২০২০-র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: সংখ্যা কম দিয়ে আশ্বস্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই

ইরফান ইঞ্জিনিয়ার এবং নেহা দাভাড়ে

 

সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম (সিএসএসএস) প্রতি বছর সাম্প্রদায়িক হানাহানি নিয়ে বিস্তারিত এবং সুসংহত রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই ধরনের হানাহানির ধরনগুলি এবং প্রবণতাগুলি যাতে সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায় সেজন্য এই রিপোর্টগুলিতে কাঠামোগত হিংসা, শারীরিক হিংসা, আচরণগত হিংসা এবং প্রতীকি হিংসার সমস্ত দিকগুলিকেই আলোচনায় আনা হয়। এই রিপোর্টের সেকশন ১-এ দেখা যাচ্ছে ২০২০-তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে শারীরিক হানাহানি আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে। ২০১৯-এ যতগুলি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল তার তুলনায় ২০২০-তে প্রায় ৬০ শতাংশ কম হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ২০২০-তে ১০টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে যাতে ৫৯টি প্রাণহানি হয়েছে। সেখানে ২০১৯-এ দাঙ্গার সংখ্যা ছিল ২৫টি এবং মৃত্যু হয়েছিল ৮ জনের। (ইঞ্জিনিয়ার, দাভাড়ে এবং নায়ার, ২০২০)। হয়তো বাস্তবত দাঙ্গার সংখ্যা ১০-এর বেশিই হবে, কিন্তু সিএসএসএস মূলত ৫টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলির কথাই ধরেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন ধরন উঠে আসছে যেগুলি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দাঙ্গার সংখ্যা কম হওয়াটা কতটা প্রকৃতই স্বস্তিদায়ক তা বুঝতে এই জিনিসগুলি অনুধাবন করা জরুরি।

২০২০-তে যে বড় দাঙ্গাগুলি হয়েছিল— যেমন ফেব্রুয়ারিতে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে এবং মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী, ইন্দোর এবং মন্দসৌরে— সেগুলিকেই বর্তমান সময়ের প্রতীক ধরা যায়। স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে অতি-সক্রিয় হয়ে উঠছে তার আদর্শ উদাহরণ এই দাঙ্গাগুলি। আগে প্রাতিষ্ঠানিক দাঙ্গা ব্যবস্থা (ইনস্টিটিউশনালাইজড রায়ট সিস্টেম বা আইআরএস) খুব যত্ন সহকারে দাঙ্গা লাগানোর জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করত, সেখানে পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা-পরিস্থিতি তৈরি করত, এবং ট্রিগার পয়েন্ট হিসেবে কিছু জায়গাকে বেছে নিয়ে সেখানে শক্তি কেন্দ্রীভূত করত। একটা দাঙ্গা লাগানোর জন্য বিস্তৃত পরিকল্পনা এবং ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণ করা হয়। কারণ, যতই দুর্বল এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বিরোধীভাবাপন্ন হোক না কেন, এইসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তদন্ত এবং বিচারের মুখোমুখি হওয়ার একটা ভয় কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে বিষয়টা পালটে গেছে। ২০২০-তে যেটা দেখা গেল সেটা হল, রাষ্ট্রের সরকারি অবস্থান থেকে নগ্নভাবে দাঙ্গায় অংশগ্রহণ। এটা আগে কখনও এইভাবে দেখা যায়নি। রাষ্ট্র আজ আর নিরপেক্ষ থাকার ভানটুকুও করছে না। মধ্যপ্রদেশে আমরা দেখেছি হিন্দু জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলি খোলামেলা মুসলিমবিরোধী প্রচার করে, ঘৃণা ছড়িয়ে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করেছে। ওরা অকুতোভয়। ওরা জানে রাজনৈতিকভাবে ওরা সুরক্ষিত। উজ্জয়িনী এবং চন্দনখেড়ি গ্রামে আমরা দেখেছি খোদ রাষ্ট্রশক্তিই মুসলিমদের বাড়িঘর ভাঙছে। পুরো নগ্নভাবেই রাষ্ট্র আজ মুসলিম উৎপীড়নে নেমে পড়েছে।

তাই, এটা পরিষ্কার, ২০২০-তে দাঙ্গার সংখ্যা কমার অর্থ এই নয় যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির হ্রাস ঘটছে। বরং সাম্প্রদায়িক পরিচিতি আরও সংহত হয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আরও বেশি করে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটাচ্ছে। তারা এখন প্রকাশ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, নির্লজ্জ হিংস্রতায় তাদের রক্ত চাইছে। এ সবই আমরা দিল্লি দাঙ্গার সময়ে দেখেছি। আরও দেখেছি রাষ্ট্রের প্রকাশ্য মদত। রাষ্ট্র যে শুধু এই ঘৃণ্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না তাই নয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিপীড়নে নিজেরাই ময়দানে নেমে পড়ছে। একটাই উদ্দেশ্য— তাঁদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া যে তাঁরা অধুনা এই অথর্ব ভারতীয় গণতন্ত্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বই কিছু না। ফলত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাতে এখন আর ভয় লাগছে না। বিষয়টা একটা স্বাভাবিকত্ব অর্জন করে নিচ্ছে, এবং ধর্মীয় মেরুকরণও তীব্রতর হচ্ছে।

পদ্ধতি

সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম তাদের রিপোর্ট তৈরি করতে ৫টি বিশিষ্ট সংবাদপত্রের খবরের ওপর ভিত্তি করে— ইংরাজি কাগজ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং দ্য হিন্দু-র মুম্বাই সংস্করণ এবং উর্দু সংবাদপত্র ইনকিলাব এবং শাহাফাত। আগে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংক্রান্ত যে রিপোর্ট বের করত সেগুলিতে যথেষ্ট তথ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যেত। এনসিআরবি সারা দেশের থানাগুলি থেকে খবর সংগ্রহ করতে পারত, ফলে সিএসএসএস-এর থেকে তাদের পরিসংখ্যান অনেক বেশি হত। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক প্রদত্ত সংখ্যাগুলিও অনেক সময়েই সিএসএসএস-এর চেয়ে বেশি হত। কিন্তু গত দু বছর ধরে এনসিআরবি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কোনও তথ্য প্রকাশ করছে না— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই কিছুদিন আগে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে কেবল। ফলে কোনও বিস্তৃত তুলনা সম্ভব নয়, এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরই এখন একমাত্র তথ্যের উৎস হয়ে দঁড়িয়েছে।

দাঙ্গার অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন

২০২০-তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভরকেন্দ্র ছিল উত্তর ভারত। উল্লিখিত ৫টি সংবাদপত্রে যে ১০টি দাঙ্গার খবর নিয়ে সিএসএসএস অধ্যয়ন করেছে, তার মধ্যে ৫টিই হয়েছে উত্তর ভারতের বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং দিল্লিতে। দক্ষিণের কর্নাটক এবং তেলেঙ্গানায় দুটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, একটি পশ্চিমের গুজরাটে, একটি উত্তর-পূর্বের অসমে এবং একটি পূর্ব ভারতের ঝাড়খণ্ডে।

উত্তর ভারতের সাম্প্রদায়িক প্রবণতার কথা মাথায় রাখলে সেখানে দাঙ্গার এই সংখ্যাধিক্যের মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। বহু বছর ধরে উত্তরপ্রদেশ দেশের সর্বাধিক দাঙ্গাপ্রবণ রাজ্যের মর্যাদা ভোগ করছে। যদিও ২০২০-তে দাঙ্গার ভরকেন্দ্র ছিল দিল্লি এবং মধ্যপ্রদেশ। দিল্লির দাঙ্গা ঘটানো হয়েছিল সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বদলা হিসেবে— তিনদিনেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল এবং জাফরাবাদ, মৌজপুর, শিবপুরীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী, ইন্দোর এবং মন্দসৌরের দাঙ্গার কারণ রামমন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দুত্ববাদীদের চাঁদা তোলার ছলে গুণ্ডামি, দাদাগিরি। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিকে লাভ-জিহাদ, রামমন্দির নির্মাণ বা গোহত্যা জাতীয় সাম্প্রদায়িক প্রচার লাগাতার চালিয়ে উত্তপ্ত করে রাখা হয়েছিল। এখানে এটাও খেয়াল রাখা খুব জরুরি যে সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যা রায়ের পরেই সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন গজিয়ে উঠেছে এবং এদের সবারই দাবি কোনও না কোনও মসজিদ বা দরগার তলায় কোনও প্রাচীন হিন্দু মন্দির রয়েছে। কাশী আর মথুরার জমি হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি হিন্দু মহাসভা অনেকদিন আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছে। হুমকিও দিয়ে রেখেছে তাদের দাবি পূরণ না হলে জনগণকে খেপানোর জন্য তারা যাত্রা শুরু করবে (অবস্থি, ২০২০)।

দক্ষিণ ভারতের দাঙ্গাগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই দাঙ্গাগুলি সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ রোপণের একটা ধারাবাহিক প্রয়াসের ফল। এগুলি সেই জায়গাগুলিতেই হয়েছে যেখানে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের রাজনৈতিক বা নির্বাচনী জমি বানাতে চাইছে দীর্ঘদিন ধরে। একটা হয়েছে তেলেঙ্গানার ভাইঁসাতে, এবং অন্যটা কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে। ভাইঁসা একটি সাম্প্রদায়িক স্পর্শকাতর অঞ্চল। এখানে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়েরই বাস, এবং এখানকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং দাঙ্গার পূর্ব-ইতিহাসও রয়েছে। এখানে সাম্প্রদায়িক হিংসার শেষ বড় ঘটনাটি ঘটে ২০০৮-এর অক্টোবর মাসে। দুর্গাপূজার বিসর্জনের মিছিলকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়ায়, এবং যার পরিণতিতে তিনজনের মৃত্যু ঘটে। পশ্চিমে গুজরাটের খাম্বাত অঞ্চলে একটি দাঙ্গা হয়। খাম্বাত এই কয়েক বছর ধরে সাম্প্রদায়িকভাবে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরে সেখানে প্রতি বছরই একটা করে দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। পূর্বে ঝাড়খণ্ডেও মেরুকরণের রাজনীতির প্রভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল। আর অসম বরাবরই সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর জন্য একটা সুবিধাজনক জায়গা। তার মধ্যে সেখানে এনআরসি-র প্রক্রিয়ার ফলে একটা ভয়, অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি হয়েই রয়েছে।

হাতিয়ারগুলি

সামগ্রিকভাবে সাম্প্রদায়িক চর্চায় একটা পরিবর্তন এসেছে। ২০২০ সালে হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলির হাতিয়ারগুলির দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। অতীতে আমরা দেখেছি বেশিরভাগ দাঙ্গার কারণই প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক ছিল না। অনেক সময়েই এরকম হত যে ব্যক্তিগত বা সামাজিক স্তরের দ্বন্দ্বগুলিকে সাম্প্রদায়িক রং দিয়ে দেওয়া হত এবং হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া হত। আগে প্রাতিষ্ঠানিক দাঙ্গা পদ্ধতি (আইআরএস)-র ভূমিকা এবং কার্যপদ্ধতিকে পরিষ্কার অনুভব করা যেত। যখনই কোনও সামান্য সম্ভাবনা দেখা যেত সেখানে আইআরএসকে সযত্নে কাজে লাগিয়ে সেটাকে একটা দাঙ্গায় পরিণত করার চেষ্টা করা হত। কিন্তু ২০২০-তে আমরা দেখলাম দাঙ্গাগুলি রাষ্ট্র প্ররোচিত সরাসরি সংঘর্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবিধানিক পদে থাকা লোকজনেরা দ্বিধাহীনভাবে ঘৃণা উদ্রেককারী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আরেকটা স্পষ্ট প্রবণতা হল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ইন্ধন দেয় সেইরকম ধরনের জিনিসপত্র পোস্ট করা হচ্ছে যাতে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। যুব সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক উস্কানি দিয়ে দাঙ্গায় অংশ নিতেও সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে সোশ্যাল মিডিয়া এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবিধানিক পদাধিকারীদের ঘৃণা-উদ্রেককারী বক্তব্য: প্রথমেই বলে দেওয়া যাক— দিল্লি দাঙ্গা হল রাজনৈতিক নেতাদের ঘৃণা-উদ্রেককারী বক্তব্য এবং প্রশাসনের সহায়তায় নির্মিত একটি হিংসাত্মক আবহাওয়ার প্রত্যক্ষ ফল। দিল্লির সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য পুলিশ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ফ্রি-হ্যান্ড দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সুরক্ষার বলে বলীয়ান হয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হিংস্র নেকড়ের মত ঝাপিয়ে পড়ে। সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনগুলির মাধ্যমে সারাদেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ঘোষণা করা শুরু করেছিল। সেটাই এদের চিন্তিত করে। এই হিংসা সেটাকে ভাঙার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয়েছিল।

দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশন তাদের রিপোর্টে বিজেপির কপিল মিশ্রের মতো নেতাদের ঘৃণ্য উস্কানিমূলক বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেছে। তারা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের একটি বক্তব্যের কথাও উল্লেখ করেছে। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে অমিত শাহ যে বক্তব্যে ভোটারদের নির্বাচনে ইভিএমের বোতামটা এতটাই জোরে টেপার আহ্বান জানিয়েছিলেন যাতে শাহিনবাগের প্রতিবাদকারীরা সেই জোরের মালুম পায়।

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার এসে দেওয়া যোগী আদিত্যনাথের একটি বক্তব্যের কথাও ওই রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে। আদিত্যনাথ বলেছিলেন বিজেপি সরকার আনতে। বলেছিলেন সেই সরকার সব ধর্মকে নিয়ে কাজ করবে। আর সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছিলেন যেখানে কথায় (বোলি) কাজ হয় না, সেখানে গুলি (গোলি) ভালো কাজ দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা শুনে এই রিপোর্টে দাঙ্গায় ক্ষয়ক্ষতির কিছু খতিয়ান এবং পুলিশি প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লিখিত হয়েছে। শোনা যাক:

কিছু ক্ষেত্রে দাঙ্গাবাজদের লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং হিংসার ঘটনাগুলিকে পুলিশ স্রেফ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা পরিষ্কার দাঙ্গাবাজদের উৎসাহ দিয়েছে তাদের বর্বরতা চালিয়ে যেতে। কিছু ক্ষেত্রে এমনকি এমনও হয়েছে যে, পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনির অফিসাররা দাঙ্গাবাজদের লুটপাট ইত্যাদি হয়ে যাওয়ার পরে তাদেরকে এসকর্ট করে এলাকা পার করিয়ে দিয়েছে। অবশ্য কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশ আক্রান্তদেরও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।

হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির উস্কানিমূলক স্লোগান এবং মিছিল: মধ্যপ্রদেশে দাঙ্গার চালিকাশক্তি ছিল উজ্জয়িনী, ইন্দোর এবং মন্দসৌরে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির মিছিল। এই মিছিলগুলির উদ্দেশ্য হল রামমন্দিরের জন্য চাঁদা তোলা। এই মিছিলগুলি থেকে প্রকাশ্যেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর স্লোগান দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ উজ্জয়িনীতে একটা স্লোগান দেওয়া হয়— ‘বাচ্চা-বাচ্চা রাম কা/চাচিওঁ কে কাম কা’। স্লোগানটির মধ্যে মুসলিম মহিলাদের প্রতি কুরুচিপূর্ণ যৌন ইঙ্গিত স্পষ্ট। কাছাকাছি অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়— রামের সমস্ত বাচ্চাকাচ্চাই কাকিদের জন্য যথেষ্ট কাজের। অভিযোগ, এই স্লোগান শুনেই বেগম বাগের মুসলিম অধিবাসীরা মিছিলে পাথর ছোড়া শুরু করেন। মনে রাখতে হবে এই তিনটি অঞ্চলের সমস্ত মিছিলই কিন্তু হয়েছে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র সহযোগে।

সোশাল মিডিয়া: কর্নাটকের দাঙ্গার পেছনের কারণ হল পুলিকেশি নগরের কংগ্রেস বিধায়ক আর অখণ্ড শ্রীনিবাসা মূর্তির ভাইপো পি নবীন কুমারের একটি তথাকথিত ‘অবমাননাকর’ সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট। পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ডিজে হাল্লি থানার বাইরে শ দুয়েক জনতা জমায়েত হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করার দাবি করতে থাকে। একই সময়ে প্রায় হাজারখানেক লোক জড়ো হয় শ্রীনিবাসা মূর্তির বাড়ির সামনে। দুদিকেই জনতা হিংস্র হয়ে ওঠে এবং নবীন কুমারকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে।

অন্যান্য হাতিয়ারগুলি: অসমের বক্সায় কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতি শালবাড়ির কালপানি জামা মসজিদে ঢোকে এবং ধর্মীয় বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে সারা অসম সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়ন এবং সারা বড় (Bodo) সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়ন ব্যাপক বিক্ষোভ দেখানো শুরু করে। মসজিদের বাইরে একটি ধর্নাও শুরু হয়। শালবাড়ি এলাকায় হিন্দু মুসলমান এবং খ্রিস্টান সমস্ত সম্প্রদায়েরই বাস। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ সেই শেষ এনআরসি তালিকা বেরোনোর পর থেকেই দুষ্কৃতিরা কালপানি মসজিদকে টার্গেট করেছে। ফলে এনআরসির বিভেদমূলক পদ্ধতি থেকেই এই এলাকার মতো গোটা অসমেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে বলা যায়।

ঝাড়খণ্ডের গুমলাতে বাসিয়া রোডের জনৈক বাসিন্দা আনিস আনসারি পুকুরের ধারে ঘোরাঘুরি করছিলেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা তার ওপর চড়াও হন, এবং সেখান থেকেই ঝামেলার সূত্রপাত হয়। স্থানীয়দের মধ্যে প্রচার করা হয়েছিল কিছু বহিরাগত কোভিড ১৯ ভাইরাস ছড়ানোর জন্য এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাত ৮টা নাগাদ আরেকদল লোক লাঠিসোটা এবং মশাল হাতে রাস্তায় বেরোয় আনসারির ওপর হওয়া হামলার প্রতিবাদ করতে। তারাই কয়েকজন আদিবাসীকে দেখে ফেলে এবং তাদের ওপর আক্রমণ করে।

ফলে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা, আক্রমণাত্মক মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উত্তরোত্তর বেড়ে চলা উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশ, রাজনৈতিক নেতাদের প্রকাশ্য সংখ্যালঘু-বিরোধিতা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানো— এগুলিই হল ২০২০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনের মূল হাতিয়ার। এই সব ঘটনাই ঘটেছে প্রকাশ্যে, যথেষ্ট নির্লজ্জভাবে, এবং এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকাও যথেষ্ট প্রত্যক্ষ এবং নগ্ন।

মৃত্যুর অঞ্চলভিত্তিক খতিয়ান

২০২০তে দশটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মোট ৫৯টি জীবনহানির খবর পাওয়া গেছে, যেখানে ২০১৯এ এই জীবনহানির সংখ্যাটি ছিল ৮। এই ৫৯টি প্রাণহানির মধ্যে ৪২ জনই মুসলিম। শুধু দিল্লির দাঙ্গাতেই ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ৩৮ জনই মুসলিম। বেঙ্গালুরু দাঙ্গায় ৪ জন মুসলিমের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে ১১ জন হিন্দুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ৯ জন নিহত হয়েছেন দিল্লির দাঙ্গায়, ১ জন খাম্বাতে এবং আর ১ জন ঝাড়খণ্ডের গুমলাতে। অন্য যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের ধর্ম ঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। ফলে সব মিলিয়ে বেশিরভাগ মৃত্যুই যে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সেটা পরিষ্কার।

গ্রেপ্তারির অঞ্চলভিত্তিক খতিয়ান

২০২০তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় যতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদেরও বেশিরভাগই মুসলিম। দিল্লি দাঙ্গার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যে সরাসরি হিন্দুদের হয়ে কাজ করেছে, হিন্দুদের সুরক্ষা দিয়েছে, সেই সম্পর্কে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। এফআইআর নেওয়ার ক্ষেত্রে যথেচ্ছ স্বেচ্ছাচারিতা দেখানো হয়েছে। মুসলিমদের প্রচুর অভিযোগের ক্ষেত্রে কোনও এফআইআরই নেওয়া হয়নি, আর নয় তো সেগুলো বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যদিও পুলিশের দাবি তারা বিভিন্ন অভিযোগ থেকে প্রায় ১৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, এবং সেখানে নাকি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই প্রায় সমান সমান। এই দাবী যে কতটা মর্মান্তিক এবং হাস্যকর তা লুটপাট অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মুসলিমদের সম্পত্তিহানির পরিমাণ এবং তাদের জীবনহানির পরিমাণ দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। মধ্যপ্রদেশে তো সরকার দুজন মহিলা সমেত ১৮ জন মুসলিমের বিরুদ্ধে দানবিক ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রয়োগ করেছে। এখানে তিন জায়গার দাঙ্গায় মোট ২৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।

ফলে অতীতের মতো এই ২০২০তেও আমরা দেখলাম মুসলিমরাই সাম্প্রদায়িক হানাহানির দুতরফা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। প্রথমত দাঙ্গায় ক্ষয়ক্ষতি হওয়া বা জীবনহানি হওয়ার ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এবং দ্বিতীয়ত এই এনএসএ-র মতন দানবীয় আইন তাদের ওপর প্রযুক্ত হয়ে তাদেরকেই আবার অপরাধী সাব্যস্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ঘরবাড়ি ভাঙা এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি তাঁদের রাষ্ট্রের এই নির্লজ্জ একচোখোমির শিকার হতে।

রাষ্ট্রের ভূমিকা

রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সমস্ত নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া এবং কোনওরকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুস্থিত রাখা। কিন্তু ২০২০ সালের দাঙ্গার চিত্রগুলি খুবই উদ্বেগজনকভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে রাষ্ট্র এমনকি নিরপেক্ষ থাকার ভানটুকুও আর করছে না। নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কাজটা তারা পুরোপুরি অস্বীকার করছে। দাঙ্গাবাজদের মদত এবং সুরক্ষা দেওয়াটাই এই দাঙ্গাগুলিতে রাষ্ট্রের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাঙ্গাগুলির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখলেই এই প্রবণতা স্পষ্ট বোঝা যায়।

মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর, ইন্দোর এবং উজ্জয়িনীতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলি রামমন্দিরের জন্য চাঁদা তুলতে বাইক মিছিল বের করছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলের মতন সংগঠনও ছিল এইসব মিছিলগুলিতে। উজ্জয়িনীতে মিছিলের নেতৃত্বে ছিল ভারতীয় জনতা যুব মোর্চা। উজ্জয়িনীর বেগম বাগে মিছিল থেকে উস্কানিমূলক স্লোগান দেওয়া হয়, এবং তার উত্তরে পাথর ছোড়া শুরু হয় বলে খবর। এবার পুলিশ যে এই মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের ওপর কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি তাই নয়, পরের দিন পুলিশ বেগমবাগে যায় এবং অদ্ভুতভাবে একটা বাড়ি ভেঙে দেয় এবং আরেকটা বাড়িরও যথেষ্ট ক্ষতি করে এই বলে যে এগুলি নাকি বেআইনি নির্মাণ। উজ্জয়িনীর ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর আশিস সিংয়ের কথা অনুযায়ী যারা পাথর ছুড়েছিল তাদের অর্থনৈতিকভাবে আঘাত করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। (সিদ্দিকি, ২০২০)।

ইন্দোরে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা একটি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। মসজিদের বাইরে তারা হনুমান চালিশা পাঠ করা শুরু করেছিল। মন্দসৌরের ভাইরাল হওয়া ভিডিও থেকে দেখা যায় গেরুয়া পতাকা হাতে একটা দল একটা স্থানীয় মসজিদের সামনের সরু গলিটা স্লোগান দিতে দিতে বন্ধ করে দেয়, তারপরে তাদের থেকে কেউ কেউ মসজিদের ওপরে উঠে গেরুয়া ঝান্ডা লাগিয়ে দেয়। ২৫ থেকে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে এই ধরনের মিছিল গোটা মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই সংঘটিত হয় যার অধিকাংশেরই কোনও প্রশাসনিক অনুমতি ছিল না। কিন্তু যথারীতি তাদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, উপরন্তু নির্দোষ মুসলিমদের বিরুদ্ধেই এনএসএ প্রযুক্ত হয়।

দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে অ্যামনেস্টি এবং বিবিসি তাদের রিপোর্টে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশ কেমন নির্মমতা দেখিয়েছিল তা উল্লেখ করেছে (বিবিসি নিউজ, ২০২০)। রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজরা মুসলিমদের উপর তিন দিন ধরে যথেচ্ছ অত্যাচার চালিয়েছে— তাদের হত্যা করেছে, তাদের সম্পত্তি লুটপাট করেছে, তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়েছে, এবং এই পুরো পর্যায় জুড়েই পুলিশ তাদের সাহায্য করে গেছে। নির্যাতিতদের আবেদনে তারা কোনও কর্ণপাতই করেনি। অ্যামনেস্টি এবং বিবিসি রিপোর্টে বলছে যে এরকম একটি ভিডিও দেখা গেছে যেখানে পুলিশ একজন মুসলিমকে মারতে মারতে মেরেই ফেলল। দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশন (ডিএমসি) জানিয়েছে দাঙ্গার সময় মুসলিমদের বাড়ি-দোকান এবং যানবাহন নির্দিষ্ট করে টার্গেট করা হয়েছিল। ডিএমসি তাদের রিপোর্টে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছিল। এবং ভয়ানক বিষয়টি হল, এই রিপোর্টের পরেই ডিএমসি চেয়ারপারসন জাফারুল ইসলাম খানকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। জাফারুল সাহেবের অপরাধ, দিল্লি দাঙ্গায় কেমনভাবে মুসলিমদের টার্গেট করা হচ্ছিল সেই নিয়ে তিনি ফেসবুক এবং টুইটারে পোস্ট করেছিলেন। সেগুলিই নাকি “উস্কানিমূলক” এবং “সম্প্রীতি নষ্টকারী”।

রাষ্ট্রের এই সংখ্যাগুরুদের পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মমতা দেখানোর কাজকর্ম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা ফাঁপা হয়ে গেছে। একই সঙ্গে সংবিধান যে দেশের প্রতিটি নাগরিককে আইনের চোখে সমান সুরক্ষা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে, সেই ঘোষণাও অসম্মানিত এবং নাকচ হয়ে যায়।

উপসংহার

সিএসএসএস সংবাদপত্রের খবরের ভিত্তিতে যে রিপোর্ট করেছে তাতে ২০২০-তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংখ্যা অনেকটা কম দেখা গেলেও সাম্প্রদায়িক হিংসা কমেছে সেটা কোনওভাবেই বলা যায় না। বরং এই বছর দেখা গেল রাষ্ট্র স্বয়ং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাতিয়ার করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যথেচ্ছ নিপীড়ন চালাচ্ছে। একদিকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভেদমূলক আইন এবং নীতির মাধ্যমে ধর্মীয় বিভাজন এবং মেরুকরণ তীব্র হচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এনএসএ-র মতো দানবিক কালাকানুন প্রয়োগ করে তাঁদের দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখা, নির্বিচারে তাঁদের বাড়িঘর সম্পত্তি ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে। দাঙ্গার সময়গুলিতে একদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পূর্ণ মদত এবং সুরক্ষা পাচ্ছে, এবং নিপীড়িত সংখ্যালঘুরা এমনকি তাঁদের অভিযোগটুকুও জানানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। ভারত ধীরে ধীরে অরাজকতা এবং স্বৈরাচারিতার অন্ধকার সুড়ঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে— যেখানে সাংবিধানিক রক্ষাকবচগুলিকে ন্যূনতম সম্মান দেওয়া হচ্ছে না, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে চূড়ান্ত অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যাবতীয় হিংসা এবং উৎপীড়নকে উৎসাহ দিয়ে যাওয়া হচ্ছে।


লেখাটি ইংরাজিতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি সিজেপি-র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...