বীরভূমের এসআরএসডিএফ এবং এক অনন্য শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

লোকশিল্পের গ্রাম। দারিদ্র এবং ক্ষয়িষ্ণু পেশা থেকে ক্রমাগত আধুনিকতার চাপে তলিয়ে যাওয়া শিল্প এবং আনুষঙ্গিক দারিদ্র। বাংলার লোকশিল্প-নির্ভর গ্রামগুলোর এই ছবি নতুন না। ধরা যাক, বীরভূমের তাঁতিপাড়া। বংশানুক্রমিকভাবে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই তাঁতশিল্পকে ধরে নিয়ে এগোলেও শুধুমাত্র এই শিল্পের ওপর নির্ভরতা সাংসারিক টানাটানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোপ পড়ে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ওপর। এছাড়াও, এমনিতেই গ্রামবাংলার অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের ঘরে শিক্ষার আলো, বিশেষত উচ্চশিক্ষার আলো পৌঁছনো বড়ই দুষ্কর। তাই, গল্পটা কোথাও একইরকম হয়ে গেলেও এরই মাঝে গুহার মুখে আলো হয়ে দেখা দেয় কিছু মানুষ, প্রতিষ্ঠান। সেই গল্পই হোক…

স্বয়ংভারত রুরাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। সংক্ষেপে এসআরএসডিএফ। বীরভূমের তাঁতিপাড়ায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত বসু এবং তাঁর ছয় বন্ধু মিলে তৈরি করা এক স্বপ্নপ্রতিষ্ঠান। কারা তাঁরা? শর্বরী ভট্টাচার্য, দেবযানী মিত্র, প্রদ্যুৎ ভট্টাচার্য, সন্দীপ ঘোষ, সুস্মিতা বসু এবং কল্পনা দত্ত। কীভাবে শুরু? ২০১৪ সালে একটি সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পে তাঁতিপাড়ায় আসেন সুব্রতবাবু। এবং আলাপ হয় স্থানীয় মধুসূদন ঘোষের সঙ্গে। অসম্ভব অর্থকষ্টে থাকা মধুসূদনের ছেলে বাপন ক্লাসের টপার হওয়া সত্ত্বেও পড়তে পারছে না আর্থিক কারণে। সুব্রতবাবুর কাছে হাত পাতেন মধুসূদন। আর তখনই বিদ্যুৎঝলকের মতো ভাবনা চলে আসে। কেমন হবে যদি মেধাবী এই বাপন থেকেই তৈরি হয় কয়েক হাজার বাপন। একটি সংস্থা করে তাদের যদি শিক্ষার খরচ জোগানো যায়? বেতন লাগবে না, কিন্তু এই ছেলেরাই পরে বড় হয়ে পড়াবে একসময় তাদেরই মতো থাকা আরও অনেক ছোট্ট বাপনকে। এভাবেও তো সমাজকে অনেক কিছু ফিরিয়ে দেওয়া যায়। শুরু এভাবেই…

সমীক্ষা চালালেন সুব্রতবাবু এবং তাঁর বন্ধুরা। দেখা গেল গ্রামের শতকরা ৪৫ ভাগ ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে মেয়েরা ক্লাস এইটের পর স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। কখনও কৃষিশ্রমিক, কখনও অকালে বিবাহের করাল গ্রাস। তাঁতিপাড়া অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আর তখনই মধুসূদনকে সাহায্য করেই তাঁকে নিয়েই তৈরি হল এসআরএসডিএফ। প্রথম ছাত্রদের মধ্যে একজন তাঁর ছেলে বাপন। আর এখন? শক্তিতে, খ্যাতিতে সংস্থার এবং পাশাপাশি গ্রামের আলো অনেকটাই বেড়েছে। রাজনগর এবং দুবরাজপুর ব্লকের মোট ১০টি গ্রামের ২০০০ জন ছাত্রছাত্রী এসআরএসডিএফ-এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোয় পড়ছে। ১১ জন শিক্ষক এবং ৮ জন প্রাক্তন ছাত্রকে মেন্টর করে এগোচ্ছে সংস্থাটি। সংস্থার অধীনে আছে মোট তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং একটি রিসোর্স সেন্টার। এছাড়াও সংস্থার থেকে আলো পাওয়া বেশ কিছু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাদের খরচে পড়াচ্ছে ১৫ জন আরও দুঃস্থ ছেলেমেয়েকে। শৃঙ্খলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার আলো।

শুরুতে কি সমস্যা হয়নি? গতানুগতিকতা থেকে শহুরে জীবনকেই বের করানো কষ্টকর, আর তাঁতিপাড়া তো একেবারেই ছোট্ট একটি গ্রাম। সেখানে পাহাড়প্রমাণ বাধা। মেয়েদের বাড়ির লোকেদের আপত্তি। কেন পড়বে ওরা? অথবা ছেলেদের অভিভাবকদের থেকেও মৃদু তিরস্কার। পড়লে বাড়ির কাজে, কৃষির কাজে কীভাবে সাহায্য করবে ওরা? অথবা গ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক কিছু সমস্যাও বাদ সাধে। এইসব থেকেই ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলেন সুব্রতবাবুরা। দিনরাত বোঝালেন। একসময় আলো জ্বলল। শুধুমাত্র চ্যারিটি থেকে বেরিয়ে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার আলোয় তাঁতিপাড়াকে আনতে উঠে পড়ে লাগলেন সাত বন্ধু। প্রথমে ক্লাস এইট, নাইন এবং টেনের ৮৫ জন ছাত্রছাত্রীকে জড়ো করে প্রতিষ্ঠানের প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনলেন। প্রথম লক্ষ্য স্কুল ফাইনাল পার করানো। অন্তত এই ছোট্ট লক্ষ্য তো সম্পূর্ণ হোক ওদের। ফলাফল আকাশচুম্বী। পরীক্ষাতেও সফল হল ছেলেমেয়েরা। অনুরোধ আসতে থাকল গ্রামের বাকিদের থেকেও। একে একে ক্লাস এইটের নিচের ক্লাসের ছেলেমেয়েদেরও সংস্থার অধীনে আনা হল। মেন্টরের ভাবনা চালু হল। বেশ কিছু বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে আর্থিক আনুকূল্য আসার পরে সিনিয়র ছাত্রছাত্রীদের মাসে ৫০০ টাকা বেতন দিয়ে মেন্টর করা হল। স্থানীয় কিছু এনজিও-র সহায়তায় পলিসি মেকিং, মূল শিক্ষার বাইরেও অন্যান্য বিষয়ে ভোকেশনাল ট্রেনিং, এক্সপার্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদেরকে দিয়ে পড়ানো, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর ওপরও জোর দেওয়া হল। তৈরি করা হল কোর কমিটির ভাবনা। শুধু শিক্ষিত অংশই নয়, এই কমিটিতে নেওয়া স্থানীয় কিছু চিন্তাবিদ এবং বিশিষ্ট মুখকে। শোনা হল তাঁদের বক্তব্য। জোর পেলেন সুব্রতবাবুরা…

এসবেরই পরিণাম তারা ঘোষ বা উমাশঙ্কর মণ্ডল। নিজের গরু বিক্রি করে মেয়েকে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছিলেন তারা ঘোষের বাবা। কিন্তু এইভাবে কদ্দিন? আর তখনই আলো হয়ে এসেছিল এসআরএসডিএফ। প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে এখন তারা একটি সরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করে মাসে ৩০০০০ টাকা পাচ্ছে। নিজের ভাইকেও শিবপুর আইআইএসসি-তে এমটেক করাচ্ছে। মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তারার প্রতি কোনওদিন কম গুরুত্ব দেননি প্রবীণ এই মানুষটি। আর তাই, কৃতজ্ঞ এই যুবতী এখন নিজের আয়ে বাবার জন্য একটি নতুন বাড়িও বানিয়ে দিয়েছে। অথবা উমাশঙ্কর। ক্লাস নাইনের দরিদ্র এই ছেলেটি সংস্থার সাহায্যে একসময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক হয়ে বর্তমানে আইআইটিতে স্তাতকোত্তরের পড়াশোনায় নিমগ্ন। এসআরএসডিএফ ছাড়া গ্রামের বাইরেও হয়ত কোনওদিন পৌঁছতে পারত না উমাশঙ্কর।

নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট করে বীরভূম থেকে আরও অনেক সুদূর গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে সুব্রতবাবুদের এই স্বপ্ন সংস্থা। কে থামাবে, কারা থামাবে তাঁদের?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. বাংলায় জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ুক এই প্রয়াস, এই স্বপ্ন। শুধু প্রশংসা নয়, কেননা কোনো প্রশংসাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট বলে মনে করি না। আমি নিশ্চিত, আরও যুবক যুবতী নিজ ব্যস্ততার মধ্যেও এই মহৎ কাজে সব রকম সাহায্য করতে দ্বিধা করবেন না। ভাবি প্রজন্ম চিন্তা করা অভ্যাস করুক, প্রতিবেশের সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে শিখুক। এটাই হবে এক বৈপ্লবিক কাজ।

1 Trackback / Pingback

  1. ক্ষুধার রাষ্ট্র – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

Leave a Reply to Syamal Chakrabarti Cancel reply