২৬শের ধর্মঘট: এক্ষুনি এবং এখন থেকে…

অহনা গাঙ্গুলি

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী, প্রবন্ধকার

 

 

 

একটা প্রস্তুতিহীন লকডাউন, প্যান্ডেমিকের নামে প্যানিকের লকডাউন। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটলেন তাঁরা, যাঁদের মাজার জোর ছাড়া দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি আসছেন, যাচ্ছেন, তারিখ পে তারিখ বলে যাচ্ছেন আর দেশ গড়ার কারিগরেরা পথ হেঁটে চলেছেন। তারপর থেকে অবিশ্রান্তভাবে অসীমের পথে হেঁটেছে গোটা দেশ। আমরা একটা কথা খুব শুনে শুনে বড় হয়েছি। শাসকশ্রেণির অত্যাচার শুরু হয় সমাজ-অর্থনীতির সর্বোচ্চ ভার বইতে থাকা, সবচেয়ে নীচের দিকে পিষতে থাকা, সবচেয়ে কম পাওয়া আর সবচেয়ে বেশি হারানো মানুষদের দিয়ে; ক্রমশ এই অত্যাচার বিস্তৃত হয় আপামর শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে, বেড়ে চলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষের জীবন জুড়ে। লকডাউন পর্ব এক থেকে বিপর্যয়ের শুরু অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনে, দিন-আনা-দিন খাওয়া জনতার রুটি-রুজিতে; আর আনলক এক থেকে পূর্ণ আনলক পেরিয়ে আজকে পর্যন্ত এই বিপর্যয় সমাজের প্রায় সকলের। পথ হাঁটছেন প্রায় সবাই। অসীমের উদ্দেশ্যে; কেউ চাকরির খোঁজে, কেউ অসম্ভব বেড়ে যাওয়া গাড়ি ভাড়া সামলে অর্ধেক বেতনের চাকরিটুকু বাঁচাতে, কেউ একটু কম খরচে স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে, কেউ বন্ধ কারখানার নোটিস হাতে জীবনের শেষ সঞ্চয়টুকু বিক্রি করে পরিবারের কারও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, কেউ অর্ধমৃত সন্তানকে বুকে চেপে হসপিটালের দ্বারে দ্বারে হেঁটে চলেছেন… ছুটে চলেছেন একটা বেডের আশায়…

মহামারিকে তাস বানিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত কল-কব্জা ব্যবহার করে একটা উন্মাদ সরকার মানুষের, শুধু এবং শুধুই বেঁচে থাকাটুকুর অধিকার দখল করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।

এরই মধ্যে মানুষও পথে নেমেছেন। সংসদ অন্যায়ভাবে দখল নেওয়ার বিরূদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে রাজপথের দখল নিতে। পথে নেমেছেন কৃষকদের একাংশ, জমির সম্বলটুকু বাঁচাতে। পথে নেমেছেন ছাত্র-যুবরা, পথ হেঁটেছেন মহিলারা, দলিত-আদিবাসী মানুষেরা। আবার হবে লকডাউন। এবারের লকডাউন পরিকল্পিত, খেটেখাওয়া মানুষের সিদ্ধান্তে লকডাউন। সরকারের লেবেল এঁটে বসে থাকা রোগ— আরএসএস পরিচালিত বিজেপিকে রুখতে এই লকডাউন। এই রোগের পিছনে লুকিয়ে থাকা ভাইরাস— পুঁজিবাদ— উন্মুক্ত, ব্যর্থ, নগ্ন। ভাইরাসের সঠিক ভ্যাকসিনের প্রস্তুতি নিতে এই লকডাউন। ১ মাস ২৪ দিন আগে মোদি সরকারের চোখে চোখ রেখে ঘোষিত। কোনও টিভির পর্দার আড়ালে না, রাস্তায় নেমে স্লোগান-প্ল্যাকার্ড-দেওয়াল জুড়ে লিখে রাখা প্রতিরোধ— এই লকডাউনের নাম— দেশব্যপী ধর্মঘট। সরকারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার লকডাউন, ব্যবস্থাকে ঝাঁকিয়ে দেওয়ার লকডাউন— ২৬শে নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘট।

কোভিড-১৯-এর উপস্থিতি এবং এই রোগকে অবাধে বাড়তে দেওয়ার দারুণ লাউঞ্জ তৈরি করা সরকারি উদ্যোগের মাঝে এই ধর্মঘট আমাদের সকলের জন্য একদম নতুন অভিজ্ঞতা। ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশের বুকে সংঘটিত ১৯টি দেশব্যপী সাধারণ ধর্মঘটের মধ্যে সর্বোচ্চ জঙ্গি এবং সর্ববৃহৎ হতে চলেছে আগামী ২৬শের ধর্মঘট। এই ধর্মঘটকে আটকাতে মহামারির অজুহাত দেখিয়ে Disaster Management Act এবং ১৪৪ নং ধারার প্রয়োগ থাকবে। গত ২০১৪ সাল থেকে দেখতে পাওয়া ল্যাজ আর ২০১৯ থেকে সামনে চলে আসা দাঁত-নখসহ উগ্র দক্ষিণপন্থা সমস্ত কিছু ব্যবহার করে এই ধর্মঘট আটকানোর চেষ্টা করবে। যে কোনও বিষয়ে আপত্তি বা মতবিরোধ জানানোর অধিকার, ন্যূনতম নাগরিক স্বাধীনতা, সমস্তরকম গণতান্ত্রিক পরিসর এবং প্রতিষ্ঠানের গলা টিপে শ্বাসরোধ করার মধ্যে দিয়ে যে স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী কায়দার শাসন চলছে, ধর্মঘট রুখতে তার সর্ব্বোচ্চ আত্মপ্রকাশ ঘটবে। এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। এ এক অপূর্ব সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি।

পুঁজিবাদের সবচেয়ে ট্রেন্ডি মুখোশ নয়া উদারবাদ অনেকদিন হল ধুঁকছে। মহামারির কালে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আইসোলেশন থেকে ভেন্টিলেশনের পথে। নীতি আয়োগ-এর নামে মোদির ব্যক্তিগত নীতির ঝান্ডাধারীরা বলেছে— “Now or Never”। হলও তাই। আম্বানি-আদানি-বিড়লা-টাটা সকলের সম্পত্তি গড়ে ৭৩-১১৮ শতাংশ বেড়েছে, এই মহামারির সময়ে, লকডাউনের মধ্যেও। কেননা এরা বলেছে লাভের গুড় লুটে খাওয়ার এটাই মোক্ষম সময়। Now or Never! আরেকদিকে, যারা ২৬শের লকডাউন ঘোষণা করেছেন, দেশের সেই অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে অনাহারের সূচকে নেমে এলেন গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে। আর এই একই সময়ে মোদির ফ্রেন্ডজোনড লোকেদের সম্পত্তি এমনই অশ্লীল মাত্রায় বাড়ল। নেটফ্লিক্সের মতো সিরিজ ধরে মানুষ-বিরোধী, দেশ-বিরোধী অর্ডিন্যান্সগুলো আনা হল। নয়া শিক্ষানীতি থেকে তিনটে মারণ কৃষি আইন এবং দেশের পাঁজরে বেঁধানো সব থেকে বড় বুলেট— আনা হল তিনটে শ্রমিক-বিরোধী লেবার কোড। স্বাধীনতার পরে একক দল হিসেবে সংসদে রেকর্ডভাঙা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিটসংখ্যা নিয়েও উপরে উল্লেখ করা প্রত্যেকটা বিল-কোড-ড্রাফট পাশ হয়েছে বিরোধী-শূন্য অধিবেশন করে। জোর খাটিয়ে, অন্যায়ভাবে, “বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের” সম্মানহানি করে। কৃষকদের অবস্থা এমনিতেই শোচনীয় ছিল এদেশের বুকে, ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে তা জোরালো হয়। এখন তিনটে কৃষি আইন আনার ফলে মোদি সরকার সবরকমভাবে ব্যবস্থা করে দিল যাতে দেশের কৃষি-অর্থনীতি ভূমিহীন কৃষকের হাত থেকে সরাসরি চলে যায় কর্পোরেট সংস্থার হাতে— দেশি-বিদেশি মিলিয়ে। সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ ইত্যাদি সমস্ত কৃষি-পণ্য কিনতেই হবে কর্পোরেটদের কাছ থেকে, তাদের ঠিক করা দামে; এই বিপুল অর্থ ব্যয় করার পরে সেই ফসলের ন্যায্য দামটাও থাকবে ফসল ফলানো মানুষগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। খরা-বন্যা-মন্দা-পঙ্গপালের আক্রমণ যাইই ঘটুক, সরকারের দায় থাকবে না। একই কায়দায় লেবার কোড আনা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষকে এক লাফে ক্রীতদাসে পরিণত করার মেশিন তৈরি। কাজের ঘন্টা, অতিরিক্ত কাজের মজুরি, ন্যূনতম মজুরি, ইউনিয়ন করার অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার, কাজের জায়গার নিরাপত্তা— এই সমস্ত ইতিহাস দিয়ে গড়ে তোলা অধিকারগুলোকে স্থায়ীভাবে মুছে দিচ্ছে সরকার। নয়া শিক্ষানীতির গালভরা আড়ম্বরের পিছনেও আসলে ঢাকা হয়েছে শিক্ষালাভের এক্সক্লুসিভ সব কৌশল। নয়া শিক্ষানীতি থেকে সিবিসিএস পদ্ধতি হয়ে পালটে দেওয়া সিলেবাস— ছাত্রদেরকে শুধু এবং শুধুই বাধ্য শ্রমিক বানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারিকুলামকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়নের অধিকার ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধের ইতিহাসকে ছাত্রসমাজের সাংস্কৃতিক স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার পথ প্রশস্ত হয়ে উঠবে। নরেন্দ্র মোদি আর তার ঘিলুর মালিক আরএসএস ভাবছে— এক তীর অউর বহত সারা নিশান!

কিন্তু…

নরেন্দ্র মোদি ভুলে গেছেন, তীর চালানোর ইতিহাস আমাদের গড়ে তোলা। আমরা তীর ধরতে শিখেছি বীরসা মুন্ডার কাছে, সিধু-কানহু-র হাতে। ২১শে এপ্রিল, ৩রা জুলাই, ১৬-১৭ জুলাই, ৯ই অগস্ট, ৫ই সেপ্টেম্বর, ২৫শে সেপ্টেম্বর— প্রতিটা দিনের রক্তপতাকা গেঁথে গেঁথে দেশ বাঁচানোর ব্যারিকেড গড়া হবে ২৬ তারিখ। সমস্ত প্রান্তের, সমস্ত প্রান্তিকের, সমস্ত আওয়াজ এসে ২৬শে নভেম্বরের বিন্দুতে মিলিত হবে। বিন্দু বিন্দু দিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ধুর পারে কৃষক আন্দোলনের দেওয়াল উঠবে। মেহনতির শ্রেণিসংগ্রাম দিয়ে নির্মিত প্রাচীর ঘিরে ফেলবে রাজধানী দিল্লিকে, ঠিক পরের দিন— ২৭শে নভেম্বর।

নরেন্দ্র মোদির পোষ্যরা বলেছে “Now or Never”। আমরা বলছি, NOW! এখুনি! আমরা বলছি, “Now on…”; এখন থেকে… এখন থেকে চ্যালেঞ্জ করা হবে স্বৈরাচারকে। শুধুই ১২ দফা দাবী নিয়ে নয়, চ্যালেঞ্জ করা হবে গণতন্ত্রহরণের কলকব্জাগুলোকে; নাগরিক অধিকার হরণের, আপত্তিটুকু জানাতে না দেওয়ার ব্যবস্থাকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ করা হবে। আগের সমস্ত বিক্ষোভকে পুঞ্জীভূত করে, সর্বোচ্চ শক্তি সঞ্চয় করে। এই চ্যালেঞ্জের মুখে নরেন্দ্র মোদির সরকারের কাছে দুটো রাস্তা খোলা থাকবে— হয় তারা মানুষের স্বার্থে মানুষের তোলা দাবীগুলো মেনে নেবে; নাহলে একদিনের লকডাউন থেকে এই সরকারকে কমপ্লিট শাট ডাউন করে দেওয়ার শপথ নেওয়া হবে। নাজেহাল করে দেওয়া হবে এই সরকারকে, চ্যালেঞ্জ। গদি থেকে নামিয়ে ইতিহাসের পাতায় আছাড় খাওয়ানো হবে, চ্যালেঞ্জ।

পুঁজিবাদ ভেন্টিলেশনে ধুঁকছে। আজ বলে নয়, অনেক দিন। তার দালালদের রাস্তায় নামিয়ে এনে প্রতিটা রক্ত-ঘাম-রেললাইনে পড়ে থাকা রুটির জবাব চাওয়া হবে। জবাব দিতে হবে। নাহলে এখন থেকে… এখন থেকেই শুরু হবে ভেন্টিলেশন টপকে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার কাজ। এখন থেকে… ২৬শে নভেম্বর, ২০২০-র সাধারণ ধর্মঘট থেকে! NOW! NOW ON…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...