তারান্তিনো, সিজন দুই — সতেরো

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মুহূর্তের মধ্যে ফাদারের ডেরিঙ্গার পিস্তল ঘুরে গেল সনাতন হাজরার দিক থেকে, আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিতভাবে, প্রমথরঞ্জনের দিকে।

–বন্দুকটা নামাও!

প্রমথরঞ্জন শাজাহানের দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে নামিয়ে রাখল বন্দুক।

–এই বাড়িতে কোথায় কী লোকানো আছে, তা যদি চুপচাপ দেখিয়ে দাও, তাহলে তুমিও তার ভাগ পাবে। আমাদের সঙ্গে পালাতেও পারবে।

শাজাহান ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে ফাদার তার পিস্তলের নলের মুখ থেকে সরে গেছে।

শাজাহান গর্জে উঠল।

–ফাদার! আপনার এই কনফিডেন্স আসছে কোথা থেকে, যে আমি এই ঘরে থাকতে থাকতেই আপনি এখান থেকে পালাতে পারবেন?

ফাদার আলতো হেসে বললেন,

–ঠিক পালাব না, সনাতনবাবুর থেকে হীরেটা নিয়ে, এই বাড়িতে যদি কোনও লুকনো ধনসম্পদ থাকে, তাহলে তা নিয়ে আপনাদের চোখের সামনে দিয়েই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব।

শাজাহান পিস্তল তাক করল ফাদারের দিকে।

–কী করে ভাবছেন ব্যাপারটা এত সহজ হবে?

শাজাহান বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে জিজ্ঞেস করল।

হঠাৎ একটা তীব্র ধাতব আওয়াজ এবং সনাতনের গলা থেকে একটা আঁতকে ওঠার মতো আওয়াজ বেরোল। শাজাহান ফাদারের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল তার দিকে। আর তার দৃষ্টি অনুসরণ করেই শাজাহানেরও দৃষ্টি ফিরে গেল পেছনদিকে।

সে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল, লতার হাতে হাতকড়া নেই। তা মাটিতে লুটোচ্ছে। বরং তার হাতে রয়েছে উদ্যত পিস্তল।

আর এই অসম্ভবটা সম্ভব হয়েছে, কারণ লতার পাশে চুপিসারে এসে দাঁড়িয়েছে এক যুবক। তার হাতে একটি গাদাবন্দুক।

যুবকটিকে চিনতে পারল না শাজাহান।

খাবার টেবিলের পেছনে একটা কুঠুরিঘরের দরজা আছে। শাজাহান দেখল, সেই দরজাটা খোলা। ওই ঘরেই নিশ্চয় এতক্ষণ ঘাপটি মেরে ছিল মৃন্ময়।

লতার বুক দুরুদুরু করছে। মৃন্ময়দাদার সঙ্গে অবশেষে তার দেখা হল! কিন্তু সে জানে, এখন এই নিয়ে আপ্লুত বা উত্তেজিত হওয়ার সময় নয়।

–সনাতন হাজরা, আপনি এই আহত অবস্থায় কোথাও যেতে পারবেন না। হীরেটা আমাদের হাতে দিয়ে দিন চুপচাপ। ওটার জন্য অনেক অকারণ হাঙ্গামা আমাদের পোহাতে হয়েছে। আর শাজাহান ইলিয়াস, আপনাকে এখানে রেখে আমরা যাব না। আপনাকে আমাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে। কষ্ট করে। আপনাকে আমাদের পিছু নিতে দেব না। তাই আপনাকে এমন কোথাও আমরা মারব, যেখানে পুলিশ আপনার লাশ আশাও করবে না। বন্দুকটা নামিয়ে রাখুন। আমার আর লতার, দুজনেরই বন্দুক আপনার দিকে তাক করা।

শাজাহান হাত থেকে বন্দুক নামানোর চেষ্টাও করল না। ও আন্দাজ করল, ছেলেটি কে। এই মামলার সন্দেহভাজনদের নাম ওর মুখস্থ ছিল। ও ছেলেটিকে বলল,

–মৃন্ময়, তোমাকে, লতাকে, ফাদারকে বা তোমাদের ওই সূর্যবাবুকে— সকলকে একসঙ্গে আমি একা গ্রেফতার করতে পারব না, ঠিকই। কিন্তু তোমাদের মেরে এখান থেকে চলে যেতেই পারতাম আমি। কিন্তু আমি তা করব না। শুধু এটুকু জানাতে চাই, দুজন হাবিলদারের সঙ্গে আমার একজন সুপিরিয়র অফিসার বাইরে অপেক্ষা করছে। তাদের এড়িয়ে তো তোমরা পালাতে পারবে না!

মৃন্ময়ের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।

আর এই ফাঁকেই আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল।

ফাদারের হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে ফাদারের মুখে কনুইয়ের এক ঘা মেরে সনাতনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রমথরঞ্জন। সনাতনের হাত থেকে হীরেটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করল সে।

সনাতন প্রথমেই একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটাল। হীরেটা সে মুখে পুরে দিল।

তার মুখ জোর করে হাঁ করিয়ে হীরেটা বের করতে চেষ্টা করল প্রমথরঞ্জন। ফাদার, লতা, মৃন্ময় আপাতত দর্শক। হীরেটা প্রমথরঞ্জন আদায় করলে তারা কেড়ে নিতে পারবে অনায়াসে।

এর ফাঁকেই ফাদার মৃন্ময়ের দিকে ফিরে চাপা গলায় বললেন,

–এই বাড়িতে ট্রেজার থাকতে পারে। এই লোকটা হদিশ জানে। ওকে পালাতে দেওয়া যাবে না।

শাজাহান চুপ করে দেখে যেতে পারে না। সে বুঝতে পারল, প্রমথরঞ্জনের দিকে বন্দুক তাক করে লাভ নেই। ঘরের বাকিরা তার দিকে বন্দুক তাক করতে পারে। কারণ, হীরেটা সকলের দরকার। তাই সে পিছন থেকে গুলি চালাল প্রমথরঞ্জনের কোমরে। তাকে জীবিত রেখেও আহত করার এই একটাই উপায় খোলা ছিল ওর হাতে। প্রমথরঞ্জন সনাতনের ওপর থেকে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

–ড্যাম! কেবল ও জানত কোথায় কী লুকোনো আছে এই বাড়িতে!

ফাদার প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। তারপর প্রমথরঞ্জনের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে চাপ দিতে লাগল। মুখে বাতাস করতে লাগল। এভাবে গুলি খাওয়া মানুষকে বাঁচানো যায় কি না, তা শাজাহান জানে না। শুধু সে বুঝল, ফাদার আত্মহারা! এত সহজে এত ধনসম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেটা ছাড়তে চাইছেন না ফাদার।

মৃতপ্রায় প্রমথরঞ্জন এবার একটা কাণ্ড ক‍রল।

ফাদারের গলা হঠাৎ চেপে ধরল।

–আঁ আঁ…

বিস্ফারিত নেত্রে দুবার মুখ খুলে কিছু বলার চেষ্টা করে মাথা এলিয়ে পড়ে গেল প্রমথরঞ্জন।

শাজাহানের ভুরু কুঁচকে গেল।

মারা যাওয়ার তো কথা নয় প্রমথরঞ্জনের। এটা ওর কোনও কৌশল নয় তো?

দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ফাদার ছুটে এসে শাজাহানের কলার ধ‍রে ঝাঁকাল।

–কী করলেন আপনি এটা? ও একমাত্র জানত গুপ্তধন কোথায় আছে! লতা! শুট হিম!

লতা পিস্তল তাক করেছে শাজাহানের দিকে। তার চোখ স্থির।

শাজাহান প্রতিরোধ করার সময় পেল না। লতার পিস্তল থেকে গুলি ছুটল‌। কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দেওয়ালে লেগে কিছুটা চাঙড় খসিয়ে দিল।

মৃন্ময় ফাদারের দিকে তাকিয়ে বলল, লতা এখনও রেডি নয়। তবে হ্যাঁ— এবার শাজাহানের দিকে তাকাল মৃন্ময়।

–রগে ঠেকিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে চালালে কিন্তু ওর গুলি ফসকাবে না। আপনাকে মারতে ওর হাত কাঁপবে না। লতা, ওর কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে রাখো। বেচাল দেখলে শুট করে দেবে।

লতা সোজা এগিয়ে এসে শাজাহানের মাথায় পিস্তল চেপে ধরল।

শাজাহান এই অবস্থা থেকে সহজেই উদ্ধার পেতে পারে, কিন্তু তার চোখ এখন প্রমথরঞ্জনের দিকে। প্রমথরঞ্জন কি সত্যিই মরে গেল? না কি অভিনয় করছে মরে যাওয়ার? ওর কোমরের তলা থেকে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি…

চিন্তায় ছেদ পড়ল শাজাহানের।

মৃন্ময় ও ফাদার দুজনেই এগিয়ে গিয়েছে সনাতনের দিকে। মৃন্ময় ওর গাদাবন্দুক ঠেকাল সনাতনের বুকে। ফাদার নিচু হয়ে প্রমথরঞ্জনের হাত থেকে নিয়ে নিল নিজের পিস্তল। তারপর সোজা তাক করল সনাতনের দিকে। সনাতনের মুখে তখনও হীরেটা।

–আর উপায় নেই! এবার হীরেটা যে আপনাকে দিতেই হচ্ছে!

সনাতনের অসহায়, কোণঠাসা চোখ দেখে শাজাহানের বুকটা অনেকদিন পর যেন মুচড়ে উঠল হঠাৎ। পিতৃস্নেহ সেভাবে পায়নি সে কখনও। ডেভিস সাহেবের কাছে যেটুকু, সেটুকু বাদে। সনাতনের নাম সে শুনেছে। সে জানে, ঠগীদের কাছ থেকে কোনও একটি জহরত চুরি করার দুর্নাম ছিল সনাতনের দাদুর ওপর। এইটা সেই জহরতই কি না, তা নিয়ে আগ্রহ নেই শাজাহানের। কিন্তু ওই চোখটা দেখে সে বুঝল, হীরেটা হাতছাড়া হলে সনাতন নিঃস্ব হয়ে যাবে। কিছুতেই তা মেনে নিতে পারল না শাজাহান।

সে বলে উঠল, ওকে ছেড়ে দিন!

কানের পাশে লতার পিস্তলের সেফটি ক্যাচ খোলার শব্দ পেল শাজাহান। ফাদার আর মৃন্ময়, দুজনেরই শীতল চোখ ঘুরেছে তার দিকে। সনাতনের চোখও তার দিকে। সেই চোখে করুণ আকুতি।

–হুমকি দিচ্ছেন না কি?

লতা এবার কথা বলল। ধীরভাবে।

লতার দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে শাজাহান শান্তভাবে বলল,

–আমি তোমাদের সাহায্যই করতে চাইছি।

লতার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি দেখা গেল। সেই হাসিতে ভর্তি অবিশ্বাস।

শাজাহান নারীসংস্পর্শে বিশেষ যায়নি কখনও। লতার মুখের ওই হাসি তাকে আচমকা ধাক্কা দিল। শাজাহান কি বিশ্বাসযোগ্য নয়? তার উর্দি কি তাকে এতটাই অমানুষ বানিয়ে ছেড়েছে?

কর্কশ গলায় মৃন্ময় বলল,

–পিস্তল সরাবে না লতা। শাজাহান ইলিয়াসের কথাকে বিশ্বাস করার কারণ নেই। আমাদের দলের বহু লোক ওর হাতে মরেছে। ও কসাই!

শাজাহান এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,

–কিন্তু এখন আমি আপনাদের সাহায্যই করতে যাচ্ছি।

মৃন্ময় আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। ফাদার তাকে থামিয়ে বলল,

–শুনি, কী সাহায্য করতে চাইছেন আপনি?

শাজাহান একবার প্রমথরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

–আমার মনে হয়, আমি জানি, গুপ্তধন কোথায় আছে। ওকে ছেড়ে দিন। ওর হীরেটা নেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
–আপনার কথা কেন শুনব শাজাহান? আপনি আমাদের মিসগাইড করছেন না, তার কী মানে?

বলল মৃন্ময়।

শাজাহান বলল,

–প্রমথরঞ্জনের পিছু নিয়েই এখানে এসেছি আমি। প্রমথরঞ্জন নিজে কিছু বলার আগেই আমি আন্দাজ করতে পেরেছি, এবাড়িতে গুপ্তধন থাকতে পারে। কাজেই আমার অনুমানের ওপর ভরসা করতে পারো।
–অনুমান? মৃন্ময় খেঁকিয়ে উঠে বলল, আমাদের চোখের সামনে একটা আসল হীরে থাকতে আপনার অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটা বুনো হাঁসের পিছনে ধাওয়া করব?
–কোথায় আছে গুপ্তধন?

মৃন্ময়ের কথার প্রায় মাঝখানেই লতা বলে উঠল।

–লতা! এই লোকটাকে বিশ্বাস করিস না।
–পরখ করে দেখতে চাইছি।
–কেন? হীরেটা তো আমাদের হাতের কাছে। গুপ্তধন আছে কি নেই, তার কী ঠিক?
–তবু, উনি বলুন, আমি জানতে চাই।

মৃন্ময় ফাদারের দিকে তাকাল। ফাদারের চোখে মৌন সম্মতি।

শাজাহান নিশ্বাস ফেলে বলল,

–নিচে দুর্গাদালানে, যেখানে আপনারা কালীমূর্তি রেখেছেন, ওর পেছনের দেওয়ালের ভেতর রয়েছে গুপ্তধন। ওইজন্যই অনাদি চৌধুরীর জ্ঞাতি মজু্রদের দিয়ে ওই দেওয়ালের আংটার সঙ্গে দড়ি বেঁধে রেখে টানতে বলেছিল বলে আমার বিশ্বাস। আমার অদ্ভুত লাগছিল, প্রমথরঞ্জন গুপ্তধনের সন্ধানে আসছে, অথচ সঙ্গে কোনও শাবল নেই কেন? আমার ধারণা, ও জানত, শাবল এখানেই পাবে। ওই দালানের কোণে একটা শাবল চোখে পড়েছে আমার। আমার ধারণা, জজসাহেবের অনুপস্থিতিতে ওই দেওয়াল খোঁড়ার চেষ্টা করেছিল এই বাড়ি তদারকির নাম করে থাকা লোকজন। যাদেরকে আপনারা হয় মেরে ফেলেছেন, নয়…
–দেশের লোককে আমরা মারি না অফিসার! ওদের শুধু ভয় দেখিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছি।

বললেন ফাদার।

–যাই হোক, এই হল আপনাদের গুপ্তধনের সন্ধান।

লতা হঠাৎ এগিয়ে গেল মৃন্ময়ের দিকে। গিয়ে বলল,

–আমাদের দেখা উচিত গুপ্তধনটা ওখানে আছে কি না।
–কিন্তু এই হীরেটা…
–এই হীরেটা একদম ওই হীরেটার মতো দেখতে মৃন্ময়দাদা! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, হীরেটা আমরা পাব না। উলটে হীরেটা আমাদের বিপদেই ফেলবে। হীরেটা অপয়া!
–আহ লতা! যত আজগুবি কথা।
–আমার কথা শোনো মৃন্ময়দাদা, ওই হীরেটার থেকে অনেক দামি জহরত আমরা নিচে পেতে পারি।

মৃন্ময় ফাদারের দিকে তাকাল। ফাদার বললেন,

–আমার মনে হয় লতা ঠিকই বলছে।
–কিন্তু ওখানেই যে গুপ্তধন আছে, তার কী প্রমাণ? উনি যা বলছেন, তা কি আদৌ ঠিক?
–ঠি-ঠি-ঠিক!

সকলকে চমকে দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ করে বলল প্রমথরঞ্জন। তার একটা হাত বুকে, মুখের পাশ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে।

শাজাহান বুঝল, প্রমথরঞ্জনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে গুলি খাওয়ার পর।

–ব্যস! তাহলে তো মিটেই গেল। আমাদের আসল লক্ষ্য টাকা জোগাড়, যাতে অস্ত্র কিনতে পারি। তাই না? ওই হীরের পেছনে লেগে থেকে আমাদের লাভ নেই।

মৃন্ময় মৃদু হেসে লতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–ঠিক বলেছিস একদম। চল। সূর্যবাবুকে বরং তুই ধরে নিয়ে চল।

এবার শাজাহানের দিকে তাকিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে মৃন্ময় বলল,

–কিন্তু আপনাকে যে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আপনি ঠিক বলছেন কি না, সেটাও দেখতে হবে। আর তাছাড়া, আপনিই বললেন, পালানোর পথ নেই। আমার মনে হয়, পালানোর পথ একটাই। আপনাকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে আপনার লোকজন আমাদের ওপর গুলি না চালায়।

শাজাহান হেসে বলল,

–আরেকটা রাস্তা আছে। বাইরে দুজন হাবিলদার আছে। যারা তোমাকে চেনে না। তাদের কাছে গিয়ে তুমি শুধু আমার নাম করে বলবে, প্রমথরঞ্জন ওই বাড়িতে আছে। তারা সদলবলে এদিকে আসবে। তোম‍রা সেই সুযোগে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে পারবে।

মৃন্ময় বন্দুক উঁচিয়ে রুক্ষভাবে বলল,

–কিন্তু আপনাকে মারব না, এটা ভাবলেন কী করে?

শাজাহান মৃন্ময়ের চোখের পলকে ওর গাদাবন্দুকের নল ধরে নিচে নামিয়ে দিল। তারপর বলল,

–নিজেকে বাঁচাতে আমার সমস্যা হবে না। তাতে তোমাদের বিপদ বাড়বে। আমাকে মারার থেকে বড় কাজ নিশ্চয়ই আছে তোমাদের? গদর পার্টির প্ল্যান সাকসেসফুল করতে হবে। তোমাদের সঙ্গে তো বাঘাযতীনেরও দেখা হওয়ার কথা শিগগিরই! এখানে যে তোমরা ছিলে, তোমরা যে এখান থেকে পালিয়েছ, সেটা জানাজানি হলে তোমাদের পিছু নিতে সুবিধে হবে পুলিশের। তাই না?

এবার মৃত জয়চাঁদের দিকে তাকিয়ে মৃন্ময় বলল, জয়চাঁদের লাশের কী হবে?

শাজাহান সনাতন হাজরার দিকে ফিরে জানতে চাইল, ও কী বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিল?

সনাতন বলল, জজসাহেবের কেয়ারটেকার!

–তাহলে ওই গল্পই থাকবে! শাজাহান বলল। জজসাহেবের লোক ঠিক করে দিত অনাদির আত্মীয়। সে এখন বেঁচে নেই। ফলে এই গল্পই চলবে। আর ওকে খুনের দায় নেবে প্রমথরঞ্জন।

মৃতপ্রায় প্রমথরঞ্জন চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করেও পারল না।

–আর জনার্দন সান্যাল?

সনাতনের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল শাজাহানের। শাজাহান বলল,

–ওটাও প্রমথরঞ্জনের খুন বলেই চালানো যাবে। মহেশ সেনও তাই। এরকম যমদূতের মতো একজন খুনিকে মিথ্যে কেস দেওয়া নিয়ে নিশ্চয়ই নৈতিক আপত্তি থাকবে না আপনাদের?
–কিন্তু আপনি হঠাৎ আমাদের সাহায্য করছেন কেন? ফাদার এবার প্রশ্ন করলেন।

শাজাহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ধরে নিন, হাল ছেড়ে দিচ্ছি।

শাজাহানের কথায় এমন কিছু ছিল, যাতে ফাদার বা মৃন্ময় কেউ দ্বিরুক্তি করল না। লতা সূর্যবাবুকে ধরে নামল। ফাদার আর মৃন্ময় বেরোল তার পিছু পিছু। বেরনোর আগে মৃন্ময় শাজাহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

–আপনার ওপর কিন্তু নজর থাকবে।

মৃদু হেসে শাজাহান বলল, বৃথা সময় নষ্ট হবে মৃন্ময়। তার চেয়ে যা বললাম, তাই করো। মনে করে হাবিলদারটাকে খবর দিও।

শাজাহানের দিকে একবার তাকিয়ে কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করল মৃন্ময়। তারপর ‘বন্দে মাতরম’ বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

এবার প্রমথরঞ্জনের দিকে নিচু হয়ে বসে শাজাহান বলল,

–কী ডাক্তারবাবু, কী মনে হচ্ছে? হাতে হাতকড়া পরা অবধি জীবিত থাকবেন না থাকবেন না?

এই অবস্থাতেও একটা ক্রুর হাসি হেসে প্রমথরঞ্জন হাত উলটে দেখাল। তার মানে দাঁড়ায়, জ্যান্ত অবস্থায় আমার হাতে হাতকড়া পরানো যাবে না!

শাজাহান এবার ঘরের দিকে তাকাল। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে জয়চাঁদ, জনার্দন সান্যাল আর মহেশ সেনের লাশ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাজাহান সনাতনকে ধরে তুলে একটা চেয়ারে বসাল। পকেট থেকে সিগারেটের টিন আর দেশলাই বের করে সিগারেট ধরাল একটা। একটা দিল সনাতনকে। দিয়ে বলল,

–মুখ থেকে হীরেটা এবার বের করে নিতে পারেন। ওটা এখন নিরাপদ।

সনাতন হেসে হীরেটা বের করে সিগারেট ধরিয়ে বলল, কী মনে হয়? ওরা পেয়ে যাবে গুপ্তধন?

–হ্যাঁ, মনে হয়।

সনাতন একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

–কী ব্যাপার বলুন তো দারোগা? আপনার নাম অনেক শুনেছি। আপনি তো দোর্দণ্ডপ্রতাপ! এতগুলো টেররিস্টকে হাতের সামনে পেয়ে ছেড়ে দিলেন?

শাজাহান একটু চুপ করে থেকে সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল,

–ফাদারদের দলে কজন মুসলিম আছে জানি না। তবে এই দলে তো একজনও নেই। ইংরেজরা আমাদের দিকে মাংস ছুড়ে দিচ্ছে, আমরাও কুত্তার মতো লুফে নিচ্ছি। আজ জনার্দন সান্যাল যা বলল, দেখলেন তো! তারপর থেকেই নিজেকে পোষা কুকুরের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এর চেয়ে মৃন্ময়-লতাদের দলে থাকা সম্মানের। কী করছি, তা বোঝা যায়! আজ আপনি ওদের টেররিস্ট বলছেন, ব্রিটিশ সরকার বলছে বলে। আজ থেকে একশো বছর পর জনার্দনের মতো লোক আমাদের ধর্মের লোককেও তো টেররিস্ট বলতে পারে? তখনও কি ব্রিটিশরা থাকবে? থাকলেও, এইভাবে মাংস ছুড়ে দেবে? এইসব ভেবে সবই কেমন অর্থহীন লাগল।

একটানা বলে একটা নিশ্বাস ফেলে শাজাহান বলল,

–এই দেশটা একজন হিন্দুর মতো একজন মুসলমানেরও দেশ‌। সেটা না মানে ব্রিটিশরা, না মানে একদল হিন্দু।

সনাতন চুপ করে রইল। মাথা নীচু করে।

শাজাহান এবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, উইলিয়াম স্লিম্যান আপনার ঠাকুরদাকে চিঠি লিখেছিলেন না?

সনাতন মুখ তুলে তাকাল। তার চোখ ছলছল করছে। সে বলল, ওই চিঠি আমার ঠাকুরদা নিজের হাতে লিখেছিল।

শাজাহান বলল, সে কী!

–হ্যাঁ, বলে হীরেটার দিকে তাকিয়ে বলল, এইটার লোভে এই সর্বনাশ হয়েছিল ঠাকুরদার। একে নীচু জাত বলে কলকে পেত না। গোটা ঠগীদের দলকে নিজের হাতে ধরিয়ে দিয়েও সম্মান পায়নি। কেউ স্বীকারই করেনি যে হরিধন হাজরা না থাকলে ওই দলকে ধরা যেত না। তাই রেগে গিয়ে এই হীরেটা চুরি করেছিল। তারপর কথাটা রটতে শুরু করল। তখন ওই চিঠি লিখেছিল ঠাকুরদা। যাতে সম্মানও বাঁচে, চোরের তকমাও না লাগে। সেই সম্মান আমরা এতদিন বয়ে নিয়ে আসছিলাম। ওই হীরেটাও আমাদের কাছে পয়া ছিল, ওটা হাতছাড়া করতাম না কখনও। ঠাকুরদার থেকে বাবা, তার থেকে আমি। কিন্তু…
–কিন্তু?
–আপনি তখনও আসেননি। ওই জনার্দন সান্যাল আমার চোখ খুলে দিল। চোর বলে থুতু ছেটাতে শুধু বাকি রেখেছিল।

জনার্দনের লাশের দিকে তাকাল শাজাহান। লাশের মুখে একটা লাথি মারতে পারলে ওর শান্তি হত।

–তাই মনে হচ্ছে, আমাদের এই ব‌ংশমর্যাদারও কোনও মানে নেই। আমার কোনও ছেলেমেয়ে নেই, বিয়ে-থা করিনি। কে পাবে এই হীরেটা?

বলে শাজাহানের দিকে তাকিয়ে সনাতন বলল, আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। ছেলে থাকলে তার বয়স আপনার মতোই হত। আপনি রাখুন না কেন?

শাজাহানের মাথা ঘুরে গেল। এতক্ষণ সে হীরেটা ভালো করে দেখেনি। এবার দেখল‌। এমন নিটোল আকাশি রঙের হীরে সে কখনও দেখেনি।

সনাতনের দিকে তাকিয়ে আজ এক মুহূর্তের জন্য পিতৃস্নেহের কথা মনে হয়েছিল শাজাহানের।

শাজাহান নীরবে তাকিয়ে রইল সনাতনের দিকে আর হীরেটার দিকে।

সে জানে না, কী বলা বা করা উচিত তার এই মুহূর্তে!

কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল গোবিন্দরাম আর দুই হাবিলদার। হাবিলদার বলল, তাকে খবর দিয়েছে এক ‘সোমত্ত ছোঁড়া’। মৃন্ময়রা তার মানে পালাতে পেরেছে ঠিক।

প্রমথরঞ্জনের হাতে হাতকড়া যখন পরানো হল, তখন সে মৃত।

এর কিছুদিন পরেই বুড়িবালামের যুদ্ধে মারা গেলেন বাঘাযতীন। বাংলার অগ্নিযুগের একটা অধ্যায় ফুরোল।

ছবি: স্বস্তিক করগুপ্ত

 

এর চল্লিশ বছর পরের কথা।

ইয়াঙ্গন প্রদেশের ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা জিপ যাচ্ছে। জিপে বসে আছেন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। জঙ্গল পেরলেই একটা ব্রিজ। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন দূত। কোনও গোপন খবর নিয়ে এসেছে সে।

জিপ থামল। জিপ থেকে নামলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। দূতের মুখ দেখে ভালো লাগল না তাঁর।

কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন কতটা খারাপ খবর।

যে খবর পেলেন, ততটা খারাপ খবর আশাও করেননি তিনি। তাইওয়ানের তাইপেইতে একটা প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছেন আর্জি হুকমত-ই-আজাদ হিন্দ-এর প্রধানমন্ত্রী, সকলের প্রিয় নেতাজি।

যুদ্ধ শেষই হয়ে গিয়েছিল। যেটুকু আশা দপদপ করে জ্বলছিল, সেটাও নিভে গেল লহমায়।

খবর দিয়ে দূত চলে গেল। ড্রাইভার এসে জিজ্ঞেস করল তাঁকে, তিনিও রওনা দেবেন কি না? জায়গাটা নিরাপদ নয়।

একটু সময় চাইলেন কর্নেল। ব্রিজের ওপর একা দাঁড়িয়ে তিনি।

ব্রিজ থেকে ঝাঁপ মারতে ইচ্ছে করছে তাঁর। সব স্বপ্ন এভাবে ধুলোয় মিশে গেল?

এবার নিজের পকেটে হাত দিলেন কর্নেল। পকেটে এই জিনিসটা তিনি রাখেন না সচরাচর। আজ রেখেছেন। কারণ জীবন এখন অনিশ্চিত। তিনি চান, মরার সময় যেন জিনিসটা তার সঙ্গে থাকে।

চারপাশে তাকিয়ে একবার গোপনে জিনিসটার দিকে তাকালেন তিনি।

এই জিনিসটা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তাঁর নানার কথা। যাকে দেখে ভারতের সেনাবাহিনিতে যোগ দিয়েছিলেন কর্নেল ইলিয়াস, আর যার জন্য সব ছেড়ে আইএনএ-তে যোগ দিয়ে চলে এসেছেন।

নেতাজির গ্রেট এসকেপের কিছুদিন পর একটা পরিত্যক্ত সাবমেরিনে চড়ে যখন ওঁরা কয়েকজন রওনা দিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে, তখন বন্দরে ছিল একমাত্র তাঁর বৃদ্ধ নানা। তাঁর হাতে এই জিনিসটা তুলে দিয়ে বলেছিল, নেতাজির মিশনে যদি লাগে!

কিন্তু এত সুন্দর জিনিসটা হাতছাড়া করতে পারেননি তরুণ কর্নেল মহম্মদ ইলিয়াস।

এখন তার খুব মনে পড়ছে তার নানা শাজাহান ইলিয়াসের কথা।

কী তাঁর ভবিষ্যৎ? তিনি জানেন না। কিন্তু এই জিনিসটার ভবিষ্যৎ? তাও কি তিনি জানেন নিশ্চিত করে?

আরও একবার কর্নেল তাকালেন তার প্রিয় হীরের দিকে। আকাশি রঙের, নিখুঁত, নিটোল হীরে।


[‘হেটফুল এইট’ অধ্যায় সমাপ্ত। আগামী সংখ্যা থেকে শুরু হবে শেষ অধ্যায় ‘পাল্প ফিকশন’]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

Leave a Reply to Minku Cancel reply