হকের লড়াই, বিপ্লবের উৎসব

পাঞ্চালী কর

 




নাট্য ও রাজনৈতিক কর্মী, লৈঙ্গিক রাজনীতি ও ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত

 

 

 

 

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ে বেড়াতে হচ্ছে, তবু তারই মধ্যে খানিকটা সময় বার করে চলে গিয়েছিলাম সিংঘু বর্ডার এলাকায়, কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি আমার সংহতি শুধু নয়, শ্রদ্ধা জানাতে— তাঁদের কথা তাঁদের মুখ থেকে শুনতে, জানতে, শিখতে। বেনারস থেকে দিল্লি পৌঁছই, তারপর সোজা সিংঘু বর্ডার। চওড়া হাইওয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরা, তাতে লেখা ‘রাস্তা বন্ধ’। কিছুদূরে একটি গেটওয়ে মাইলফলক থেকে একটি কুশপুত্তলিকা ঝুলছে, আর মাইকে ভেসে আসছে একটা সুর। সম্ভবত পঞ্জাবি ভাষায় কোনও প্রার্থনা। এই মুহূর্ত থেকেই মনে হয়েছিল যে, আমার এই সফরের অভিজ্ঞতা আলাদা হতে চলেছে।

এখানে প্রতিটা মুহূর্তে এক অদ্ভুত স্বতঃস্ফূর্ততা। চোখাচোখি হতেই প্রত্যেকে মানুষ নিজে থেকে হেসে কুশল বিনিময় করছেন। প্রত্যেক বাক্যালাপের মধ্যেই অবধারিত থাকে “খানা খায়া?” কিংবা “চায় পি লো।” একইসঙ্গে থাকে চাঁচাছোলা রাজনৈতিক বক্তব্য। একটা মুহূর্তের জন্যও মনে হবে না যে, আপনি আউটসাইডার— বহিরাগত। আপনি কি সত্যিই আউটসাইডার? এই আন্দোলন কি শুধুমাত্র কৃষকের? আমার-আপনার নয়? এই নতুন কৃষিআইন কৃষক এবং সাধারণ মানুষ, এই দুই গোষ্ঠীকেই সরাসরি আক্রমণ করেছে, শুধুমাত্র কৃষককে নয়। বিশেষত, আবশ্যিক পণ্য (সংশোধনী) আইন ২০২০, সরাসরি সাধারণ ক্রেতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষিবিল পাশ করায়, যা ইতিমধ্যে আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। আইনগুলো যথাক্রমে— ‘Farmers produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020’ অর্থাৎ কৃষকের উৎপাদন ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সুযোগ-সুবিধা) আইন ২০২০, ‘Farmers (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance, Farm Services Act, 2020’, অর্থাৎ কৃষকের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) মূল্য নিশ্চয়তার চুক্তি, খামার পরিষেবাসমূহ আইন ২০২০, এবং ‘The Essential Commodities (Amendment) Act, 2020′, অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন ২০২০।

প্রথম দুটি আইনের ফলে কৃষকরা তাদের ফসল রাজ্য সরকার অনু্মোদিত কৃষিপণ্য বাজার কমিটির বা এপিএমসির আওতায় থাকা ‘কৃষক মান্ডি’র বাইরে সরাসরি কোনও বহুজাতিক সংস্থা, হোলসেলার, পাইকারি ব্যবসাদার, রফতানিকারক সংস্থা, কোল্ডস্টোরেজ সংস্থা ইত্যাদির সঙ্গে প্রাক্‌নির্ধারিত মূল্যে চুক্তি করে বিক্রি করতে পারবে। সরকারপক্ষের যুক্তি অনুযায়ী, এই আইনের ফলে কৃষিজীবী মানুষ লাভজনক অবস্থায় থাকবেন কারণ তাঁরা মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে সরাসরি ফসলের দাম পাবেন। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থা চুক্তি অনুযায়ী মূল্য না-দিলে কৃষকেরা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন না। কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদি পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদন না-হয় এবং তার ফলে যদি কর্পোরেট সংস্থা চুক্তিমূল্য দিতে অস্বীকার করে, এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে, ক্ষুদ্র চাষিরা টাকা না-পাওয়ার পর পুঁজিপতি সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা লড়ে যাওয়ার নূন্যতম অবস্থাতেও থাকবেন না। এমনিতেই কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় এবং ঋণ মকুব না-হওয়ার ফলে কৃষকের আত্মহত্যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

অন্যদিকে কৃষক মান্ডির অধীনে বিক্রি করলে কৃষকেরা এমএসপি বা নূন্যতম সহায়ক বিক্রয়মূল্যের আওতায় সুরক্ষিত থাকবেন, যার ফলে উৎপাদন যাই হোক না কেন কিছু নূন্যতম টাকা তাঁদের প্রাপ্য হয়। কর্পোরেশনের অধীনে চলে গেলে কৃষকরা এমএসপি-র অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এই অধিকার ১৯৬০ সালের সবুজ বিপ্লবের ফলে অর্জন করা। এর আগেও আমরা দেখেছি পেপসিকোর সঙ্গে চুক্তিতে গিয়ে আলুচাষিরা কী ভয়ঙ্কর আতান্তরে পরেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, কৃষকেরা এই চুক্তিতে লাভবান হবেন কারণ আলু চাষের সমস্ত টাকা আগাম দিচ্ছিল কোম্পানি। এরপর একটা বস্তায় একটা আলু পচা বেরোলে বস্তা ধরে বাতিল এই ধরনের নানা অছিলায় বা উৎপাদন যথেষ্ট নয় এই মর্মে চাষিদের হেনস্থা শুরু করে এবং আগাম দেওয়া টাকা ঋণের বোঝার মতো চাষিদের মাথায় চেপে বসে। উপরন্তু পেপসিকোর চিপ্‌সে ব্যবহৃত আলু অন্যত্র উৎপাদন করার অভিযোগ এনে চাষিদের বিরুদ্ধে মামলা করে পেপসিকো। কর্পোরেট কখনওই গরিব চাষি, মজুর, মানুষের স্বার্থ দেখে না, তাদের মূল লক্ষ্য যেকোনও মূল্যে ব্যবসাবৃদ্ধি। প্রথম দুটি আইন কার্যকর হলে হাজার হাজার চাষি একইরকম সমস্যার সম্মুখীন হবেন।

তৃতীয় বিল অনুযায়ী খাদ্যশস্য, তৈলবীজ, ডালশস্য, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি আর অত্যাবশ্যক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না, এবং এর ফলে এইসব পণ্য মজুত করার ক্ষেত্রে বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে কোনও সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া যাবে না। চাষ হওয়া ফসল সোজাসুজি চলে যাবে বহুজাতিক সংস্থার গুদামে, যার প্রভাবে তৈরি হবে আরোপিত খাদ্যসঙ্কট। সেই সুযোগে কর্পোরেট সংস্থা চড়া দামে খাদ্যসামগ্রী বাজারে ছাড়বে যা থাকবে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এখনই ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে আলু কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ফলে, আইন কার্যকর হওয়ার পর খাদ্যের অধিকারের ওপর কোপ পড়বে নিশ্চিতভাবে।

আন্দোলনরত চাষিরা এই আইনগুলো সম্পূর্ণভাবে খারিজ না-হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর, এবং তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হাজারো মানুষ। সম্পন্ন চাষি যেমন আছেন, যিনি ব্র্যান্ডেড জ্যাকেট পরেন, যাঁর একাধিক ট্র্যাক্টর আছে, তেমনই তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনের ময়দানে সামিল একেবারে প্রান্তিক ও ভাগচাষিরা। প্রত্যেকটি মানুষ যথাসাধ্য কন্ট্রিবিউট করছেন আন্দোলনে। কেউ বাড়ি থেকে গরম গরম জিলিপি বানিয়ে এনেছেন লরি-বোঝাই করে, কেউ বা ছোট সাইকেল ভ্যানে আলু আর রাঙাআলুর চাট নিয়ে এসেছেন। অসাধারণভাবে দুই শ্রেণির মানুষই একইরকম মর্যাদা পাচ্ছেন― গরিবির কুণ্ঠা নেই, বিত্তের অহঙ্কার নেই। সাচ্চা কমরেডশিপের অবাধ প্রদর্শনী এখানে। সব চাইতে ভাল বিষয় যে, সম্পন্ন চাষিরা এই সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি, তাঁরা ভাবেননি কর্পোরেটদের পক্ষ নিলে তাঁদের লাভ। তাঁরা অশনিসঙ্কেতটিকে আগাম চিহ্নিত করতে পেরেছেন এবং রাতের পর রাত প্রবল ঠান্ডার মধ্যে খোলা আকাশের নীচে তাঁবু খাটিয়ে রয়েছেন।

আন্দোলনের ময়দানের একেবারে লাগোয়া একটি নির্মীয়মাণ বাড়ি, সম্ভবত কোনও হোটেল বা শপিং সেন্টার তৈরি হচ্ছে। তার একটি তল জুড়ে ঢালাও বিছানা পাতা, আন্দোলনরত মানুষেরা অনেকে এখানে রাতে থাকছেন, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে। আমরা রোজ দিল্লি থেকে যাতায়াত করব শুনে একজন বললেন, প্রতিদিন সকালে এতদূর আসার চেয়ে তাঁবুতে থেকে গেলে সুবিধা হবে। নিজে থেকেই সব ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হলেন।

পাঞ্জাবি এবং শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের আতিথেয়তার কথা আমরা সবাই জানি। এই আতিথেয়তা রাজনৈতিক, পরম স্নেহে চায়ের সঙ্গে পাউরুটি এগিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক— কারণ রাজনীতি জীবনের থেকে আলাদা নয়। তাই নীল পোশাক পরা নিহাঙ্গ সম্প্রদায়ের শিখদের দেখা যায় এক হাতে তলোয়ার ধরে অন্য হাতে বিশাল এক গামলা ফুটন্ত চায়ে চিনি মেশাতে। তাই বৃহদাকার একটা কড়াইতে অড়হর ডাল নাড়তে নাড়তে সরদারজি কৃষিআইন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। মিছিল ও লঙ্গর, পোস্টার লেখা ও মেডিকেল ক্যাম্প, স্লোগান ও প্রার্থনা, বক্তৃতা ও আতিথেয়তা— সব পাশাপাশি চলতে থাকে। এক বয়স্ক ভদ্রলোক এক কাপ স্যুপ এনে আমার হাতে দিয়ে বলেন, “খেয়ে নাও, ঠান্ডি বহোত হ্যায়।” তেমনই এক পুস্তিকাবিক্রেতা বইয়ের দাম দিতে হবে না জানিয়ে বলেন― “এমনিই নিয়ে যাও, কিন্তু পোড়ো, আর বাকিদেরও পড়িও।” হকের লড়াইতে কার্পণ্য থাকে না, তাই লঙ্গরে মকাইয়ের রুটি আর সর্ষে শাক নেওয়ার পর হাতে একটুকরো মাখনও দিচ্ছেন হাসিখুশি এক যুবক। এখানে মানুষ যে একে অপরের কমরেড তা প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ব্যবহারে প্রকাশ পাচ্ছে। শহুরে পরিবেশের আন্দোলনে আমরা সচরাচর যে ধরনের “আমি তোমার কমরেড” জাতীয় মৌখিক আশ্বাস শুনতে অভ্যস্ত, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ভালোলাগা, ভরসা, বিশ্বাসের নিরাপদ ক্ষেত্র তৈরি হয়ে উঠছে অনায়াসে, যা কিনা আমার পরিচিত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ বিরল।

কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন কলকাতার প্রতিক্রিয়া কী এই আন্দোলনের প্রতি, বিরাট মিছিল হয়েছে শুনে ছবি, ভিডিও দেখতে চেয়েছেন। কেউ কেউ তাঁদের বেড়ে ওঠার গল্প, পরিবারের গল্প, চাষাবাদের গল্প বলেছেন। একটি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, যাঁরা বাংলার রাজনীতি নিয়ে আশাবাদী কারণ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলা এবং পঞ্জাবের মানুষেরা; তাঁদের বিশ্বাস, বিজেপি-র সাম্রাজ্যবাদকেও আমরা খতম করব হাতে হাত মিলিয়ে।

এককোনায় খাটিয়া পেতে পাগড়ি বেঁধে দিচ্ছিলেন কিছু মানুষ। আমরা শিখ ধর্মাবলম্বী নই জেনেও তাঁরা পাগড়ি বাঁধতে রাজি হয়ে গেলেন এক কথায়, শুধু মনে করিয়ে দিলেন পাগড়ির ঈমানের কথা, তা ক্ষুণ্ন যেন না-হয়। আমার বন্ধুর মাথায় গেরুয়া পাগড়ি বাঁধা হচ্ছিল, অনেকদিন পর গেরুয়া রং দেখে ভয় করেনি, বরং ভরসা পেয়েছি।

যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে, সেটা হল এই আন্দোলনের প্রতি সামগ্রিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সহমর্মিতার বোধ— পুরুষ, মহিলা, জোয়ান, বৃদ্ধ এমনকী স্কুলে-পড়া বাচ্চারা পর্যন্ত এই আন্দোলনকে দু হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। বিশেষত মহিলাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে কথা এখানে অবশ্যই উল্লেখ করার মতো। আমরা প্রায়শই মহিলা কমরেডদের মিটিং মিছিলে খাবার সাপ্লাই করাকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে ভুলে যাই যে, হেঁশেলের বাইরের মূলধারার যে রাজনৈতিক কাজ রয়েছে, তা তাঁরা করার সুযোগ পাচ্ছেন না হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতে। ভুলে যাই যে, উত্তর ভারত কত বেশি নারীবিদ্বেষী তা নিয়ে চর্চা চালানোর সময় খিদে পেলে যে রুটিগুলো আমরা খাই, তা বানান আমাদের মা বোনেরাই। আর সিংঘু-তে দেখে এলাম, উত্তর ভারতীয় কিষাণদের বহুত মরদাঙ্গি নিয়ে পরম যত্নে রুটি সেঁকার ছবি। সে ছবি দেখে মনভরে গিয়েছে।


*লেখার ভেতরের সব ছবি লেখকের সৌজন্যে

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4643 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...