তাল বে-তাল

আর্কাদি গাইদার

 

চলে গেলেন মনোজিত দত্ত। মনোজিত দত্ত নামটা চিনতে পারলেন না নিশ্চয়ই। তাহলে যে নামে সবাই চিনত, সেটাই ব্যাবহার করা যাক। কচু দত্ত। বা কচুদা। কলকাতার সঙ্গীতপ্রিয় মানুষের কাছে যিনি পরিচিত ছিলেন ‘ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ নামক ব্যান্ডের পারকাশন প্লেয়ার হিসেবে। কিন্তু এর বাইরে তার যে বিশাল একটি পরিচয় ছিল, সেটা জানতেন খালি গানবাজনার জগতের গীতবাদ্যকাররা।

কলকাতার অভিজাত দত্ত বাড়ির ছেলে কচু দত্ত। তার আরেক ভাই অমিত দত্ত গীটার প্লেয়ার হিসেবে দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে মার্গসঙ্গীতের আবহে বড় হয়ে ওঠা, এবং সেই বয়স থেকেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘কচুদা’। কিন্তু তার মধ্যেই অদ্ভুতভাবে বাকি জীবনের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন ড্রামস, তবলা, কংগো, ইত্যাদি পারকাশনকে। সাত এবং আটের দশকে কলকাতার প্রথম ইংরেজি ব্যান্ডগুলো শুরুর সময় যুক্ত ছিলেন ‘শিভা’ বা ‘ডি ফর ব্রাদার’-এর সাথে। সঙ্গী ছিলেন ভাই অমিত দত্ত। এর মধ্যেই সঙ্গীত নিয়ে চর্চা করতে করতে ভালোবেসে ফেলেন ল্যাটিন মিউজিককে। এবং সিদ্ধান্ত নেন, আজীবন ল্যাটিন মিউজিক নিয়েই চর্চা করে যাবেন, তার প্রসার ঘটাবেন, মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলবেন। এবং সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় ‘ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’। ভারতের প্রথম এবং বোধহয় একমাত্র ল্যাটিন ব্যান্ড। বেশিরভাগ গান স্প্যানিশ ভাষাতে গেয়েও যা ভারতে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। নিজে বাজাতেন পারকাশন, চর্চাও করতেন তাই নিয়ে, কিন্তু ব্যান্ডের সদস্যদের হাতে ধরে ল্যাটিন আঙ্গিকে গীটার, কিবোর্ড এমনকি গায়কীও শেখাতেন।

এবং কলকাতার বেশ কয়েক প্রজন্মের গীতবাদ্যকারদের সঙ্গীত শিখিয়েছেন কচুদা। তারা যেত পারকাশনের বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে, কিন্তু প্রতিটি ক্লাসে তাদের জ্ঞানের বহর বাড়ত হরেকরকম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে, সঙ্গীতের নান্দনিকতা নিয়ে, জীবনের দর্শন নিয়ে। মিতভাষী, নম্র, প্রচারবিমুখ এই মানুষটি ভারত এবং বিদেশের মাটিতে বাজিয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা শিল্পীদের সাথে। তারা চমকিত হয়েছেন, এবং বারবার তাকে বলেছেন আন্তর্জাতিক স্তরে তার প্রতিভা এবং দক্ষতার সঠিক কদর প্রয়োজন, এর জন্যে তার উচিত নিজের শহর, নিজের দেশের বাইরে বেরনো। কিন্তু কচু দত্তর জীবনে দর্শন নির্ধারিত হয়ে গেছিল আগেই– ভারতের মাটিতেই, কলকাতা শহরে বসেই তিনি আজীবন কাজ করে গেলেন এই দেশের জনগণের মধ্যে ল্যাটিন মিউজিককে জনপ্রিয় করতে। এবং এই কাজের মধ্যেই শেষ মুহূর্ত অবধি রইলেন। দিল্লীতে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেশের শো শেষ হওয়ার পর হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন মনোজিত দত্ত। চলে গেলেন নিঃশব্দে, নির্বিরোধে, কাউকে ব্যাতিব্যস্ত না করে, ঠিক যেরকমভাবে এতদিন বেঁচে ছিলেন।

সঙ্গীতের একটি যুগের অবসান ঘটল।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...