ফতেহ কর হি লওটেঙ্গে

কুন্তল রুদ্র

 



কবি, প্রবন্ধিক, আবৃত্তিকার, প্রাক্তন অধ্যাপক

 

 

 

 

জয়ী হয়েই ওরা ফিরবে, এটা এখন আর শ্লোগান মাত্র নয়, দেওয়ালের এই লিখন এখন প্রতিদিন স্পষ্টতর। মেনস্ট্রিম মিডিয়া কার্যত ওদের লড়াইয়ের খবর ব্ল্যাক আউট করে রেখেছে, তাতে ওদের থোড়াই কেয়ার। এতদিনে ওরা চিনে ফেলেছে কার কী অবস্থান। ওরা জেনেছে, বাঁচার অনিবার্য তাগিদে ওদের রাজপথেই অবস্থান নিতে হবে। তাই জমি থেকে পথে উঠে এসেছে ওরা লক্ষ হাজার। রাজধানী দিল্লি প্রবেশের প্রধান প্রধান সব সড়ক বন্ধ করে দিয়েছে সরকার, ওই ‘উটকো’ লোকগুলি যাতে কিছুতেই সেখানে না ঢুকে পড়ে! সিংঘু, টিকরি, শাহজাহানপুর, গাজিপুর, সাজাপুর সহ আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় সড়কের উপর সারি সারি ট্রাক্টর, আর তার উপরে নিচে এক ডিগ্রি তাপমাত্রায় ওরা আগুন পোহাচ্ছে। আগুনটা ওদের সত্যিই ভারি দরকার, বাঁচার জন্য, আর বাঁচাটা লড়াইয়ের জন্য। ২০২০-র করোনা সংক্রামিত পৃথিবীতে মৃত্যুযাত্রার পাশাপাশি ভারত এক আশ্চর্য রকমের বাঁচার, বাঁচতে চাওয়ার ছবিও দেখছে, ছবিটা ২০২১-এ আরও উজ্জ্বল হবে— জয়ী না হয়ে ওরা ফিরবে না। গ্রাম গ্রামে আছে, জমি মাঠে আছে, ওরা রাজপথে।

ভারত ইতিহাসের পাতায় জয়ী হতে চাওয়ার এমন শান্ত সুদৃঢ় প্রত্যয় আর কখনও কি এভাবে দেখেছে মানুষ? দেশের স্বাধীনতার লড়াই-এর চূড়ান্ত পর্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রবল উন্মাদনা জেগেছিল, আন্দোলনের উপর নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ বুঝি আর থাকছিল না, হিংসার ঘটনাও ঘটেছিল অনেক। ২০২০ কৃষকজনতা বিস্ময়কর এক শান্ত জনসমুদ্র, সমস্ত উত্তাপকে ভিতরে সংহত করে বাইরে কী অদ্ভুত রকমের নিস্তরঙ্গ। যে পুলিশ একটু আগেই তাদের উপর নির্মম লাঠিবাজি করেছে তাদেরই রাজপথে পাত পেড়ে খাইয়েছে হাসিমুখে। কৃষকসংগ্রামের চেতনায় রাজপথে জন্ম নিয়েছে সভ্যতার নতুন ব্যাকরণ।

কৃষকের বহু সংগ্রাম দেখেছে ভারত। কিন্তু এমন অভূতপূর্ব কৃষক ঐক্যের ছবি আমরা আর কখনও কি দেখেছি? ধর্মের নামে বিভেদের বিষ বিগত একশো বছরে এ-দেশ কম দেখেনি, বিগত তিন দশক ধরে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে ধর্ম এবং জাতপাতের নামে মানুষের মধ্যে যারা বিভাজন ঘটিয়ে ভোটের ফয়দা লুটেছে এই মুহূর্তে তটস্থ তারা। কৃষক ঐক্যের এমন নিশ্ছিদ্র লোহার বাসরে ছিদ্র করা তাদের বিশ্বকর্মারও আয়ত্বের বাইরে। সেই কথাটাই যেন ফুটে বেরিয়েছে রাজস্থানের হনুমানগড়ের সিকান্দার খানের মুখে— “এই লড়াইয়ে কোনও হিন্দু মুসলিম শিখ নেই। আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা কৃষক।” ভারতবর্ষের ধর্মপ্রাণ কৃষকজনতা এখন লড়াই-এর পথে নিজেদের এক নতুন পরিচয়কে খুঁজে পাচ্ছে। এর মধ্যে যেমন গণতন্ত্রের জন্য নতুন আলোর ঝিলিক আছে তেমনি আছে কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদলের জন্য রাজনৈতিক অশনির সঙ্কেত। সামন্ততন্ত্রের আবহে প্রতিপালিত কৃষকসমাজ সামাজিক প্রগতিচেতনায় শ্রমিকশ্রেণি এবং আলোকপ্রাপ্ত পাতিবুর্জোয়া মধ্যবিত্তের তুলনায় নিশ্চিতভাবেই ধীরগামী, হয়ত বা কিছুটা পশ্চাদপদও। সেই কৃষকই যখন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে তখন তার চিন্তার জগতেও এক অদ্ভুত জঙ্গমতা দেখা দিতে পারে। তখন এক ঝটকায় তারা শাসকের বুজরুকি ভণ্ডামি প্রতারণাকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। ঠিক তাই ঘটছে এখন। এই সংগ্রামের যে বিপুল প্রসার এবং গণভিত্তি তার মধ্যে যে বারুদ পুঞ্জীভূত তা আগামীদিনে দেশের রাজনীতিরও মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে কিনা অদূর ভবিষ্যতে সেটাও দেখার।

এ লড়াইয়ের আর একটি লক্ষণীয় দিক, কেবল একজন কৃষকমাত্র নয়, তার সমগ্র পরিবারই একটি সুডৌল একক হিসাবে ক্রিয়াশীল। বাড়ির প্রধান যখন রাজপথের অবস্থানে, তখন তাদের খেতি গোশালা এসব সামলেছে মেয়েরা, কখনও-বা তার সঙ্গে তাদের কলেজে পড়া ছেলেও। আবার এখন ফসল তোলা শেষ করে মেয়েরা এসে দাঁড়াচ্ছে লড়াইয়ের ফ্রন্টলাইনে। কৃষকের কৃষক পরিচয় যে এত গর্বের এই লড়াই যেন তাও শেখাচ্ছে। আমরা দেখতাম, পিতা যে চাষি, শিক্ষিত ছেলে সেই পরিচয় প্রকাশ করতে গ্লানি বোধ করে। পোড়া বঙ্গে ‘চাষা’ শব্দের মধ্যে অশ্রদ্ধার ভাবটির কথা অনেকেই জানেন। আর এই লড়াই দেখাচ্ছে ক্রীড়া ও সিনেমাজগতের অনেক মানুষকে, যাঁরা এই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন গর্বের সঙ্গে এই পরিচয় নিয়ে যে তাঁরা কৃষকসন্তান। এই আত্মপরিচয়ের মধ্যে যেন নতুন এক আত্মগরিমাকে তারা চিহ্নিত করতে পারছে, পাঞ্জাবের ডিআইজি (কারা) লখিন্দর সিং জাখর আন্দোলনের সমর্থনে পুলিশের চাকরি থেকে পদত্যাগ করে বলে— “আগে আমি একজন কৃষক, তারপর পুলিশ অফিসার।”

ভারতবর্ষের হিন্দিবলয় কোনও লড়াইয়ে এত বিপুল সংখ্যায় লাল ঝাণ্ডা যে কোনওদিন দেখেনি নিশ্চিতভাবেই তা বলা যায়। হ্যাঁ, এই আন্দোলনে বামপন্থীরাও আছে, একেবারে নেতৃত্বের সারিতেই আছে তা স্পষ্ট। তার অর্থ এই নয় যে তারাই এই আন্দোলনে প্রথম এবং শেষ কথা বলছে। পাঁচশো সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং এতদিন ধরে সেই ঐক্যকে ক্রমশই আরও মজবুত করে চলার কাজটি যাঁরা মসৃণভাবে করছেন তাঁদের ধৈর্য্য নিষ্ঠা এবং অধ্যবসায়কে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। এই আন্দোলন থেকে বামপন্থীদেরও অনেককিছু শেখার আছে। বিশেষ করে, ডগমার চেয়ে যে মানুষ অনেক বড়— এই কথাটি। মানুষের কথাকে মর্যাদা দিয়েই যে ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলা যায় এবং এই বিশাল দেশে সেটাই আরও ধৈর্য্যের সঙ্গে, আরও নিবিড় নিষ্ঠায় বহু বহুদিন যে করে চলতে হবে, সেই অমূল্য শিক্ষা আশা করি তারা গ্রহণ করছে। এ লড়াই পার্টিজান নয়, এবং তা নয় বলেই জয়ের পথ প্রশস্ত হচ্ছে প্রতিদিন। ওরা জিতবে, জয়ী হয়েই ফিরবে কৃষকভারত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...