মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ
অনুবাদ: অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সারা পৃথিবী জুড়েই আজ মুক্ত চিন্তা, গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিসর ইত্যাদি সবকিছুই ফ্যাসিবাদের ক্রমাগত আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে যুঝতে যুঝতে ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। তবুও তারই মধ্যে, বিশ্বজোড়া তদন্তমূলক সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হল মারিয়া রেসা এবং দিমিত্রি মুরাতভকে। প্রথমজন দীর্ঘদিন যাবৎ সিএনএনের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার পর নিজস্ব উদ্যোগে র্যাপলার নামে একটি স্বাধীন সংবাদগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করেন। এই গোষ্ঠী বর্তমান ফিলিপিন্সের শাসক রডরিগো দুতের্তে ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে লাগাতার তদন্তমূলক সাংবাদিকতা ও সত্য উদ্ঘাটনের কাজে লিপ্ত রয়েছে। এর ফলে মারিয়া রেসাকে একাধিকবারে জেলবন্দি হতে হয়েছে এবং তাঁর একাধিক সহকর্মী রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট গুণ্ডাদের হাতে নিহত হয়েছেন। মারিয়া রেসা, ফিলিপিন্সের প্রথম নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব। অন্যদিকে দিমিত্রি মুরাতভ রাশিয়ার অন্যতম বিরোধী মনোভাবাপন্ন সংবাদগোষ্ঠী নোভায়া গ্যাজেটা-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। দীর্ঘ সময় ধরে রাশিয়ার বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতি, জেলবন্দিদের উপরে অমানবিক অত্যাচার ইত্যাদির বিষয়ে নোভায়া গ্যাজেটা সরব হয়ে এসেছে। মারিয়া রেসা অথবা র্যাপলারের মতোই, দিমিত্রি মুরাতভদেরও একাধিক সহকর্মী রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তবুও, মুক্ত কণ্ঠ, মুক্ত চিন্তা ও গণতন্ত্রের প্রয়োজনে মারিয়া রেসা বা দিমিত্রি মুরাতভেরা নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁদের কাজ করে চলেছেন। এই পুরস্কার সেই কাজেরই স্বীকৃতি মাত্র। তাঁদের নোবেল বক্তৃতাদুটি অনুবাদ করা জরুরি বলে মনে হয়েছিল। কারণ বক্তৃতাদুটি মনোযোগ সহকারে পড়লে অনেকেই হয়তো বর্তমান ভারতবর্ষের সার্বিক অবস্থার সঙ্গেও ফিলিপিন্স, রাশিয়া ও অন্যান্য সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্রের যে উত্থান— সেই ঘটনাবলির সঙ্গে এক আশ্চর্য সদৃশতা লক্ষ করতে পারবেন। ফলে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এগুলি অনুবাদ করা এবং যত বেশি সম্ভব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আজ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদের যে লড়াই, সেই লড়াইকে স্মরণে রেখে আমাদেরকে যে আজ একত্রিত হয়ে উঠতেই হবে। একতা ভিন্ন সংগ্রাম হয় না, সংগ্রাম ভিন্ন ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা যায় না। নতুন বছরে এই সংগ্রামের পক্ষেই আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই চলুন।
১০ ডিসেম্বর, ২০২১ — মারিয়া রেসা–র নোবেল সম্ভাষণ
রাজন্যবর্গ, নোবেল কমিটির সম্মানীয় সদস্যেরা ও অন্যান্য মাননীয় অতিথিবৃন্দ,
আমি আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি দুনিয়ার প্রত্যেক সাংবাদিকের প্রতিনিধিস্বরূপ— যাঁরা প্রতিনিয়ত ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন সত্যের সীমারেখাটিকে টিকিয়ে রাখতে— আমাদের মূল্যবোধ ও কাঙ্খিত লক্ষ্যের প্রতি সততা বজায় রাখতে, আপনাদের সামনে সত্যকে সর্বদা উন্মোচিত করতে ও যাতে কৃতকর্মের দায়ভার সঠিক দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষের ওপরে বর্তায় সেটি সর্বদা নিশ্চিত করতে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়ছে জামাল খাশোগ্গীর নির্মম হত্যা, মালটায় দাফন কারুয়ানা গালিজিয়ার করুণ মৃত্যু, ভেনেজুয়েলার লুজ মেলি রেয়েসকে, বেলারুশের রোমান প্রোটাসেভিচকে (যাঁকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে আরও অন্যান্য যাত্রী সমেত গোটা প্লেনটাকেই হাইজ্যাক করতে হয়েছিল), হংকংয়ের জেলে পচতে থাকা জিমি লাইকে, সোনি স্যুইকে— ৭ বছর জেলে বন্দি থাকার পরেও, মুক্তি পাওয়া মাত্রই যিনা জেল থেকে বেরিয়ে এসে আরও একটি নতুন সংবাদগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করেছে এবং মায়ানমার ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে; আরও মনে পড়ছে আমার দেশের ২৩ বছর বয়সী ম্যায় কুম্পিওকে— আজ দু বছর হল সে জেলে বন্দি। মনে পড়ছে মাত্র ছত্রিশ ঘন্টা আগেই গুলিতে নিহত আমার সহকর্মী জেস মালাবানানকে। এঁদের সবাইকেই আজ আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।
আরও এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁদের কারণেই আমরা এখনও নিরাপদ বোধ করছি ও কাজ করতে পারছি। এই সময় #হোল্ডদ্যলাইন (#HoldTheLine) আন্দোলনে ৮০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সংগঠন সংযুক্ত হয়েছে, এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার্থে তারা একযোগে কাজ করে চলেছে। এছাড়াও মানবাধিকার সংগঠনগুলিও আমাদের পাশে রয়েছে। তারাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদেরকে আরও সামনের দিকে এগোতে সহায়তা করেছে। এর জন্য অবশ্য তাদেরকেও কড়া মূল্য চোকাতে হয়েছে— এ পর্যন্ত ফিলিপিন্সে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতের্তের শপথ নেওয়ার সময় থেকে আজ অবধি সাংবাদিকদের তুলনায় আইনজীবীদের হত্যার ঘটনা বেশি। যেখানে আজ অবধি ২২ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তার বিপরীতে নিহত আইনজীবীদের সংখ্যাটা কিন্তু প্রায় তিনগুণের কাছাকাছি— ৬৩। সেই সময় থেকে আজ অবধি আমাদের #কারেজঅন (#CourageOn) মানবাধিকার গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য সংগঠন ‘কারাপাতান’-এর অন্তত ১৩ জন সহযোগী নিহত হয়েছেন। জনপ্রতিনিধি ও সাংসদ লেইলা দে লিমা, যিনি এই সমস্ত ঘটনার বিচার চেয়েছিলেন, তিনি আজ অবধি তাঁর জেলবাসের পঞ্চম বর্ষপূর্তি উদযাপন করছেন; আর এরই সঙ্গে এবিএস-সিবিএন, আন্তর্জাতিক সংবাদ মঞ্চে আমাদের সর্ববৃহৎ প্রচারক যাঁরা, একসময়ে আমি যার কর্ণধার ছিলাম— সেই সংস্থাকে গত বছর ফিলিপিন্সে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তখন আমি র্যাপলার নামে একটি স্টার্টআপ সংস্থা তৈরি করা শুরু করেছিলাম, আগামী জানুয়ারিতে যার দশ বছর পূর্ণ হবে। র্যাপলার তৈরির পিছনে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি বিশেষ মুদ্রার দুটি পিঠকেই একত্রে নিয়ে আসা, যা কিনা বর্তমান পৃথিবীর সমস্ত অন্যায় উন্মোচিত করবে— উন্মোচিত করবে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের চরম অনুপস্থিতি। এই মুদ্রাটি হল আসলে আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তার তথ্য-বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে এক রূপকস্বরূপ, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যান্য সমস্ত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে। সাংবাদিকেরা, সেই প্রাচীন গণতন্ত্রের দ্বাররক্ষকেরা, এই মুদ্রার এক পিঠে রয়েছেন। অন্য পিঠে রয়েছে প্রযুক্তি, তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে সঙ্গে নিয়ে— যে প্রযুক্তির কারণেই আজ মিথ্যের ভাইরাস আমাদের প্রত্যেককেই কোনও না কোনওভাবে আক্রান্ত করতে পেরেছে, আমাদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, বের করে এনেছে আমাদের সমস্ত রাগ, অবিশ্বাস, ঘৃণা— আর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে এই পৃথিবীতে স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্রের সহজ উত্থানের।
আজ আমাদের তরফে সবচেয়ে বেশি করে যা প্রয়োজন তা হল এই ঘৃণা ও হিংসার বাতাবরণকে প্রতিহত করা। আমাদের তথ্য-বাস্তুতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত যে ঘৃণার বিষাক্ত কর্দম প্রবাহিত হয়ে চলেছে— আমেরিকান ইন্টারনেট কোম্পানিগুলির প্রাথমিক নীতি অনুসারে, কারণ এর ফলে তাদের মুনাফা হয়— তারা আমাদের মধ্যেকার ঘৃণা ও অবিশ্বাসকে সুচারুভাবে বাড়িয়ে তোলে। আজ আমাদের মধ্যেকার সবচেয়ে খারাপটাকে বের করে আনাতেই তাদের যে নোংরা আর্থিক বৃদ্ধির কৌশল, সেই অবস্থার আশু পরিবর্তন করা প্রয়োজন। অবশ্যই এর অর্থ হল— আমাদের আরও অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। [একটি টিশার্ট তুলে ধরে দেখালেন] নিজে ভালো হতে চাওয়ার অর্থ হচ্ছে “পৃথিবীতে এখনও ভালো কিছু রয়েছে, এই বক্তব্য বিশ্বাস করা” (to Believe THEre is GOOD in the world.)।
আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে সাংবাদিকতার এই পেশাতে রয়েছি। এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে আমি পৃথিবীর সংঘর্ষপ্রবণ এলাকাগুলিতে, যুদ্ধাঞ্চলগুলিতে কাজ করেছি। সেখানে আমি মানবতার সবচেয়ে খারাপ জিনিসগুলি যেমন প্রত্যক্ষ করেছি, তেমনই প্রত্যক্ষ করেছি মানবতার সৌন্দর্যকে— সর্বস্ব খোয়ানো মানুষও যেখানে তার সামান্য সম্বলটুকু আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে। সমস্তরকম সরকারি আক্রমণকে প্রতিহত করে র্যাপলার যে শেষ পাঁচ বছরে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে তার অন্যতম কারণই হল অজানা অচেনা সমস্ত মানুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতা ও সহানুভূতি; এবং এই সমস্ত মানুষেরা সবরকম সন্ত্রাস ও বিপদের কথা জেনেও আমাদের যে সাহায্য করেছে তার এক এবং একমাত্র কারণ হল তারা সেটা করতে চেয়েছিল। কোনও কিছুর প্রত্যাশা ছাড়াই তারা এভাবে পাশে থাকতে চেয়েছিল। এটাই মানবতার সবচেয়ে সুন্দর দিক, এবং এরই কারণে আজও এই পৃথিবীতে মির্যাকল ঘটানো সম্ভব— আর এইটুকুই আমরা যখন হারিয়ে ফেলি, তখন আমরা হিংসা ও সন্ত্রাসের এক অবিশ্বাস্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে বাধ্য হই।
শেষবারে যখন কোনও সাংবাদিককে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল, সালটা ছিল ১৯৩৬। সেবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন সাংবাদিক কার্ল ভন অসিয়েৎস্কি। যদিও শেষ অবধি তিনি অসলোতে এসে নিজের পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ সেই সময় তিনি জার্মানির এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। আমরা সত্যিই বোধ করি আজ অন্ততপক্ষে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এক কদম হলেও সামনের দিকে এগোতে পেরেছি। আমরা অন্ততপক্ষে আজ এখানে এসে নিজেরা দাঁড়াতে পেরেছি। আজ আবারও সাংবাদিকদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দিয়ে নোবেল কমিটির সদস্যেরা বোধকরি সেই পুরনো এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। গণতন্ত্রের পক্ষে এই সময় এক গুরুত্বপূর্ণ সময়— সেই কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। দিমিত্রি এবং আমি, আমরা নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি, কারণ আজ আমরা আপনাদের সুমুখে দাঁড়িয়ে আপনাদেরকে আমাদের কথা শোনাতে পারছি। কিন্তু এখনও, এই মুহূর্তে এমন অজস্র সাংবাদিক রয়েছেন, যাঁরা অন্ধকারের আড়ালে ক্রমশ নিষ্পেষিত হচ্ছেন। যাঁদের পিছনে কারও কোনও সমর্থনের হাত নেই এবং সংশ্লিষ্ট সরকার বা প্রশাসনও কোনওরকমের কোনও ভয় বা দ্বিধাবোধ ছাড়াই তাঁদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার এই সমস্ত কার্যকলাপ আরও ত্বরান্বিত করছে, আরও সহায়তা করছে। এ এক এমন সন্ধিক্ষণ, যেখানে ধ্বংসকে কার্যত এক শৈল্পিক উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়া গেছে।
আমরা পুরনো পৃথিবীর এক ধ্বংসস্তুপের ওপরে দাঁড়িয়ে— এবং আমাদের এখন সেই দূরদৃষ্টি ও কল্পনাশক্তির জোর থাকা প্রয়োজন, যা আমাদের বলে দেবে— এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা যদি কিছু করতে না পারি, তাহলে তার যে কী ভীষণ ফল হতে চলেছে। পরিবর্তে আমাদের এখন এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর, আরও সহমর্মী ও সকলের পক্ষে আরও বাসযোগ্য করে তোলার জন্য চেষ্টা করতেই হবে।
আর তা করতে হলে, একবার অন্তত নিজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করুন— জিজ্ঞেস করুন সেই প্রশ্নটিকে, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমাদের দল এবং আমাকেও যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল—
“সত্যের জন্য আপনি কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছেন?”
আমি আমার মতো করে তিনটি ভাগে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইব। প্রথমত, আমার জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে— কেমন করে আমি আমার উপরে নেমে আসা সমস্ত আক্রমণগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে এই ধরনের জীবনের জন্য প্রস্তুত করেছি; দ্বিতীয়ত, আমরা সকলে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিশেষ কোন সমস্যাটির সম্মুখীন হয়েছি; এবং, শেষত, সেই সমস্যাটির সমাধান কোন পথে সম্ভব, কারণ সেই সমাধানকেও যে শেষ পর্যন্ত আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এ ব্যতীত আর অন্য কোনও উপায় নেই।
গত দু বছরেরও কম সময়ে ফিলিপিন্স সরকার আমার বিরুদ্ধে মোট ১০টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। স্রেফ আমার পেশাটুকুকে বাঁচিয়ে রাখবার প্রয়োজনে আমাকে মোট ১০ বার জামিনের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। গতবছর আমাকে ও আমার এক সহকর্মীকে, আমাদের পোর্টালে প্রকাশিত একটি খবরের জন্য সাইবারমাধ্যমে মানহানির অভিযোগ তুলে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। প্রসঙ্গত খবরটি ৮ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং সেই সময় আমাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে প্রযুক্ত সাইবার আইনটিরও কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে আমার বিরুদ্ধে মোট যত কটি অভিযোগ রয়েছে, সেগুলির সাহায্যে আমাকে ফিলিপিন্সের আইন অনুযায়ী ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে আটকে রাখা যেতে পারে।
কিন্তু, এতদসত্ত্বেও আমার বিরুদ্ধে যতই আঘাত এসেছে, আমি ততই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি। ক্ষমতার অপব্যবহার যে কোন চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তা আমি নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করেছি। তবুও, যা কিছু দিয়েই র্যাপলার ও আমাকে সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছে, তা আদতে আমাদের আরও শক্তিশালী করেছে।
সাংবাদিকতার মূলে রয়েছে একটি সম্মানের সূত্র। আমার কাছে সেই সূত্রটি আমার জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় থেকে সংগৃহীত, সেই সমস্ত অধীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুসজ্জিত। যে পরিবেশে আমি বড় হয়েছি— সত্যি এবং মিথ্যে আলাদা করে চিনতে শিখেছি; আমার কলেজজীবন— যেখানে আমি আমার নিজের ক্ষেত্রে আত্মসম্মানের সূত্রটিকে আহরণ করেছি; এবং সর্বোপরি সাংবাদিক হিসেবে আমি যে সময় কাটিয়েছি— যেখানে সঠিক সাংবাদিকতার মান ও মূল্যবোধ সম্পর্কে আমি জেনেছি এবং সেইভাবেই লিখতে শিখেছি— আর এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘উটাং না লুব’-এর ফিলিপিনো মূল্যবোধ, যা আমাদের অন্তর থেকে ঋণী করে। এই মূল্যবোধ আমাদের এমন একটি সমাজ তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে যেখানে আমরা সেই ঋণ উপলব্ধি করি, এবং তা কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে চেষ্টা করি।
এই মুহূর্তে সততা ও মূল্যবোধের সম্মান সমস্ত ধরনের ঘৃণা, মিথ্যাচার ও বিচ্ছেদভাবনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে। মাত্র আঠারোতম মহিলা হিসেবে আমি যখন এই সম্মান হাত পেতে নিচ্ছি, আমাকে বলতেই হবে লিঙ্গভিত্তিক অ-তথ্যের কথা। যে লিঙ্গভিত্তিক অ-তথ্য এবং মিথ্যা তথ্য প্রচারের কারণে নারী, কন্যা, রূপান্তরকামী ও বৃহত্তর এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ভুক্ত সকলেরই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ওপরেও ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। নারী সাংবাদিকরা এখন এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাতে রয়েছেন। পুরুষশ্রেষ্ঠতা এবং ঘৃণার এই অতিমারিকে আমাদের প্রতিহত করতেই হবে, এবং এখনই তা করা প্রয়োজন। সেখানেও আমরা নিশ্চিত দেখব যে আমরাই আসলে শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউই আমাদের নিজস্ব শক্তির সঠিক পরিমাপ করে উঠতে পারি না, যতক্ষণ না অবধি আমাদের সেই শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।
এবারে বরং ব্যক্তিগত পরিসর ছেড়ে আমরা সমস্যাটির কথায় আসি। কেমন করেই বা আমরা আজ ঠিক এই জায়গাটিতে এসে দাঁড়ালাম সেই বিষয়ে আলোচনা করি।
র্যাপলারের বিরুদ্ধে আজকের যে ক্রমাগত আক্রমণ, আদতে তার সূচনা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে এমন একটা সময়ে, যখন আমরা একইসঙ্গে দুটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে সরকারি দায়সারা মনোভাবের অবসান দাবি করেছিলাম। প্রথমটি হল দুতের্তের ড্রাগওয়ার এবং দ্বিতীয়টি হল মার্ক জুকেরবার্গের ফেসবুক। যদিও আজকের পরিস্থিতি তখনকার চেয়েও আরও অনেকগুণে খারাপ হয়েছে। সিলিকন ভ্যালির সম্মিলিত পাপপুঞ্জের বিষফলটিকে, আমরা গত জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে খাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই পরিপূর্ণরূপে বিকশিত ও প্রস্ফূটিত হতে দেখেছি। আমরা দেখেছি ক্যাপিটল হিলের ঘটনা।
আমাদেরকে আজ মনে রাখতে হবে, সামাজিক মাধ্যমে যা ঘটে তা আর শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমেই আটকে থাকে না।
অনলাইন মাধ্যমে হিংসার ঘটনা, আজ যে কোনও বাস্তব জীবনের হিংসার ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়।
সামাজিক মাধ্যমগুলি আসলে বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা ও অর্থ রোজগারের এক মারণ-মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে শোসানা জুবভ সঠিক অর্থেই নজরদারির পুঁজিবাদ বা নজরদারির ধনতন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই নতুন ধরনের ধনতন্ত্রের লক্ষ্যই হল আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে আমাদের থেকে নিংড়ে নিয়ে, তাকে ব্যবহার করে মুনাফা নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, আবেগ, অনুভূতি আমাদের থেকে শুষে নেওয়া হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সেই সবকিছুরই প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে এবং সবচেয়ে বেশি দাম দেওয়া ধনী ব্যক্তিটির কাছে সেই তথ্য বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। উচ্চলাভজনক একেকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র লক্ষ্য-নির্ভর ছোট ছোট অপারেশন বা প্রক্রিয়াকে এরপর খুবই সন্তপর্ণে সকলের অলক্ষ্যে সাজিয়ে ফেলা হচ্ছে, যার মাধ্যমে ক্রমশ একটু একটু করে আমজনতার স্বাভাবিক চিন্তা বা বুদ্ধির ওপরেও প্রভাব বিস্তার করা যাচ্ছে। পরিণামে আমরা কার্যত পাভলভের পরীক্ষাতে ব্যবহৃত সেই নিষ্পাপ সারমেয়টির অবস্থায় পর্যবসিত হচ্ছি। আর সবচেয়ে বড় কথা— এই মারণ-পরীক্ষার বিষয়টি কেবল যে আজও, এই মুহূর্তেও জারি রয়েছে তা নয়, ইতিমধ্যেই তা যথাসাধ্য রকমে ফলও দিচ্ছে। আমাদের দেশে তার বিপজ্জনকে ফল ইতিমধ্যেই আমরা বিকশিত হতে দেখেছি, এবং একই জিনিস দেখেছি মায়ানমারে, ভারতবর্ষে, শ্রীলঙ্কায় ও অন্যান্য আরও অনেক জায়গাতেই। এমন পরীক্ষাতে লিপ্ত সমস্ত বিপজ্জনক সংগঠনগুলিই নিশ্চিন্তে সংবাদমাধ্যমগুলির মূলধনের জোগানকে ক্রমশই নিজেদের দিকে শুষে নিংড়ে নিতে পারছে, এবং এর কারণে সরাসরি বাজার অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক সমাজে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপরেও মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে।
এই মুহূর্তে ফেসবুক হল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সংবাদ-প্রচারক মাধ্যম। অথচ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, হিংসা ও রাগের মোড়কে পরিবেশিত মিথ্যা তথ্য বা ‘সংবাদ’সমূহ, সঠিক সমস্ত তথ্যের চেয়ে অনেকগুণে বেশি তাড়াতাড়ি সামাজিক মাধ্যমগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম।
এই সমস্ত মার্কিনি সংস্থাগুলি, যারা কার্যত আমাদের বিশ্বব্যাপী তথ্য-বাস্তুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে— তারা সম্পূর্ণভাবে সঠিক তথ্যের বিরোধী, সাংবাদিকদের বিরোধী। তারা তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী, আমাদের একে অপরের থেকে আলাদা করে দিচ্ছে, মৌলবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তথ্য-ব্যতিরেকে সত্যের হদিস মেলে না। সত্য ব্যতীত কারও পক্ষে আস্থা বা বিশ্বাস অর্জন সম্ভব নয়, আর বিশ্বাস-বিনা গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই, সহাবস্থানের সুযোগ নেই। এমন একটি অবস্থার ফলে, পৃথিবীতে তখন অন্যান্য সমস্ত সমস্যাগুলির সমাধান কার্যত আরওই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়— যেমন কিনা করোনাভাইরাস, যেমন কিনা পরিবেশ পরিবর্তন অথবা সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই।
২০১৯ সালে আমাকে যখন প্রথমবারের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই অফিসারটি আমাকে বলেছিলেন, “ম্যাডাম, ত্রাবাহো লাং পো (আমি কেবল আমার কাজটুকুকে সম্পন্ন করছি)।” এরপর আমাকে আমার মিরান্ডা অধিকারগুলির বিষয়ে জানাতে গিয়ে, সেই অফিসারের গলার স্বরটি ক্রমশ খাদ থেকে আরও খাদে নেমে গিয়েছিল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, তাঁর চূড়ান্ত অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। আমারও তাঁর জন্য খারাপ লেগেছিল। তিনি আমাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, কেন না আমি একজন সাংবাদিক!
এই সমস্ত অফিসারেরা আদতে ক্ষমতার হাতে পুতুল হয়ে থাকা তুচ্ছ একেকটি যন্ত্র মাত্র, এঁরা হলেন সেই একেকটি উদাহরণ— কেমনভাবে মানুষ ভালো থেকে খারাপে পরিবর্তিত হয়— এবং এর থেকেই কেমনভাবে বৃহত্তর আরও একেকটি স্বৈরাচারের জন্ম হতে পারে। হানা আর্ডেন্ট যেমনটা বলেছিলেন, অন্যায়ের এক চূড়ান্ত অস্বাভাবিকতার কথা। তিনি বলেছিলেন অন্ধভাবে একনায়ক হিটলারের সমস্ত হুকুম তামিল করে চলতে থাকা সেই সব বোধশূন্য আমলাদের কথা, কেমনভাবে তাঁরা স্রেফ আদেশ পালনের অজুহাতে হিটলারের অধীনে কেরিয়র গড়তে চেয়ে চূড়ান্ত বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
এইভাবে— ঠিক এইভাবেই একেকটি দেশ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পৃথিবীও, ক্রমশ বুদ্ধিহীন, বিবেকশূন্য হয়ে দাঁড়ায়।
এখন আপনাকে জানতেই হবে যে আপনি ঠিক কোন নীতির জন্য, কোন মূল্যবোধের জন্য লড়াই চালাচ্ছেন; আর সেটা জানামাত্রই আপনাকে তার জন্য নির্দিষ্ট সেই সীমারেখাটিও টেনে দিতে হবে। যদি এখনও আপনারা সেই সীমারেখাটি টেনে না দিয়ে থাকেন, তাহলে এখনই তা টানুন। যে সীমারেখাটির এই পারে আপনি থাকলে আপনি সত্যের পক্ষে রয়েছেন, আর অন্যপিঠে যিনিই থাকুন না কেন তাঁর উদ্দেশ্য মন্দ। কোনও কোনও দেশের সরকার বা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা হয়তো এই সীমারেখাটির বিষয়ে একেবারেই হাতের বাইরে চলে গিয়েছেন, কিন্তু আপনি যদি প্রযুক্তি-জগতের বাসিন্দা হয়ে থাকেন— তাহলে আমি বিশেষ করে আপনার বা আপনাদের উদ্দেশ্যেই আমার এই কথাগুলিকে ছুড়ে দিতে চাইব।
নির্বাচনের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা কীভাবেই বা সুনিশ্চিত করা যাবে, যদি তথ্যের অখণ্ডতা বা নিরাপত্তাই সুনিশ্চিত না হয়?
আগামী বছরে যে সমস্ত দেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, তারা প্রত্যেকেই আজ ঠিক এই প্রশ্নেরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, আমেরিকা এবং আমাদের ফিলিপিন্স— আগামী বছরের মে মাসে আমাদের যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংঘটিত হতে চলেছে, তা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাছে এক জীবনমরণের সন্ধিক্ষণ। ৩৫ বছর আগে জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে একনায়ক ফার্দিনান্দ মার্কোসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল ও তার পরিবারকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, সেই ফার্দিনান্দেরই পুত্র ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র এবারের নির্বাচনে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। ইতিমধ্যেই সে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে অ-তথ্য ও মিথ্যা সংবাদের এক জঘন্য বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এই ঘটনাকে র্যাপলারই প্রথম ২০১৯ সালে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছিল। আমরা, আমাদের চোখের সামনে ইতিহাস পালটে যেতে দেখছি।
অ-তথ্য বা কু=তথ্য প্রচার যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একইসঙ্গে একটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা বোঝানোর জন্য বরং এখানে একটা উদাহরণ দিই। মনে করে দেখুন ২০২০ সালে, সেপ্টেম্বর মাসে ফেসবুক তাদের মাধ্যম থেকে একটি চিনা প্রচার-ষড়যন্ত্র নামিয়ে নিয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে ফেসবুকে একাধিক ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছিল এবং সেই সমস্ত অ্যাকাউন্ট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারের কিছু ছবি ও ভিডিও আবারও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে দরকারমতো বিকৃত করে ছড়ানো হচ্ছিল। সেই সমস্ত ছবি বা ভিডিওতে ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রকে দেখা যাচ্ছিল প্রেসিডেন্ট দুতের্তের মেয়ের হয়ে প্রচার করতে এবং র্যাপলার ও আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে।
তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি?
আমাদের তথ্য-বাস্তুতন্ত্রে, প্রকৃতপক্ষে আমাদের সকলের অগোচরে বিগত কয়েক বছরে কার্যত একটি পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ পৃথিবীর মানুষকে তাই এমনভাবেই সচেষ্ট হতে হবে, যেমনভাবে তারা হিরোশিমার পরে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ঠিক সেই সময়ের মতোই আমাদেরকে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে— রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো; এবং আমাদের মূল্যবোধকে নতুনভাবে সাজাতে হবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার্থে জারি করা সেই সনদের মতো, যাতে মানবতা নিজেকে আরও নীচ অবধি টেনে না নামায়। আজ আমাদের তথ্য-বাস্তুতন্ত্রে কার্যত একটি অস্ত্র-প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। একে থামাতে গেলে এক বহুমুখী আন্দোলন প্রয়োজন এবং আমাদের সকলকেই তাতে সামিল হতে হবে। এই আন্দোলনের সূচনা হবে সঠিক তথ্যের পুনঃস্বীকৃতির মাধ্যমে।
আমরা চাইব যে আমাদের তথ্য-বাস্তুতন্ত্রটিতে যেন সত্য এবং কেবলই সত্য ভিন্ন আর অন্য কোনও তথ্যই যেন না থাকে। এই বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে গেলে সবার প্রথমে আমাদের, সর্বাধিক সামাজিক গুরুত্বের সঙ্গে সাংবাদিকতার পেশাটিকে আবারও নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে হিংসা এবং ঘৃণাকে মুনাফার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার যে ‘নজরদারির অর্থনীতি’, তাকে সমূলে ছুড়ে ফেলতে হবে। তাকে বেআইনি ঘোষণা করতে হবে।
স্বাধীন সাংবাদিকতা বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিজমকে আমাদের যে কোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রথমেই প্রত্যেক সাংবাদিকের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে হবে এবং যে সমস্ত দেশে এই নিরাপত্তা নেই সেই সমস্ত দেশের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। এর পরবর্তীতে আমাদের বিশেষভাবে বিজ্ঞাপন-নির্ভর সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকতার মডেলটির বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। এই কারণেই আমি ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর পাবলিক ইন্টারেস্ট মিডিয়া-র যুগ্ম-সভাপতির পদ গ্রহণ করতে রাজি হয়েছি। এই ফান্ডের উদ্দেশ্য হল অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টনের মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে সংবাদমাধ্যমগুলিকে সহায়তা করা। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন সব দিক থেকেই সাংবাদিকতার উপরে আঘাত নেমে আসছে, তখন মনে রাখতে হবে সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে মোট ওডিএ বা অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্সের মাত্রই ০.৩ শতাংশ পরিমাণ অর্থ সাংবাদিকতা বা সংবাদমাধ্যমগুলির পিছনে খরচ করা হয়ে থাকে। এই শতাংশের হিসেবকে বাড়িয়ে আমরা যদি তাকে ১ শতাংশ পরিমাণেও নিয়ে যেতে পারি তাহলেও, প্রতি বছর নতুন সমস্ত সংবাদমাধ্যমগুলির সাহায্যার্থে অন্তত পরিমাণে ১০০ কোটি ডলারের নিয়মিত অর্থসাহায্য সংগ্রহ করা সম্ভব। বিশেষ করে দক্ষিণ মহাদেশীয় অঞ্চলগুলির জন্য এই প্রস্তাবকে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
সাংবাদিকদেরকে প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে হবে। তাকে বরণ করে নিতে হবে। এই কারণে গুগল নিউজ ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে সহায়তায় আজ থেকে মাত্র দিন পনেরো আগেই র্যাপলার একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে, যেখানে স্থানীয় স্তরে কর্মী-নির্ভর একেকটি সামাজিক গোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব হবে। খবরকে ভাইরাল করাটা সাংবাদিকদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দেওয়ার অর্থ নয়। বরং সেই প্রযুক্তির ব্যবহার আদতে দৈনন্দিন খাবারে শাকসবজির মতোই সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত পুষ্টিকে আরও সহায়তা করবে, এবং মুনাফাখোর প্রতিষ্ঠানগুলিকে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দেবে না। সমাজে আবারও— সত্য, তথ্য এবং বিশ্বাসের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
এবারে আসা যাক প্রশাসন ও আইনের দিকটিতে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে আমি ধন্যবাদ জানাব তাঁদের ডেমোক্রেসি অ্যাকশন প্ল্যানের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলতে চাইব সেদেশের সংবিধানের ধারা ২৩৪-কে অবিলম্বে সংশোধন অথবা বাতিল করতে। এই ধারাটি সামাজিক মাধ্যমগুলিকে দৈনন্দিন প্রয়োজনের ব্যবহার্য বস্তু হিসেবে দেখতে চায়। এগুলি অবশ্যই সম্পূর্ণ সমাধান নয়, কিন্তু শুরুতে এগুলিকে দিয়েই লড়াইয়ের সূচনা করাটা প্রয়োজন। এই সমস্ত সামাজিক মাধ্যমগুলি, যে কোনও তথ্যের বিস্তার তাদের অঙ্গুলিহেলনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই, যে সময়ে জনগণ ব্যস্ত রয়েছে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত বক্তব্যগুলির পরিমার্জন ও সংশোধনের জন্য, তাদেরকে আরও বলতে চাইব— এখন এর চাইতেও বেশি করে দরকার ওপরের দিককার সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা। যেখানে কম্পিউটারের কোডে লেখা একেকটি নির্দিষ্ট অ্যালগরিদমের সাহায্যে সংবাদ বা তথ্যের বিস্তার নির্ধারিত করে দেওয়া হচ্ছে। সম্পাদকের বক্তব্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে মুনাফাখোর মালিকেরা, সেই বক্তব্যের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করছে যন্ত্র। সারা পৃথিবীতে এর প্রভাব পড়ছে। যত্রতত্র সামাজিক মাধ্যমের নিকৃষ্ট বাহুবলীরা (ভাড়াটে সৈনিকেরা) একেকটি দেশে গণতন্ত্রের ভুষ্টিনাশ করে ছাড়ছে। অন্ততপক্ষে ৮১টি দেশে এমন ঘটনার কথা শোনা গিয়েছে। এই অকাতর, দায়ভারহীন ব্যবস্থার সমাপ্তি হওয়া প্রয়োজন।
গণতন্ত্রে এখন নারীর বিরুদ্ধে নারী, পুরুষের বিরুদ্ধে পুরুষ, একের বিরুদ্ধে একের লড়াইয়ের সময় এসেছে। আমরা নিশ্চিতভাবেই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যেখান থেকে আমরা ফ্যাসিজমের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে পারি, অথবা এক নতুনতর পৃথিবীর জন্য লড়াই করতে পারি।
এর জন্য কেবল আপনাকে এইটুকুই নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে:
“সত্যের জন্য আপনি কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছেন?”
আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে আজ, আমি সত্যি করেই আপনাদের সামনে এভাবে এখানে এসে দাঁড়াতে পারব। আমার জীবনের প্রত্যেকটি দিন আমি নিশ্চিতভাবেই এই ভয় বুকে নিয়ে কাটাতে বাধ্য হই, যে আগামীকাল থেকে হঠাৎ হয়তো বা আমাকে আজীবন জেলে বন্দি থাকতে হবে। কারণ আমি যে একজন সাংবাদিক। দিনশেষে প্রতিরাতে বাড়ি ফিরি যখন, তখন আমি সত্যিই জানি না যে আমার ভবিষ্যতে ঠিক কীই বা লেখা আছে। কিন্তু আমি এই ঝুঁকিটুকু নিতে ভালোবাসি। যা কিছু পাই— তার সবকিছুর বিপরীতে এই ঝুঁকিটুকু সত্যিই নেওয়া চলে বোধহয়।
বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে। এখন পুনর্গঠনের সময়। সেই পৃথিবীকে গড়ে তুলতে হবে, যাকে আমরা দেখতে চেয়েছি।
এখন, এক মুহূর্তের জন্য আসুন, আমার সঙ্গে, আমরা সকলে চোখ বন্ধ করে থাকি। ভাবতে চেষ্টা করি আমাদের কল্পনার সেই পৃথিবীকে, এমন এক পৃথিবী, যে পৃথিবীতে শান্তি, বিশ্বাস ও সহাবস্থানের রাজত্ব। আমরা আমাদের মধ্যেকার সবচেয়ে ভালোটুকু বের করে আনতে চেষ্টা করছি…
আসুন, এবারে এটাকে বাস্তবে করে দেখাই। সত্যের সীমারেখাটুকুকে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচি— একসঙ্গে, একত্রেই।
১০ ডিসেম্বর, ২০২১ — দিমিত্রি মুরাতভের নোবেল সম্ভাষণ
নোবেল কমিটির মাননীয় সদস্যেরা, ও সম্মানীয় অতিথিবর্গ,
৮ অক্টোবর সকালে আমার মা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। এমনিই, কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই।
–উমম, মা আমরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি …
–বাঃ, এ তো ভালো খবর! আর কিছু?
–হ্যাঁ মা দেখো, সবটা বলি তোমায়…
***
আমি নিশ্চিত যে বিবেকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং তারই সঙ্গে অন্যান্য নাগরিক অধিকার, এগুলিই প্রগতির পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ।
আমি মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারসমূহের নিশ্চিত গুরুত্বের বিষয়ে আমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
আমি নিশ্চিত যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, (…) নিরস্ত্রীকরণ ও আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ইত্যাদি সবকিছুই— এক মুক্ত সমাজ ভিন্ন সম্ভবপর নয়। যে সমাজে তথ্যের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার অধিকার সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত।
শান্তি, প্রগতি ও মানবাধিকার— আমাদের এই তিনটি লক্ষ্য অঙ্গাঙ্গী ভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
এই কথাগুলি অ্যাকাডেমি অব সায়ান্সের সদস্য আন্দ্রেই শাখারভের নোবেল বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত। তিনি ছিলেন একজন বিশ্বনাগরিক ও প্রভাবশালী চিন্তক।
তাঁর স্ত্রী এলেনা বনার, তাঁর এই বক্তৃতাটিকে ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭৫, বৃহস্পতিবার— এই তারিখে এই হলঘরের ঠিক এই জায়গাটিতে দাঁড়িয়েই সকলের উদ্দেশ্যে পাঠ করেছিলেন।
আমি বিশেষভাবে চেয়েছিলাম বিশ্বখ্যাত এই হলঘরটিতে আবার, আবারও একটিবার শাখারভের সেই বক্তব্যটিই প্রতিধ্বনিত হোক।
কেন আমাদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ? কেনই বা আমার জন্যেও?
পৃথিবীর সঙ্গে গণতন্ত্রের আজ বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে।
ক্ষমতাসীন ধনিক ব্যক্তিদের আচরণে আজ পৃথিবী ক্ষুব্ধ।
পৃথিবী আজ স্বৈরাচারিতার দিকে মুখে ফিরিয়েছে। একনায়কতন্ত্রের দিকে ফিরিয়েছে মুখ।
আমরা ভুল ভেবেছিলাম যে, প্রযুক্তি ও হিংসার মাধ্যমেই প্রগতি সম্ভব। মানবাধিকার ও মুক্তির মাধ্যমে নয়।
মুক্তির ব্যতিরেকে এই কি প্রগতি?
এ যেন গরু ছাড়াই দুধ পেয়ে যাওয়ার মতো কল্পনা।
একনায়কেরা আজ হিংসার একচ্ছত্র অধিকার হাতে পেয়েছে।
আমাদের দেশে (এবং একমাত্র সেখানেই নয়) মনে করা হয় যে, সেই সমস্ত রাষ্ট্রনায়কেরা যাঁরা কিনা রক্তপাত ঘটাতে অনাগ্রহী, তাঁরা আসলে দুর্বল।
এবং বিশ্বকে কেবলই যুদ্ধের ভ্রূকুটি দেখিয়ে চলাটাই আদর্শ দেশভক্তের কর্তব্য।
এভাবেই ক্রমশ যুদ্ধের অনিয়ন্ত্রিত বেসাতির মধ্যে থাকতে থাকতে, সাধারণ সমস্ত মানুষেরাও কখন যেন তাদেরও মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলে যুদ্ধকে অবশ্যকাম্য বলে ভাবতে শুরু করে।
সরকার এবং তাদের অনুগত ভক্তেরাই, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে সামরিক কায়দাতে এমন রেটরিক (চর্বিতচর্বণ) প্রচারের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু এমনও অন্যান্য অনেক টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে যারা কিন্তু সত্যের নগ্ন রূপটিকেই সকলের সামনে তুলে ধরে। আমি সেই সমস্ত চ্যানেল দেখেছি।
চেচেন যুদ্ধের সময় পাঁচটি বরফ-ঠাসা রেফ্রিজরেটর-গাড়িকে একটি রেলস্টেশনের কাছে, রেলওয়ে ট্র্যাকের ওপরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। ২৪ ঘন্টা ধরে সেই গাড়িগুলিকে পাহারা দেওয়া হত। সেগুলি আদতে ছিল চলমান একেকটি মর্গ, প্রতিরক্ষা দপ্তরের ১২৪নং ল্যাবরেটরির আওতাভুক্ত।
এই রেফ্রিজরেটর-গাড়িগুলিতে অশনাক্ত সেনাকর্মী ও অফিসারেদের মৃতদেহগুলিকে সংরক্ষণ করা হত।
এই সব মৃতদেহগুলির মধ্যে অধিকাংশেরই মুখ বা মাথার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। চরম অত্যাচারের ফলে সেগুলি ছিন্নভিন্ন, বিকৃত হয়ে থাকত। উক্ত ল্যাবরেটরির যিনি প্রধান ছিলেন, সেই মেজর কমান্ডার শেরবাকভ নিঃশেষে চেষ্টা করতেন একজনও সৈনিকের দেহ যেন অশনাক্ত না থাকে। রেললাইনের ধারে একটি ছোট্ট কুঁড়েবাড়িতে আরও ছোট্ট একটি টেলিভিশন সেট ছিল। যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া সন্তানেদের বাবা-মায়েরা সেই কুঁড়েবাড়িটিতে বসে অপেক্ষা করতেন। একজন ক্যামেরাম্যান মৃতদেহগুলির ছবি তুলে তুলে সেই টেলিভিশন সেটটিতে পাঠাত। একেকবারে একেকটি করে দেহ, মোট ৪৫৮ জন। এতজন তরতাজা সৈনিক, সেই রেফ্রিজরেটর গাড়িটির ভিতরে তখন মাইনাস পনেরো ডিগ্রির শীতলতায় শায়িত। মায়েরা যারা চেচনিয়ার পাহাড়ে, গিরিবর্ত্মগুলিতে তাঁদের সন্তানেদের অস্তিত্বকে খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন, তাঁরা তখন তাঁদের সন্তানেদের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মুখগুলিকে, দেহগুলিকে টেলিভিশনের পর্দাতে প্রত্যক্ষ করতেন আর কেঁদে উঠে, চিৎকার করে বলতেন, “না না, এ তো সে নয়। কখনওই নয়! এ অন্য কেউ।”
কিন্তু, এই তো সে-ই…
আজকের আদর্শবাদীরা দেশের জন্য বাঁচার ধারণাকে নয়, দেশের জন্য মরার ধারণাকে অধিকতর গৌরবের বলে প্রচার করে থাকে। টেলিভিশনের পর্দাগুলিকে— সেই সমস্ত পর্দাতে সম্প্রচারিত হওয়া ঘৃণ্য জিঘাংসামূলক বক্তব্যগুলিকে— আমরা আর কোনওভাবেই সেগুলিকে আমাদের বোকা বানাতে দেব না। আমরা বরং সেই ছোট্ট ঘরের, সেই আরও ছোট্ট টেলিভিশনের বিশেষ পর্দাটিকেই মনে করে দেখব। সেই সমস্ত রেফ্রিজারেটর-গাড়িগুলিতে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা আমাদেরই সন্তানেদের হিমশীতল মৃতদেহ।
দোআঁশলা এই যুদ্ধ এবং সেই চরম নৃশংস, চরম বেদনাদায়ক, নোংরা, অপরাধমূলক ঘটনা— বোয়িং এমএইচ ১৭-র মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্পর্ক আজ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা জানি না যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কোনওদিন সেই ভাঙা সম্পর্ককে জোড়া লাগাতে পারবে কিনা।
সবচেয়ে বড় কথা, কিছু উন্মাদ ভূ-রাজনীতিকের চিন্তা অনুযায়ী এখন আর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেকার যুদ্ধ এতটুকুও অসম্ভব কোনও সম্ভাবনা নয়। কিন্তু আমরা তো জানি যে যুদ্ধের অর্থ হল, সৈনিকদের দেহ শনাক্তকরণ ও বন্দি-প্রত্যর্পণ। চেচেন যুদ্ধের সময়, নোভায়া গ্যাজেটা এবং তারই সঙ্গে আমাদের পর্যবেক্ষক মেজর ইজমালভ অন্ততপক্ষে ১৭৪ জন বন্দিকে শনাক্ত করে মুক্ত করে আনতে পেরেছিলেন। আজ, এই পুরস্কার-পরবর্তীতে আমার পক্ষেও যদি আমার এই নতুন সামাজিক অবস্থাকে ব্যবহার করে একজনও জীবিত যুদ্ধবন্দিকে ফিরিয়ে আনাটা সম্ভবপর হয়, আমাকে বলুন। আমি তার জন্য সবকিছু করতে রাজি আছি।
***
এখানে আমি আরেকজনের কথাও স্মরণ করতে চাইব। তিনিও ১৯৯০ সালে, এই হলঘরে দাঁড়িয়েই নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন।
মস্কো, ক্রেমলিন। ১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল। পলিটব্যুরোর একটি মিটিং চলছে তখন। একজন সোভিয়েত মন্ত্রী দাবি করলেন, আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনিকে আরও কিছুদিন রেখে দেওয়া হোক। মিখায়েল গর্বাচভ তাঁর কথার মাঝখানেই তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সজোরে বলে উঠেছিলেন, “আঃ, তোমার শকুনের চিৎকার থামাও!”
তোমার শকুনের চিৎকার থামাও।
এটাই কি আজকের রাজনীতিকদের ও সাংবাদিকদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়? এমন একটি পৃথিবীর সৃষ্টি করা কি উচিত নয়— যেখানে “কিলড ইন অ্যাকশন” বলে কোনও একটিও নোট আমাদেরকে জারি করতে হবে না?
***
আজ আমরা ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দুতে যা কিছুকে ঘটতে দেখছি, পূর্ব ইউক্রেনের মাটিতে চলতে থাকা যে নোংরা খেলাটি আজ বাড়তে বাড়তে কার্যত রক্তবন্যার পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে— বেলারুশের রাষ্ট্রপতি লুকাশেঙ্কোর মদতে। লুকাশেঙ্কোর সৈনিকেরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত শরণার্থীদেরকে তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত অভিমুখে, মেশিনগানধারী সমস্ত সীমান্তরক্ষীদের দিকে— যারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত ও প্রহরারত। দুটি গোষ্ঠীই একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে, আর এরই মাঝখানে পড়ে গিয়েছে চরম শঙ্কাগ্রস্ত, নিজেদের জীবনরক্ষার্থে মরিয়া একদল মানুষ।
আমরা সাংবাদিক। আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার। আমরা তথ্য ও অ-তথ্যের মধ্যেকার বিভাজন নিরূপণ করি। নতুন প্রজন্মের পেশাদার সাংবাদিকেরা বিপুল পরিমাণে তথ্য এবং সেই তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারের প্রযুক্তিগত কলাকৌশল জানেন। প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আমরা জানতে পেরে গেছি যে কারই বা মদতে এরোপ্লেনে চাপিয়ে এই সমস্ত শরণার্থীদেরকে এই সংঘর্ষ-অঞ্চলে নিয়ে এসে ফেলা হচ্ছে। তথ্য ভিন্ন আর কিছুই নয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক অবধি চলতে থাকা ফ্লাইটের সংখ্যা এবছরের শরৎকাল অবধি প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের আগস্ট মাস থেকে নভেম্বরের মধ্যে যেখানে মাত্র ছটি বিমান মধ্যপ্রাচ্য থেকে উড়ে এসে মিনস্কে নেমেছিল, এই বছরে— সেই একই সময়ের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭-এ। বেলারুশিয়ান বিমানসংস্থাটি সীমান্ত পেরোনোর জন্য মোট ৪৫০০ জন শরণার্থীকে চলতি বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। গত বছরে এই সংখ্যাটি ছিল ৬০০ মাত্র। আরও একটি ইরাকি বিমানসংস্থার মাধ্যমে একইভাবে উড়ে এসেছেন আরও ৬০০০ জন।
এভাবেই সশস্ত্র অস্থিরতা ও সংঘর্ষকে উসকানি দেওয়া হয়। আমরা, সাংবাদিকেরা এই সম্পূর্ণ বিষয়টাকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করেছি। আমাদের কাজ আপাতত শেষ হয়েছে, এবারে রাজনীতিকদেরকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
***
রাষ্ট্রের জন্য জনতা, নাকি জনতার জন্য রাষ্ট্র? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটিই প্রধান বিতর্কের বিষয়। স্তালিন এই বিতর্কের মীমাংসা করেছিলেন বলগাহীন অত্যাচারের মাধ্যমে।
আজকের রাশিয়াতেও কারাগারগুলিতে সাজার মেয়াদ চলাকালীন বা তদন্ত চলাকালীন অত্যাচার বন্ধ হয়নি। নির্মম অত্যাচার, ধর্ষণ, বসবাসের অযোগ্য একেকটি ভয়াবহ কুঠুরি, কারও সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া, এমনকি কারও মায়ের জন্মদিনেও তাকে ফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনন্তকাল ধরে বাড়িয়ে চলা জেল হেফাজতের মেয়াদ— এই সবকিছুই সেখানে প্রকট। সঙ্কটজনকভাবে অসুস্থ মানুষকেও সেখানে জেলে বন্দি করে তাদের ওপরে অত্যাচার করা হয়েছে। অসুস্থ শিশুদেরও কার্যত পণবন্দি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কোনওরকম প্রমাণ ছাড়াই সেই সব শিশুদের ওপরে নিষ্ঠুর চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে দিয়ে দোষ স্বীকার করানো হয়েছে।
আমাদের দেশে চলতে থাকা ফৌজদারি মামলাগুলির অধিকাংশই মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে সৃষ্ট, অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিখ্যাত এক ফরাসি কসমেটিক কোম্পানির রুশ শাখার সিইও-র পক্ষে দায়ের করা এক মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে আজ রাশিয়ার বিরোধী রাজনৈতিক দলের অন্যতম নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনিকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। প্রসঙ্গত এটা বলা প্রয়োজন, সেই বিখ্যাত কোম্পানির সিইওকে কিন্তু কখনওই কোর্টে হাজিরা দিতে হয়নি বা কোর্টও তাঁর বক্তব্য শোনবার জন্য তাঁকে ডেকে পাঠায়নি। কিন্তু নাভালনিকে জেলে পাঠানো হয়েছে। সেই কসমেটিক কোম্পানিটি অবশ্য এই মামলাটি থেকে নিজেদেরকে অতি সন্তর্পণে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। তীব্র এই কটু গন্ধের কারণে তাঁদের সুগন্ধির বাজার যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আমি বা আমরা প্রতিনিয়তই দোষী সাব্যস্ত হওয়া অথবা বিনা বিচারে আটকে থাকা মানুষদের ওপর নির্মম অত্যাচারের খবর পাচ্ছি। ততক্ষণ অবধি এদের উপরে অত্যাচার চালানো হচ্ছে, যতক্ষণ না অবধি এরা অবশেষে ভেঙে পড়ে নিজেদের ‘সমস্ত অপরাধ’ কবুল করে না নেয়। এই ঘটনা বর্বরোচিত।
আমি প্রস্তাব দিচ্ছি এই সমস্ত অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক। যারা এই বিষয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে, বিভিন্ন দেশে তথ্য সংগ্রহের কাজ করবে; এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক বা আধিকারিকদেরকে চিহ্নিত করবে।
অবশ্যই এই কাজের জন্য আমি সবার প্রথমে তদন্তমূলক সাংবাদিকতা এবং তার সঙ্গে জড়িত সাংবাদিকদের ওপরেই নির্ভর করতে চাইব।
এমন অত্যাচারকে মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গভীর অপরাধ বলে আজ আমাদের স্বীকার করতেই হবে।
প্রসঙ্গত এটাও বলে রাখি, নোভায়া গ্যাজেটা এখনও কাগজ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যাতে জেলবন্দিরাও এই কাগজ সুলভে পড়তে পারেন, কারণ জেলের ভিতরে ইন্টারনেটের সুবিধা থাকে না।
***
এই মুহূর্তে রাশিয়াতে দুটি পরস্পরবিরোধী মনোভাব দেখা যাচ্ছে।
একদিকে শাখারভের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট তাঁর মূর্তি উন্মোচনের ব্যবস্থা করছেন।
অন্যদিকে রাশিয়ার প্রসিকিউটর জেনারেল আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘মেমোরিয়াল’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চাইছেন। এই সংগঠন স্তালিনের আমলে নিপীড়িত পরিবারগুলির প্রতি সুবিচার ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কাজ করে; আর প্রসিকিউটর জেনারেল কিনা তাদেরকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করছেন! একটি কারণ অবশ্য এর পিছনে থাকলেও থাকতে পারে— সম্প্রতি রাশিয়ার ফেডেরাল সিকিউরিটি সার্ভিসের তরফে স্তালিন জমানার অপরাধী প্রশাসক ও খুনি ব্যক্তি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
কিন্তু মেমোরিয়াল যে আদতে শাখারভের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন।
মেমোরিয়াল মোটেই জনগণের শত্রু নয়।
মেমোরিয়াল জনগণের বন্ধু।
***
অবশ্যই, আমরা একথা বুঝতে পারছি যে আজকের এই পুরস্কার তদন্তমূলক সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত সমস্ত সাংবাদিকের পুরস্কার।
আমার সহকর্মীরা একাধিক আর্থিক দুর্নীতির বিষয় জনসমক্ষে এনেছেন এবং কোটি কোটি রুবল সরকারি কোষাগারে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরা বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত গুচ্ছ গুচ্ছ বেনামী অ্যাকাউন্টের তথ্য ফাঁস করেছেন এবং সাইবেরিয়ার বনাঞ্চল ধ্বংস রুখতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়েছেন। সবশেষে, রাষ্ট্র অবধি নোভায়া গ্যাজেটা, এখো অব মস্কো এবং দোঝড টিভি-সহ অন্যান্য আরও কয়েকটি সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন— যে উদ্যোগের মাধ্যমে বিরল অসুখে ভুগতে থাকা শিশুদের চিকিৎসা সম্ভব হয় এবং তাদের ওষুধ কেনার বিষয়ে আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা যায়। এই সমস্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ঔষধসমূহের দরকার পড়ে।
(এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে রাখি, আমি আশা করব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি— যাঁরা কিনা বিরল রোগে আক্রান্ত এই সমস্ত শিশুদের সত্যিই কোনওভাবে সাহায্য করতে সক্ষম— এবং বিশেষ করে যাঁরা কিনা স্পাইনাল মাসল অ্যাট্রফি বা এসএমএ রোগে আক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারেন, এমন সমস্ত কোম্পানিগুলি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইবেন। খুবই উপকার হয় যদি তাঁরা কোনওভাবে স্বল্পমূল্যে ওষুধ এবং চটজলদি রোগ ডায়গনোসিসের ক্ষেত্রে কোনওরকমের সহায়তা করতে পারেন। সহস্র সহস্র রুগ্ন ও অসুস্থ শিশুর কাতার, যাদের হৃদযন্ত্রটুকু কেবলই কোনওক্রমে এখনও তালে তাল দিয়ে চলেছে, ধনিকসম্প্রদায় কি তাদের জন্য সামান্য কয়েকেমুঠো ডলারও বরাদ্দ করবে না?)
আমরা এই পুরস্কারকে নিবেদন করছি, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য— ও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
***
কিন্তু রাশিয়াতে বর্তমানে সাংবাদিকতা এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অন্ততপক্ষে একশোজন সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার কর্মী, ও এনজিওকে সম্প্রতি ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাশিয়াতে এই শব্দবন্ধের অর্থ হল ‘জনগণের শত্রু’, গণশত্রু। আমাদের বহু সংখ্যক সহকর্মী (সমপেশার লোক, সাংবাদিক) ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
কেউ কেউ বা দীর্ঘ সময়ের জন্য সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হয়তো বা অনন্তকালের জন্যই… ইতিপূর্বেও যে আমাদের দেশের ইতিহাসে এমনটা ঘটেছে।
আগামী বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে আমরা ‘ফিলজফার্স শিপ’ বা ‘দার্শনিকদের জাহাজ’ ঘটনাটির শততম বর্ষ উদযাপন করব। একশো বছর আগের এই দিনেই, বলশেভিকদের তাড়া খেয়ে প্রায় ৩০০ জন রুশ বুদ্ধিজীবী, ‘ফিলজফার্স শিপ’ বা ‘দার্শনিকদের জাহাজ’-এ চেপে সেন্ট পিটসবার্গ থেকে জার্মানির স্টেটিন শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। আধুনিক হেলিকপ্টারের আবিষ্কর্তা সিকরস্কি, টেলিভিশনের আবিষ্কর্তা জোভরিকিন, তিন দার্শনিক পণ্ডিত ফ্র্যাঙ্ক, ইলিন ও পিটিরিম সোরোকিন— এঁরা সকলেই সেদিন নির্বাসনকে বরণ করে নিয়ে ‘দার্শনিকদের জাহাজ’-এ চেপে বসেছিলেন। প্রখ্যাত চিন্তক নিকোলাই বেরদেয়েভও এই দলের মধ্যে ছিলেন। অন্য সকলের মতোই তাঁকেও কেবলমাত্র তাঁর পাজামার রাতপোশাক, দুটো শার্ট, দুটো মোজা এবং একটি শীতের কোট সঙ্গে নিতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই এক মাতৃভূমি বিদায় জানিয়েছিল তার গর্বের সন্তানবর্গকে। প্রবাদের মতোই সেও হয়তো বা তার বিদায়ী এই দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠেছিল, “তোমাদের পার্থিব জিনিসগুলি তোমরা এখানেই রেখে যাও, কেবল তোমাদের মস্তিষ্কটি সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে রাখো।”
আজ সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গেও ঠিক একইরকম ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘দার্শনিকদের জাহাজ’-এর পরিবর্তে আজ ‘সাংবাদিকদের এরোপ্লেন’-এর খবর শোনা যাচ্ছে। যদিও এটি আসলে রূপক-অর্থে ব্যবহৃত, তবুও ডজনে ডজনে সাংবাদিক আজ রাশিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
আবার কেউ কেউ এই সুবিধেটুকুও পাননি।
ব্যক্তিগত মালিকানাধীন রুশদেশীয় এক অস্ত্রব্যবসায়ী সংগঠনের অভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপের বিষয়ে তদন্ত চালাতে গিয়ে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ওরখান ঝেমাল, কিরিল রাদচেঙ্কো ও আলেজান্দার রাস্তরগুয়েভ— প্রমুখ তিনজন সাংবাদিক অচেনা আততায়ীর বন্দুকের গুলিতে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছেন। ওরখানের বিধবা স্ত্রী ইরা গোর্দিয়েনকো আমাদের নোভায়া গ্যাজেটার প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত। ৩০ জুন ২০১৮, খুনের তারিখ থেকে আজ অবধি সে সরকারি তদন্তের বিষয়ে একটির পরে আরেকটি মিথ্যাচারকে প্রকাশ্যে এনে চলেছে। একটি উদাহরণ শুনবেন? খুন বা এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে অমূল্য সূত্র যেটি— আক্রান্তের জামাকাপড়— তদন্ত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের তরফে সেগুলি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলা হয়। রাশিয়াতে সরকারি তদন্তকারী সংস্থার তরফেও এই মামলাটির বিষয়ে আজ অবধি এতটুকুও আলোকপাত করা হয়নি। আন্তর্জাতিক সাহায্যের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টিতে বিশেষ কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস একসময় এই মামলাটির বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করার অঙ্গীকার করেছিলেন। হয়তো বা তিনি সেই অঙ্গীকার বিস্মৃত হয়েছেন। কেবল মনে করিয়ে দিলাম।
হয়তো বা আমি প্রতিনিয়তই এরকম ধরনের একেকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে থাকি বা হতে থাকব, “কেনই বা তোমার সহকর্মীরা এমন সব জায়গাতে যেতে আগ্রহী হয়? এমন সব বিষয়ে কেনই বা তারা জড়িয়ে যায়?”
হ্যাঁ, তারা সাক্ষী থাকতে ভালোবাসে। প্রমাণ করে দিতে ভালোবাসে। নিজের চোখ দিয়ে সমস্ত কিছুকে দেখতে ভালোবাসে। যেমনভাবে বিশ্বখ্যাত এক আলোকচিত্রী রবার্ট কাপা বলেছিলেন, “তোমার ছবিটি যদি কোনও কারণে যথেষ্ট ভালো না হয়ে থাকে, তাহলে তুমি যথেষ্ট পরিমাণে কাছে যাওনি।”
“তোমাদের ভয় করে না?” আমার সহকর্মীরা সবচেয়ে বেশি করে এই প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
কিন্তু এইটিই যে তাদের লক্ষ্য। প্রশাসকেরা যেমন অতীতকে সুন্দর করতে চায়, তেমনি সাংবাদিকেরা চায় ভবিষ্যৎকে সাজিয়ে তুলতে।
***
কাজেই এই পুরস্কার সৎ সাংবাদিকতার পক্ষে পুরস্কার। এই পুরস্কার নোভায়া গ্যাজেটাতে আমার সেই সব সহকর্মীদের পক্ষে জারি হওয়া পুরস্কার, যাঁরা এই কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন— ইগর দমনিকভ, ইউরি শেকতস্কিখিন, আনা পোলিতকভস্কায়া, আনাস্তাসিয়া বাবুরোভা, স্তাস মারকেলভ এবং নাতাশা এস্তেমিরোভা। এই পুরস্কার সেই সমস্ত মানুষদের জন্যও, যাঁরা বেঁচে আছেন এবং পেশাদারি দক্ষতায় তাঁদের পেশাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
…যেদিন এই পুরস্কার ঘোষিত হয়েছিল, তার ঠিক আগের দিনটিতে আমরা আনা পোলিতকভস্কায়ার হত্যার পঞ্চদশ বর্ষপূর্তিকে স্মরণ করছিলাম। খুনিরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল, কিন্তু মূল চক্রীকে আজ অবধি গ্রেপ্তার করা যায়নি এবং সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এত বছর পর পুরনো সেই মামলাটিকে অবশেষে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা এই মঞ্চ থেকে সরাসরি জানাচ্ছি, নোভায়া গ্যাজেটার সম্পাদকমণ্ডলী এই মামলাটিকে বন্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য সরকারি সিদ্ধান্তের সর্বতোভাবে বিরোধিতা করছে।
***
রুশ ভাষাতে, এমনকি ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাতেও একটি প্রবাদ রয়েছে, যার মূল বক্তব্য হল, “কুকুরেরা যতই চিৎকার করুক, ক্যারাভ্যান ঠিকই এগিয়ে যায়।” এর একটি ব্যাখ্যা হল, যা কিছুই ঘটে যাক না কেন ক্যারাভ্যানের অগ্রগতি কেউ রুখতে পারে না। প্রশাসকেরা অনেক সময়ই তাচ্ছিল্য করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে এই প্রবাদটি ছুড়ে দিয়ে থাকেন; যে এরা চিৎকার করে বটে, কিন্তু তাতে করেও কিচ্ছুটি থেমে থাকে না।
কিন্তু অতি সম্প্রতি আমি এই প্রবাদের আরেকটি অর্থের বিষয়ে জানতে পেরেছি।
ক্যারাভান সামনের দিকে এগিয়ে যায়, কুকুরেরা চিৎকার করে বলেই।
তারা চিৎকার করে, পাহাড়ে ও মরুভূমিতে শিকারী পশুদের হাত থেকে ক্যারাভ্যানকে বাঁচায়। কুকুরেরা চারিদিক থেকে ঘিরে থাকে বলেই, ক্যারাভ্যান নিশ্চিন্তে সামনের দিকে এগোয়।
হ্যাঁ, আমরা গর্জন করি— এমনকি সময়ে সময়ে কামড়েও দিতে পারি। আমাদের দাঁত ধারালো ও মুষ্টি জোরালো।
কিন্তু আমরাই প্রগতির বিষয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ।
আমরাই স্বৈরাচারের প্রতিষেধক।
***
পুনশ্চ: সবশেষে আমি এক মিনিটকাল সময় সচেতনভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।
আসুন আমরা সকলে উঠে দাঁড়াই, আমার এবং মারিয়া রেসার সেই সব সহকর্মীদের জন্য যারা কিনা এই পেশার নিমিত্তে নিজেদের জীবনকে অবধি আহুতি দিয়েছে। তাদের জন্য থাকুক এক মিনিটের নীরবতা; আর সেই সঙ্গে আমাদের সমর্থন থাকুক এই মুহূর্তে প্রশাসনিক রক্তচক্ষুর সামনে বন্দি হয়ে থাকা সেই সমস্ত সহকর্মী সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে।
আমি চাই সাংবাদিকেরা যেন চিরটাকাল কেবলই বৃদ্ধ হয়ে, জরাগ্রস্ত হয়ে— বার্ধক্যজনিত কারণেই মৃত্যুবরণ করে।
খুবই প্রাণবন্ত অনুবাদ।