চাষায় কেন পিৎজ়া খায়: কৃষক আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণের ‘কপিবুক’ ছুৎমার্গ বিষয়ে দু-চার কথা

সুব্রত রায়

 



ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য

 

 

 

 

 

ধানের গোছার মত জীবনকে ছেঁচে ফেলে সারা মাঠময়,
পৌষালি ফসলটুকু নিয়ে যায় কুটিল সময়,
প’ড়ে থাকে আঁটি আঁটি খড়
অসার অনড়।

– দিনেশ দাস (ভূগোল)

 

শিবঠাকুরের আপন দেশে

শিক্ষানীতি প্রস্তুত হবে শিক্ষার্থীর ভালোর জন্য, শ্রম আইনে সবচেয়ে দামি হয়ে উঠবেন শ্রমিক, কৃষি আইন কথা বলবে কৃষকের হয়ে। এটাই আকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু ডিসেম্বর-জানুয়ারির তীব্র শীত উপেক্ষা করে দিল্লির রাস্তায় কৃষকদের মরিয়া অবস্থান অন্তত সে কথা মনে করাচ্ছে না। সময় বড়ই কুটিল, সন্দেহ নেই!

কৃষিক্ষেত্রে লাগু হয়েছে তিন-তিনটে একুশে আইন। তাতে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ অনুল্লিখিত। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেলের মতো ২০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিজাত পণ্য; ফলে এগুলো মজুত রাখার ঊর্ধসীমাও বাতিল। চুক্তিচাষের মাধ্যমে অবাধ কর্পোরেট লুণ্ঠনের বন্দোবস্ত হয়েছে; চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে যাতে কৃষক আদালতেও না দাঁড়াতে পারেন, তারও রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে আটঘাট বেঁধে।

ফসল ফলানোর জাদু জানা নেই আমার। পরিবার এক-পুরুষ আগে চাষবাস ছেড়ে নিরাপদ ঝুঁকিহীন জীবিকায় সরে এসেছিল। ওইরকম নিরাপদ পেশা আমারও। কৃষিকাজের উত্তরাধিকার আমাতে চুঁইয়ে নামেনি, এ ব্যাপারে আমাকে প্রায় নিরক্ষরই বলা চলে। কিন্তু গ্রামজীবনে লেপটে থাকার সুবাদে বেশ বুঝি যে, কৃষিকাজের অনিশ্চয়তা ভরা জীবনে সমস্যার শেষ নেই! এমন নয় যে, বর্তমান কৃষি পরিস্থিতিতে কৃষকরা রসেবশে আছেন। এমন নয় যে, আগেকার কৃষিনীতির পরিবর্তনের কোনও দরকার নেই। খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি-অকালবর্ষণের কবলে পড়ে ফসল না ফলাতে পারলে কৃষকের সমস্যা। কিন্তু ফসলের অতিরিক্ত উৎপাদনেও সমস্যা কমে না। দাম পড়ে যায়। এ কারণেই দরকার হয় ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের। আবার ফসলের মূল্য অতিরিক্ত বেড়ে গেলেও মুশকিল, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে দামের সাযুজ্য না থাকলে চলে না। কাজেই, কৃষির সঙ্গে যুক্ত নানান ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হয়, বাজারের স্রোতে তাকে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না। বিদ্যুৎ, সার, সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদিতে সরকারি টাকা বরাদ্দ করতে হয়। আবার, সরকার যেভাবে কৃষকদের থেকে কৃষিজাত পণ্য কেনে, তাতে যেমন প্রশাসনিক গাফিলতি আছে, তেমনি সে সুবিধে সকলে সব সময়ে পানও না। ফলে সরকার নির্ধারিত সহায়ক মূল্যের অনেক কম দামে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সামগ্রী বেচতে বাধ্য হন। এতে যা হয়, খেয়েপরে বিশেষ উদ্বৃত্ত থাকে না। দুরবস্থাও কাটে না। কাজেই, চাষের মরসুমে ফসল বোনার জন্য অনেকেই ঋণ নিতে বাধ্য হন এবং সময়মতো তা শোধ না দিতে পারলে সমস্যা জটিলতর হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, প্রতিদিন আমাদের দেশে ২৮ জন কৃষক ঋণের দায় মাথায় নিয়ে আত্মহত্যা করেন। উপরন্তু, ফসল বেচতে গিয়ে ফড়েদের দৌরাত্ম্য আছে, উৎপাদনের সাথে সাথে উপযুক্ত দাম না পেয়ে ফসল পরে সময়সুবিধেমতো বেচার জন্য যে সংরক্ষণ করে রাখবেন, তার পরিকাঠামোও সর্বত্র হাতের কাছে মজুত থাকে না। অর্থাৎ, বলা বাহুল্য, ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।

নতুন আইন হিসেবে যেটা এল, তাতে এইসব সমস্যা মেটাতে প্রথমবারের জন্য কৃষিপণ্য হস্তান্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপটিতে নজর দেওয়া হল। এখানে প্রাথমিক ক্রেতা হিসেবে কৃষকদের সামনে কর্পোরেটদের বিশেষ মর্যাদা দিয়ে হাজির করা হয়েছে। এমন নয় যে, কৃষকদের থেকে কর্পোরেটদের সরাসরি ফসল কেনায় কোনও আইনি বাধা ছিল। এমনও নয় যে, চলতি কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষকরা কর্পোরেটদের সঙ্গে কোনও চুক্তি করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্র চাইলেও নীতিগতভাবে কোনও কৃষককে কারও সাথে চুক্তি করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আন্দোলনকারী কৃষকরা কিন্তু এই কৃষক-কর্পোরেট চুক্তির মধ্যেই অশনিসঙ্কেত দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, ওই চুক্তিতে কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে সরকারের যে উদ্বেলতা-তৎপরতার ছবি ফুটে উঠছে, কৃষকদের বেলায় তার ছিটেফোঁটাও নেই! তাঁদের আশঙ্কা এই যে, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে কর্পোরেটরা তাদের নিজস্ব শর্তে কৃষকদের চুক্তিচাষে বাধ্য করবে এবং ঐতিহাসিক নীলচাষের কালো অধ্যায় আবার ফিরে আসবে।

আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে

এই মুহূর্তে দিল্লির রাজপথ উত্তাল। পাঞ্জাব-হরিয়ানা থেকে দলে দলে কৃষক দেশের রাজধানীতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। দেশের নানান প্রান্ত থেকে রোজই কৃষকরা এতে সামিল হচ্ছেন। যোগ দিচ্ছেন অন্যান্য ক্ষেত্রের আন্দোলনকারীরাও এবং অবশ্যই বহু সাধারণ মানুষ। পাঞ্জাবে কৃষকরা রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে বিশেষ সফল না হয়ে দিল্লি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ট্রাক্টরে চেপে পুলিশ-প্রশাসনের নানান বাধা অতিক্রম করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কয়েক মাসের খাবারদাবার। খোলা জায়গায় রান্নাবান্না চলছে। সরকারের দেওয়া জলও তাঁরা স্পর্শ করেননি। প্রাত্যহিক অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের জন্য স্থানীয় মানুষজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারের সাথে ইতিমধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছে। কৃষকরা কোনও দরকষাকষি বা রাজনৈতিক প্যাঁচপয়জারে না গিয়ে নিজেদের দাবিকে সহজ-সরল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁদের যথেষ্ট দৃঢ়তা লক্ষ করা গেছে। আইন বাতিলই তাঁদের একমাত্র অভীষ্ট।

আন্দোলনকারী কৃষকরা জানেন যে, এ লড়াই দীর্ঘমেয়াদী হয়ে উঠবে। তার আগাম প্রস্তুতি নিয়েই তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে এজন্য যে, আর্থিকভাবে ওই কৃষকরা যথেষ্টই ধনী। দেশের অধিকাংশ কৃষিজীবীই ভূমিহীন হতদরিদ্র হলেও, পাঞ্জাব-হরিয়ানার অধিকাংশ কৃষক সেরকম নন। এঁদের পরিবারপিছু জমির পরিমাণ জাতীয় গড়ের অনেক উপরে। এঁরা খাটো ধুতি আর ছেঁড়া চপ্পল পরেন না। অনেকেরই হাতে দামি স্মার্ট ফোন, ঘরে স্মার্ট টিভি শোভা পায়। এঁদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত, ইংরেজিতে কথা বলে। দিল্লির রাজপথে বসে এরা কখনও কখনও দামি রেস্তোরাঁ থেকে খাবার আনাচ্ছেন। নাচাগানা করছেন। রান্না করে পথচারীদের খাওয়াচ্ছেন, এমনকি মন্ত্রীসান্ত্রীদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন সুস্বাদু খাবারের থালা। আবার, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকছেন খোলা আকাশের নিচে। প্রতিবাদ আজ উৎসবের চেহারা নিয়েছে।

শ্রেণিচরিত্রের চালুনি

এমন একটা সময়ে খোদ রাজধানী শহর এই আন্দোলনকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠছে, যখন গোটা দেশকে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার ধর্ম, জাতপাত, নাগরিকত্ব ইত্যাদি প্রশ্নে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। ঘৃণা আর অবিশ্বাসের রাজনীতির ঢেউ আছড়ে পড়েছে জীবনের প্রতিটি কোণায় কোণায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কার্যত দিশাহীন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতার অভাবও প্রকট, কোনও দলেরই অবস্থান প্রশ্নাতীত নয়— স্বার্থের কাটাকুটি খেলায় এরা শতধাবিভক্ত, হীনবল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অর্থনীতি ইত্যাদির ঘোরতর দুঃসময়েও যেন এরা একজোট হয়ে লড়ার সামর্থ্য হারিয়েছে। একটি আধুনিক রাষ্ট্র যে যে খুঁটিগুলির ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার প্রায় প্রত্যেকটি নড়বড়ে হয়ে উঠলেও বিরোধী দলগুলি কোনও সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এই ফাঁকে, অতিমারি আবহকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক জনবিরোধী আইন চুপিসারে সংসদে পাশ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গণআন্দোলনের উপরে নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় দমননিপীড়ন। স্বভাবত, কৃষকদের জেগে ওঠাকেও বিজেপি ভালো চোখে দেখেনি। কৃষকরা যাতে দিল্লি না পৌঁছতে পারেন, তার জন্য নানা জায়গায় ব্যারিকেড করা হয়েছিল, এমনকি রাস্তাও কেটে দেওয়া হয়। পুলিশ বল প্রয়োগ করে, কনকনে ঠান্ডায় বেআদবি সমঝে দিতে কামান থেকে ছোঁড়ে বরফঠান্ডা জল। অন্যদিকে, কৃষক আন্দোলনকে উগ্রপন্থার সাথে এক করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কৃষকদের খালিস্তানপন্থী বলা হয়েছে। এই অনুষঙ্গে ‘মাওবাদী’, ‘শহুরে নকশাল’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ ইত্যাদি অভিধা নির্দ্বিধায় প্রযুক্ত হয়েছে। বিজেপির নেতামন্ত্রীরা এই বিদ্রোহের পেছনে খুঁজে ফিরেছেন পাকিস্তান ও চিনের ছায়া, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এমনকি, কৃষকদের জীবনযাত্রা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

সবিশেষ আশ্চর্যের কথা হল, গণতন্ত্রকামী সেক্যুলার নাগরিকদের একাংশও কতকটা বিজেপি-র সুরে সুর মিলিয়ে কৃষকদের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণে মন দিয়েছেন। এঁদের অভিযোগ, পাঞ্জাব-হরিয়ানার এই কৃষকরা ভারতের ভুখানাঙ্গা চাষাভুষোর প্রতিনিধি নন। ওঁরা অর্থবান, নিজেদের শ্রেণিস্বার্থের তাড়নায় শোরগোল করছেন মাত্র! এও বলা হচ্ছে, এঁরা আসলে রক্ষণশীল রাজনীতিরই সমর্থক, এবং হয়তো বা বিগত নির্বাচনগুলোতে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকেই ভোট দিয়েছেন।

ফলে কৃষকদের এই আন্দোলন সর্বাত্মক হয়ে উঠতে গিয়েও কোথাও যেন আটকে যাচ্ছে, কারও কারও মনোজগতের বাধাটি পেরোতে পারছে না। অথচ প্রবল প্রতাপান্বিত শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শুধু ভুখানাঙ্গা জনতাই নয় ক্ষমতাবানের একাংশের ভূমিকাও যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, ইতিহাসে এ কথা সুবিদিত। কাজেই, শ্রেণিচরিত্রের এই সর্বব্যাপী চালুনিটি কোথায় ঠিক কতখানি প্রাসঙ্গিক, তা খতিয়ে দেখার দরকার আছে।

যে যেখানে লড়ে যায়

এই মুহূর্তে যাঁরা বিক্ষুব্ধ কৃষকের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণে নেমেছেন, তাঁদের কাছে এক বৃহত্তর বাস্তবতা অধরা থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশের শাসনক্ষমতায় যে রাজনৈতিক দলটি অবস্থান করছে, তারা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিকতার প্রতিটি সৌধকে কদর্যভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেবার চেষ্টা করে চলেছে। দেশের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক কিন্তু অমিত শক্তিশালী এই দলটিকে থামানোর মতো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এই মুহূর্তে দেশে সংগঠিত নেই। কৃষক আন্দোলন যে ঢেউ তুলেছে, লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাতে কেবল কৃষিক্ষেত্রের সমস্যাই নয়, অন্যান্য সমস্যাগুলোর কথাও একে একে উঠে আসতে শুরু করেছে। ধর্ম, নাগরিকত্ব ইত্যাদি বিষয়ও ক্রমে এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কৃষক নেতারা শাসকের সঙ্গে শোষকের গাঁটছড়াটিকেও সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছেন। শাসকের কর্মসূচি নির্ধারণে শোষক ও অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রদের ভূমিকা কৃষকরা কার্যত বেআব্রু করে দিয়েছেন। মোবাইল টাওয়ার গুঁড়িয়ে দেওয়া, গোদি মিডিয়াকে ভাগানো— এসব তারই প্রতিফলন। তাঁরা সরকারি ভোজের আহ্বান করজোড়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের সহায়তা সাদরে গ্রহণ করেছেন। শত্রু-মিত্র চিনতে তাঁদের কোনও ভুল হয়নি। কাজেই, এই আন্দোলন এখন কেবলমাত্র ‘ধনিক কৃষকের’ ‘শ্রেণিস্বার্থের’ আবর্তে আটকে নেই। এই আন্দোলন যে মানবতার চরম অবমাননাকারী রাজনৈতিক দলটিকে মোক্ষম ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, কোনও প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে যদি সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ যোগদান করেন, তাহলে তার সাফল্যের সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে যায়। এই যোগদান বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সব সময় সকলেই যে সব বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারবেন, তা আশা করা যায় না। কিছু দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে, বিভিন্ন সংগঠন বা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব অ্যাজেন্ডা থাকাটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের মূল অবস্থানটি যদি সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষটির কাজে লাগে, তাহলে সেই মূল অবস্থান বা দাবিটির কারণেই তাতে অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে। কৃষক আন্দোলনে হয়তো এখনও সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু নতুন কৃষি আইন বাতিলের মূল দাবিটি কৃষকশ্রেণির অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল অংশের সাথে সাথে যে ক্ষুদ্র চাষি ও জমিজিরেতহীন ক্ষেতমজুরদেরও কাজে আসবে, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। মোদ্দা কথায় বললে, কৃষক আন্দোলনের মূল দাবিগুলির সঙ্গে যদি সবচেয়ে গরীব কৃষকটিও সহমত হতে পারেন, তাহলে এই আন্দোলনকে সমর্থন না করার কোনও মানবিক যুক্তি থাকতে পারে না। শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ চলতেই পারে, যতক্ষণ না তাতে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানটুকু বিসর্জিত হয়।

হাঁপায় যে এ হাপর

আমি সামান্য যুক্তিবাদী কর্মী, বিজ্ঞান আর যুক্তির বার্তা নিয়ে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছই। মনের অচলায়তন ভাঙার জন্য প্রশ্নশীলতাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। এই অর্থে, মানুষের রুটিরুজির আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নই। তবে এটুটকু বুঝে নেওয়া হয়তো কঠিন কিছু নয় যে, কামারশালায় যে হাপর হাঁপিয়ে মরে তা আমার নিজস্ব বুকের পাঁজর না হতেই পারে, কিন্তু আমার বুকের খাঁচাটির অস্তিত্বটিও তো নিরালম্ব কিছু নয়! কাজেই, কৃষকদের এই বর্ণিল অভ্যুত্থানে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসার সময়ের দাবিটাকে অস্বীকার করতে পারি না। এ তো কেবল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন নয়, যূথবদ্ধভাবে বেঁচে থাকার অন্যতম শর্তও। উপরন্তু, তা এই মুহূর্তের দাবিও বটে।

সর্বোপরি, অযৌক্তিক ক্ষমতার দিকে আঙুল যে-ই তুলুক, ‘যুক্তি’ কি তার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে না? তাই, কৃষক আন্দোলনে শতফুল বিকশিত হোক।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...