চন্দ্রকেতুগড়: ঘুমিয়ে থাকা ইতিহাসের ঐশ্বর্য

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

টাকি রোড ধরে বাসটা যখন নির্লজ্জের মত হা-হা করে ছুটে চলছিল, দুপুরের উত্তপ্ত হাওয়ার সঙ্গে আরও কিছু অনুভব করছিলাম। দূরত্ব কমে যাওয়ার অনুভব। নিজের সঙ্গে দূরত্ব কমে যাচ্ছে। ইতিহাসের ঐশ্বর্যের কাছাকাছি পৌঁছোতে পারছি ভেবেই রোমাঞ্চকর অনুভূতির জালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। বারাসাত পৌঁছোতেই সেইসব কল্পনার জাল ছিঁড়ে গেল। বাস থেকে নেমে বেড়াচাঁপা মোড়ের অটো ধরে পৌঁছলাম চন্দ্রকেতুগড়।

বারাসাত রোড হয়ে চন্দ্রকেতুগড় যাওয়ার রাস্তা

রাস্তা। মানুষ। যেন ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা অচেনা পৃথিবী। ইতিহাস আর স্মৃতির সম্পর্ক বড় গভীর। তবে চন্দ্রকেতুগড় পৌঁছানোর রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার পথে মানুষগুলোর সারল্য অন্য কোনও এক ঐশ্বর্যের দিকনির্দেশ করছিল। মানবতার ঐশ্বর্য।

জল। শীতলতা। আখের রসের গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দেওয়ার সময় অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছিলেন বিক্রেতা। গ্রামের মেঠো পথে আমি কোন সৌন্দর্য খুঁজতে এসেছি! তাঁর চোখে সেই প্রশ্ন।

মাস্ক পরেই পথচারীদের ক্লান্তি জুড়িয়ে দিচ্ছিলেন মানুষটি।

‘চন্দ্রকেতুগড়টা ঘুরে দেখব।’ অব্যক্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে এগিয়ে চললাম।

ঘুমিয়ে থাকা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে কলকাতা থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের এই পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ‌ চন্দ্রকেতুগড়। কলকাতা থেকে বারাসাতগামী যেকোনও বাসে বারাসাত নেমে সাধারণত অটোতে যাওয়া যায় চন্দ্রকেতুগড়।

চন্দ্রকেতুগড়: সংরক্ষিত এলাকার শুরু

সময়টা উনিশ শতক। এক বাঙালি পুরাতত্ত্ববিদ পৌছলেন বারাসাত অঞ্চলে। ইতিহাসের গন্ধমাখা এই জায়গার খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি। তবে ইতিহাসের অস্তিত্ব বরাবরই প্রমাণ দাবি করে। তাই প্রয়োজন ছিল খননকার্যের। ওই বিশেষ জায়গাটির নাম বেড়াচাঁপা। সেই অঞ্চলে খননকার্যের অনুরোধ করে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চাইলেন ওই ইতিহাসপ্রেমী পুরাতত্ত্ববিদ। এদিকে কর্তৃপক্ষের অনুমতিসহ খননকার্য সম্পন্ন করার চিঠি যখন এসে পৌঁছল ওই পুরাতত্ত্ববিদ তখন অবসর নিয়েছেন। ইতিহাস আরও গহীনে তলিয়েছে।

সরকারি ফলক

তবে ততদিনে ইতিহাসের সোঁদা গন্ধ সময় পার করে পৌঁছে গেছে আরও এক ঐতিহাসিকের কাছে। নবীন ওই ঐতিহাসিকের উদ্যোগে অবশেষে বেড়াচাঁপা অঞ্চলে শুরু হল খননকার্য। মিলল ঐশ্বর্য। ঘুমিয়ে থাকা ইতিহাসের সম্পদ মানুষের গোচরে এল। পাওয়া গেল এক হারিয়ে জাওয়া প্রাচীন জনপদ। বলা ভালো, জনপদের ধ্বংসাবশেষ। নেপথ্যে ছিলেন সেই নতুন ঐতিহাসিক। উনিশ শতকের শুরুর সময় থেকে ক্রমাগত দু বছর বেড়াচাঁপা অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে চন্দ্রকেতুগড়ের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেছিলেন সেদিনের সেই নবীন পুরাতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ফলক

প্রাচীন জনপদের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে এই ঐতিহাসিকের জুড়ি মেলা ভার। মহেঞ্জোদারোর মতো প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষও উদ্ধার করেছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এরপরেও একাধিকবার এই বেড়াচাঁপা অঞ্চলে অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়েছেন।

চন্দ্রকেতুগড়: এখানে একাধিক বার খননকার্য চালানো হয়েছিল

এর ফলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসপত্র আশুতোষ সংগ্রহশালা ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও বেশ কিছু নিদর্শন শহরে এবং শহরের বাইরেও ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে।

কথিত আছে, এক ঐতিহাসিকের মাধ্যমে চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত পঞ্চচূড় অপ্সরা, নগরশ্রেষ্ঠী ও গজদন্তের প্রতিকৃতি এই মহাদেশ পার করে পৌঁছে গেছে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংগ্রহশালায়।

“সেই রাজার জায়গায় যাবে? ওই দিকে।” স্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তিটির চোখে মুখে তখন রাজ-গর্ব ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক বিকেলের সোনালী রোদ্দুরের মত। তাঁর দেখানো পথে যখন চন্দ্রকেতুগড় পৌছলাম, মাথার উপর সূর্যের গনগনে আঁচের অবস্থান টের পাচ্ছি। মার্চ মাসেই সে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

চন্দ্রকেতুগড়: সুরক্ষিত প্রত্নস্থল

আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সংরক্ষিত জায়গায় পৌঁছে দেখি স্থানীয় কচিকাঁচাদের ভিড়। তবে আমার মত কিছু ইতিহাসপ্রেমীরাও ইতি-উতি ছড়িয়ে রয়েছেন। চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলের সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য টুকে নিচ্ছেন নোটবুকে। ইতিহাস বোধহয় এমনই, মানুষের গল্প মানুষের মাধ্যমেই পাড়ি দেয় সময় পার করে। তাই তা মূল্যবান রত্নের মতো গচ্ছিত থাকে।

চন্দ্রকেতুগড় একটি প্রাচীন জনপদ। আনুমানিক চারশো থেকে আটশো খ্রিস্টপূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আনুমানিক বারোশো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই প্রত্নস্থলটিতে জীবনের অস্তিত্ব ছিল। সম্ভবত তারপরেই পরিত্যক্ত হয়ে যায় জনপদটি।  জনবসতিও সেভাবে ছিল না তারপর থেকেই। এখানকার মানুষেরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ইতিহাসবিদরা অনুমান করছেন, এটি বন্দরনগরী ছিল। উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে এই বন্দরনগরীর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। এই অঞ্চলের পাশে নদীর উপস্থিতি এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে।

চন্দ্রকেতুগড়ের খননকার্যে পাওয়া রুপোর মুদ্রায় যে বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া গেছে তার রূপ স্বতন্ত্র। ঠিক জায়গাটার মতই। এখানে বুদ্ধদেব বজ্রমুষ্টি। এমনই স্বতন্ত্র উপস্থিতি ছিল এই প্রাচীন জনপদের। একটি ছোটখাটো সভ্যতার ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে। ভূতত্ত্ববিদরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এখানে জলপথের উপস্থিতির খোঁজ পেয়েছেন। নৌকো ব্যবহৃত হত বাণিজ্যের জন্য। ঘোড়া, পালতোলা নৌকার প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে মুদ্রায়। চন্দ্রকেতুগড় নামের উৎপত্তি নিয়েও মতভেদ রয়েছে ঐতিহাসিকদের। একদল ঐতিহাসিকের মতে পাল যুগের পরবর্তী সময়ে চন্দ্রকেতু নামে এক রাজা ছিল, সেই রাজার নাম অনুযায়ী এই জনপদের নাম হয়েছিল চন্দ্রকেতুগড়। কেউ কেউ মনে করেন রাজবংশের দুর্গের নাম ছিল চন্দ্রকেতু, সেখান থেকেই এই অঞ্চলের নাম চন্দ্রকেতুগড়। রাজার দুর্গের ধ্বংসাবশেষ যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বিশেষভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে সেই জায়গাটি। প্রায় এক বর্গ মাইল বিস্তৃত এলাকা সংরক্ষিত বলে বিবেচিত হয়েছে। এই দুর্গের বিশ্রামাগারে নাকি বণিকরা রমণীরা বিশ্রাম নিতেন। বর্তমানে সেই ধ্বংসাবশেষ জুড়ে বিস্তৃত মাঠ। সবুজের সমাহার। স্মৃতির আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে বর্তমান। খানিক সময় নিয়ে গেলে ওই এলাকায় ইতিহাসের কাল্পনিক ফিসফিস শোনা যেতেই পারে। যে জায়গাটিতে চন্দ্রকেতুগড় এর জনপদ ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, সেই বিস্তৃত অঞ্চলে সবুজেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার পাশেই দূষণহীন ধানক্ষেতের পাশে এলিয়ে পড়া সূর্য। প্রায় পাঁচশো বছর আগের বাণিজ্য-পথে ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে সোনালী ধানের উপস্থিতি যেন ঝিলমিলিয়ে ওঠে। ইতিহাসের গর্বে না কি মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থার অহঙ্কারে তা বলা যায় না।

সম্ভাব্য বাণিজ্যপথ

এর পরের গন্তব্যস্থল খনা-মিহিরের ঢিবি। চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খনামিহিরের ঢিবি মাটি ও ইটের তৈরি আয়তাকার দুর্গ-প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ। এই দুর্গ প্রাচীরের অভ্যন্তরেই প্রাচীন ভারতের সভ্যতার পাঁচটি পৃথক সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে।

খনামিহিরের ঢিবি

ভারতের রাজা বিক্রমাদিত্যের সভারত্ন ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির। তাঁর পুত্রবধূ খনা। খনামিহিরের ঢিবি অঞ্চলে বাসস্থান ছিল খনা ও বরাহমিরিরের। এই ধ্বংসাবশেষটিও আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সংরক্ষিত এলাকা বলে বিবেচিত হয়েছে। জায়গাটি লোহার দরজা দিয়ে ঘেরা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আসা যায় এখানে। দুর্গ-প্রাচীরে চলাফেরা করায় রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ইতিহাসের গন্ধ মাখতে যাঁরা ওই অঞ্চলে যান, তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ করে রাখা হয় একটি রেজিস্টারে। সেটি সংরক্ষণ করার জন্য রক্ষী রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের তরফে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

সংরক্ষিত এলাকা

কথিত আছে বরাহমিহিরের নির্দেশে এখানেই অন্তঃপুরে বন্দি ছিলেন খনা। এই অঞ্চলটি যেন ইতিহাসের হিম-গহ্বর। এক নারীর ইচ্ছে, অনিচ্ছা আকাঙ্ক্ষা বন্দি ছিল ওই আয়তাকার দুর্গ-প্রাচীরে। কত স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে এই দুর্গ প্রাচীরে।

তবে এখন ইতিহাসপ্রেমী মানুষরা ছাড়াও নিছক সময় কাটাতেও সেখানে ভিড় জমান স্থানীয় লোকেরা। ইতিহাসের সম্পদ আর মানুষের এক-টুকরো অবসর সহাবস্থান করছে খনামিহিরের ঢিবি অঞ্চলে।

আয়তকার ধ্বংসাবশেষ

চন্দ্রকেতুগড়ে একটি সংগ্রহশালা রয়েছে। এখানে খননকার্যে প্রাপ্ত নানান প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসপত্র রাখা রয়েছে সেখানে। খনামিহিরের ঢিবি থেকে হাঁটাপথে মিনিট দশেক। সংগ্রহশালায় পৌঁছে দেখি সেটি বন্ধ হওয়ার পথে। তাও রক্ষীকে অনুরোধ করে ইতিহাসের আশ্চর্য নিদর্শন দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে নিলাম।

চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলে খনন-কার্যে প্রাপ্ত বেশ কিছু নিদর্শন আসাদুজ্জামান এবং দিলীপ কুমার মাইতি নামের দুই স্থানীয় মানুষের কাছেও রয়েছে। ইচ্ছে ছিল তাঁদের সঙ্গে আলাপ করার। কিন্তু সূর্যের অস্ত যাওয়ার ব্যস্ততা আর ঘড়ির কাঁটার চোখ-রাঙানিতে সেই ইচ্ছে মনের মধ্যে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। ইতিহাসের আশ্চর্য সব আনন্দ-বিষাদমাখানো তথ্য তখন মাথা আর মনের মধ্যে গিজগিজ করছে। বাড়ি ফিরে আমিও সময়-ভ্রমণ করব সেই ঐশ্বর্যের জগতে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. সর্বনাশের সপ্তপদী — পঞ্চম বর্ষ, দ্বিতীয় যাত্রা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...