভিতে দেখায়। খবরের কাগজে বেরোয়৷ স্কুলের ওয়ার্কশপে বলে দেওয়া হয়। জামলোর জানার উপায় ছিল না। চাইল্ড রাইটস কমিশন আছে ভারতের রাজ্যে রাজ্যে। তা খায় না মাথায় মাখে, জামলোরা জানে না। বড় হলে উনিশশো ছিয়াশি সালের শিশুশ্রম-বিরোধী আইনও তোমরা জানবে… কিন্তু জামলোরা সেসব জানবে না। সে আইনে চোদ্দ বছরের কম বয়সী শিশুর যে কোনওরকম শ্রমদান নিষিদ্ধ। জামলোর বয়স ছিল বারো।

জামলো একা নয়। গত মার্চের মধ্যে মরে গেছে নানা বয়সী অন্তত বাইশ পরিযায়ী শ্রমিক। উত্তর প্রদেশে বাড়ি ফেরা শ্রমিকদের সার বেঁধে বসিয়ে গায়ে কীটনাশক স্প্রে করা হয়েছে, যেন তারা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ। বান্দ্রা স্টেশনে জড়ো হওয়া শ্রমিকদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করেছে ‘নিয়মনিষ্ঠ’ পুলিশ। ওরাও জানত না, লকডাউনের সময়কাল বেড়েছে। বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে গেছিল লকডাউন ওঠার পূর্ব-নির্ধারিত দিনে। যেমন জামলো জানত না শিশুশ্রম-বিরোধী আইন। জানত না ইস্কুল, মিড ডে মিল। যেমন ভিন রাজ্যে আটকে পড়া পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক জানে না কীভাবে ‘স্নেহের পরশ’ অ্যাপ ডাউনলোড করে, কীভাবে ফিল আপ করে ফর্ম। ‘আমরা’ আর ‘ওরা’-র যত যোজনই ফারাক থাকুক, ওদের রাতারাতি হতেই হবে অ্যাপ ব্যাবহারে আমাদের সমান সিদ্ধহস্ত। নাহলে ওরা ফুটে যাবে। যেমন গেছে জামলো।

 

দুঃস্বপ্ন মনে হয়? ‘দুঃস্বপ্নে’ বিসর্গর দুইটি গোলকের মধ্যে যেটুকু ফাঁক, সেটুকুই মাত্র ভৌগোলিক ব্যবধান ছিল মৃত্যুকালে, জামলো আর ওর গ্রামের। আর মোটে দু-এক ঘণ্টা হাঁটতে পারলেই নিজস্ব খড়ের পুতুলটি জড়িয়ে ধরে মরতে পারত। কিংবা ছেঁড়া দোলনায় ঘুমিয়ে পড়ত চিরতরে। মোদ্দা কথা, মরতে ওকে হতই। আজ অথবা কাল। মৃত্যু সহজতর ছিল, বেঁচে থাকার চেয়ে।

ভুলে যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না আমাদের। এসো যুক্তাক্ষর পড়ি। রং শিখি। ইংরিজি গ্রামার। অঙ্ক। ‘ক্ষুধা’ শব্দে যুক্তাক্ষর আছে বলে বুঝতে খানিক বেগ পেতে হচ্ছে। ‘পথক্লান্তি’-তেও আছে যুক্তাক্ষর। যদিও মরণকালে খিদের চোটে শিশুর চোখে যে জল আসে, তা সততই যুক্তাক্ষরবিহীন।


অধুনা শিশুদের জুম-ক্লাস দ্বারা অনুপ্রাণিত এক কাল্পনিক ক্লাসরুম

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. প্রকৃত ভারতবর্ষ টাইটানিক ভারতের কাছে এভাবেই অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। ছুটন্ত ভারত এদের কোনো দিন খোঁজ রাখেনি। নিভৃতে দুফোঁটা চোখের জল ফেলার অবকাশ নেই। আপনার অসাধারণ টেকনিক মুগ্ধ করে দিয়েছে। সাধুবাদ জানাই।

Leave a Reply to Koushik Dutta Cancel reply