কৃষক আন্দোলন: সুড়ঙ্গের শেষে একফালি আলোর রেখা

মেঘ শান্তনু

 




কবি, সম্পাদক

 

 

 

 

সোনার ফসল ফলায় যে তার
দুই বেলা জোটে না আহার …

সংখ্যাটা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান। কিছু মানুষ পৃথিবী থেকে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেলেন। ৫৭ জন। পার্লামেন্টে বিল পাশ হওয়ার পর থেকে এই লেখা শুরু করা অবধি মোট মৃত্যুর সংখ্যা। সমাধানসূত্র এখনও অধরা। আরও কত মৃত্যু হলে রাষ্ট্রের টনক নড়বে আপাতত বোঝা যাচ্ছে না।

ধরা যাক কাশ্মির সিং-এর কথাই। বয়স ৭৫। নিবাস— উত্তরপ্রদেশের রামপুর। সবার কাছে তিনি আদরের ‘বাপু’ নামে পরিচিত। কে কল্পনা করেছিল এই বয়সে পৌঁছে স্বাধীন দেশের মাটিতে নিজের জমি ও ফসলের অধিকার সুনিশ্চিত করার আন্দোলনে তিনি প্রতিবাদস্বরূপ আত্মহত্যা করবেন! গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার আগে তিনি একটি চিঠি লিখেছেন। তাতে সরকারের কালো আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন যেন প্রতিবাদস্থলেই তাকে দাহ করা হয়।

বাবা রাম সিং। বয়স ৬৫। হরিয়ানার একটি গুরুদ্বারের পুরোহিত। আন্দোলনের ২১তম দিনে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। সুইসাইড নোটে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানিয়ে সরকারি আইনের প্রতি প্রতিবাদ জানাতে নিজেকে উৎসর্গ করার কথা লিখে গেছেন।

এমন আরও কত! মনে পড়ছে এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ অজয় মুরের কথা। ৩২ বছরের তরতাজা যুবক। নিবাস সোনিপত। টানটান চেহারার কৃষক যুবা। আন্দোলনের ১৩ দিনের মাথায় স্রেফ ঠান্ডায় জমে মরে গেলেন। খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়েছিলেন রাতে, আর সকাল দেখা হল না।

এইভাবেই সামসের সিং, কুলবীর সিং-এর মতো কিছু মানুষ বর্তমানে যাঁর যাঁর বাড়ির দেওয়ালে প্রিয়জনদের মাঝে ছবি হয়ে ঝুলে আছেন। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।

ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমে যেমন তীব্র ঝড় ওঠার কথা সেই উত্তাল হেলদোল বর্তমানে অনুপস্থিত। স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে যারা পরিচিত তারা অনেকাংশেই তাঁবেদার হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদ ও ক্ষমতার। লড়াইটা তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সরাসরি শাসক ও শোষিতের। অথচ যদি রাষ্ট্রের তথাকথিত সমস্ত নাগরিক সমাজ একসঙ্গে আজ মিলিতভাবে সোচ্চার হতে পারতাম, চেঁচিয়ে উঠতে পারতাম, তাহলে চিত্রটা আরও ব্যাপক হতেই পারত।

রাস্তা-ঘাটে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও খুব বেশি আলাপ আলোচনা নেই। ভোগবাদী সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে আমরা যারা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, নিজেদের পেটে সরাসরি পদাঘাত না পড়া পর্যন্ত তাদের কিছু এসে যায় না। তাই ক্রিসমাস, নিউইয়ার, আনন্দ, উৎসব, সিনেমা, সিরিয়াল নিয়ে মেতে থাকতে থাকতে আর যে কোনও বিতর্ক আর বিপদ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চলতে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকা প্রান্তিক মানুষদের কথা মনেই থাকে না। এত বিরাট মাপের একটা কৃষক আন্দোলন ভারতের বুকে গত কয়েক দশকে একটিও হয়নি, অথচ সব‌ই চলছে এক‌ইরকম। যেন কিছুই হয়নি।

তবু সবটাই হয়তো এত অন্ধকার নয়।

সাহিত্য, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি সরাসরি কৃষকদের সংহতি ও সমর্থন জানিয়েছেন। প্রবাসী ভারতীয়দের একটা অংশ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই বিপুল দেশের নাগরিকদের একটা অংশ সচেতন হয়ে উঠছেন, প্রতিবাদে পথে নামছেন। আগামী দিনে এভাবেই আরও মানুষ এগিয়ে আসবেন, আরও তীব্র আকার ধারণ করে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে এই আন্দোলন। তার লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। এই আশাটুকুই আলো দেখায়। ভরসা দেয়। স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখে।

গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল একটা দেশ। এখনও ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষিক্ষেত্রের উপার্জনের উপর নির্ভর করে সংসার চালান, বেঁচে থাকেন। অথচ সেই দেশেই সবচেয়ে অবহেলিত জমির উপর নির্ভরশীল এইসব মানুষরা। সারা দেশের গ্ৰাসাচ্ছাদনের ভার যাঁদের উপর তাঁরা কেমনভাবে বেঁচে আছেন তার খবর আমরা রাখি না! শুধু ২০১৯ সালেই আত্মহত্যা করেছেন ১০২৮১ জন কৃষক, এর বাইরেও রয়েছে অনেক মৃত্যু যেগুলো নথিভুক্ত হয়নি। অভাবনীয়। এই ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার কর মকুব করে দেওয়া যায় অনায়াসেই। অথচ ফসল বিক্রি করে, জমি বিক্রি করেও কৃষি ঋণ শোধ করতে না পেরে মৃত্যুর পথ বেছে নেন প্রতি বছর হাজার হাজার চাষী। কে আর ভাবে ওদের কথা! ধুর আমাদের আম্বানি, আদানি, পতঞ্জলি রয়েছে না!

ক্যাপিটালিজম এক এমন দৈত্যের নাম যার সর্বগ্ৰাসী খিদে একটা গোটা সমাজকে কিভাবে ধীরে ধীরে গিলে নেয় তার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে নীরবে সেটাকেই রীতি বলে ধরে নিতে যখন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে একটা গোটা নাগরিক সমাজ, ঠিক তখনই হঠাৎ ফুলকির মতো একটা যেন আগুন জ্বলে উঠল। আর তা ক্রমশ আরও ছড়িয়ে পড়তে পড়তে কাঁপিয়ে দিচ্ছে মসনদে আসীন পুঁজিবাদের প্রতিনিধিদের। চিন্তার ভাঁজ পড়েছে শাসকের কপালে। এই অতিমারির সুযোগ নিয়ে কত বিল পাশ করিয়ে নেওয়া গেছে পার্লামেন্টে। কত আন্দোলন, প্রতিবাদ দমন করা গেছে সহজেই। এত বেগ আগে পেতে হয়নি। প্রায় ফাঁকা রাজ্যসভায় কত সহজেই এবারেও পাশ করা গিয়েছে, কৃষি ও শ্রম আইন। তাহলে হিসাব মিলল না কেন! এরা কারা! এত সাহস এরা পেল কোথা থেকে! এরা সেইসব দরিদ্র, বোকা, সরল আপনার আমার দেশের মানুষ হুজুর। শোষিত হতে হতে একদিন ঠিক জেগে ওঠে, ভয় ধরিয়ে দেয় প্রচলিত শোষণের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে। মিটিং, মিছিল, সভা করে সহস্র কন্ঠে সমবেত চিৎকার করে শপথ নেয়, ‘মরতে দম তক হিম্মত নেহি তোড়েঙ্গে’। রাজধানীর সীমান্তে বসে থাকে অবিচল ভঙ্গিতে, হাতে প্ল্যাকার্ড, ‘অপনা জমিন, অপনি আজাদি’।

৩৯টা দিন কেটে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সিংঘু, টিকরি, গাজিপুর দিল্লির এই তিনটি সীমান্তে প্রবল হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে কৃষকরা বসে আছে। শত শত মাইল পথ অতিক্রম করে ওরা এসেছে জমি জীবন ফসলের লড়াইয়ে অংশ নিতে। এরা কিছুতেই কর্পোরেট দাস হবে না। চুক্তিচাষ করবে না।  ফুরিয়ে আসছে রসদ। অসুস্থ হয়ে পড়ছে সহযোদ্ধারা। মরে যাচ্ছে একে একে অনেকে। তবু ওরা থামবে না। ভয় পাবে না। এই ওদের সঙ্কল্প। এই লেখা যখন লিখিত হচ্ছে তার ঠিক আগে থেকেই প্রবল শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ভিজে গেছে রান্নার জন্য জড়ো করে রাখা কাঠ, গায়ে দেওয়ার কম্বল। খাদ্যাভাব, ওষুধপত্রের অভাব। আন্দোলন, ধর্না, প্রতিবাদ যেখানে চলছে, সেখানে জায়গায় জায়গায় জল জমেছে। তাঁবুতেও ঢুকে পড়েছে জল। তবু কিছু এসে যায় না। এরা জানে কিভাবে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। তোমার হাতে পুলিশ আছে, আইন আছে, অস্ত্র আছে, আমাদের আছে সঙ্কল্প।

এই আন্দোলনের আরেকটি বড় তাৎপর্য হল মহিলাদের অংশগ্রহণ। জীবন, জীবিকার লড়াইয়ে তারা একচুলও পিছিয়ে নেই, যাদের মধ্যে অনেকেই কোনওদিন নিজের গ্ৰামের বাইরে অবধি পা দেয়নি, আজ রাষ্ট্রের সঙ্গে এই অসম লড়াইয়ের দিন তারা লজ্জা, ভয়, খিদে উপেক্ষা করে নেমে পড়েছেন পথে। কোলে বাচ্চা, রুগ্ন, গায়ে ছেঁড়াফাটা চাদর, মলিন মুখগুলো হারতে চায় না। চোখে তেজ আর সঙ্কল্পের সেই জোর হতবাক করে দিচ্ছে প্রবল প্রতাপশালী রাষ্ট্রশক্তিকে।

আন্দোলন দমনের পন্থা হিসেবে শাসকের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছে খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদের তত্ত্ব। আবার বলা হচ্ছে মাওবাদী ও আর্বান নকশাল যোগের কথা। কিন্তু সমস্যা হল এসব কোনও কিছুই আর তেমনভাবে এই আন্দোলনের পক্ষে একটু একটু করে বেড়ে চলা জনসমর্থন ও আবেগকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। গত বহু বছর এমন ব্যাকফুটে আর কখনও যেতে হয়নি এই সরকারকে। কৃষকদের নিজেদের মধ্যে সংহতি, দৃঢ়তাও ঐক্যে একটুও চিড় ধরানো যায়নি। ওরা শেষ দেখে ছাড়বে।

ইতিহাস সাক্ষী দেয় একটা আদ্যোপান্ত ফ্যাসিস্ট, পুঁজিবাদের দোসর সরকারের পতন কীভাবে অনিবার্য হয়ে ওঠে। দেশে কোনও সংগঠিত শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। ধর্ম আর পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে মগজধোলাই করে দেওয়া হয়েছে একটা বড় অংশের মানুষকে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সামরিক বিভাগ থেকে সংবাদমাধ্যম সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জা করার প্রচেষ্টা চলছে চোখের সামনে। তবু এত দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের‌ও হিসেবে একদিন ঠিক গড়মিল হয়েই যায়। আর সেটা তখনই হয় যখন মানুষ সংগঠিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অধিকার আদায়ের জন্য নেমে আসে পথে। প্রান্তিক মানুষ। কৃষক। শ্রমিক। চাষাভুষো মানুষ। যাদের অনেকেই রাজনীতি বোঝে না। সংবিধান পড়েনি। অথচ সম্মান আর অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করতে জানে। আগামী দিনের ঝান্ডা এদেরই হাতে। এই কৃষক আন্দোলন, সুড়ঙ্গের শেষে এক ফালি আলোর রেখা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...