বন্যার রাত

বন্যার রাত | শুভ্রদীপ চৌধুরী

শুভ্রদীপ চৌধুরী

 

এক আশ্বিন মাসের মাঝরাতের ঘটনা।

আত্রেয়ী নদীর বাঁধ ভেঙে হুড়মুড় করে জল ঢুকে পড়ল বাতাসীপুরে। বেশ কয়েকদিন থেকেই নদী ফুঁসছিল। গ্রামের পুকুর, খাল, বিল ছিল জলে টুপটুপ।

সেই মাঝরাতে জলের কলকল শব্দে জগুপাগলার কান্না চাপা পড়ে গেল। জগুপাগলা এই গ্রামেই থাকে। সময় পেলেই সে গলা ছেড়ে কাঁদে। কান্নাকাটির কারণ জিজ্ঞেস করলে সে হাসিহাসি মুখে উত্তর দেয়— কান্দনের মত মজা আর কিছুতে নাই। কান্দে দেখবেন খুব মজা, মনডা একদম ফেরেশ হয়ে যায়।

জগুপাগলার কান্নাসমস্যা নিয়ে বিচারসভা বসেছিল ভাদ্রমাসের প্রথম বুধবার, মেম্বার সুরেশ মন্ডলের বাড়ির বাইরের বারান্দায়। অভিযোগ এনেছিল কামাক্ষাচরণ ভুঁইমালি। অভিযোগ হিসেবে সে বলেছিল— আমার তন্ত্রমন্ত্রের অদ্ভুত শক্তি জগুর কান্নার ফলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। আপনাদের সহজে বুঝবার জন্য কিছু উদাহরণ দিলাম,

এক, এই হপ্তায় জয়নালের সাংসারিক অশান্তি দূর করার জন্য যজ্ঞ করেছিলাম তা কাজে আসেনি।

দুই, বিদ্যুৎকে আমি লটারি কাটতে বলেছিলাম, সেটাও বিফলে গেছে।

তিন, বিদ্যালাভের তাবিজ ধারণ করার পরও সুখলাল এবারও মাধ্যমিক পাশ করতে পারেনি। দিনকে দিন আমার পসার নষ্ট হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে ঘোর অকল্যাণ নেমে আসবে এই বাতাসীপুরে। এই আমি বলে রাখলাম।

মেম্বার সুরেশ মন্ডল এসব শুনে সামান্য হেসে বলেছিল— আপনার তন্ত্রমন্ত্রের কথা আমার কাছে ঢাক পিটিয়ে আর বলতে আসবেন না। মন্ত্রের জোর থাকলে আমি প্রধান হতাম। মনে রাখবেন, আমি মনে করি প্রতিটি গাঁয়ে একজন-দুজন পাগল থাকা ভাল। এতে গাঁয়ের ইজ্জত বাড়ে।

কামাক্ষাচরণ এমন কিছু শুনবে আশা করেনি। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে— আমার মন্ত্র সব মহাদেবের মুখনিঃসৃত বাণী, একথা মোটমুটি সকলেই জানেন, বিশ্বাস করেন বলেই জানি। সেই মন্ত্র আজ বিফলে যাচ্ছে জগুর জন্য। আমি চাই গাঁয়ের মঙ্গলের জন্য ওকে গাঁ-ছাড়া করা হোক।

সে সময় মেম্বারের বারান্দায় বেশ কিছু মানুষ বসেছিল। এদের মধ্যে গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ দীনবন্ধু সরকার জগুপাগলার পক্ষ নিয়ে বলে— আমরাও কী কম দুঃখে থাকি? কত কান্না চাপা দিয়ে রাখি। হুটহাট করে কান্নাকাটি করলে বোধহয় এর চেয়ে ঢের ভাল থাকা যেত। আমার তো জগুপাগলাকে হিংসে হয়। ও থাকুক এই গ্রামেই।

অন্যরা দীনবন্ধু সরকারের কথায় সায় দিল। কামাক্ষাচরণ সুবিধে করতে না পেরে গজগজ করতে করতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

সেই থেকে জগুপাগলা দিব্যি আছে। যখনতখন ফুঁপিয়ে কাঁদে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে, একমুখ হাসি নিয়ে বলে— কিছুক্ষণ কান্দে দ্যাখেন সুখ পাবেন।

তিনেক থেকে সমান তালে বৃষ্টি হওয়ায় জগু মেম্বারের আমবাগান থেকে অবিনাশের বাড়ির সামনের বারান্দায় এসে উঠেছে। রাতে ভাত দিয়েছিল অবিনাশের বউ। ভাত, ডাল, তরকারি সঙ্গে কাঁচালঙ্কা আর আস্ত একটা পেঁয়াজ। কলাপাতায় ভাত দেওয়ার সময় অবিনাশের বউ বলেছিল— চুপচাপ খেয়ে নিবি, আজ একদম কান্নাকাটি করবি না, জগু।

জগুপাগলা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল— কাঁদব না। বিশ্বাস করেন কাঁদব না।

লণ্ঠন নিয়ে তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বউটা।

জগুপাগলা সামনে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, ভাতের মাঝে ঘন ডাল, পাশে তরকারি— এসব দেখে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তার কান্নার চোটেই হয়ত ঝমঝমে বৃষ্টি গেল থেমে। মোটামুটি মিনিট পনেরো কেঁদে সে আয়েশ করে ভাত খেল। তারপর রাস্তার পাশের টিপকল ঠেসে অল্প জল খেয়ে বারান্দায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল।

বৃষ্টি থামার পর আকাশে চমৎকার চাঁদ উঠল। নীলচে আলোয় ভেসে গেল চারদিক। এইসব দিনে জগুপাগলার বড্ড উড়তে ইচ্ছে করে। শুধু উড়তে নয়, সে ভাবছিল উড়তে উড়তে মন খুলে বৃষ্টির মত কাঁদবে। শুধু কাঁদবে না, একটু নাচবে। আর ঠিক তক্ষুণি সোঁ-সোঁ আওয়াজটা কানে এল জগুর।

 

দুই.

সুরেশ মন্ডল তার শোওয়ার ঘরে চৌকির উপরে একখানা টেবিল রেখে তার উপরে বসে সবে একটা বিড়ি ধরিয়েছে, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার কোলে শুয়ে আছে একটা তিনব্যাটারি টর্চ। পকেটে মোবাইল।

একটু আগে প্রধানসাহেব ফোন করে চাপা গলায় বলেছে— কেটে পড় সুরেশ। গাড়ি পাঠাব। অবস্থা ভাল নয়। এটা দাও ওটা দাও শুরু হওয়ার আগে কেটে পড়তে হয়। থাকলে চাপ বাড়বে। আর ভগবানকে ডাকো, বন্যা যেন বড় হয়। যত বড় বন্যা, তত আয়।

সুরেশ মন্ডলের কাছে প্রায় গা ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে বসে আছে রতন। সে এইজন্য মনে মনে খুব লজ্জিত।

রতন টুকটাক ফাইফরমাশখাটা মানুষ। তার মত সামান্য মানুষের মেম্বারের গা ঘেঁষে বসে থাকা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। এই কারণেই সে চুপ করে বসে আছে। একটু আগে সে দাঁড়িয়েছিল এক কোমর জলে। মেম্বার নিজে তাকে টেবিলে উঠে বসতে বলেছে। তা না হলে সে জলেই দাঁড়িয়ে থাকত। এমন সময় ঘরের ভেতরে খলবল শব্দ হল।

রতন আর চুপ করে থাকতে পারল না— বাবু, মনে হচ্ছে বড় মাছ ঘরে ঢুকে পড়িচে। ঘাই দিচ্ছে। আপনার দীঘির লক্ষ্মী হবার পারে। যাকে গেলবছর রূপার নথ পড়ালেন, সেই কাতলাটা। ভাবেন, কত ভালবাসে আপনাকে, প্রভুভক্তির দিকটা একটু খেয়াল করে দ্যাখেন মেম্বার সাহেব।

সুরেশ মন্ডল তার কথার জবাব দিল না।

রতন থামল না— বুঝলেন মেম্বারসাহেব, জল নামে গেলে জনে জনে এই গল্পটা করা লাগবে। চারদিকে জল থইথই তবু, তবু সে অন্য কোথাও যায়নি। আপনার কাছে ফিরে আসিচে। আর ওদিকে বৌদির আক্কালটা দ্যাখেন, বন্যার ভাব হতেই ঝগড়া করে ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি গেল। এই মাছের কাছে মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে।

সুরেশ মন্ডল চেঁচিয়ে উঠল— থাম, অযথা ভ্যাজরভ্যাজর করে কানের মাথা খাস না। চুপচাপ বসে থাক।

–আচ্ছা চুপচাপ বসে থাকব, তবে খুব জানার ইচ্ছা হচ্ছিল যে লক্ষ্মীকে এ যাত্রায় ধরা হবে, না ছাড়ে দেওয়া হবে?
–আবার কথা, এরপর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিব।

মেঝেয় খলবল শব্দটা আবার হল।

রতন মিনতির সুরে বলল— টর্চটা একবার জ্বালান মালিক। লক্ষ্মী আপনাকে না দেখে বুঝি যাবে না। একেই বলে টান!

টর্চ জ্বালিয়েই চমকে উঠল সুরেশ মন্ডল। একটা ছাগল, জলের উপরে ভেসে আছে তার মাথা। চমকে ওঠার বিষয় হল ছাগলটার গলা ও মাথা জুড়ে পেঁচিয়ে আছে একটা কুচকুচে কালো সাপ। ছাগলটা শুধু মাথা নেড়ে আপ্রাণ চেষ্ঠা করছে সাপটাকে ছাড়ানোর, পারছে না। যেন প্রচণ্ড ভয়ে বোবা হয়ে আছে।

এবার রতন চেঁচিয়ে উঠল— হায় ভগবান, এ যে আমার পূর্ণিমা। পোয়াতি ছাগল, কী কুক্ষণে যে ছাড়া থাকে, গাঁয়েগঞ্জে এই জন্য চোর থাকা ভাল।

–তুই থামবি রতন!

রতন থামল না। আবার চিৎকার করে উঠল— মনার মা দেখে যাও তোমার ছাগল আমার চোখের সামনে শেষ হল গো।

মনার মা গাঁয়ের আর কয়েকজন মেয়ে বউ মিলে পাশের ঘরে চৌকির উপরে চৌকি তুলে কোনওমতে বসে আছে। রতনের কথার উত্তর এল— কী হইচে পূর্ণিমার?

–সাপে ধরিচে।

মনার মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল— তুমি পুরুষ মানুষ, যে করেই হোক পূর্ণিমারে বাঁচাও।

রতন আর দেরি করল না। সুরেশ মন্ডলের পা চেপে ধরল— টর্চটা আর একবার জ্বালান মালিক।

টর্চের আলো জলে পড়তেই সে ঝাঁপিয়ে নামল জলে। তার হাতে কাঠের বাটওয়ালা একটা ছাতা। যেন ছাতা নয়, বন্দুক!

রতনের সাহস দেখে সুরেশ মন্ডল মুগ্ধ হল। রতন মুখে বিড়বিড় করতে লাগল, আস্তিকমুনি, আস্তিকমুনি, আস্তিকমুনি। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাগল সমেত উঠে এল। জবজবে ভেজা ছাগলটা বুকে জড়িয়ে রতন ফিসফিস করে বলতে লাগল, একবার আওয়াজ দিলি না কেন পূর্ণিমা? আজ যদি কিছু একটা হয়ে যেত!

পাশের ঘর থেকে ভেসে এল— জয় মাকালী। জল নামলেই যা মানত করিচি তা দিয়ে পূজা দিয়ে আসব।

রতন বলল— এর মধ্যে আবার মানত করে ফেললা। তুমি শুধু খরচ বাড়াও মনার মা।

সুরেশ মন্ডলের হাসি পেল। তবু সে মুখ গম্ভীর করেই বসে থাকল।

রতন চাপা গলায় বলল— এবার টর্চটা বন্ধ করেন। অযথা ব্যাটারি নষ্ট করবেন না।

সুরেশ মন্ডল টর্চের সুইচ থেকে আঙুল সরিয়ে নিল। আবার সেই কুচকুচে কালো বিড়ালের মত অন্ধকারে ডুবে গেল ঘরটা।

 

তিন.

জল আরও বাড়তে লাগল।

বৃষ্টি আবার ফিরে এসেছে। নদীর জল এখন ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত ফুঁসছে।

ভয়ার্ত গলায় সুরেশ মন্ডল বলল— আর ঘরে থাকা ঠিক হবে না। চলো সবাই প্রাইমারি ইস্কুলে যাই। হাঁটুজল এখন কোমরে এসে দাঁড়িয়েছে।

এই কথাটুকুর অপেক্ষাতেই যেন সবাই বসেছিল। মুহূর্তের মধ্যে এক কোমর জল ঠেলে যে যার অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মাথায় তুলে এগিয়ে চলল।

সবার সামনে দেখা গেল রতনকে, তার কাঁধে পূর্ণিমা। রতন পেছন ফিরে সুরেশ মন্ডলের দিকে তাকিয়ে বলল— মালিক বগল থেকে ছাতাটা এবার বের করে মাথায় ধরেন।

সুরেশ মন্ডল হেসে ছাতাটা ফুটিয়ে মাথা বাঁচাল।

তিনটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আদরী পিছিয়ে পড়ছে বারবার। পিছিয়ে পড়ার কারণ সে পেটে আরেকজনকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা তাকে টানছে সামনে, সে ধীরেসুস্থে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে চলে যাচ্ছে মানুষজন।

আদরী দাঁড়িয়ে পড়ল। এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যেন সে হারিয়েছে। ছেলেমেয়েরা আকুল কণ্ঠে ডাকতে লাগল— ওমা, মা, তুমি থামে গেলা ক্যান? পা চালাও নয় তো ঘরে জায়গা পাবা না।

আদরী ওদের হাত ধরে কোনওমতে হাঁটতে লাগল। পেটেরটা পা ছুড়ছে। হাজার কষ্টের মধ্যেও তার কেমন আনন্দ হচ্ছে। এই সময় তার খুব খুব ভাল লাগে। সে এগিয়ে চলল।

প্রাইমারি স্কুলের দরজার তালা ভাঙা হল। জোয়ান ছেলেপুলেরা ছুটল ছেড়ে আসা দরকারি জিনিসপত্র আনার জন্য। গরু ছাগল রাখা হয়েছে বারান্দায়। স্কুলের চারটে ঘর মানুষের জন্য।

সুরেশ মন্ডল অযথাই দাঁড়িয়ে থাকল বারান্দায়। স্কুলের চারটে পাকা ঘরে যেন ঠাসাঠাসি করে ঢুকে পড়েছে পুরো একটা গ্রাম। কুপি, লন্ঠন জ্বালানো হয়েছে। দেওয়ালের বাঁধানো ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মনা বলল— ওই ছবির মানুষগুলার নাম জানো, মা?

মনার মা বলল— না রে মা।

মনা বলল— গোল চশমা পরে হাসিমুখের বুড়ো লোকটা হল গান্ধিজি, পরেরজন নেতাজি, তারপর রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দ।

ঘরের সবাই মনার কথা শুনে হাসতে লাগল। যেন সবাই দল বেঁধে যাত্রার আসরে বসে আছে, কারও কোনও ক্ষতি হয়নি!

মনার মা তার ক্লাস টুয়ে পড়া মেয়েকে গর্বে জড়িয়ে ধরল। তার চোখে টলটল করছে জল। ভেজা সপসপে আঁচল দিয়ে সে তার চোখ মুছল।

দীনবন্ধু বলল— মনার মা, তোমার মেয়ে একদিন এই পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করবে। আমার কথা পরে মিলায়ে নিও। আহা, এতটুকু বয়সে গান্ধিজি, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ সব চেনে— এ চাট্টিখানি কথা নয়। জল নামলে মেম্বারসাহেবকে বলে এই মেয়ের জন্য একটা পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।

মনার মায়ের চোখ আবার ভিজে এল। আনন্দের সময় এত কান্না কোথা থেকে ছুটে আসে কে জানে? এসব সে যত ভাবে ততই অবাক হয়।

চারিদিকে হাঁকডাক বাড়ল।

বন্যার নিয়ম অনুসারে একজনকে ডাকলে অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে! প্রচুরজন সাড়া দিচ্ছে। তাতে কে, কাকে, কেন ডাকল এসব চাপা পড়ে যাচ্ছে। শুধুই হুই হুই শব্দ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

মোবাইল বাজছে। কানে ফোন নিয়ে বারান্দা থেকে জলে নেমে পড়ল সুরেশ মন্ডল। ওপাশ থেকে ভেসে আসছে প্রধানের গলা— ভোরের দিকে আবার গাড়ি পাঠাব। রিলিফের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছ বলে কেটে পড়বে সুরেশ। ওখানে থাকলে সমস্যা বাড়বে।

–এই অবস্থায় গ্রামের মানুষদের ছেড়ে…!
–বন্যা, খরা, ঝড় এসব না হলে তোমার আমার উন্নতি হবে? এসব নিয়ে ভাবতে নেই সুরেশ। গতবার বন্যায় আমার দুটো ট্রাক্টর আর দু বিঘা ধানি জমি বেড়েছে। তুমি চাইলে তোমারও হবে। আমি ভগবানের কাছে বলি, বছরে একটা খরা নয় তো বন্যা দাও। ভাল করে শোনো, ভোরে গাড়ি পাঠাব মাদারগঞ্জের মোড়ে। চলে আসবে। ওখানে থেকো না। কেটে পড়ো। রাখছি।

সুরেশ মন্ডল জল ঠেলে কোনওরকমে এগোতে লাগল। কোথায় যাচ্ছে জানে না।

 

চার.

–দিল, ধান, চাউল সব গেল মেম্বারসাহেব। খাব কী?

সুরেশ মন্ডল চেঁচিয়ে উত্তর দিল— আমি আছি তো। সামান্য কথাটুকু বলার সময় তার গলা কেঁপে উঠল।

টিনের চাল থেকে উত্তর এল— আপনি আমাদের ভরসা মেম্বারসাহেব। আরও সামনে এগিয়ে চলল সে। কলাগাছের ভেলায় করে রতন খানকয়েক মানুষ নিয়ে এগিয়ে আসছে। তার কাছাকাছি আসতেই রতন বলল— বাবু আপনি ভেলায় উঠে পড়েন।

সুরেশ মন্ডল বলল— আমার রেডিও আনিচিস রতন?

রতন হেসে উত্তর দিল— ওটা আনব না তা হয়। আপনি আগে ভেলায় উঠে পড়েন। তারপরের টিপে জয়দেবের চালের লোকজনকে স্কুলঘরে ঢোকাতে পারলে এক্কেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।

স্কুলঘরে ফিরে সুরেশ মন্ডল তার সাধের রেডিও নিয়ে বসেছে। প্রথমদিকে রেডিও থেকে সোঁ সোঁ আওয়াজ ছাড়া কিছুই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। খানকয়েক চড় খাওয়ার পর রেডিওটা লাইনে এসেছে।

স্কুলের ঘরের দেওয়ালে একটা বন্ধ ঘড়ি ঝুলছে। কোনও এক সকাল কিংবা সন্ধে ছয়টা কুড়িতে সেটা বন্ধ হয়েছে। বারবার ঘড়িটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে সবার।

মহাপুরুষদের বাঁধানো ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে দীনবন্ধু। গান্ধিজির ছবির গায়ে পুঁচকে একটা টিকটিকি টিক টিক করে উঠল। ঘরের প্রায় অনেকেই ঠিক, ঠিক, ঠিক বলে মেঝেতে আঙুলের টোকা দিল।

শেষ রাতের দিকে বৃষ্টির বেগ কমে এল। রেডিওতে গম্ভীর গলায় স্তোত্র পাঠ শুরু হল। সুরেশ মন্ডল নব ঘুরিয়ে সাউন্ড বাড়িয়ে দিল।

দীনবন্ধু চেচিয়ে উঠল— মহালয়া আরম্ভ হইচে, সবাই উঠে পড়ো।

মনার মা মেয়েকে ঘুম থেকে টেনে তুললেন। মনা চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল— এত রাতে ঘুম ভাঙ্গালা ক্যান?

মনার মা উত্তর দিল— মহালয়া হচ্ছে, শুনবি না!

মনা হাসিমুখে মাথা নাড়ল। পাশের ঘরগুলো থেকে ছুটে এল অনেকেই। রেডিওর চারদিকে এখন গোল হয়ে বসেছে সবাই। আর সব বাচ্চাকাচ্চাদেরও চড়থাপ্পড় মেরে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে। তাদের দু-একজন ছিল্লি দিয়ে কান্না জুড়েছে। এতে তাদের মায়েরা লজ্জায় দিশেহারা হয়ে বাচ্চাদের পিঠে আবার চড় মারছে। সুরেশ মন্ডল তাদের থামাল— কান্দুক, কান্দুক, মার দিয়ে কান্না থামানো যায় না।

জগুপাগলা হাসছে কিন্তু তার দুচোখ উপচে পড়ছে জল। রতন সেদিকে তাকিয়ে বলল— দেখেছেন বাবু পাগলটার ভড়ং? হাসতে হাসতে কাঁদে!

সুরেশ মন্ডল টর্চ নেভাল। পকেটে মোবাইল বাজছে। প্রধান কলিং। তবে কি মাদারগঞ্জ মোড়ে তাকে নিয়ে যেতে গাড়ি চলে এসেছে?

অনেকটা আলো হয়েছে চারপাশে, অন্ধকার হলে এই পাগলটির পাশে সে কিছুক্ষণ বসত। আবছা আলোর দিকে তাকিয়ে সুরেশ মন্ডল ঠিক করল, সে এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবে না। নব ঘুরিয়ে রেডিওর মহালয়ার সাউন্ড বাড়িয়ে দিল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...