২০২৬, লক্ষ্য লাক্ষাদ্বীপ

অংশুমান দাশ

 


পরিবেশবিদ ও খাদ্যসুরক্ষা বিশেষজ্ঞ। কবি ও প্রাবন্ধিক

 

 

 

আমি লাক্ষাদ্বীপ যাব। কলকাতার সব শপিং মল আমার ঘোরা হয়ে গেছে। শুনেছি আন্দ্রট দ্বীপে চমৎকার একটা শপিং মল হয়েছে। মাত্র পাঁচ বর্গ কিলোমিটার একটা দ্বীপ— দেড় কিলোমিটার চওড়া— ভাবুন তো মশাই, সেখানে একটা শপিং মল! মলটার মাথায় উঠলে সে একেবারে একঘর ভিউ। এদিকে নীল সমুদ্র— ওদিকেও নীল সমুদ্র। একদিকে বিত্রা আইল্যান্ডটাও দেখ যায়। ওখানে মাত্র আড়াইশো লোক ছিল, তা সবই প্রায় ট্রাইবাল, বুঝেছেন তো? জংলি। না, মানে আপনি যেরকম ভাবছেন সেই জারোয়াদের মত ইয়ে নয়, তবে ওই লোকাল লোকজন। যাইহোক, ওখান থেকে সবাইকে ভাগিয়ে দিয়েছে। ভালোই করেছে। ওখানে এখন নাকি একটা ফাইভ স্টার হোটেল হয়েছে। একেবারে জম্পেশ। কোচি থেকে সোজা হেলিকপ্টারে একবারে হোটেলের নিজস্ব হেলিপ্যাডে। তারপর মজাই মজা। ওখানে একদিন থাকব। শুনেছি দুবাইয়ের মত লাগজারি ব্যাপার স্যাপার। বিয়ার নাকি প্যাকেজের মধ্যেই? শুনেছেন কিছু? ভিউ আটকায় বলে পাড়ে পাড়ে নারকেল গাছ সব কেটে দিয়েছে। ভালোই হয়েছে— বিয়ার থাকতে ডাবের জল কে খায় বলুন তো— হ্যাঃ হ্যাঃ। অবশ্য ভদকার সঙ্গে ভালোই লাগে— তবে আজকাল তো আবার ডাবের জলের মত কী একটা ড্রিঙ্কও পাওয়া যায়। প্রচুর লোক একসময় লাক্ষাদ্বীপে কোরাল রিফ দেখতে যেত। আরে ওই যে প্রবাল প্রাচীর— সে তো অনেকদিন থেকেই কমে কমে আসছিল— এখন বোধহয় আর নেই। তাতে কী? এই সব হোটেল রিসর্ট থেকে ডলার কি কম আসছে নাকি? সরকার কিছু কোরাল তুলে বেচেও দিয়েছে— প্রচুর টাকা পেয়েছে বোধহয়, যদিও শুনছি তাতে নাকি দ্বীপগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তাতেই বা কী? উঃ, জলের মধ্যে ধরাচুড়ো পরে মুখে পাইপ নিয়ে ডুবে ডুবে লাল নীল পাথর দেখা— কী যে লোকের পোষাত, বুঝি না। আহা পাথর ঠিক নয়, কিন্তু ওই হল আর কী— নড়ে চড়ে না— পাথর কি শাঁকালু কী আসে যায়! অবশ্য এই লাক্ষাদ্বীপের সব দ্বীপগুলো নাকি ওই কোরালের ডেডবডির উপরেই তৈরি। কোরালের মাঝে মাঝে নাকি নানা রকম মাছটাছ পাওয়া যায়— নাহ, খাওয়ার মাছ নয়— ওই সামুদ্রিক মাছ আর কী। বাঙালি বুঝেছেন তো, মাছ হলেই আগে রুইমাছ ভাবে— হ্যাঃ হ্যাঃ। ওই ফাইভ স্টার হোটেলটার বেঙ্গল কুইজিন শুনেছি কলকাতার থেকেও ভালো। ওহ, কোরাল নিয়ে আপনাদের মহা উৎসাহ। একসময় কোরাল দেখতে শুনেছি অনেক লোক আসত। লোকাল লোকজনের একটা বড় রোজগার তো ওটাই ছিল। এতই যদি উৎসাহ— কাভারেত্তি দ্বীপে একটা মেরিন মিউজিয়াম করেছে তো লাক্ষাদ্বীপে— মনে হবে সমুদ্রের মধ্যে বসে আছেন একবারে সিঙ্গাপুর আর থাইল্যান্ডের মত। না না, কোনও দেশি লোক নেই— গাইড থেকে শুরু করে সব ফটাফট ইংরেজি বলছে। স্যুটবুট মিনিস্কার্ট পরা কর্পোরেট ব্যাপার-স্যাপার। আমি ওসব মিউজিয়াম টুজিয়াম দেখতে যাব না। সে তো বিবিসি চ্যানেলেই হরদম সমুদ্রের মাছ-টাছ দেখাচ্ছে। আরে মশাই এই ঘিঞ্জি কোলকাতার থেকে ওখানে একটু ফাঁকায় ফাঁকায় থাকব— একবারে ফ্রেশ। সমুদ্রের হাওয়া। সন্ধ্যাবেলায় পাড়-বরাবর হাঁটাহাঁটি— এর জন্যই তো যাব। এই তো ছবি দেখলাম সমুদ্রের পাড়ে যত জেলেদের ঘর ছিল, নৌকা ছিল, সব ভেঙে দিয়ে ‘লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ সেখানে দারুণ মেরিন ড্রাইভ করেছে। সারি সারি আলো, বাঁধানো পাড়। ওইসব জেলে, জাল, কাঠের বাড়ি, আঁশটে গন্ধ— সব ফাঁকা। একটা দুটো মডেল বাড়ি অবশ্য মিউজিয়ামটায় আছে। আগে তো সব ‘ইন্টিগ্রেটেড আইল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’-এর আওতায় ছিল, উন্নয়ন কিছুই প্রায় হয়নি। আগে মানে এই ২০২০ ডিসেম্বরের আগে। ৬৪০০০ লোক ছিল— যার মধ্যে, বুঝলেন তো, পঁচানব্বই ভাগই শিডিউল ট্রাইব— তারা থাকলে কি আর উন্নয়ন হবে বলুন তো? সব দিন-আনি-দিন-খাই লোক— সারা পৃথিবীর মধ্যে ক্রাইম রেট ছিল সব থেকে কম। আরে ক্রাইমটা করবে কী বলুন তো? চুরি ডাকাতি ছিনতাই— আরে কারও পকেটেই তো মাল্লু নেই— চুরিটা করবে কী? বুঝলেন তো উন্নতি বুঝবেন ক্রাইম রেট দিয়ে— লোকের হাতে পয়সা আসবে— তবেই তো ক্রাইম। যত উন্নতি তত ক্রাইম। এই দেখুন ইন্টিগ্রেটেড আইল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি হয়ে ২০২৬-এর মধ্যে ক্রাইম রেটে সর সর করে লাক্ষাদ্বীপ উপরের দিকে উঠছে! কত উন্নতি হয়েছে— মাল্টিপ্লেক্স, চওড়া চওড়া রাস্তা, ট্রাম— একবারে ফরেন। হ্যাঃ— বিনা পাসপোর্টে ফরেনের স্বাদ। আচ্ছা, লোকাল লোকেরা থাকলে এমন হত? তাদের বাড়ি-ঘর-জমি নিয়েই তো এসব হল। ওই যে একটা আইন করা হল ২০২১ সালে— যাতে সরকারের পছন্দমত প্ল্যানিং না হলে সরকার চাইলে জমি নিয়ে নিতে পারে— ভাগ্যিস হল! তবেই না বিদেশিদের আমরা এমন উন্নয়ন দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলাম! এখানকার লোকজন সব দেখুন গে কোচি গিয়ে লেবার টেবার হয়ে গেছে। এখানে তো এনআরসি-ও হয়ে গেছে— নিশ্চয় অনেকে ক্যাম্পেও আছে। এখানে এমনিতেই কেমন বেমানান লাগত না? আর তাছাড়া কস্ট অফ লিভিং এত বেড়ে গেছে যে লোকাল লোকেরা মানিয়েও নিতে পারত না। যাগগে ভালোই হয়েছে। আমাকে লাক্ষাদ্বীপ যেতেই হবে— যদি ভালো লাগে, ছোট্ট দেখে একটা বাড়িও করে ফেলব— টেম্পোরারি। কানাঘুষো শুনছি, এই তো এটা ২০২৬ সাল, কোরাল ক্ষয়ে যাচ্ছে বলে আর বছর দশেকের মধ্যে এমনিতেই লাক্ষাদ্বীপ ডুবে যাবে। তদ্দিন যতটুকু মস্তি করা যায় আর কী!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...