দানিল হার্মসের দুটি গল্প

দানিল হার্মসের দুটি গল্প | অভিষেক ঝা

অভিষেক ঝা

 

দানিল হার্মস (১৯০৫–১৯৪২) সোভিয়েত-রাজ চলাকালীন সক্রিয় এক সোভিয়েত-রাজবিরোধী স্বর। মজাকে তিনি এমনভাবে তার লেখায় হাতিয়ার করে তোলেন যে খুব ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সব গঠনতন্ত্র হয়ে ওঠে খিল্লির বিষয়। তাঁর পৈতৃক উপাধি ‘ইভানোভিচ ইয়ুভাশভ’ বাদ দিয়ে ‘হার্মস’ (Kharms) বেছে নেওয়ার ভিতর দিয়েই ‘charms’ ও ‘harms’-এর মজাদার ম্যাজিকাল খিল্লির শুরু। ছোটদের জন্য তার লেখালেখি সোভিয়েত বিরোধিতা করছে এই অভিযোগে ১৯৩১-এ জেলে যেতে হয়। ছাড়া পেলেও সবসময় তাঁকে কড়া নজরদারিতে রাখা হত। হার্মস ম্যাজিকের সমাপ্তি ১৯৪২-এ সোভিয়েতবিরোধী স্বরের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে মানসিক হাসপাতালে বন্দি অবস্থায়। ১৯৮০-র আগে তার লেখা রাশিয়ায় প্রকাশিত হতে দেওয়া হয়নি।

বর্তমান গল্প দুটি রুশ ভাষায় লেখা। বাংলায় তর্জমা করা হয়েছে তার ইংরাজি অনুসৃজন থেকে।

যোগসূত্র

দার্শনিক!

১) তোমার সেই চিঠির উত্তর লিখতে বসেছি যা তুমি আমায় লিখতে চাইছ আমার সেই চিঠির উত্তরে যা আমি তোমায় লিখেছিলাম।

২) এক বেহালাবাজিয়ে তার বেহালার জন্য একটি তার কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে পড়লেন কিছু গুণ্ডার খপ্পরে আর ধ্বস্তাধ্বস্তিতে তাঁর টুপি গেল খুলে। বাতাসে ভেসে সেই টুপি আপন রাস্তা ধরল।

৩) তারটার ফেলে বেহালাবাজিয়ে টুপির পেছনে লাগালেন দৌড়। টুপিটা ঝুপ করে গিয়ে পড়েছিল একদলা নাইট্রিক অ্যাসিডে। ফলত গলে গেল।

৪) সেই ফুরসতে গুণ্ডারা বেহালার তার নিয়ে দিল চম্পট।

৫) কোট ও টুপি ছাড়াই বেহালাবাজিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন কারণ টুপিটা নাইট্রিক অ্যাসিডে গলে গিয়েছিল আর টুপির শোকে বেহালাবাজিয়ে নিজের কোটটা ট্রামে ভুলে গেলেন।

৬) সম্ভবত ট্রামের কন্ডাক্টর কোটটা নিয়ে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড দোকানে গিয়েছিল। কোট বেচার টাকায় খানিক জইয়ের ছাতু আর অনেক টমেটো কিনেছিল।

৭) সেই কন্ডাক্টরের শ্বশুর কী বলব আর বাল সব কয়টা টমেটো খেয়ে ফেলল! এবং পগার পার। কন্ডাক্টরের শ্বশুরের বডি মর্গে থাকাকালীন ব্যাপারগুলো একটু ঘেঁটে যায় আর সেই কন্ডাক্টরের শ্বশুরের জায়গায় কোনও একলা ওয়ারিশ বুডঢিকে কবর দেওয়া হয়।

৮) বুড়িটার কবরের উপর একটা সাদা স্মৃতিফলক লটকানো হয়। তাতে খোদাই: ‘আন্তন সারগেভিচ কোন্দ্রাচেভ’।

৯) এগারো বছর পর ফলকটা পড়ে গেল, পোকায় কুরে কুরে খেয়েছিল সবটুকু। এবং ফলকটাকে কবরখানার দারোয়ান পড়ে থাকতে দেখে চার টুকরো করে উনুনের ভিতর চালান করে দিল। আর তার বউ সেই আগুনেই একটা ফাটাফাটি ফুলকপির ঝোল রেঁধেছিল।

১০) ঝোলটা যখন প্রায় হয়ে এসেছে দেওয়াল থেকে ঘড়িটা সটান পড়েছিল ঝোলের কড়াইয়ে। ঝোল থেকে ঘড়িটা তোলা গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঘড়িটায় ছিল বহুতদিনের সব ছারপোকা আর তারা ততক্ষণে ঝোলে। টিমোফি নামে এক ভিখিরিকে ঝোলটা দিয়ে দেওয়া হল।

১১) টিমোফি ঝোল, পোকা, আর সবকিছু চেটেপুটে খায় আর নিকোলে নামের আরেক ভিখমাঙনাকে কবরখানার দারোয়ানের দরাজ দিলের কথাও বলেছিল।

১২) পরদিন নিকোলে কবরখানার দারোয়ানের কাছে যায় আর ভিক্ষার জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করে। কিন্তু কবরখানার দারোয়ান নিকোলেকে কিচ্ছুটি ভিক্ষা দেয়নি। উলটে তাফাল দিয়ে ভাগিয়ে দেয়।

১৩) হিসাব না মিলায় নিকোলের ঝাঁট জ্বলে যায়। ভিখারিচোতটা কবরখানার দারোয়ানের ঘরে ফুরসত বুঝে দেশলাই মেরে দেয়।

১৪) আগুন ঘর থেকে গির্জায় ছড়িয়ে পড়ল আর গির্জাটা ছাই হয়ে গেল।

১৫) একটা বিশাল লম্বা তদন্ত চলেছিল, কিন্তু আগুনের কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারা গেল না।

১৬) আগে যেখানে গির্জাটা ছিল সেখানে একটা ক্লাব বানানো হল আর ক্লাবের উদ্বোধনের দিন একটা কনসার্টের আয়োজন করা হল যেখানে বাজালেন সেই বেহালাবজিয়ে যিনি চোদ্দ বছর আগে তাঁর কোট খুইয়েছিলেন।

১৭) এবং দর্শকদের মধ্যে বসেছিলেন সেই গুণ্ডাদের একজনের ছেলে, যারা চোদ্দ বছর আগে ধাক্কা দিয়ে বেহালাবাজিয়ের টুপি ফেলে দিয়েছিল।

১৮) কনসার্টের পর তাঁরা একই ট্রামে বাড়ি ফিরছিলেন। কিন্তু যে ট্রামটা তাদের ট্রামের পিছু পিছু আসছিল, সেটার ড্রাইভার হল গিয়ে ওই কন্ডাক্টর যে ফাঁকতালে বেহালাবাজিয়ের কোটটা সেকেন্ড-হ্যান্ড দোকানে বেচে দিয়েছিল।

১৯) এবং তাই তারা এখন এবং এখানে। শেষ সন্ধ্যায় শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে: সামনে রয়েছেন সেই বেহালাবাজিয়ে আর সেই গুণ্ডার ছেলে; আর তাদের পিছনে সেই লোক: বর্তমান ট্রাম-ড্রাইভার ও পূর্বতন কন্ডাক্টর।

২০) তারা ঘুরে বেড়াতেই থাকে আর জানতেও পারে না তাদের ভিতরকার যোগসূত্র। এবং মরার দিন অবধি এটা তারা কখনওই জানতে পারবে না।

 

স্বপ্ন

কালুগিন ঘুমিয়ে পড়ল আর একটা স্বপ্ন দেখল: সে একটা ঝোপে বসে আছে আর একটা পুলিশ হেঁটে হেঁটে ঝোপটা পেরুচ্ছে।

কালুগিন ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছিল। নখ দিয়ে মুখ চুলকে আবার ঘুমোতে গেল আর আরেকটা স্বপ্ন দেখল: সে হেঁটে হেঁটে একটা ঝোপ পেরুচ্ছে আর একটা পুলিস সেই ঝোপে লুকিয়ে বসে রয়েছে।

কালুগিন ফের উঠে পড়েছিল। মাথার তলে একটা খবরের কাগজ রাখল যাতে বালিশ লালায় ভিজে না যায়, আবার ঘুমোতে গেল; আবার সে স্বপ্ন দেখল: সে একটা ঝোপে বসে আছে আর একটা পুলিশ হেঁটে হেঁটে ঝোপটা পেরুচ্ছে।

কালুগিন উঠে পড়েছিল ধড়ফড়িয়ে। খবরের কাগজটা পালটাল, বিছিয়ে নিল এবং আবার ঘুমোতে গেল। এবং আরেকটা স্বপ্ন দেখল: সে হেঁটে হেঁটে একটা ঝোপ পেরুচ্ছে আর একটা পুলিস সেই ঝোপে বসে রয়েছে।

অবস্থা বেগতিক বুঝে কালুগিন সটান উঠে পড়েছিল আর ঠিক করেছিল যে আর ঘুমোবে না। কিন্তু শিগগিরই সে ঘুমিয়ে পড়ল আর একটা স্বপ্ন দেখল: সে একটা পুলিশের পেছনে বসে রয়েছে আর কিছু ঝোপঝাড় সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

কালুগিনকে গোঙায় ধরেছিল আর সে বিছানায় এদিক সেদিক করেছিল, কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারেনি।

টানা চারদিন আর চাররাত ধরে কালুগিন ঘুমাল। এবং পঞ্চম দিনে সে যখন উঠল এতটাই খ্যাংরাকাঠি হয়ে গিয়েছিল যে জুতোয় তার পেঁচিয়ে পায়ে গলাতে হল যাতে খুলে না যায়। যে বেকারি থেকে কালুগিন সবসময় গমের পুরো একটা পাউরুটি কিনত, তারা তাকে চিনতেই পারল না আর হাফ-রাই পাউরুটির একটা টুকরো হাতে ধরিয়ে দিল।

একটি জনস্বাস্থ্যকমিশন যা ঘরে ঘরে তখন টহল দিচ্ছিল, কালুগিনকে দেখতে পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে সে জনস্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক এবং কোনও কাজেই লাগার নয়। সেই কমিশন জমাদারদের নির্দেশ দিল জঞ্জালের সাথে সাথে কালুগিনকেও ছুড়ে ফেলা হোক।

কালুগিনকে দু-ভাঁজ করে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা হল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4821 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...