ট্রাক্টর চলুক মধ্যবিত্তের চেতনায়

চার্বাক মিত্র

 

রাজনৈতিক ভাষ্যকার

আদত যে কথাটা বোঝা গেল, কৃষি আন্দোলন নিয়ে এই দেশের রাজনীতি জানাবোঝা মধ্যবিত্তের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। রাজদীপ সরদেশাই দিনকয়েক আগে হিন্দুস্তান টাইমসের উত্তর সম্পাদকীয়তে সেকথা স্পষ্টাস্পষ্টি লিখেছেন। তিনি একটি চমৎকার তুলনা টেনেছেন, আন্না হাজারের লোকপাল বিল আন্দোলন এবং ইউপিএ ২-এর দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাবতীয় আন্দোলনের সময় মধ্যবিত্তের বাড়াবাড়ি রকমের অংশগ্রহণ এবং এই চলতি কৃষি আন্দোলনে মধ্যবিত্তের আশ্চর্য ঔদাসীন্যর। এখন মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সরকার আর কিছু হোক না হোক, মধ্যবিত্তের ঘোষিত শত্রু। যে কজন ভারতীয় হোমরাচোমরা এই নব্য কৃষি আইনের পক্ষে এবং কৃষি আন্দোলনের বিপক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন, তার মধ্যে এক প্রাক্তন আইএএস অফিসার, রাজীব মহর্ষি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে একটি লেখায় কবুল করেছেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন আদতেই শহুরে মধ্যবিত্তের পক্ষে ছিল। এই শহুরে মধ্যবিত্তকে তিনি বলছেন, ‘রাদার স্পয়েলট’। বলা বাহুল্য, বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি থেকে শুরু করে পিএফের সুদ বা পেনশন বিল নিয়ে যাবতীয় হারাকিরি কিন্তু মধ্যবিত্তকে সরাসরি ছুড়ে দেওয়া তীর। এখন প্রশ্ন, সে তীর সরাসরি গায়ে লাগা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত এই সরকারের জনবিরোধী এইসব আইন এবং তার পক্ষে সাফাইয়ের বিরোধিতা করছে না কেন? বা আরও স্পষ্টভাবে বললে, উদ্বাহু হয়ে সমর্থন করছে কেন?

এর উত্তর আসলে সমাজতাত্ত্বিক। কিন্তু সহজ করে, কিছুটা সরলরৈখিক ঢঙেই যদি এর উত্তর দিতে হয়, তাহলে বলব— নয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েতের ভাঙন এবং এদেশে গ্যাট চুক্তি সাক্ষর একটা বড় অংশের মধ্যবিত্তকে ধাক্কা দিয়েছিল। কারণ, নেহরুভিয়ান অর্থনীতি থেকে শুরু করে ইন্দিরা সরকারের অর্থনীতি পর্যন্ত যে সমাজতান্ত্রিক বা ওয়েলফেয়ার স্টেট অর্থনীতির আবহ ছিল, তাতে মধ্যবিত্ত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সবুজ বিপ্লব বা জয় জওয়ান জয় কিষাণ-এর জনমুখী কল্যাণকামী আহ্বান যেমন ছিল সেই আবহে, তেমনই মধ্যবিত্তকে যথেষ্ট সুবিধা দেওয়ার একটা ভাব অন্তত সেই অর্থনীতির বহিরঙ্গে ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, পাবলিক এবং প্রাইভেট সেক্টর শিল্পের একটা ভারসাম্য ছিল। নব্বইয়ের গোড়ায় তা পরিষ্কার ঘেঁটে গেল। এবং এই ঘেঁটে যাওয়াকে কাজে লাগাল মুক্তবাজার। মধ্যবিত্ত বুঝতে শিখল, আমূল সংস্কারের কোনও বিকল্প হয় না। ফলে পপুলার কালচারে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ জাতীয় ছবির যে প্রভাব ছিল, সাধারণ মধ্যবিত্তকে কৃষিচেতনা যতটা নাড়া দিত, তা ধীরে ধীরে উবে যেতে শুরু করল।

এই অবস্থার নগ্ন উদাহরণ যিনি তুলে এনেছিলেন, তার নাম পি সাইনাথ। বিদর্ভের আঁধার থেকে তিনি তুলে এনেছিলেন কৃষক আত্মহত্যার ভয়াবহ খতিয়ান। দক্ষিণ বম্বের এলিটদের খুশি করতে মিডিয়া তখন ব্যস্ত ছিল ল্যাকমে ফ্যাশন উইক কভার করতে। সাইনাথ ছাড়া বিদর্ভের বাইরে থেকে সেখানে সর্বভারতীয় ও মহারাষ্ট্রের স্থানীয় সাংবাদিক মিলিয়ে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ছ জন। সাইনাথ লিখেছিলেন, সরকারি নথি বলছে, আরও খোলাখুলি বললে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫— এই কুড়ি বছরের মধ্যে ৩,১০,০০০ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন (যদি রাইটস টু ইনফরমেশন অ্যাক্টের সঠিক ব্যবহার এদেশে অবশিষ্ট থাকে, তাহলে সেই নথি সরকারের কাছে চাইলেই পাওয়া যাবে)। এই বেশিরভাগ কৃষক আত্মহত্যার নথি স্থানীয় থানায় রেজিস্টার্ড হয়েছে পেটের গোলমালে মৃত্যু, দাম্পত্য কলহের জেরে আত্মহনন ইত্যাদি আশ্চর্য মিথ্যে তথ্য হিসেবে।

২০১৮ সালের নভেম্বরের শেষভাগেও লাখো কৃষকদের মিছিল ভারতবর্ষের খরা আক্রান্ত রুক্ষ মাটির অভিশাপ পায়ে বহন করে, খুলিগুহার অন্ধকার বুকে নিয়ে, নগ্ন শস্যক্ষেত্রের জরা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ভারতবর্ষের রাজধানীতে। পি সাইনাথ সেই কৃষিজীবীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পি সাইনাথ বলেছিলেন তখন, এ দেশের সত্তর শতাংশ দরিদ্র মানুষের কথা— যাঁরা প্রতিনিয়ত চাপা পড়ছেন বলিউড তারকা বা কোটিপতিদের বিবাহবাসরের তুমুল বৈভবের তলায়। তুলনা টানছিলেন ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্টের, যা ইতিহাসের বিস্মরণে চলে গেছে। সিপাহী বিদ্রোহের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান, রানির শাসন শুরু। ভিক্টোরিয়ার দরবারের জৌলুস কীভাবে চাপা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষপীড়িত লক্ষাধিক ভারতবাসীর লাশ, সে কথা মনে করাচ্ছিলেন। বলছিলেন, বাণিজ্যনগরীর বুকে এক বহুতল তৈরি হচ্ছে, যার প্রতিটি তলায় একটি করে সুইমিং পুল; এবং সেই বহুতলের কর্মীরা আদতে চাষি, যারা চাষ করতে পারছেন না জলের অভাবে। এই বৈপরীত্যের পরিহাস নিয়েই তৈরি আমাদের তৃতীয় বিশ্ব। পি সাইনাথ বলছিলেন, এই বৈষম্যের ছিটেফোঁটাও ছুঁতে পারে না ভোটরাজনীতি, যা নিয়ে মিডিয়া সর্বক্ষণ ব্যস্ত। তাই ২০১৮  সালের নভেম্বরে কৃষকরা দিল্লি চলো ডাক দিলে সাইনাথের কাছে কিছু সাংবাদিক ‘বাইট’ চান। সাইনাথ পরে বলেন, ‘আই উড লাইক টু বাইট দেম ইন রিয়েল।’

সাইনাথ বারংবার চিহ্নিত করেছেন, কীভাবে চাষিদের ঋণের বোঝা বাড়িয়ে ঋণ মকুব করা হয়েছে অ্যাগ্রো বিজনেসের সঙ্গে যুক্ত কর্পোরেটদের। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে যে নয়া সংশোধনী এল, তাতেও আদতে লাভ হল সেই একাংশের কর্পোরেট কৃষি-ব্যবসায়ীরই। সাইনাথ ফায়ে ডিসুজাকে সাক্ষাৎকারে সেদিনই বলছিলেন, কোনওদিনই কৃষকদের ফসল স্টকপাইলিং নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। নিষেধাজ্ঞা ছিল কৃষি ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেশনের উপর। সেই নিষেধাজ্ঞা আলগা করার অর্থ, এবার নির্বিচারে স্টকপাইলিং এবং মূল্যবৃদ্ধিতে আর কোনও সরকারি লাগাম থাকবে না। ভুলে গেলে চলবে না, দিনকয়েক আগে পরিবেশ আইনের নতুন সংশোধনীও কিন্তু পরিবেশ-বান্ধব উন্নয়নের জন্য যে কড়াকড়ি ছিল কর্পোরেটদের উপর, বিশেষত কিছু ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে, তা শিথিল করেছে।

তাই ভেবে দেখা উচিত আজকের মিছিল কাদের মিছিল। ভেবে দেখা উচিত নতুন আইন, নতুন সংস্কার, নতুন সংশোধনী আদতে কাদের বিরুদ্ধে, এব‌ং কাদের পক্ষে।

আর এখানেই মধ্যবিত্তের সঙ্গে এই কৃষি আন্দোলনের দূরত্ব। শুধু এই আন্দোলন নয়, কৃষক-সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনাই তাদের কাছে আগন্তুক হয়ে থেকে যাচ্ছে। ২৬ জানুয়ারি তাঁরা কি ট্রাক্টরের কুচকাওয়াজ করে মধ্যবিত্তের মন ফেরাতে পারবেন? দিলজিৎ দোসাঞ্জ বলেছেন, কৃষকরা যখন বিষ খাচ্ছেন, তখন যে মধ্যবিত্ত নীরব, সেই মধ্যবিত্ত কীভাবে কৃষকরা পিজা খাচ্ছেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত হতে পারে! আসলে এই কৃষকদের মধ্যবিত্ত চিনতেই পারছে না। কারণ এঁরা অনাহারের ক্লেশে আত্মহত্যা করবেন না। এঁরা জানেন ট্রাক্টর চালানোর গায়ের জোর বাগাতে কটা রুটি লাগে। ততগুলো রুটিই এঁরা খাবেন। এঁরা ঠিক করেছেন, মরতে হলে মেরে মরবেন।

মধ্যবিত্তর চেতনায় ট্রাক্টর চলবে কি?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...