আদালত ও যৌনকর্মী

প্রতিভা সরকার

 



প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী

 

 

 

 

আমাদের দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা কত? উত্তর হল মোটামুটি ৯ লক্ষ। এদের মধ্যে বেশিরভাগ চূড়ান্ত দারিদ্র অথবা মানুষ পাচারের শিকার। শখ করে বা শুধুই টাকা কামাবার জন্য এসেছে এমন মেয়ের সংখ্যা কোটিকে গুটিক।

অনেকেই মিস রূপালি বা ওইরকম কারও চকচকে স্কিন, দেদার পয়সা দেখিয়ে বলে, “ঐ দ্যাখো ওরা তো ভালোই আছে।” হয় এরা ইচ্ছে করে ন্যাকা সাজে কিংবা সত্যিই নাদান, কারণ  যারা সোনাগাছি বা কালিঘাটে কোনও এনজিও-র কাজে বা শুধু কথা বলতেই গেছে তারা সবাই জানে গড় যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যের কী হাল, ঘরের কী অবস্থা! নিচের দিকের কর্মীদের অবস্থা তো খুব খারাপ এবং তারাই সংখ্যায় খুব বেশি। আসলে অনেক পুরুষের বদান্যতায় এরা টাকা কামালেও রাখতে পারে না। সেসব সামাজিক অর্থনৈতিক কারণ এই লেখার বিচার্য নয়।

সোনাগাছিতে খুব পুরনো আলিশান বাড়িতে খুব সুন্দরী এবং বাউন্সার রেখে নিজেদের পাহারার বন্দোবস্ত করা কিছু মেয়েকে দেখেছিলাম। কথা এবং ব্যবহারে বিহারি মনে হওয়া কিছু যুবককে একদিন হাট্টাকাট্টা এক বাউন্সার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অন্যেরা যার ঘাড় মটকাবে দঙ্গলের মধ্যমণি সেই দামড়া যুবকটি এমন লাজুক লাজুক ভাব করছিল, যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু অল্প টানেই নিজে সে এগিয়ে যাচ্ছিল দেখে বুঝলাম ওসব ভাণ। বাউন্সারের থেকে সেকথা বেশি আর কে জানে! তাই সে দুহাতে গোটা দলটাকে আইয়ে আইয়ে বলে খাতিরদারি করে হাত দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম ঐ মেয়েদের অবস্থা টাকাপয়সায় কিছুটা ভালো হলেও অত্যাচার এবং লুণ্ঠন ওদের ওপরেও কিছু কম হয় না। বেশিরভাগ বাউন্সারই আসলে মেয়েটির বাবু, তার কল্পিত স্বামী এবং রক্ষক। পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেও বাবুর ছোটার কথা, ঘরে ঢোকা খদ্দের বেরোতে না চাইলেও তাই। বাবুর অফিসিয়াল সংসার চলে যৌনকর্মীর পয়সায়, কিন্তু রক্ষক ভক্ষক হয়ে ওঠার উদাহরণ কিছু কম নয়। বাবুর হাতে অত্যাচারিত এবং নিহত মেয়েদের সংখ্যা অনেক কিছু বলে।

এই যদি হয় ওপাড়ার তথাকথিত মক্ষিরানিদের অবস্থা, তাহলে একেবারে সাধারণ যারা তাদের কী হাল!

আসলে লালবাতির আলো যদ্দূর যায় কিলবিল করছে শোষণ এবং বঞ্চনার পোকা। আর সেই শোষণ এবং বঞ্চনা কি কেবল একরকম?

পেশা বেআইনি নয়, কিন্তু রাস্তায় নেমে খদ্দের ধরা অপরাধ। ব্রথেল চালানো অপরাধ। মানে পেশাটা থাকতে পারে, কিন্তু অন্য পণ্যের মতো নিজেকে পণ্য জেনেও প্রদর্শন করা যাবে না। খদ্দের আকৃষ্ট হলে তাকে নিয়ে পাড়ায় ঢোকা যাবে না। সোনার পাথরবাটি আর কাকে বলে!

শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনকে পিছনে রেখে মিত্র কাফে ছাড়িয়ে সোজা গেলেই রাস্তার ডানদিকে দুপুর থেকে কিছু মেয়ে পুরুষদের পেছন পেছন ছোটে। পরিষ্কার বোঝা যায় ওরা কাকুতিমিনতি করছে, দরদামও, ব্যর্থ হলে খিস্তিখেউড়।

এরা তাহলে কী করে পারে রাস্তায় নামতে? কারণ ঐ অঞ্চলে পুলিশের তোলা দেওয়া আর গৃহদেবতাকে রোজ পুজো দেওয়ার মতো অবশ্যকর্তব্য। না দিলে পাপ হয়। আর সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে ঠাঁই হতে পারে লকআপে। এই পুজোতে শুধু পয়সাকড়ি নয়, শোনা যায়, বহু ব্যবহৃত শরীরও অপাংক্তেয় নয়। সেই ফুর্তিফার্তাটা অবশ্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে একেবারে বিনে পয়সায় হবে। পয়সা চাইলে দেবতা অসন্তুষ্ট হবেন এবং আবার লকআপের কথা উঠবে। পয়সা দেওয়া বেওয়ারিশ মেয়েগুলোর সাহস কী যে উলটে পয়সা চাইবে!

এবং এই চক্রটা কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না। পুলিশ, রাজনৈতিক ক্ষমতাবান, পয়সাওয়ালা, সবাই জড়িয়ে যেতে থাকে। এই অঞ্চলগুলো অনেকের কাছেই সোনার খনি।

লকআপের কথা উঠল তাই বলছি একটি মেয়ে তার প্রতিবেশী এবং একই পেশার মেয়েটিকে পুলিশ মিথ্যা অভিযোগে ঘর থেকে তুলে মারতে মারতে ভ্যানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে সহমর্মিতার কারণে সে নিজে থেকেই তার সঙ্গে থানায় গিয়েছিল। আগের মেয়েটিকে আটকে রাখা তো হলই, এই সহমর্মী মেয়েটিকেও মারধোর করে নানা মিথ্যা কেসে জড়িয়ে লকআপে পোরা হল।

এই অঞ্চলগুলোতে লকআপ একটা বিরাট জুজু, হেনস্থার কল এবং যখনতখন যে কেউ সেখানে কিছু না করেও ঢুকে যেতে পারে।

একেবারে সেরা যৌনকর্মীদেরও পেটে টান পড়েছিল করোনাকালে। এপাশে পুলিশ ভ্যান, ওপাশেও তাই, গোটা মহল্লা একেবারে সিল করা। খদ্দেরকে ঢুকতে দেখলেই পুলিশ লাঠিপেটা করছে।

সে ভালো কথা, রোগ যাতে না ছড়ায় তা তো দেখতেই হবে। কিন্তু আধার কার্ড, এপিক, অনেক ক্ষেত্রে প্যান কার্ডধারী এই নাগরিকরা কী খাবে সে কথা রাষ্ট্র ভাবেনি। দলে দলে অভিবাসী শ্রমিক ঘরে ফিরছে, লাঠিপেটা হচ্ছে, মরছে, তাই নিয়ে আমরা সঠিকভাবেই প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু উদাসীন থেকেছি ঘরের পাশে এই হতভাগ্য মেয়েগুলোর শুকিয়ে মরার দিকে। খাওয়া তো দূরের কথা, হাত ধোওয়ার এক টুকরো সাবানও জোটেনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে সোনাগাছিতে কাজ করা সবচেয়ে বড় এনজিও খোলাখুলি অর্থসাহায্যের আবেদন করে। সেই সংক্রান্ত অনুরোধ করতে গিয়ে আবার কত ঝামেলা! নাকি ওরা বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থসাহায্য পায়! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ‘পাশে আছি’ সংস্থার মিতুল দত্ত সহানুভূতির সঙ্গে এক লপ্তে একটা ভালো পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছিলেন মনে আছে। এইরকম কিছু সাহায্য এসেছিল বলে মেয়েরা একবেলা হলেও খেতে পেয়েছিল। তবে অনাহারে কোথায় কতজন মরেছে সে হিসেব আর কে রাখতে গেছে!

এই হতভাগ্য মেয়েদের জন্য সুপ্রিম কোর্ট গত ৯ মে একটু অনুকূল রায় দিয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়াতে কী বিপুল হইচই। রায়ের ভুল ব্যাখ্যা তো আছেই, যৌনকর্ম কীভাবে সমাজ ও সততার বারোটা বাজাচ্ছে তা নিয়েও কত সুচিন্তিত মতামত!

প্রথম ভুল, সুপ্রিম কোর্ট নাকি এই রায়ে যৌনকর্মকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। পেশার সম্মান দিয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানে প্রাপ্তবয়স্কদের যে কোনও কাজ বেছে নেওয়ার অধিকার এবং স্বাধীনতা আছে। নতুন করে মান্যতা দেওয়ার কী আছে! যৌনকর্মীর পেশা আইনসম্মত না আইনবিরোধী, এই রায় তা নিয়ে একটি কথাও বলেনি। বরং ব্রথেল চালানো বা রাস্তায় নেমে খদ্দের ধরা ইত্যাদি সম্বন্ধে পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিই বহাল আছে। কেবল যৌনকর্মীর ওপর সমাজ ও প্রশাসনের ‘অপরাধী’ তকমার বিরুদ্ধে তাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়েছে এই রায়। এই পেশাকে কিছুটা ‘decriminalization’ করার কথা বলেছে মাত্র। তার মধ্যে রয়েছে অকারণ পুলিশি হেনস্থা থেকে মুক্তি, অতিমারি বা অন্য বিপর্যয়ের সময় তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা, ট্রাফিকিং-এর শিকার হলে ফিরে আসতে ইচ্ছুকদের সামাজিক পুনর্বাসন ইত্যাদি। পুলিশি অভিযানের সময় তাদের পরিচয় গোপন রাখতে বলেছে। যৌনকর্মী মা-কে তার সন্তানের থেকে জোর করে আলাদা করা যাবে না। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী সমব্যবহার (equal treatment) সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে এই নাগরিকদের পাওনা।

সত্যিই তো নানা ট্যাক্স নেওয়ার বেলায় সমান চোখে দেখা হয় যাদের তারা নিশ্চয়ই এ দেশের নাগরিক। নাগরিকত্বের প্রমাণও তো আছে। কিন্তু এরা পারিবারিক বা পার্টনার ভায়োলেন্সের অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে তা গ্রাহ্য হয় না কেন? স্কুল-কলেজে সন্তানদের পাঠাতে গেলে এত বিরোধিতা কেন? এসব তো বড় বড় ব্যাপার, ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসের লাইনে পেশা জেনে ফেললে বা চেহারা দেখে সন্দেহ হলে তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার করা হয়, তার কিছু নমুনা একেবারে অপ্রতুল হবে না। আর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হলে এলাকা, পেশা ইত্যাদি উল্লিখিত হলে তার চিকিৎসা কতদূর হবে কে জানে। আসলে সুযোগ বুঝে আমরা সবাই নীতিবাগীশ হয়ে উঠি কিনা, ভয়টা সেখানেই।

তবে যৌনকর্মীরা কি পরিবারবর্জিত এবং যজ্ঞক্ষেত্র থেকে দ্রৌপদী বা সীতার মতো স্বয়ং-আবির্ভূতা? তা তো নয়, তারা আমাদের এই রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থারই ফসল। তাহলে মানবিক অধিকারগুলি থেকে তারা বঞ্চিত হবে কেন? তাদের যেটা মূল দাবি শ্রমিকের মর্যাদা পাওয়া, সেটি ঠিক কি বেঠিক, আমি এখানে সে আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু তা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় একটি কথাও বলেনি। যৌনকর্মীদের এক কদমও এগিয়ে দেয়নি। বলেনি ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মী সম্বন্ধে একটি কথাও। অথচ কে না জানে, শেষোক্তদের দেখলেই পুলিশের হাতের লাঠি সবচেয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

তবুও প্রচুর গেল গেল রব উঠেছে। এই রায়ের কারণে নারী পুরুষেরা নাকি এত উৎসাহিত হবে যে গোটা দেশ ব্রথেলে ভরে যাবে। ভারত হয়ে যাবে নেদারল্যান্ডস। চোর ডাকাতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের তুলনা করা হচ্ছে, কারণ উভয়েই নাকি শরীর খাটিয়ে খায় (কীভাবে তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়), ফলে পেশার স্বীকৃতি দিতে হলে সবাইকেই দিতে হবে। আইনকানুন নাকি যৌনকর্মীদের প্রতি এতই সদয় যে মাদক ব্যবসায়ী এবং সুপারি কিলারদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার ফলে ট্রাফিকিং নাকি হু হু করে বাড়বে। এত সব বলার পরে, এই পেশা টিঁকে আছে কাদের কল্যাণে জেনেও তারা গোটা দায়টাই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারের ঘাড়ে। যে সরকার সীতা সাবিত্রীর দেশের নারীদের এই পেশায় ঠেলে দেয় সে সরকার মুর্দাবাদ, ইত্যাদি। লাও বলা তো সোজা, কিন্তু আনে কে! যে দেশের নাগরিকদের  মানবিক বিচারবুদ্ধি তলানিতে, সে দেশের সরকারের বয়ে গেছে এই পেশায় নিযুক্তদের জন্য কিছু করতে।

জানি, বাস্তবকে জানা অত সহজ নয়। স্বচ্ছন্দ এবং পিতৃতন্ত্রের নির্দিষ্ট করে দেওয়া গণ্ডিটানা জীবনে তা একরকম অসম্ভবও। আমার মনে হয়, আধোচেনা, আধোজানার ফল এই অসংবেদনশীল এবং অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মূলে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিল এই সাম্প্রতিক রায়।

পারবে কি তা? কিছু কি পাল্টাবে? আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। আপনার?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...