অতিমারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

গৌতম দাস

 



চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক। নিবন্ধটি দি ডেইলি স্কেপ্টিক-এ গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ প্রকাশিত। মূল রচনাটির সচল, সহজ, স্বচ্ছন্দ ভাষান্তর করেছেন স্থবির দাশগুপ্ত

 

 

 

‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ সারা দুনিয়ার মানুষজনের স্বাস্থ্য নিয়ে সদা-উদ্বিগ্ন থাকে, তার চোখে ঘুম নেই। স্বাস্থ্যের পক্ষে আশঙ্কাজনক কিছু ঘটবার আঁচ পেলেই সে আমাদের জানান দেয়। এই কারণেই কোভিড-১৯ নিয়ে সে সারা দুনিয়াকে সতর্ক করে দিয়েছিল। সেই বিপদ থেকে কোনওক্রমে পরিত্রাণ পেয়ে আমরা যখন সবে ধাতস্থ হওয়া শুরু করছি ঠিক তখনই ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র পরিচালক, শ্রীযুক্ত তেদ্রস আধানন আমাদের জানালেন, ‘পালাবার পথ নাই…!’ জানালেন, কোভিড-১৯-এর পর এবার এসে গেছে বানরবসন্ত— ‘মাঙ্কিপক্স’, বিশ্বজনতার পক্ষে এই ব্যাধি ভয়ানক বিপজ্জনক। আর সঙ্গে সঙ্গেই দুনিয়া জুড়ে সংবাদপমাধ্যমগুলো কানফাটানো দামামা বাজিয়ে বলতে শুরু করল, ওরে, এ এক নতুন বিপদ, ‘ও তোর যম আছে পিছে!’ কোভিড-১৯ অধ্যায়ের মতো এবারেও বিশারদরা আবির্ভূত হয়ে বলতে শুরু করলেন, ঘনায়মান এই জগৎজোড়া বিপদ থেকে জনমানুষকে উদ্ধার করতেই হবে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ ইংরাজিতে এই বিপদের নাম দিয়েছে, পাবলিক হেলথ এমার্জেন্সি অফ ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন বা সংক্ষেপে, ‘ফিক’।

এমন ঘোষণার পর দেড় মাস অতিক্রান্ত, অথচ জনমানুষের মধ্যে কোনও হেলদোল এখনও চোখে পড়ছে না। প্রাণঘাতী বসন্ত রোগের একটি দুর্বল স্বজাতি, বানরবসন্ত চারদিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, এই মর্মে দিনকয়েক দ্রুতবেগে প্রচুর রিপোর্ট বেরোল। তারপর ততোধিক দ্রুততায় সেগুলো বিলীন হয়ে গেল। এসব দেখে মনে হচ্ছে, আতঙ্ক প্রচার করে যারা লোকজনের নিরাপত্তা বজায় রাখতে চায় তাদের মুখে ছাই দিয়ে বানরবসন্ত যেন নিজের বাঁদরামিই জিইয়ে রাখল। আমরা এই প্রবন্ধে কিছুকাল ধরে চলা ভয়ঙ্কর গল্পগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আমরা বরং জানতে চাই, যাঁরা নিজের নিজের খোল থেকে বেরিয়ে এসে আতঙ্ক প্রচার করছিলেন তাঁরা কি বিফলমনোরথ হয়ে নিজের নিজের খোলেই আবার ঢুকে পড়লেন? এর উত্তর হবে, হ্যাঁ এবং না, দুটোই! এটাই মজার কথা।

লোকে যাতে ভয় পায় তার জন্য তেদ্রসবাবুর চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু তিনি যেন দিশেহারা। একবার বললেন, এমন নতুন নতুন কায়দায় সংক্রমণের ফলে বানরবসন্তের প্রাদুর্ভাব ঘটছে যেসব সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। অথচ এর পরেই বললেন, এমন এমন পদ্ধতি আমাদের জানা আছে যা দিয়ে আমরা এই প্রাদুর্ভাব থামিয়ে দিতে পারব। এই প্রাদুর্ভাবকে ‘ফিক’ বলে ঘোষণা করার আগে, গত ২৩ জুন তিনি উপদেষ্টাদের জরুরি মিটিং ডাকলেন। দেখা গেল, চোদ্দজনের মধ্যে মাত্র তিনজন তেদ্রসবাবুর পক্ষে। তিনি জানালেন, আমাদের হাতে বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলি, তথ্য এবং প্রাসঙ্গিক জানকারি অবশ্য এখনও যথেষ্ট না। এর ঠিক এক মাস পরে, গত ২১ জুলাই আবার মিটিং হল এবং দেখা গেল, পনেরোজনের মধ্যে নয়জনই তেদ্রসবাবুর বিপক্ষে। কিন্তু আর অপেক্ষা না, এবার তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঘোষণা করে দিলেন, বানরবসন্ত হল একটি ‘ফিক’, এবং এও জানালেন, তিনি নাকি ‘টাই-ব্রেকার’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

একদিকে তিনি বলছেন, যথেষ্ট সূত্র, তথ্য আর জানকারি নেই; আবার বলছেন, তাঁর নাকি সংক্রমণ রোধ করে দেওয়ার ম্যাজিকটি জানা আছে। এ-ব্যাপারে তাঁর মনে কোনও সংশয় নেই যে, বানরবসন্তের প্রাদুর্ভাব ঘটছে তাদের মধ্যেই যারা সমকামী, উভকামী এবং যথেচ্ছ যৌন আচরণকারী। আবার পরক্ষণেই ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ জানাচ্ছে, যাদের শরীরে রোগনিরোধক শক্তি কম, অন্তঃসত্ত্বা এবং শিশুদের মধ্যে কিছু সাময়িক ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে তারা বানরবসন্তে আক্রান্ত না-হয়। অন্তঃসত্ত্বা এবং শিশুরা কীভাবে যথেচ্ছ যৌন আচরণকারীদের দলে পড়ে যায় তা ভেবে ওঠা মুশকিল। এমন উদ্ভট কথা লোকস্বাস্থ্যরক্ষার ভাঁড়দের পক্ষেই বুঝে ওঠা সম্ভব, বিজ্ঞানের নামে ভাঁড়ামিই যাদের কাজ। নানাবিধ ভাঁড়ামি। বানরবসন্তের সংক্রমণে যখন মোটে পাঁচজন মারা গেছেন, যখন এই ব্যাধির নিবাস বলে পরিচিত আফ্রিকার মাত্র দুটি দেশ ছাড়া আমেরিকা বা ইউরোপের কোথাও মৃত্যুর খবর নেই, তখন বলা হল, ইউরোপে নাকি বিশেষ সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। সেখানে নাকি এই ব্যাধির টিকা, চিকিৎসাপত্র এবং অন্যান্য পদ্ধতি নিয়ে গবেষণায় অগ্রগতি ঘটাতে হবে।

শ্রীযুক্ত তেদ্রস যেদিন বানরবসন্তকে একটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ব্যাধি বা ‘ফিক’ বলে ঘোষণা করলেন সেইদিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়ে দিল এই ব্যাধিটিকে নিয়ে পরীক্ষাগারে কীভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে হবে। তাতে তারা বলল, বানরবসন্তের ভাইরাসটির মতো আরও কিছু ভাইরাস আছে যারা প্রায় একই জাতের। তাদের মধ্যে থেকে বানরবসন্ত রোগটিকে নির্দিষ্টভাবে চিনতে হলে কিছু বিশেষ ধরনের পরীক্ষা করতে হবে, যেমন ‘জেনেরিক’ এবং ‘পিসিআর’ পরীক্ষা। বলা হল, ‘পিসিআর’ পরীক্ষা করে নাকি রোগটিকে নির্দিষ্টভাবে চিনে ফেলা যায়। অথচ এ নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে প্রশ্ন আছে। আমেরিকার ‘সিডিসি’ (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল) ২০০৬ সালের ৭ জুলাই একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিল। তাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, ‘পিসিআর’ পরীক্ষাটি আলাদাভাবে কোনও সংক্রামক ভাইরাসকে চিহ্নিত করতে পারে না। এই পরীক্ষায় বড়জোর ভাইরাস-এর একটি পরিবারকে চেনা যায়, কিন্তু সেই পরিবারের কোন সদস্য সংক্রামক এবং ব্যাধির জন্য দায়ী তা বোঝা যায় না। এমনকী, এই বছরের জুন মাসেও এই পরীক্ষাটি নিয়ে সিডিসি সতর্কতা জারি করেছে। তার মানে, ‘পিসিআর’ কী পারে আর পারে না তা একটি বুনিয়াদি প্রশ্ন। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই বুনিয়াদি প্রশ্নটিকেই ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিল।

যে-‘জেনেরিক’ পরীক্ষার কথা বলা হল তাও কোনও বৈধ এবং সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি না। বলা হল, কেবল একটা নমুনা হিসেবে ওই পরীক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘সিডিসি’-এর ভূমিকাও প্রশ্নসাপেক্ষ। তারা এই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার সীমাবদ্ধতা জানা সত্ত্বেও আমেরিকার নাগরিকদের এইসব পরীক্ষায় সামিল হতে বলছে। জেভিয়ার বেসেরা, যিনি একাধারে একজন আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং মার্কিন সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক দায়িত্বশীল পদে অভিষিক্ত, তিনি জানালেন যে, বানরবসন্ত নিয়ে মার্কিন নাগরিকদের সতর্ক থাকতেই হবে। সতর্কতার সবচেয়ে বড় উপায় হল, বেশি বেশি সংখায় ‘টেস্ট’ করা, জনসাধারণের উপর পরীক্ষাগুলো চালিয়ে যাওয়া।

ব্যাধিনির্ণয়, চিকিৎসা, টিকা এবং ওষুধপত্রের যথেচ্ছাচার নিয়ে দ্বিচারিতা এবং সন্দেহজনক বক্তব্যের ছড়াছড়ি সত্ত্বেও বানরবসন্ত নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর পরিত্রাহি চেষ্টা কিন্তু মাঠে মারা গেল। তার সহজ কারণ হল, বানরবসন্ত-এর স্বাভাবিক নিবাস পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলিতে যেখানে এটি একটি স্থানীয় রোগ বা ‘এন্ডেমিক’ বলে পরিচিত। সেখানে সুস্থ মানুষজনের মধ্যে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা নগণ্য। তাই তাকে সারা দুনিয়ার জনস্বার্থের প্রতি অতি বিপজ্জনক বলে দাবি করা যায় না। জোর করে অমন দাবি করলে জনস্বার্থই বিপন্ন হয়।

এ-পর্যন্ত যা বুঝলাম তাতে মনে হচ্ছে, হ্যাঁ, সত্যিই আতঙ্ক-প্রচারকরা খেলায় হার মেনে নিজ নিজ ঘরে ফিরে গিয়েছেন, বা অন্তত তেমনই হওয়ার কথা। কিন্তু না। বিষয়টা এত সহজ না, আতঙ্কপ্রচার কমেনি এবং তার চেয়েও বড় কথা হল, আতঙ্ক এমন এক মানসিক অবস্থা যা থেকে সহসা বেরিয়ে আসা কঠিন। বিশেষ করে যারা সচ্ছল সেইসব নাগরিকদের বেলায় কথাটি যে কত সত্য তার প্রমাণ আমরা কোভিডকালে পেয়েছি। যারা আতঙ্ক ছড়ায় তারা একথা বিলক্ষণ জানে। তাই জৈব-নিরাপত্তা নিয়ে আজকাল সারা দুনিয়া জুড়ে, বিশেষ করে আমেরিকায় বড় হইচই। এই মর্মে নানান্‌ সংগঠন আছে, তারা নানান্‌ উৎস থেকে বড় বড় অঙ্কের টাকা পায় এবং দুনিয়া জুড়ে প্রচার চালায়, কোন ভাইরাস আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নষ্ট করে দিচ্ছে, আর তার জন্য আমরা কী কী করতে পারি।

তেমনই একটি সংগঠনের নাম, ‘সেপি’ (কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস এন্ড ইনোভেশন্স)। অর্থাৎ এরা অনাগত মহামারির বিরুদ্ধে আগেভাগে মানুষজনকে তৈরি করে রাখে এবং নব নব উদ্ভাবনী কায়দায় মহামারি রোধ করে। এর বর্তমান পরিচালক হলেন, ডাঃ রিচার্ড হ্যাচেট। তিনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্যবিদ। ইনি সম্প্রতি, এই মে মাসেই একটি রচনায় জানিয়েছেন, অদূর ভবিষ্যতে গুটিবসন্তের মতো কোনও ভাইরাস আমাদের জীবন বিপন্ন করে দেবে। খুব ব্যয়সাধ্য হলেও এর বিরুদ্ধে বসন্তের টিকা মজুত করে রাখতে হবে, তার সঙ্গে থাকবে ভাইরাস-বিরোধী ওষুধপত্র। খুব উর্বর মস্তিষ্ক না-হলে, যে-ভাইরাসটি নির্মূল হয়ে গেছে সে বা তার স্বজাতি কীভাবে আমাদের সর্বনাশ ঘটাবে তা ভেবে ওঠা মুশকিল। আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, এমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে তাহলে তা রোধ করার জন্য এত ব্যয়সাধ্য উপায় না-হলেও চলে। কোভিড-১৯-এর সবচেয়ে বড় শিক্ষা তো এই যে, কাণ্ডজ্ঞান খাটাতে হবে, সত্যি কথাটাই বলতে হবে এবং আমাদের পরিমিতি বোধ থাকতে হবে। অবশ্য ক্ষমতাবানদের হাতে পড়ে এই ত্রিমূর্তিই শহীদ হয়েছে।

ওই শহীদত্ব যাতে বজায় থাকে, জনমানুষ যাতে ত্রিশঙ্কু হয়ে থাকেন, তার জন্য ডাক্তার হ্যাচেটের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তিনি জানিয়েছেন, প্রথমে কোভিড-১৯ এবং এখন বানরবসন্ত আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে, ভাইরাস কোনও সীমা মানে না, এক দেশ থেকে যেকোনও দেশে তারা অনায়াসে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সারা দুনিয়ার জনগণকে কায়মনোবাক্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আমাদের টিকা-লাইব্রেরি তৈরি করতে হবে, নতুন নতুন টিকা বানাতে হবে যাতে যেকোনও ভাইরাসকে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়। আমরা এক বিশ্বের বাসিন্দা, একই হুমকির মোকাবিলায়, একই উপায় হাতে নিয়ে সদাজাগ্রত থাকব। অতএব, ‘সেপি’ যে তেদ্রসবাবুর আশীর্বাদধন্য হবে তাতে আর সন্দেহ কী! এ-বছর মার্চ মাসে তিনি জানিয়েছেন, ‘সেপি’ মানেই বিজ্ঞান, সে যত আর্থিকভাবে পুরুষ্টু হবে ততই আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর। তাই আমাদের সকলের উচিত, ‘সেপি’র ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের থলি যাতে পূর্ণ থাকে তার জন্য মুক্ত হস্তে দান করা।

প্রকৃত প্রস্তাবে ‘সেপি’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই একটি মঞ্চ যার কাজ হল, মহামারির ভয় দেখিয়ে, তার বিরুদ্ধে তৈরি থাকার অজুহাতে টিকা, ভাইরাস-বিরোধী ওষুধপত্র আর রোগনির্ণয়ের উপকরণ বিক্রি করা। তার পিছনে আছে বিরাট বিরাট বাণিজ্য সংস্থা, গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর মতো বড় বড় ব্যাঙ্ক, আর ওয়েলকাম ট্রাস্ট, বিল অ্যান্ড মেলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশন এবং ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর মতো বিশাল সংগঠন। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সম্মেলন থেকে এর যাত্রা শুরু, আর ইতোমধ্যে সে দুনিয়ার প্রায় সব দেশ থেকেই অনুদান পেতে শুরু করেছে। এর প্রধান লক্ষ্যগুলোর অন্যতম হল, যেকোনও ব্যাধির প্রাদুর্ভাবের আগেই যাতে টিকা মজুত থাকে তা নিশ্চিত করা এবং মহামারি শুরু হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যেই টিকার বর্মে সজ্জিত হয়ে ওঠা। নতুন নতুন, এমনকী অজানা জীবাণুর বিরুদ্ধেও টিকার ব্যবস্থা করে রাখা এর মূল্যবান কর্তব্য।

কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, অজানা ভাইরাস-এর বিরুদ্ধে টিকা মানে কী? যাকে জানা হয়নি, চেনা হয়নি তার বিরুদ্ধে টিকা? এ কি শুভঙ্করের ফাঁকি, না কী? এও ভাবতে পারেন যে, মহামারি শুরু হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে টিকা বাজারজাত হয়ে যাবে, এমন প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত? ওষুধের নিয়ামক সংস্থাগুলোর অনুমতি লাগবে না? অনুমতি লাগে ঠিকই, তবে ‘সেপি’ও তো নিতান্ত শিশু না, সে আগেভাগেই ওইসব নিয়ামক সংস্থাগুলোর হত্তাকত্তাদের নিজের সংগঠনে ঢুকিয়ে নিয়েছে। সেকথা জুন রেইন, যিনি ইংল্যান্ডের ওইরকম একটি সংস্থার পরিচালক, নিজেই স্বীকার করেছেন। তাছাড়া, ‘সেপি’র লক্ষ্য চরিতার্থ করতে গেলে গবেষণাপত্রও লাগবে; তাই তার ঝুলিতে গবেষক এবং বিজ্ঞানীরাও আছেন, যখন যা দরকার তাঁরা তার জোগান দেবেন বইকি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি বক্তৃতায় তেদ্রস সাহেব জানিয়েছেন, ‘সেপি’র জন্মের দুই বছর আগে, ২০১৫ সালেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘সার্স’, মার্স’-এর মতো মহামারি যাতে আর না-হয় তার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিল। সেই রোগবিরোগের তালিকায় ‘ডিজিজ এক্স’ নামে একটি রোগও ছিল, মানে যে-রোগ তখনও অজানা। পরবর্তীকালে এই রোগটিই কোভিড-১৯ নামে খ্যাত বা কুখ্যাত হয়েছে। তো এইভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনতার সেবায় নিদ্রাহীন। কোভিড-১৯ অতিমারি নাকি আজও খতম হয়নি। যতদিন দুনিয়ার কোথাও তার সামান্যতম উপস্থিতির সন্ধান পাওয়া যাবে ততদিন নাকি কোভিড-১৯ শেষ হবে না। তাই আমাদের স্বস্তির কোনও কারণ নেই।

বলাবাহুল্য, এইসব বক্তৃতায় সাধারণ, পরিশ্রমী, অসচ্ছল জনতা উজ্জীবিত হন না, তাই তাঁদের হেলদোল থাকে না। উলটোদিকে, অভিজাত এবং অতি সচ্ছল শ্রেণি অতি অল্পেই অথবা অকারণেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অতএব, অতিমারির বিরুদ্ধে প্রস্তুতি কথাটার অর্থ হল, বিশ্বের অভিজাত শ্রেণির হাতে দুটো অতি শক্তিশালী অস্ত্র মজুত রাখা। এক, এখন থেকে সারা বিশ্বে অতিমারির হুমকি চিরস্থায়ী হয়ে থাক, আর দুই, বানরবসন্তের ছক ধরে যাবতীয়, সম্ভাব্য অতিমারির বিরুদ্ধে টিকা-গবেষণা চালু থাক।

শ্রীযুক্ত তেদ্রস তো বলেই রেখেছেন, কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে, সার্বিক নজরদারি, জিনচর্চা, রোগ নির্ণয়ের উপকরণ, টিকা এবং চিকিৎসার বিচিত্র পদ্ধতিগুলোর ক্ষমতা কী অসীম। অতএব, আপনারা কিচ্ছু জানতেন না একথা আর বলতে পারবেন না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...