এই সময় নিজের কর্তব্য বুঝে নেওয়ার

সব্যসাচী কর

 




সমাজকর্মী

 

 

 

 

আজ সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের ‘চাক্কা জ্যাম’ কর্মসূচি পালিত হল। ছাব্বিশে জানুয়ারির পর এ তাঁদের প্রথম বড় কর্মসূচি, যা তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোকেই সূচিত করে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা দেশের নানা জায়গায় পথ অবরোধ করল শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি আর উত্তরাখণ্ডে কোনও কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। কারণ এই জায়গাগুলিতে অবরোধ হলে হিংসার সম্ভাবনা আছে, কৃষকরাই এমন মনে করছিলেন৷ অথচ সরকার তাঁদেরই আন্দোলনকে ‘সহিংস’ বলে দাগিয়ে দিতে চায়।

অবশ্য দিল্লিতে অবরোধ না থাকলে, অবরোধের সম্ভাবনায় টিকরি, সিংঘু, গাজিপুরে ছিল পুলিশ, বনদপ্তর, সৈন্যবাহিনীর নিশ্চিদ্র প্রহরা। সরকার কি ভয় পেয়েছেন?

এই যেমন কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে এক বিদেশি পপ তারকার একটি ট্যুইট নিয়ে সারা দেশ উত্তাল হল। সেই ট্যুইটের অনুষঙ্গে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও ট্যুইট। কৃষক আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে পৃথিবীর নানা কোণ থেকে সচেতন মানুষের বার্তা সরকারকে ভালোরকম বেকায়দায় ফেলে দিল। বোঝাই যাচ্ছে, এতদিন ধরে কৃষকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সাজানোর চেষ্টা আর কাজে দিচ্ছে না। তাঁরা আদপেই চাষি কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহের জালের বুনটও আর তেমন জোরালো হচ্ছে না। ধনী কৃষক-দরিদ্র কৃষকের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার চেষ্টাও অসফল। ফলত শাসক দলকে নতুন ন্যারেটিভ নামাতে হচ্ছে। এইসবই নাকি ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ। ভারতের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানার অপচেষ্টা। আন্দোলনের পিছনে বিদেশি মদত আছে নাকি! দেশের স্থিতি বিনষ্ট করার জন্য বৈদেশিক ষড়যন্ত্র— ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি….

এর দ্বারা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করা মুশকিল নয়। ঠিক যেমন প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন কৃষকদের ট্র্যাক্টর মিছিল থেকে লালকেল্লার ঘটনা নিয়েও সাধারণ মানুষ চিন্তিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। সরকার, সরকারপোষিত মিডিয়া, সরকার-অনুগত সেলেব্রিটিদের বয়ান, ট্যুইট, ফেবুপোস্ট তাঁদের এমনটাই ভাবিয়েছে। কৃষক আন্দোলনের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি এসব কারণে ধাক্কা খেয়েছে। লালকেল্লার মতন ঐতিহাসিক সৌধে জাতীয় পতাকার তথাকথিত অবমাননা অতীব গর্হিত এবং দেশবিরোধী কাজ হয়েছে নাকি! অবশ্য লালকেল্লাকে দেশের চৌকিদার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে পাঁচ বছরের জন্য তুলে দিয়েছেন। তা হোক, তাই বলে এই ‘অবমাননা’ মেনে নেওয়া নাকি কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এবং দিনের শেষে গিয়ে আমরা দেখলাম, জাতীয় পতাকার অবমাননা সংক্রান্ত সব ঘটনাই মিডিয়ার মিথ্যে প্রচার ছিল। জাতীয় পতাকা ছিল যথাস্থানেই। অন্য একটি খিলানে ওড়ানো হয়েছিল কৃষকদের পতাকা। আমাদের দেখানো হয়েছিল খণ্ডচিত্র। তার উপর যে দলটি লালকেল্লায় ঢুকেছিল, তাদের নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের হৃদ্যতার খবরও এখন সুবিদিত। (গন্ধটা কেমন সন্দেহজনক লাগছে না?) তা এই যে একটা ন্যারেটিভ তৈরি করে আমাদের গেলানো হলো বা প্রায়শই গেলানো হয়, কোনও ঘটনায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ওঠার আগেই মগজের দোরগোড়ায় আইটি সেলের তৈরি সন্দর্ভ এসে দাঁড়িয়ে পড়ে… এইসব আসলেই একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অংশ যেখানে আমাদের প্রতিদিন বোঝানো হয় যে সরকারবিরোধী যে কোনও আন্দোলন বা বক্তব্য আসলে দেশদ্রোহিতা। এর পিছনে সবসময়েই শত্রুরাষ্ট্রের প্ররোচনা থাকে। এই ধরনের আন্দোলনকে সমর্থন করা মানেই আপনিও দেশবিরোধী।

এই মোদিপন্থী মিডিয়ার ঢক্কানিনাদ বা অনুগত সেলেব বাহিনীর সমবেত হুক্কাহুয়ার বাইরে যদি একবার কান পাতা যায়, তবে শোনা যায় কোথাও যেন “ঢেউ উঠছে কারা টুটছে”। গত আড়াই মাস ধরে রাজধানীর তিন প্রান্তে যে হাজার হাজার মানুষ প্রবল ঠান্ডা উপেক্ষা করে বসে আছেন সরকারের চোখে চোখ রেখে (কমবেশি ১৬৭ ইতোমধ্যে মৃত) তাদের মুখের দিকে ভালো করে তাকালে আপনার ভাই-বেরাদরকেই দেখতে পাওয়া যায়। তাদের চোখে চোখ রাখলে অই শান্ত প্রত্যয়ী দৃষ্টিতে মনে হয় না কোনও দেশদ্রোহী খুঁজে পাওয়া যাবে। সিংঘু-টিকরি-গাজিপুর সীমান্তে সেই ভারতবর্ষ বসে আছে যে ভারতে শিখ লঙ্গরখানার পাশেই মুসলিম লঙ্গরখানা সমান উদ্যমে চলছে। যেখানে খাবার বা ওষুধ শুধুমাত্র আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যেই বিলি বা জোগাড় হচ্ছে না বরং আশেপাশের সাধারণ মানুষের প্রয়োজনেও আরোগ্য দিচ্ছে। যেখানে একের পর এক অস্থায়ী লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে সকলের সুবিধার্থে কেননা কে না জানে একমাত্র শিক্ষাই আনে চেতনা। আপনাকে অনুগত মিডিয়া এইসবের খোঁজ দেবে না। তাই চাষিরা নিজেরাই পিপলস মিডিয়া তৈরি করে নিজেদের বক্তব্য বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আন্দোলন নতুন করে সংহত হচ্ছে। শক্তিশালী হচ্ছে। চাষিদের প্রতি সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা দিতে দিল্লি শহরের ছাত্র যুবক ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ জড়ো হচ্ছেন সমাবেশের জায়গায়।

বহুদিন পরে ফ্যাসিস্ট শাসকের বিপক্ষে আন্দোলন জোরালো হচ্ছে। প্রতিবাদের জোরালো স্বর আছড়ে পড়ছে রাজধানীর দেওয়ালে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদসভা মিছিল সংঘটিত হচ্ছে। মিডিয়া ব্ল্যাকআউট করেও পুরোটা চাপা দিতে পারছে না। এইসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে বুকের মধ্যে নতুন করে আশার মুকুল জেগে উঠছে না কি? ক্রমশ প্রতীতি হচ্ছে পারলে ওঁরাই পারবেন। তেভাগা বা তেলেঙ্গানা আমরা দেখিনি। কেবল তার ইতিহাস পড়ে উদ্বেলিত হয়েছি। আর আজ হয়তো তেমনই একটা ঐতিহাসিক সময়কে প্রত্যক্ষ করতে করতে এগোচ্ছি আমরা। প্রকৃত বহিঃশত্রুর সীমানা আগ্রাসনের মোকাবিলার বদলে নিজের দেশের মানুষের আন্দোলনের সামনে পাঁচিল তুলে কাঁটাতার লাগিয়ে রাস্তায় গজাল পুঁতে দিচ্ছে সরকার। এ বড়ই দুর্ভাগ্যের। দুর্ভাগ্য এও যে “জয় জওয়ান জয় কিসান” নীতিকে ভুলিয়ে দিয়ে কিসান আর জওয়ানকে প্রতিস্পর্ধী হিসেবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশার আলো এর মধ্যেই খুঁজতে হবে। হয়ত আশার শেষ রশ্মি এই আন্দোলন৷ শেষ খড়কুটোও বলা যায়। লাখো মানুষের জমায়েত থেকে যে বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে পারলে তাই পারে ফ্যাসিবাদের ছায়া বিস্তারকারী মেঘকে দূর করতে। গণতন্ত্রের সূর্যোদয়ের আহ্বানসঙ্গীত একমাত্র ওঁরাই গাইতে পারেন। আমি আশাবাদী… আর আপনি? এই সময় নিজের কর্তব্য বুঝে নেওয়ার। শত্রু ঘরের ভিতর ঢুকে আসার আগেই পথে নেমে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া শ্রেয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...