জয়ন্ত দেবব্রত চৌধুরী

জয়ন্ত দেবব্রত চৌধুরী | তিনটি কবিতা

তিনটি কবিতা

 

সাপুড়ে

বাতিল বারঠাকুরের ভাগাড়ের সামনে, যেখানে অশীতিপর বটের তলায় মণিহীন মনসার বসত, শতচ্ছিন্ন শতরঞ্চিতে বসে নিরালা খেলা দেখায় চন্দননগরের সত্যচরণ সাপুড়ে। বাসুকির লেজে সুধাভাণ্ড জবরদস্তি মন্থন করলে ফেনা উথলে ওঠে যেন কামধেনুর বাঁট থেকে বাড়তি দুধ; বিষের কূট জ্বালায় যখন ভেসে যায় চরাচর, তখন অন্তরঙ্গ গুহায় সরল নাগিনীর মুখোমুখি একা বসে থাকে নীলকণ্ঠ বেদে। তার হাতে সদ্যোজাত গোখরো বিষ ঢালে, পায়ে বাচ্চা বেড়ালের শবপুষ্ট বেগুনী মন্ত্রপুষ্প বিষ ঢালে, পেটে গতকাল রাতের গেঁড়িগুগলির খোল বিষ ঢালে, মাথায় চাঁপাডাঙার দুলাল মাঝির বউ বাসন্তীর অহেতুক যৌবন বিষ ঢালে। সে বিষে বিষম ব্যাথা; হাকুচকালো মরণের মত, খয়েরি কুকুরীর ক্ষুধার মত, ধবধবে সাদা পাতার মত! আধাচেতনায় একটানা বীণ বাজিয়ে চলে সাপুড়ে; সে সুরের তালে তালে কাশ ঝোপের ভেতর কালকেউটে দোলে, কোমরের ঘুনসিতে হেলে সাপের হাড় ঝোলানো বছর সাতেকের রুগ্ন ছেলের চিন্তা দোলে, মঙ্গলকাব্যের মধ্যযুগীয় পর্দা দোলে। সাথে মহিষপোতার কাদাচরে গোল হয়ে ঘুরতে থাকা ন্যাড়ামাথা দেবদেবীর দল হাততালি দিতে দিতে দোলে, তা দেখে খুশি হয়ে বামনের পোষা চাঁদের ছায়া গঙ্গার ভরাট দুই বুকের মাঝে দোদুল দোলে। খুশি হয়ে নৃত্যকুশলী দেবী বর দিতে চান সাপুড়েকে; বেছে নিতে বলেন শঙ্খচূড়ের শাপ, ময়ালের সাত পাক অথবা লাউডগার ঘ্রাণের মধ্যে থেকে। আঁধারমানিক চিরকাঙ্গাল মঙ্গলবীর বেদে টলতে টলতে এসে তখন গড় করে বলে,

“মাগো, কেঁদে যাই শুধু দেবতার কাছে, হয় না গুনাহ্‌ মাফ
আমার খোয়াবে শাওনের রাতে কিলবিল করে সাপ।”

 

গুণিন

রাতের তিন প্রহরে বাগদিবাড়ির দুলিকে বাঁশঝাড়ে চেনা ভূতে ধরে আচমকা। পোয়াতি চাঁদের পাণ্ডুর আলোয় অভুক্ত শিবা হয় তার একাকী সাক্ষী। ছেঁড়াখোঁড়া দুনিয়া কোনওমতে সামলেসুমলে ভোরবেলা লুকিয়ে ঘরে ফেরে মেয়েটা, আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে চলে খুনখুনিয়ে। ভরদুপুরে মায়ে এসে নাইতে যেতে বললে অবিকল মরা ঠাকুমার গলায় ইনিয়ে বিনিয়ে গায়,

ও রাত, কেন আমায় নিলি?
আমি ছিলাম তোর বন্য খেলার দোসর
হিমে ঝরা বকুল কুড়াবার সাথী
তুই কেন আমায় নিলি?
ও গুখেকো চাঁদ, আমি তো ছিলাম তোর
প্রস্তরসন্তান, সিঁদুরলেপা বারাহীমূর্তি
তুই কেন আমায় চিবিয়ে খেলি?

তামাশা দেখতে পাড়ার লোক ঘনিয়ে আসে রোয়াকে; কৌতূহলী কুঁচোকাচারা উঁকি মারে, একটা উদোম-গা, নীল জাঙ্গিয়া পরা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ভয় পেয়ে গোঙায় ভিড়ের মাঝে। বাড়ির বড়বুড়োরা তখন হরিণার বিরহের মত ঘন কালো মেঘের হাতে খবর পাঠায় গুণীর কাছে। সে আসে শক্ত চোয়ালে; চাঁড়ালের বাম পায়ের হাড়, পোড়ামাটির পুতুল, কস্তূরীনাভি, সাপের তেল, খণ্ডহরের যত খাজানা হাত বাক্সে ভরে। তাঁকে দেখেই লাল লাল চোখে চেয়ে থাকে সোমত্তা মেয়ে, ঝিনুকসাদা দাঁতের ফাঁকে গোলাপি জিভ পুঁটিমাছের মত খলবল করে; বুড়ি মাকড়সার অলস সুরে সে গুনগুন করে,

ও সূদন, আমি যে তোর প্রাচীন অপ্সরা
কই, আমায় চিনতে পারলি না?
এখুনি নিয়ে চল তোর ধূসর কুটিরে
কণ্ঠের মালা করে নিয়ে যাব ইন্দ্রসভায়
দেখবি নাচগানের তালে তালে স্বর্গের
দেবতারা কেমন কাম, কান্না আর বরফ ঝরায়!
তোকে চেয়েই শাপগ্রস্ত দানবী হয়েছি ফের
আমানি খাবার গর্তে ঘেরা সংসারে নিয়ে চল।

গুণিন সোজা চোখে দেখে মেয়েটার গোসাপের মত পিছল শরীর, অভিমানে ভরা স্বর্ণচিবুক, ঈষৎস্ফীত তলপেট; তিন হাজার বছর আগের নরম হাসের বুকের পালক, গা-গতরে গম্ভীরবেদী হাতির রমণের অসহ্য ব্যাথা আর মাংসল মৎস্যযোনি আবছা মনে পড়ে তার। গোমড়ামুখে তাও অভ্যস্তমন্ত্র পড়ে দুলে দুলে, বাক্স হাতড়ে বের করে ভূত তাড়াবার অমোঘ নিদান। হলুদ পোড়ার গন্ধ নাকে গেলে পাহাড়ি ঝরনার শব্দে হাসে সেই নারী, আর সইতে না পেরে দুই হাতে চোখ ঢেকে পালিয়ে যায় অসহায় সর্বগুণী। পায়ের গোছে ঠেকে জাদুবাক্স উল্টে পড়ে ফেরার সময়; এদিকওদিক গড়াতে থাকে মাটির মালসা আর ঘোড়ানিমের শেকড়, মুগের ডাল আর সোনাতপাল।

এখনও কাঁকসা গাঁয়ের পশ্চিমপ্রান্তে জ্যোৎস্নার মরা আলোয় দেখা যায় হারা লোকটাকে কখনওসখনও। দুই চোখে জোনাকবাতির মত মিটমিট করে জ্বলে সবুজ কষ্ট, দীর্ঘ পক্ক দাড়িগোঁফ উড়ছে যেমন করে শিমূলের বীজ ফেটে তুলো ভাসে বাতাসে; আঁধার জলায় জোড়া শিঙিমাছ আজও সূদন ওঝার সাথে খেলা করে চলে নির্বিচারে।

 

ডাইনি

মুখুজ্জেদের বাঁশবনের ভেতরে যেখানে এক জোড়া প্রস্তরদেউল দশ হাত দূর হতে পরস্পরকে চোখে চোখে আগলে রাখছে সেই কালু ডোমের আমল থেকে, তার আধ রশি দূরে বজ্রাঘাতে সদ্যোমৃত বিষ্ণুমন্দিরের দাওয়ায় বসে তার কৃষ্ণের জন্য ঘেঁটু ফুলের মালা গেঁথে চলে ব্যথিত খাগী একলা বুড়ি। শেষবার মৌখিরা থেকে পালাবার সময় জীর্ণ দধিমাধবের চালা থেকে আঁচলের তলে লুকিয়ে এনেছিল যে অপরূপ কেষ্ট ঠাকুর, সে ছাড়া আর কেউ নেই তার; বাকি সকলকেই সে খেয়েছে। কিন্তু সে তাহার কী করিবে, থেকে থেকেই যে রূপসায়রের কুমিরটা লেজ নাড়ে; থেকে থেকেই যে মনে পড়ে যায় ছয়মাসের গোলগাল শিশুর স্বাদ নধর কুমড়োডগার মত রসালো সবুজ! জোয়ান ভাতার, কালোকোলো এক খোকার কথা আবছা মনে পড়ে কখনও, মুখগুলি যেন ঘষা আরশির ওপার, সেই যে বার বর্গি এল দেশে—

দশ কুড়ি হল বয়স, তবুও সে প্রস্তরপ্রেতিনীর মত বেঁচে রইল কীভাবে? এঃ, তা সে কিছুতেই কইবে না কাউকে। অথচ জানে সে, সব জানে; বড় মানুষের সফলতার পেছনে জমা থাকা হানাবাড়ির সব ইতিহাস, দিনের দুই প্রহরে ধ্যানস্থ দাঁড়কাকের দল মনে মনে কী মন্ত্র পড়ে জানে, তিমিমাছের দীর্ঘশ্বাসের গুহ্য অর্থ, রামধনু দেখে কাকতাড়ুয়ার আহ্লাদ হলে তার গুঁড়ো থেকে ভারী উর্বর সার হয়— তাও! কাউকে কক্ষনও জানাবে না সে, তাকে দেখে কেন ভয়ে পালিয়ে যাবে লোকে, মর মর মিনসের দল, কেন তার সাথে হাসিমুখে দুটো কথা কইবে না মেয়েলোকেরা, খাব খাব আজই একটাকে খাব চুষে, কাউকে বলবে না যে সে জেনেছে একশো বছরের বেশি বয়সি কোনও মানুষ বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে হোগলা বনের ধারে একা একা কাঁদলে তার চোখের জল জমাট বেঁধে মুক্তো হয়ে যায়, দেড়শো বছর ধরে আপন মনে দুঃখ চেপে রাখলে দুই হাতে চিতল হরিণের মত ছোপ ছোপ দাগ ফুটে ওঠে।

রাতে পিদিমের আলোর তলে শুয়ে শুয়ে বুড়ি ভাবে এই আপদ বর্ষাকাল শেষ হলেই কোনও অমাবস্যার আঁধারে গাছের গুঁড়ি চেপে আকাশ পথে রওনা দেবে আকুলিয়ার পানে, তার সাধের বিগ্রহ আর কোঁচড়ভরা মুক্তো নিয়ে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে, মেঘগর্জনের ফাঁকে ফাঁকে মন্দির থেকে গান ভেসে আসে যার গলার স্বর কিছু ভাঙা ভাঙা হলেও সুরের মিষ্টতা আর আকুতি লুকোনো থাকে না আশেপাশের গাছের ডালে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ভেজা শালিক, নীচে উইয়ের ঢিবির ভেতর লুকিয়ে থাকা কালাচ আর মন্দিরের ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা মিশমিশে কালো পোষা বেড়াল লখিন্দরের কাছে।

আদতে কুসুমপুরে রঝি, নামছিল তার কমলা, ছাতিফাটা বর্ষার রাতে, দুশো বছরের পুরনো কোনও কষ্টিপাথরে গড়া পুরুষকে ভেবে গেয়ে চলে,

“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর       মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।”

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...