শিকলবন্দি কবি

ভারভারা রাও

 

[জেলজীবনের নোটস]

আমরা এখন সংবাদসূত্রে জানতে পারছি ভারভারা রাও অসুস্থ। ওনার পরিবার ১২ই জুলাই একটি জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আশি বছরের মানুষটির জন্য যথোপযুক্ত চিকিৎসার দাবী জানালেন। গত ২২ মাস ধরে ভীমা-কোরেগাঁও ষড়যন্ত্র মামলার এক অভিযুক্ত হিসেবে উপস্থিত থাকবার ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। গত ২৮শে মে তিনি গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ফলে ওনাকে তালোজা জেল হাসপাতালে এবং পরে সরকারি জেজে হসপিটালে স্থানান্তরিত করা হয়। এর আগে, ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষদের জেলে না রাখা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন হওয়ার পর তাঁর উকিলেরা ওনার অসুস্থতা উল্লেখ করে জরুরি অন্তর্বর্তী খারিজের জন্য ১৬ই মে একটি আবেদন করেন। কিন্তু তা শুনানি হওয়ার আগেই ওনাকে জেজে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে আবার জেলে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে এনআইএ আদালত দুটি হাসপাতাল থেকে ওনার মেডিক্যাল রেকর্ড চেয়ে পাঠায় এবং ২৬শে জুন ওনার অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন নাকচ করে, যার ভিত্তিতে বোম্বে হাইকোর্টে একটি আবেদন করা হয়েছে। 

১২ই জুলাই জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে ভারভারার স্ত্রী হেমলতা এবং ওনাদের কন্যারা জানান জেলে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে ইনি তিনবার ওনাদের ফোন করেন। প্রথম দুইবার ওনার কণ্ঠস্বর অসুস্থ শোনায়। উনি তেলুগু বলতে বলতে হিন্দিতে কথা বলা শুরু করেন। গত ১১ই জুলাই উনি যখন আবার ফোন করেন, তখন ভারভারার প্রলাপ শুনে ওনারা ভয় পেয়ে যান। উনি প্রশ্নের উত্তরগুলি ঠিকভাবে দিতে পারছিলেন না। অন্য এক জেলবন্দি ফোনে জানান ভারভারা হাঁটতে পারছেন না, ভুলভাল দেখছেন। কারও সাহায্য ছাড়া প্রাকৃতিক কর্মটিও করতে অসমর্থ– ওনার এখনই চিকিৎসার প্রয়োজন। 

২০১৯-এর নভেম্বরে ভারভারা যখন ভীমা-কোরেগাঁওর আরোপঈরা ইয়েরবাদা জেলে বন্দি এবং মামলাটি এনআইএ-র কাছে হাতবদল হয়নি, তখন তেলুগু ভাষার এই বিশিষ্ট কবি নিজের বন্দিদশার অভিজ্ঞতা লেখনীবদ্ধ করেছিলেন। ভীমা-কোরেগাঁও-এর অভিযুক্ত নয়জন হলেন ভারভারা, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, সুরেন্দ্র গাডলিং, মহেশ রাউত, অরুণ ফেরেরা, সুধীর ধাওয়ালে, রোনা উইলসন এবং ভার্নন গঞ্জালভেজ। তা এখন ‘বিকে-১১’ নামে পরিচিত আনন্দ তেলতুম্বড়ে এবং গৌতম নওলাখা জেল বন্দি হবার পর। 

ভারভারা রাও প্রসিদ্ধ তেলুগু কবি যিনি গত ৪৫ বছরে ২৫টি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। ওনাকে গ্রেপ্তার করবার ইতিহাস, লেখনীশক্তি, অধ্যাপনা, রাজনৈতিক চিন্তাধারা, ক্ষমতা ও অত্যাচারের বিশ্লেষণীক্ষমতা এবং মুক্তির সন্ধানের মধ্যেই ওনার জীবন সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি সম্ভব।

ভারভারার নিজস্ব ১৫টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যা প্রায় সব ভারতীয় ভাষায় অনূদিত। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ওনার গবেষণাপত্র, ‘Telangana Liberation Struggle and Telugu Novel – A Study into Interconnection between Society and Literature’-কে তেলুগু ভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট এক মার্ক্সীয় সমালোচনামূলক অধ্যয়ন বলে স্বীকার করা হয়। উনি নিজের যে জেলখানার ডায়রি লেখেন ১৯৯০ সালে তা ‘সহচারালু’ নামে প্রকাশিত হয়, যার ইংরেজি অনুবাদ পরে Captive Imagination নামে প্রকাশিত হয়েছে। 

ভারভারার লেখা নিজের এই অভিজ্ঞতাটি চল্লিশটির বেশি সংস্থার ঐক্যরূপ মুম্বাই রাইজেস টু সেভ ডেমোক্রেসি (এমআরএসডি)-র পক্ষ থেকে ‘A Quest for Freedom: The Story of Bhima-Koregaon’ নামে একটি পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। ওয়্যার সংবাদ পোর্টালে কিছুটা সম্পাদনার পর মার্জিত এবং সংহত রূপে তা পুনঃপ্রকাশিত হয়, যার বাংলা ভাষান্তর চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য। ভাষান্তর করেছেন সত্যব্রত ঘোষ

 

ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় কেজি কান্নাবিরন আমাকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘শিকলবাঁধা কবি’। তখন রামনগর ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯৮৬-২০০৩) অভিযুক্ত হিসেবে সেকেন্দ্রাবাদ জেলা কারাগারে ১৯৮৫-১৯৮৯ অবধি আমি নিঃসঙ্গ বন্দিত্ব ভোগ করছি। 

ইয়েরবাদা জেলে আমিই সবার শেষে এসেছি ভীমা-কোরেগাঁও হিংসা থেকে পরিণত এলগার পরিষদের মামলার অভিযুক্ত হিসেবে। 

সুপ্রিম কোর্টের থেকে দেওয়া সুযোগটি ব্যবহার করবার চেষ্টা করছিলাম আমি। যাতে সেকেন্দ্রাবাদ হাইকোর্টের দ্বারা প্রযুক্ত সুবিধাগুলি নিয়ে তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় গৃহবন্দি হতে পারি। শেষ অবধি পুনে পুলিশ নভেম্বরের ১৭ তারিখ আমাকে গ্রেপ্তার করে রাত ৮-টায় এবং ১৮ তারিখ আমাকে থার্ড অ্যাডিশনাল সেসনশ জাজ-এর সামনে পেশ করে ২৭-শে নভেম্বর অবধি জেল হাজতে পাঠায়।

নভেম্বরের ২৭ তারিখ আমাকে আদালতে পেশ করে জুডিসিয়াল কাস্টডিতে পাঠানো হয়, রাখা হয় ‘আফটার’ নামে জায়গায়, যেখানে শীতের রাত দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। সেখান থেকে ২৮ তারিখ আমাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ‘ফাঁসি ওয়ার্ডে’। একই কারণে অভিযুক্ত মুম্বাইয়ের একজনকে সেদিনই ওখানে সরিয়ে আনা হয়েছিল।

আমাকে ২০ নম্বর সেলে ওনার সঙ্গে রাখা হয়। এর পাশেই ফাঁসির মঞ্চ। মাঝখানে শুধু একটি দেওয়াল। ফাঁসি মঞ্চের উপরের অংশটি সবসময় দেখা যায় সেলটি থেকে। সেখে মনে পড়ে গেছিল সেকেন্দ্রাবাদ জেলা কারাগারে ফাঁসির মঞ্চের কথা। সেখানে আমি থাকতাম এমনই এক ‘গুঞ্জ’-এ অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের যেখানে রাখা হয়। ১৯৮৫-র ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৬-র জানুয়ারি অবধি সেখানেই ছিলাম। এর আগে আমি সেখানে ফাঁসির মঞ্চ দেখেছি। সেখানে ১৯৭৪ সালে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং আমি ভুমাইয়া আর কিষ্টা গৌড নামে দুই কিষান কমরেডদেরকে নিয়ে একটি কবিতা রচনা করি, যখন ওনাদের ফাঁসির আদেশ শোনানো হয়েছে। শেষ মুহূর্তে সেই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। (কিষ্টা গৌড-কে অবশ্য পরবর্তীকালে ১লা ডিসেম্বর ১৯৭৬ ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়।) 

যদিও মামলাধীন আসামির সংখ্যায় বরাবর এক বা দুই জনের হেরফের হচ্ছিল, এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডিতদের এই জেলা কারাগারে সরিয়ে আনা হচ্ছিল, তবে মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের সংখ্যা সবসময়ই ২০-র বেশি থাকত। এদের মধ্যে দুজন মুসলমান রাজনৈতিক আসামি ছিল যাদের বয়স ৪৫ আর ৫০। এদেরকে ২০০৮ সালের মুম্বাই ট্রেন বিস্ফোরণের মামলায় ফাঁসানো হয়। অরাজনৈতিক বন্দিদের মধ্যেও দুইজন মুসলমান ছিলেন। বাকিদের বেশিটাই দলিত, নিপীড়িত শ্রেণি, দরিদ্র, অত্যন্ত দরিদ্র মানুষ, এক বা দুইজন বাদে। এদের কেউ হয়তো শিশুধর্ষণ জাতীয় জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত। তবে অধিকাংশই নির্দোষ– সেই সব অপরাধীদের বদলি হিসেবে জেলে বন্দি, যারা আইনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবার ক্ষমতা রাখে। যেমন একটি মারাঠি তরুণীকে দলিতরা ধর্ষণ করে বলে মারাঠি গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার হয়। অবে যে দলিতদের গ্রেপ্তারের পর আসামি সাব্যস্ত করা হয়, তারা নির্দোষ তরুণ। দুই-একজন বাদে এই দলে বাকিদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে।

এই ব্লকটিকে এখন সরকারিভাবে ‘সুরক্ষা ব্লক ১’ বলা হয়। আমার জোর ছিল এই তরুণেরা। এরা ইংরেজি শিখত, ভলিবল, ক্যারাম আর দাবা খেলা এবং হাতের কাজ, আঁকাজোকা এবং গানে এরা যথেষ্ট পারদর্শী। এদের একজনের মৃত্যুদণ্ড রদ হয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে। সে এরপর কবিতা লেখা শুরু করে এবং মনেপ্রাণে নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এখন আমার মনে হয় সমাজ, আইনব্যবস্থা এবং সংসদের যে ভাবগতিক বিচারব্যবস্থায় প্রতিফলিত হচ্ছে, তা এমন কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য যা মৃত্যুদণ্ডেই সমাধান খোঁজে। 

একজন লেখক এবং অধিকাররক্ষা কর্মী হিসেবে আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। মানুষ যে নিজেকে শুধরে নিতে পারে, তা আমি মানি। বিশেষ করে অত্যাচারিত তরুণ-তরুণীরা। এখানে আমার যে কারাসঙ্গীরা আছে তারা অন্যদের সঙ্গে যথেষ্ট মানবিক আচরণ করে। এদের তুলনায় আমার মাত্র দশ মাসের সংক্ষিপ্ত কারাবাস যথেষ্ট নয়। বছরের পর বছর আমাদের ব্লক থেকে বার হতে পারে না এরা। তবুও আনন্দে থাকে, রাতের পর রাত নিঃসঙ্গ কাটানোর পরেও। এদের বেঁচে থাকবার ইচ্ছা আর জীবনতৃষ্ণা দেখে আমি বিরাট শক্তি পাই। ফাঁসির রজ্জু এদের ঘাড়ের এত কাছে ঝুলছে, তবুও অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে যে আশা একটি আলোকরেখা যে জেগে আছে, তা এরা জানে। 

সাহিত্যচর্চা আর বই পড়া বাদে এরাই আমার দৈনিক অক্সিজেন। এদের রক্তমাংসের শরীরে মায়ামমতা কম নেই।

***

 

আমাদের মধ্যে তিনজন আইনজীবী আছেন এবং এক বা দুজন ভারতীয় সংবিধান এবং বিভিন্ন আইন কীভাবে প্রণয়ন হচ্ছে, তা অধ্যয়ন করছেন, বিশেষ করে সেই কালা কানুনগুলি। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে ওনারা রাজনৈতিক কর্মী অথবা রাজনীতির ছাত্রছাত্রী হিসেবে কারাবন্দি আছেন। ইউএপিএ আইন এবং এখন অবধি তার যাবতীয় সংশোধনগুলি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। এবং সেই অধ্যয়নের জোরে সেশনস কোর্টে সমবেতভাবে বিচারব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে একটি পিটিশন ফাইল করেছেন যাতে আমাদের মামলা নিয়ে আবার শুনানি করা যায়। মৃত্যুদণ্ড, ক্রিমিনাল ল এবং রাজনৈতিক বন্দিদের বিরুদ্ধে আইনগুলি এবং দেশদ্রোহিতা সংক্রান্ত আইন ইত্যাদি নিয়ে এঁদের যথেষ্ট সূক্ষ্মদৃষ্টি আছে এবং প্রতিদিন সুপ্রিম কোর্ট আর অন্য আদালতগুলির দেওয়া বিভিন্ন রায় নিয়ে চর্চা করেন। 

আমাদের মধ্যে একাধিক মানুষ মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলিত, আদিবাসী, মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে এবং লিঙ্গভিত্তিক চর্চায় সম্পূর্ণ নিমজ্জমান। এনাদের কেউ বিজ্ঞান নিয়ে, কেউ পরিবেশ নিয়ে, কেউ পলিটিক্যাল ইকোনমি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। 

আমরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি কেন ২০১৭ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের এলগার পরিষদের সভাটিকে ‘মাওবাদী’ দ্বারা প্ররোচিত এবং তাঁদের টাকায় আয়োজিত বলা হচ্ছে। কেন সভাটিকে ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারিতে ঘটিত ভীমা কোরেগাঁও হিংসার কারণ বলা হচ্ছে, তাও আমরা বুঝতে পারছি। প্রখ্যাত লেখক অমিতাভ ঘোষ আমাকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে যখন তিনি এক তরুণ ছাত্র হিসেবে কলকাতায় থাকতেন নকশাল আন্দোলনের তুঙ্গে ওঠা সময়টিতে, তখন তিনি ওদের মতবাদ মানতেন না। কিন্তু ওনার পর্যবেক্ষণে ভীমা কোরেগাঁও হিংসাকে মাওবাদী হামলার মতো মনে হয়নি। উনি জানেন যে ওখানে দলিত, আদিবাসী, মুসলিম, ওবিসি এমনকি একশ্রেণির মারাঠি ও গণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হিংস্র ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা ষড়যন্ত্র করেছিল।

২০১৯-এর ৫ই আগস্ট আদালতে আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। এর মধ্যে আমাদের জেলজীবনের সমবেত ভাবনা এবং অনুভূতি প্রতিফলিত হয়েছে।

আমরা– তরুণ, মধ্যবয়স্ক এবং প্রৌঢ়– সবাই সংবেদনশীল এবং আবেগপ্রবণ মানুষ। বিশেষত বন্দিদশার দিনগুলিতে, যখন সারাক্ষণ আমরা সংবাদপত্র বা বই পড়ছি, যাতে কাজেকর্মে সামিল না হয়েও তথ্য, জ্ঞান এবং বোধশক্তির দিক থেকে পিছিয়ে না থাকি। আমরা মানুষ, তাই আমাদের রাজনীতি আছে। আমাদের প্রথম ব্যাচের পাঁচজনের জেলজীবন ততদিনে চোদ্দমাস অতিক্রান্ত। দ্বিতীয় ব্যাচের চারজন এক বছর সেই গৃহবন্দি দশা থেকে জেলে আছেন। অনুভূতির দিক থেকে দেখলে শুধুমাত্র মাত্রার তারতম্য।

যেহেতু আমরা ফরেনসিক ল্যাবেরটরি থেকে আসা অভিযোগের নথিপত্রগুলির অনুলিপি দেখবার দাবী জানিয়েছিলাম, আদালত তা মেনে নেয়। আদালতে সহায়ক প্রশাসনিক অফিসার নাসের-এর ঘরে সেগুলি আমাদের দেখানোর বন্দোবস্ত হয়। আমাদের হিসাব অনুযায়ী সব নথিপত্রগুলি সরবরাহ করতে অন্তত ১৯ বছর সময় লাগা উচিত ছিল। ব্যবস্থাদি আরামপ্রদই ছিল– আদালতের চৌহদ্দিতে একটি ঘরে ভালো কুর্সি, লাঞ্চে বড়াপাও আর চা, জলের বোতল, টয়লেট এবং অনুকূল পরিবেশ। অসুবিধা একটাই। যাঁরা আমাদের পাহারা দিচ্ছিলেন, তাঁরা বুঝতেই পারছিলেন না আমরা কেন এসব দেখবার জন্য তাড়া দিচ্ছি। কারণ অভিযুক্তদের পাহারা দেওয়াটা তাঁদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। 

আমাদের নয়জনকে জেলখানার তিনটি পুরুষ বিভাগে আর দুটি মহিলা বিভাগে আলাদা করে রাখা হয়েছে। এই একটি ক্ষেত্রে আমরা সবাই অন্তত পাঁচ-ছয় ঘণ্টার জন্য একত্রিত হতে পারলাম। যদিও আমাদের নিজস্ব উকিলদের সঙ্গে যখন এই মামলা এবং অন্যান্য কেসগুলির আলোচনায় বসতে হবে তখন অন্যরা হয়তো নিজেদের স্বাস্থ্য, খাবার, সাহিত্য এবং বাইরের জগতে কী ঘটছে তা নিয়ে কথাবার্তা বলবে। অনুলিপির কাজ চলাকালীন নাসেরের ঘরে আসা থেকে আবার আদালতে ফিরে যাওয়া অবধি আমাদের কোনও আত্মীয় বা বন্ধুকে ভিতরে আসবার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে। আমরা দুজন তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন থেকে শুরু করে ব্রাহ্মন্যবাদি হিন্দুত্বের সক্রিয় যোগদান যাবত মুসলিমদের অপরীকরণ (otherisation) নিয়ে আলোচনা করছি। বিভিন্ন পণ্ডিতদের লেখার কথা বলছি– সুমন্ত্র ব্যানার্জি-র উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা থেকে আদিবাসীদের কালো দুর্গা কীভাবে উঁচু জাতের ধবধবে দুর্গায় রূপান্তরিত হল, অধ্যাপক জিএন সাইবাবা (যিনি নাগপুর সেন্ট্রাল জেলের আন্ডা সেলে বন্দি)-র সাংস্কৃতিক নিরীক্ষণ এবং পিএইচডি থিসিস এবং ছয়জন ভারতীয় সাহিত্যিকের ইংরেজিতে রচিত উপন্যাস। আলোচনার মাধ্যমে আমরা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী কায়েমি স্বার্থের প্রেক্ষিতে অপর (the other)-দের বিরুদ্ধে– মুসলিম, দলিত এবং আদিবাসী ও সাধারণভাবে খেটে খাওয়া মানুষদের বিপক্ষে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের বেনিয়া চরিত্রটি গঠন করতে চেষ্টা করছিলাম। 

আমাদের সঙ্গে অভিযুক্ত এক ব্যক্তি মজার ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন ৪ঠা আগস্ট রবিবারের ‘হিন্দু’ পত্রিকায় জি সম্পতের সাপ্তাহিক কলমটি পড়েছি কি না। যেহেতু আমাদের প্রায় সবাই লেখাটি পড়ে নিয়েছেন, তাই জমাট আড্ডা শুরু হল। ছোটা ভলডেমর্ট হিসেবে আরবান মাওয়িস্ট, নাম ধরে টেররিস্ট আর অ্যান্টি-ন্যাশনালিস্ট ঘোষণা ইত্যাদি চলতে থাকল। ভলডেমর্ট একটি চরিত্র, এবং ছোটা ভলডেমর্ট কোন ব্যক্তি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

তারপরে আলোচনা সরে হ্যারি পটারকে নিয়ে চলল। আমাদের কয়েকজন জেজে রাউলিং-এর লেখা কোনও বই পড়েননি। একজন বললেন বইগুলি শুধু বাচ্চাদের জন্য নয়, তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে আমাদেরও পড়া উচিত। মজার ভঙ্গিতে কথা বলতে বলতে উনি কাগজ দিয়ে লেজওয়ালা একটি পাখি বানাচ্ছিলেন। তার ছোট্ট লেজটা টানলে ডানাজোড়া ঝাপটে ওঠে এবং ‘আজাদি’ পেয়ে আকাশে উড়ে যায়। উনি আমাকে পাখিটা দিলেন। আমরা কিছুক্ষণ খেললাম, কিন্তু হায়! আমাদের তো আর লেজ নেই যে টানা যাবে, ডানাও নেই যে ওড়া যাবে। আমরা তাই সারাক্ষণ পড়ছি, কথা বলছি, ঘুমোচ্ছি, অবচেতনে চলে যাচ্ছি, স্বপ্ন দেখছি, জেগে উঠছি, স্বাধীনতা চাইছি। প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী, এবং বিশেষ করে মানুষ তাঁদের হৃদয়ের গভীরে স্বাধীনতার আকাঙ্খার সুখ উপভোগ করেন।

বিকেল ৪টের পরে অনুলিপিগুলি হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের আবার আদালতকক্ষে আনা হল। আমরা ততক্ষণে জেনে গেছি সরকারি উকিল সেদিন আসেননি। কেউ বললেন সেদিন নাগপঞ্চমী, তাই আসেননি। ওনার সেদিন আমাদের আর্জির প্রতিবাদে বক্তব্য পেশ করবার কথা। বিচারক বললেন, সরকারি উকিল লিখিত আবেদনে জানিয়েছেন যে ১২ই আগস্ট অবধি উনি আসতে পারবেন না। তাই আগামী শুনানীর তারিখ ১৩ই আগস্ট ধার্য হল। 

আদালতে আমাদের ফেরত নিয়ে যাওয়ার আগে বিচারক অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই রক্ষীবেষ্টিত হয়ে আমাদের বাইরে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে হল। দুটি দম্পতি, দেখলে মনে হয় শ্রমজীবী, রায়পুর থেকে এসেছেন সুধা ভরদ্বাজের সঙ্গে দেখা করতে। উনি রক্ষীদের কর্তার অনুমতি নিয়ে ওদের সঙ্গে আলাপ করলেন। একজন রক্ষীকে মোতায়েন করা হল। সে অপলক দৃষ্টিতে ওদের দেখতে দেখতে (সুধা)-র কথা মন দিয়ে শুনছিল। একটা সময়ে সে উঠে গিয়ে আরেকজনকে পাহারা দেওয়ার অনুরোধ করে। সেটা আমি দেখিনি। ঠিক তখনই তদন্তকারী অফিসার এসিপি নিজের মোবাইল ফোনে মেসেজ করবার জন্য বাইরে এসে ওদের চারজনকে দেখেন সুধার সঙ্গে কথা বলছে। চারপাশে কোনও রক্ষী নেই। ইনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা সান্ত্রীকে বললেন ইন-চার্জ ডেকে আনো। ঐ চারজন সম্পর্কেও জানতে চাইলেন, বিশেষ করে ওদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ, এবং দলের নেতা গোছের মানুষটি সম্পর্কে। উনি কী বলছিলেন, তা আমি শুনতে পারছিলাম না বটে। তবে ভাবভঙ্গিতে বুঝতে পারছিলাম উনি কী জানতে চাইছেন। রক্ষীদের কর্তা এলেন। মনে হল বকুনিও খেলেন। আমি দেখলাম সুধা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে তদন্তকারী অফিসারের দিকে তাকিয়ে আছেন।     

তারপর রক্ষীদের পাহারায় আমাদের আদালতে নিয়ে যাওয়া হল। তদন্তকারী অফিসার হন্তদন্ত হয়ে আদালতে গেলেন। ঘরে ঢুকতেই সুধা দৌড়ে আমাদের উকিলের কাছে গেলেন, সম্ভবত এই অনুরোধ করতে যে বিচারকের সঙ্গে একবার যেন কথা বলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। সুধা ফিরে এসে আমার পাশে বসলেন। ওনার মেজাজ আর আবেগপ্রবণ অবস্থা দেখে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। উকিল বিচারকের কাছে অনুরোধটি পেশ করতে বিচারক যন্ত্রবৎ এক আলস্যে জানিয়ে দেন সুধাকে ওনার নিজের উকিলের মারফৎই দেখা করতে হবে, তা সে যতই জরুরি কারণ হোক। আমাদের উকিল জানালেন যে সুধার উকিল আজ আসেননি। সুধা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। বিচারক সুধার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন উনি রেগে গেছেন। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুধাকে দেখা করে কথা বলবার অনুমতি দিলেন।

সুধা ঝড়ের মতো ছুটে গিয়ে কাঠগোড়ায় উঠে বললেন, “আমার অভিভাবক নেই। পরিবারও নেই। শুধু একটি মেয়ে আছে যাকে আমার পরিবার বলে দাবী করতে পারি। আমার ইউনিয়নের কর্মচারীরাই আমার পরিবার। অনেক দূর থেকে ওনারা এসেছেন শুধু একটুক্ষণের জন্য আমাকে দেখবে বলে। ওদের পরিচয়পত্র আছে। পুলিশ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। আমার একটাই অনুরোধ, পুলিশ যেন ওদেরকে হয়রান না করে।” কথাগুলি বলে কিছুটা হালকা হয়ে সুধা নেমে এসে আমার পাশে বসলেন। আমি সাহস করে বললাম, “তুমি তো বললে পারতে, তুমি একজন উকিল আর ওরা তোমার মক্কেল।” উত্তরে সুধা শুধু বললেন, “আমি তো এখন উকিল নই।”

সরকারি উকিল যেহেতু আসেননি, তাই বিচারক আমাদের শুনানির পরবর্তী তারিখ জানিয়ে ওয়ারেন্টে সই করে দিলেন। পুলিশ রক্ষীরা এল। প্রথমে মহিলা রক্ষীরা দুই মহিলা অভিযুক্তকে নিয়ে গেল, তারপর আমাদের হেফাজতে নিল রক্ষীরা। বাইরে এসে রায়পুর থেকে সুধার সঙ্গে দেখা করতে আসা চারজনকে কোথাও দেখতে পেলাম না। জানি না সুধাও ওদের সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ পেয়েছেন কিনা। ওঁকে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনি, কারণ আলাদা গাড়িতে ওঁদের আনা হয়েছিল। জানার কোনও উপায় নেই।

পরের দিন একটি মারাঠি সংবাদপত্রে খবরটা প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা হয় সুধা আদালতে কী বলেছিলেন। সম্ভবত আমাদের মামলা মুলতুবি হবার পর সাংবাদিকটি তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে কথা বলেন, অথবা অন্য কোনও অফিসারের সঙ্গেও বলতে পারেন যিনি তখন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। খবর অনুযায়ী, পুলিসের বক্তব্য ঐ চারজন ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা-র পক্ষ থেকে এসেছিলেন। ওনাদের কাছে জায়গাটি নতুন। তাই ওদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তাই আদালতে মোতায়েন পুলিশ থানায় (‘চৌকি’-তে) নিয়ে গিয়ে রেখেছে। ওদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে খবরে কোথাও কোনও উল্লেখ নেই। 

***

 

পুনশ্চ: ৯ই আগস্ট যখন আমাদের আবার আদালত চৌহদ্দিতে নাসিরের ঘরে আনা হয়, আমি সুধাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ঐ চারজনের কী হল। উনি বললেন, জিজ্ঞাসাবাদ করে ছবি তুলে নিয়ে নিশ্চয়ই ওদের ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। “কিন্তু প্রত্যেকবার একই ঘটনা ঘটছে, এবং এই ধরনের হয়রানি থামানোর জন্যই ব্যাপারটা আমি বিচারকের নজরে এনেছিলাম। ব্যস।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...