সত্যজেঠু ও এক ছেঁড়া ছাতার গপ্পো

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

সত্যজেঠুর ছাতা

এই লেখার সূত্র ধরে আপনাদের সকলকেই একবার পেছনে ফিরতে হবে। না, না, টাইম মেশিনে নয়, আমার সঙ্গে গুটি গুটি মন মিলিয়ে স্মৃতির আলপথ ধরে চলতে হবে আপনাদের। আমার সাবেক পাড়ায় সেকালে বহু বিচিত্র চরিত্রের মানুষের জমজমাট ভিড় ছিল। সেইসব মানুষের টইটম্বুর জটলার ভেতর থেকে আলাদা করে ডেকে এনে আজ আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব সত্যজেঠুর। পোশাকি নাম সত্যকিঙ্কর সেন। সত্যজেঠুর কথা আজও স্মৃতিপটে বেশ উজল হয়ে রয়েছে এই কারণে যে বছরভর তাঁর মাথার ওপরে মেলা থাকত একটা ঢাউস ছাতা। কোনও এককালে সেটা কালো রঙেরই ছিল বটে, তবে দীর্ঘ ব্যবহারে তার কাপড়ের রং জ্বলে গিয়ে অনেকটাই সাদাটে হয়ে গিয়েছিল। তবে এহ বাহ্য! সত্যজেঠুর ছাতার ওপরে ছিল বেশ বড় বড় কয়েকটা ফুটো, ফলে মাথার ওপর অভ্যাসমতো মেলা থাকলেও তাতে না আটকাত রোদ, না আটকাত জল। সাহস করে সত্যজেঠুকে সে কথা বললেই প্রথমে হো হো করে হেসে উঠতেন, আর তারপর খাটো গলায় আমাদের কানের কাছে মুখ এনে বলতেন— বুঝলে ভাইপোরা, বুড়ো মানুষের ছাতা জোয়ান হবে কী করে? আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার ছাতাটিও যে বেজায় বুড়িয়ে গেছে! আর তাছাড়া, এটাকে নিয়ে যথেচ্ছাচার তো কম করিনি! ময়দানের র‍্যাম্পার্টে দাঁড়িয়ে খেলা দেখা থেকে শুরু করে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ করতে করতে পদাতিক হয়ে পথে হাঁটা, রাজদ্বার থেকে শ্মশানঘাট যখন যেখানে গিয়েছি এই ছাতা বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো আমার পাশে থেকেছে…। আর আজ তোমরা আমার ফুটো ছাতা দেখে হাসছ! কিন্তু যেদিন পৃথিবীর ছাতাটা এরকম ছ্যাঁদা হয়ে যাবে, সেদিন তোমাদের যে কাঁদতে হবে।

সেদিন সত্যজেঠুর কথাগুলো কেমন হেঁয়ালিমাখা বলে মনে হয়েছিল, অথচ সেই কথাগুলোই আজ এমন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে দেখে মনে মনে বড্ড অবাক হই। পৃথিবীর ছাতাটা আজ সত্যিই ফুটো হয়ে গিয়েছে। আর সেই ফুটো পথে বেয়ে আসা সৌররশ্মির দাপটে বাড়ছে বিপন্নতার আর্তনাদ। বিষয়টা নিয়ে নাহয় একটু খোলসা করেই কথা বলি।

বায়ুমণ্ডলের ক্ষয়রোগ

একথা আমাদের সকলের জানা যে আমরা এক গ্যাস-সমুদ্রের মধ্যে ডুবে রয়েছি। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণী ও উদ্ভিদপ্রাণের অস্তিত্ব এই গ্যাসমণ্ডলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রাণদায়ী গ্যাসীয় বাতাবরণ, যদিও তার গ্যাসীয় অনুপাত সর্বত্র সমান নয়। ভূপৃষ্ঠের একেবারে সংলগ্ন অংশটি যা সাধারণভাবে পার্থিব বায়ুমণ্ডল নামে পরিচিত, তাতেই জীবনধারণের একান্ত প্রয়োজনীয় গ্যাসীয় উপাদান বিশেষত অক্সিজেনের পরিমাণ সর্বাধিক। ফলে আমরা স্বচ্ছন্দে শ্বসনকাজ চালাতে পারি। তবে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপীয় সমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় আবরণটির গুরুত্ব অপরিসীম।

যেমন ধরা যাক পৃথিবীর ছাতা নামে পরিচিত ওজোন স্তর বা ওজোনোস্ফিয়ারের কথা। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০-৪০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরের নিম্নভাগেই ওজোন স্তরের উপস্থিতি। তবে সারা বছরই একই উচ্চতায় এর অবস্থান তেমনটা অবশ্য নয়। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে পৃথিবীর অক্ষাংশ ও ঋতুগত পরিবর্তনের ফলে এই স্তরের উচ্চতাতেও পরিবর্তন ঘটে। এই স্তরের উপস্থিতি আমাদের কাছে পরম আশীর্বাদের মতো, কেননা সৌর আলোকতরঙ্গের মাধ্যমে পৃথিবীর দিকে নিয়ত ধাবমান ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি এই স্তরেই এক আলোক রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাবে বিয়োজিত হয়। যার ফলে আমরা অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা পাই। একটি নিশ্ছিদ্র ছাতা যেমন রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে আমাদের মাথা তথা শরীরকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক ওজোন স্তর পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদকূলকে রক্ষা করে চলেছে। তাহলে গোল বাধল কোথায়?

হ্যালি বে উপাখ্যান ও একরাশ উদ্বেগ

গোলমালের সূচনা একেবারে হাল আমলে, তেমনটা কিন্তু মোটেই নয়। গত শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকেই ওজোন স্তরের অবক্ষয় নিয়ে গবেষণার তাগিদ অনুভূত হল বিজ্ঞানী মহলে। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা আন্টার্কটিকার হ্যালি বে অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব মাপতে গিয়ে বেশ অবাক হন। কেননা মেরু অঞ্চলে ওজোন গ্যাসের যে স্বাভাবিক ঘনত্ব থাকার কথা তার তুলনায় বেশ খানিকটা কম মাত্রায় ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি লক্ষ করেন তাঁরা। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন বোধহয় নিছক যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই এমন ব্যত্যয় ঘটছে। কিন্তু ১৯৫৭ সাল থেকে এই পরিমাপনের কাজে নিয়োজিত গবেষকদলের পক্ষে এমন যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি মেনে নেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। তাঁদের মনে জেগে উঠল দুটি প্রধান প্রশ্ন— ১) কেন ওজোনের ঘনত্ব মাত্রা এমন কমে গেল? আর ২) এই পার্থক্যের হেতু কি নিতান্তই প্রাকৃতিক?

শুরু হল গবেষণা— নতুন উদ্যমে। পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে আন্টার্কটিকার বসন্তকালীন তিনটি মাসে— সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বরে— ওজোন মাত্রা প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও ঋতু-পর্যায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই হ্রাসবৃদ্ধির বিষয়টি প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার, তবু প্রতি বসন্তেই এভাবে ওজোনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণ প্রায় অজ্ঞাতই ছিল।

ওজোন স্তরের এই অবক্ষয়ের বিষয়টিকেই বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করলেন ওজোন গহ্বর বা Ozone Hole হিসেবে। আসলে ওজোন গহ্বর মানে সত্যজেঠুর ছাতার মতো কাপড় এফোঁড়-ওফোঁড় হওয়া নয়, ওজোন স্তরের কার্যকর বিস্তৃতি বা গভীরতা কমে যাওয়া বা পাতলা হয়ে যাওয়া। বিজ্ঞানী মহলের দাবি অনুসারে আন্টার্কটিকার ওজোন গহ্বরটি ছিল বৃহত্তম বায়ুমণ্ডলীয় ওজোন গহ্বর যা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তনীয়।

তবে ওজোন গহ্বরের বিষয়টি মানবজাতি তথা পার্থিব প্রাণীকুলের পক্ষে কতটা বিপদ বা আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠবে তা ঠিক করে উঠতে আরও খানিকটা সময় লেগে গেল বিজ্ঞানীদের। কারণ তাঁরা সমস্যার গভীরে যেতে চাইছিলেন— কেন এই অবক্ষয়? এমনটা কি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা, না এই অবক্ষয়ের পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে? অবশেষে ১৯৮৫ সালে বিজ্ঞানীদের তরফে ঘোষিত হল রায়— ওজোন স্তরের গভীরতা কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী মানুষের উন্নত যাপনের আকাঙ্খা, স্বাচ্ছন্দের আকাঙ্খা, এবং এই অভিলাষের সূত্রে সৃষ্ট একটি রাসায়নিক যৌগ যার নাম ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বা সিএফসি। ১৯৬০ সাল থেকে মানুষের আয়েশি যাপনের জন্য বাতানুকূল ব্যবস্থা, হিমাউন ব্যবস্থায় সিএফসি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ল যা বায়ুমণ্ডলের উচ্চতর স্তরে পৌঁছে রীতিমতো তালিবানি কায়দায় ভাঙতে থাকল ওজোন গ্যাসের ভাসমান কণাগুলিকে। আর এই ভাঙনের অনিবার্য পরিণতি ওজোন স্তরের গভীরতা হ্রাস।

বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে উঠে এল আরও চমকপ্রদ কিছু তথ্য। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন আন্টার্কটিকার ওজোন গহ্বরের আয়তনের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা জানি যে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে বছরের ছয় মাস দিন ও বাকি ছয় মাস দীর্ঘ শীতল রাত্রি। এই তমসাঘন শীতকালে বায়ু মেরু অঞ্চলে অতি-নিম্নতাপবিশিষ্ট ঘূর্ণবাত্যায় পরিণত হয়ে একটি শীতল হিমকণাযুক্ত মেঘের সৃষ্টি করে। এই মেঘের ওপর সূর্যরশ্মি আপতিত হলে ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের যৌগ ভেঙে ক্লোরিন কণিকার সৃষ্টি করে এবং বসন্তকালে ক্লোরিন কণার ওপর সূর্যরশ্মি আপতিত হলে তা ওজোন কণাকে (O3) ভাঙতে থাকে (O2+O) দুরন্ত গতিতে। ফলে বাসন্তিক গহ্বরের আয়তন অনেকটাই বেড়ে যায়।

আর্কটিক বা উত্তর মেরুর বায়ুমণ্ডলে শীতকালীন হিমানী মেঘের গঠন সেভাবে হয় না। ফলে ওজোন স্তরের ভাঙন তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়। ওজোন স্তরের অবক্ষয় একটি বৈশ্বিক সমস্যা— তাই এই সমস্যার প্রতিবিধানকল্পে আহুত হল এক পরিবেশ সম্মেলন।

চলো মন্ট্রিয়াল… চলো পাল্টাই…

১৯৮৭ সাল। কানাডার মন্ট্রিয়াল শহরে পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সমবেত হয়েছেন পৃথিবীর ক্ষীয়মান ওজোন স্তরকে রক্ষা করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে। ওজোন স্তরের অবক্ষয়ের সমস্যাটি যে প্রাকৃতিক নয় বরং তার পেছনে মানুষের তথাকথিত ভোগবাদী আয়েশি জীবনযাত্রার বড়সড় প্রভাব রয়েছে— একথা বিজ্ঞানীদের তরফে খুব জোরের সঙ্গে বলার পর থেকেই আন্তর্জাতিক স্তরে আলাপ-আলোচনা ও নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য উপায় নির্ধারণের তাগিদ ক্রমশই জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। মন্ট্রিয়াল জলবায়ু সম্মেলন এই বর্ধমান গণচেতনারই ফল।

এই সম্মেলনে যোগদানকারী দেশের প্রতিনিধিরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে ওজোন স্তরের দ্রুত সঙ্কোচনের কারণ হিসেবে যে সমস্ত পার্থিব গ্যাসীয় উপাদানকে দায়ী করা হচ্ছে, যেমন ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন, হ্যালোন, ইত্যাদির যথেচ্ছ ব্যবহারকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ করে ওজোন স্তরের ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব সীমিত রাখা হবে। দীর্ঘ আলোচনা আলাপ-আলোচনার পর ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিয়াল চুক্তির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলিকে ‘মন্ট্রিয়াল প্রোটোকল’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রের আকারে প্রকাশ করা হল। এই মহাঘোষণার ঠিক দু বছর পর ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এই ঘোষণাপত্রটিকে ওজোন স্তরের অবচয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এক আন্তর্জাতিক অনুশাসনের কার্যকর প্রয়াস হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হল।

কিন্তু চুক্তিপত্র রূপায়ণের মধ্যে দিয়েই ওজোন স্তরের সমস্যার পরিপূর্ণ নিরসন হল এমনটা তো নয়। সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের যে বিপুল সংখ্যক সদস্য রাষ্ট্র এই সমঝোতাপত্রের শরিক হয়েছিল তাদের আর্থসামাজিক সামর্থ্যের তারতম্য প্রয়োজনীয় প্রাযুক্তিক ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে উঠল। পৃথিবীর অতি-উন্নত দেশগুলি আঙুল তুলে পৃথিবীর উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলির ওপর অবক্ষয়ের সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে দিতে চাইল। প্রাথমিকভাবে তাদের অভিমত ছিল, যেহেতু সমস্যাটি বৈশ্বিক সেহেতু সমস্ত রাষ্ট্রকেই সমান দায়িত্ব নিতে হবে। অন্যদিকে ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলি যারা উন্নতিকামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত তাদের স্পষ্ট অভিমত ছিল— এখন আঙুল তুলে একে অন্যকে দোষারোপ করলে এই সমঝোতার আদর্শগত ভাবনার পরিসরকেই খাটো করা হবে। বরং কঠোর নিয়মবিধিগুলিকে জবরদস্তি কার্যকর করার আগে উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থে গৃহীত আইনের প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করা হোক যাতে এই কর্মযজ্ঞ সর্বার্থেই সকলের জন্য, সকলের দ্বারা একটি সর্বাত্মক সর্বজনীন প্রয়াসের স্বীকৃতি লাভ করতে পারে।

মন্ট্রিয়াল প্রোটোকলের মূল সনদে ওজোন স্তরের অবক্ষয় রোধ করে তাকে প্রাক-১৯৮০ সালের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও কাজটি মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। প্রোটোকলের সনদে আরও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের অবক্ষয়ের বিষয়টি বিশেষ প্রাধান্য পাওয়ায় সিএফসি গ্যাসের নিয়ন্ত্রণের কথাই ঘোষণাপত্র উল্লেখ করা হয়েছিল। এর ফলে বিশ্ব-উষ্ণায়নের মত আরও একটি গুরুতর আবহমণ্ডলীয় সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হল বলে অনেকে আপত্তি জানায়। বাস্তবিক বিশ্ব-উষ্ণায়ন ও ওজোন স্তরের অবক্ষয়— এই দুইটি পরস্পর সম্পর্কিত। সিএফসির কার্যকর বিকল্প হিসেবে হাইড্রোফ্লুরোকার্বন যৌগগুলিকে ব্যবহার করার কথা বলা হলেও দেখা গেল হাইড্রোফ্লুরোকার্বনের কণাগুলি পৃথিবীপৃষ্ঠ-বিযুক্ত তাপকে ধরে রেখে বায়ুমণ্ডলকে ক্রমশই গরম করে তোলে। অনুসন্ধানে দেখা গেল কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তুলনায় এইচএফসি কণাগুলি প্রায় ১০০০ গুণ তাপ ধরে রাখতে সক্ষম। তাহলে উপায়? এ তো শ্যাম-রাখি-না-কুল-রাখি অবস্থা। পৃথিবীর ছাতাকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি পৃথিবী একটি অসহনীয় তাপকুণ্ডে পরিণত হয় তাহলে তো সমূহ বিপদ! অতএব প্রস্তাব এল কেবল ওজোন-অবক্ষয়ী উপাদানের পরিমাণ কমানোর জন্য উদ্যোগী হওয়াটাই যথেষ্ট হবে না, পাশাপাশি বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারক হিসেবে যে রাসায়নিক কণিকার কথা বলা হচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণের কথাও আন্তর্জাতিক মহলের আলোচনায় ঠাঁই দিতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে যাতে এই কাজ সম্পন্ন হয় তার উদ্যোগ নিতে হবে সকল অংশগ্রহণকারী সদস্য রাষ্ট্রকে। ১৯৮৫-র ভিয়েনা কনভেনশনের ইচ্ছাপত্রকে মান্যতা দিতেই তৈরি হয়েছিল মন্ট্রিয়াল প্রোটোকল, কিন্তু তার ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে মান্যতা দিতে প্রস্তাবনার মূল সনদের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংযোজনের পর্ব চলল আরও দীর্ঘ সময়কাল ধরে— লন্ডন (১৯৯০), কোপেনহেগেন (১৯৯২), ভিয়েনা (১৯৯৫), মন্ট্রিয়াল (১৯৯৭), বেজিং (১৯৯৯), মন্ট্রিয়াল (২০০৭)। এ এক দীর্ঘ পথে পাড়ি দেওয়ার নিরলস কাহিনি। এও এক যুদ্ধ, জলবায়ু যুদ্ধ।

মন্ট্রিয়াল থেকে কিগালি…

মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ড আমাদের বাসভূমির শৃঙ্খলাকে নিরন্তর বিপর্যস্ত করে চলেছে। মন্ট্রিয়াল প্রোটোকলের সূত্র ধরেই তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। আজ এই মুহূর্তে বিশ্ব-উষ্ণায়নের সম্ভাব্য বিপর্যয় নিয়ে চলছে ভাবনা। মন্ট্রিয়াল সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে পৃথিবীর দেশগুলির সহমত পোষণ করা খুব জরুরি ছিল। ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ বাতাবরণের ভারসাম্য নষ্ট করছে জেনেও জলবায়ু যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তিগুলি। আর এই কারণেই কিয়োটো প্রোটোকল (১৯৯৭) ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি (২০১৫) বিশ্ব-উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে দুটি কার্যকর মাইলফলক হয়ে ওঠে। কিন্তু এখানেই সব জটিলতার অবসান হল এমনটা নয়। দায় স্বীকার করার ক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রধান শিল্পোন্নত দেশগুলির দোদুল্যমানতা পুরো বিষয়টিকে আরও একটি সম্মেলনের পথে টেনে নিয়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের যথেচ্ছ নিঃসরণ কমিয়ে এনে ওজোন স্তরের অবক্ষয় তথা বিশ্ব-উষ্ণায়ন মাত্রা হ্রাস করার লক্ষ্যে আফ্রিকার রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে (২০১৬) বিশ্ব-নেতৃত্ব পুনরায় মিলিত হয়। ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত মন্ট্রিয়াল সম্মেলনের পরবর্তীকালে কিগালি সম্মেলন হল অষ্টবিংশতি সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সহমতের ভিত্তিতে কতগুলি সংশোধনী আনেন যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিপত্তি-নিরপেক্ষভাবে পৃথিবীর ছোট-বড়, উন্নত-অনুন্নত বা উন্নয়নশীল— সকল দেশের মানুষই এই বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে আন্তরিক প্রয়াস করতে পারে।

মন্ট্রিয়াল সম্মেলনের পর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন দশক সময়কাল। পৃথিবীর বাতাবরণ শুদ্ধিকরণের কাজে সবাই একটু একটু করে সচেতন হলে এই সমস্যার নিরসনে আমরা নিশ্চয়ই সফল হব।

কেমন আছে ছাতাটা…?

আজ শেষ করব ওজোনোস্ফিয়ারের হালফিলের খবর দিয়ে। কেমন আছে পৃথিবীর ছাতা? গহ্বর সমস্যার কোনও সুরাহা হল? বিজ্ঞানীমহল এই প্রসঙ্গে কী বলছেন? ওজোন স্তরের সমস্যাগুলিকে কি আমরা সবটা বুঝে উঠতে পেরেছি? বুঝতে পারছি এমন হিংটিংছট প্রশ্নে এসে বাসা বেঁধেছে আমাদের মাথার ঘুলঘুলিতে। উত্তরগুলি খুঁজে দেখা যাক আজকের এই আলোচনার একদম শেষ পর্বে এসে।

কেমন আছে ওজোন স্তর?

আগের তুলনায় ওজোন স্তর অনেকটাই সুস্থিত। মন্ট্রিয়াল সনদের ঘোষণাকে মান্যতা দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশই ওজোন-ধ্বংসকারী রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার ও নিঃসরণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে, ফলে পৃথিবীর ছাতা ফিরে পাচ্ছে তার হারানো চেহারা। তবে এই স্বাস্থ্যোদ্ধারের পর্বটি কতটা দীর্ঘায়িত হবে তা নির্ভর করবে সদস্য রাষ্ট্রগুলি তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে কতটা দায়বদ্ধ থাকছে তার ওপর। ১৯৮৭ সালে মাত্র ৪৫টি দেশ মন্ট্রিয়াল ঘোষণাপত্রের প্রত্যক্ষ অংশীদার ছিল, আর আজ দায়বদ্ধ রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৯৭। এই সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টিকে অবশ্যই ইতিবাচক প্রতিফলন হিসেবে গণ্য করা উচিত।

ওজোন রহস্য কি সমাধান করা সম্ভব হল?

এক রহস্য উদ্ঘাটন হয় তো নতুন রহস্যের হাতছানি বিজ্ঞানী মহলকে উদ্দীপ্ত করে। খুব সম্প্রতি ওজোন স্তরের রসায়নে এক নতুন রদবদল ঘটে চলেছে। গবেষণাসূত্রে জানা গেছে স্ট্রাটোস্ফিয়ারের উচ্চতর অংশে ওজোন কণার ঘনত্ব বাড়লেও নিম্ন স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওজোন স্তরে ওজোন কণার ঘনত্ব কমছে। ওজোন স্তরের কেন এমন দ্বৈত আচরণ? বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে দুটি স্বতন্ত্র সম্ভাবনার কথা আমাদের জানিয়েছেন—

  1. সিএফসির বিকল্প হিসেবে শিল্পক্ষেত্রে এমন কিছু রাসায়নিক যৌগ ব্যবহার করা হয়তো হচ্ছে যেগুলি ক্ষণস্থায়ী হলেও ওজোন গ্যাস ভাঙার ক্ষেত্রে বেশ দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা কিছু ক্লোরিন যৌগের ব্যাপক ব্যবহার এই অবক্ষয়ের কারণ।
  2. বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাবে পার্থিব বায়ুপ্রবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলেও এমন বৈপরীত্য অসম্ভব নয়। তবে ওজোন স্তরের এমন সমস্যা নিয়ে খুব উদ্বেগের কারণ নেই বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। মন্ট্রিয়াল প্রোটোকলের সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা এখন অনেক তৎপর। আমাদের পৃথিবীর ছাতাটি এখন অনেক অনেক বিজ্ঞানীর নেকনজরদারিতে রয়েছে। ফলে কোনওরকম বিচ্যুতি নজরে এলেই তা মেরামতির চটজলদি নিদান দিচ্ছেন বিশ্বের বিজ্ঞানী মহল, তাই তাঁদের কথার প্রতি নিবিষ্ট থাকতে হবে সকলকেই।

 

১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ওজোন দিবস গেল। সেদিন ছেলেবেলার সেই সত্যজেঠুর ছাতার কথা খুব মনে পড়ছিল। নিজের মাথার ওপর মেলে ধরা ফুটোফাটায় ভরা ছাতা নিয়ে তাঁর সামান্যতম আক্ষেপ, উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা ছিল না। প্রাগদর্শী সেই মানুষটি অনেক বেশি উৎকণ্ঠিত ছিলেন পৃথিবীর ছাতার সুস্থতা নিয়ে। তাঁর কাছেই প্রথম পৃথিবীর আশ্চর্য ছাতার কথা শোনা। আজ মন্ট্রিয়াল প্রোটোকলের মন্ত্র মাথায় নিয়ে ওজোন স্তরের মেরামতির কাজ চলছে। এর ফলে দীর্ঘায়িত হবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি। এসব কথা সত্যজেঠুর কানে গেলে কী করতেন তিনি? পাড়ার গলির মোড়ে বলাইদার চায়ের দোকানের সামনের পাতা বেঞ্চে আয়েশ করে পা গুটিয়ে বসে এক গ্লাস গরমাগরম লাল চায়ে বেশ জম্পেশ করে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলে উঠতেন— আ! ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস! তাঁকে ঘিরে থাকা আমরা সবাই চিৎকার করে বলে উঠতাম— ইয়াক ইয়াক!

নিজের কাঁধের ওপর রাখা ঘামে ভেজা সবুজ গামছাটা মাথার ওপরে বনবন ঘুরিয়ে বলাইদা বলে উঠতেন— সব ভালো যার শেষ ভালো!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4649 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...