ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো— একটি সহজপাঠ [১২]

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: শারীরতত্ত্ব থেকে মনস্তত্ত্ব

চিন্তাশক্তির স্বাঙ্গীকরণ

কোনও মানবশিশুই ভাষা বা চিন্তার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না। শুধু তাই নয়, জন্মকালে মানবশিশুর মস্তিষ্ক অন্যান্য প্রাণীর তুলনীয় শাবকদের মস্তিষ্কের সাপেক্ষে অনেকটাই অবিকশিত থাকে। যেমন, গরিলা বা শিম্পাঞ্জির বাচ্চা মস্তিষ্কের ৬৫ শতাংশ বিকশিত অবস্থা নিয়ে জন্মায়। বাকি ৩৫ শতাংশের বিকাশ হয় জন্মোত্তরকালে। পক্ষান্তরে একটি স্বাভাবিক মানবশিশুর মস্তিষ্কের শতকরা মাত্র ৩৫ ভাগ বিকাশ হয় গর্ভাবস্থায়। বাকি প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে শৈশব ও আদি কিশোরবেলায়।

এর ফলে মানুষের সন্তান বহু ব্যাপারে, এমনকি জৈবিক কার্যকলাপেরও অনেক ক্ষেত্রে নিজে থেকে কিছু করে উঠতে পারে না। গরুর বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়েই লাফালাফি শুরু করে দেয়। আর মানবসন্তান প্রথম পাঁচ-ছয় মাস পর্যন্ত শুয়েই কাটায়। তারপর সে বসতে শেখে। দাঁড়াতে এবং হাঁটতে লাগে অন্তত এক বছর। কান্না বা চিৎকার সে নিজে নিজেই করতে পারে, এই ক্ষমতাটা তার জন্মগত। শর্তহীন পরাবর্ত। কিন্তু হাসতে তার সময় লাগে। নিজে হাতে সব কিছু খেতে পারে, গ্লাস বা বাটি থেকে জল/দুধ পান করতে পারে তিন বছরের মাথায়। তাও আবার এই বসা, দাঁড়ানো, হাঁটা, খাওয়া, জল বা দুধ পান করা— সবই তাকে শেখাতে হয়। নিজে নিজে সে কোনও কিছু আয়ত্ত করতে পারে না। ভাষা শিক্ষার তো প্রশ্নই ওঠে না। অর্থাৎ, চিন্তার ক্ষমতাও নয়। তার পরিবার, অর্থাৎ, তার সামাজিক অস্তিত্বই তাকে জৈব কর্মগুলিও শিখতে বা আয়ত্ত করতে সাহায্য করে।

শিশুদের এই অবস্থা সম্পর্কে একজন ফরাসি মনোবিজ্ঞানী, অঁরি পিয়েরোঁ (১৮৮১-১৯৬৪), ভারি সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন:

A child, at birth, is a candidate for humanity; it cannot become human in isolation; but has to learn to become a man in contact with other men.[1]

অর্থাৎ, পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে সে মানুষ হতে এসেছে, কিন্তু একা একা সে মানুষের গুণাবলি আয়ত্ত করতে পারবে না। সমাজই তাকে মানুষ বানাবে (কিংবা অমানুষ)!

সত্যিই তাই। জন্ম নেওয়ার সময় কোনও মানসিক ক্ষমতাই তার থাকে না। এমনকি শব্দগত জ্ঞাপনের প্রাথমিক ক্ষমতাও নয়। জন্মের পরে একটা শিশু যখন কাঁদে— আসলে আমরা বলি কান্না— সেটা কিন্তু সত্যিই কান্না নয়। সে একরকম শারীরিক আওয়াজ, চিৎকার, কোনও অসুবিধায় জীবগতভাবে সাড়া দেওয়ার লক্ষণ। সদ্যোজাত শিশুটি তার মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বাইরে এসে নতুন পরিবেশে অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করাতেই সেই আওয়াজ বেরোয়। তার আগে, মাতৃগর্ভে কোনও শিশুই আওয়াজ করতে পারে না, কেন না, শব্দের অবলম্বন বা মাধ্যম, হাওয়া, সে পায় না। তার শ্বসনক্রিয়া সম্পন্ন হয় পরোক্ষভাবে, মায়ের রক্ত থেকে অক্সিজেন নিয়ে। আবার, এই চিৎকারের মাধ্যমেই শিশুটির ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, অন্তঃকর্ণ, ইত্যাদি থেকে ভ্রূণকালের তরল পদার্থগুলি বেরিয়ে যায়। তার আগে অবধি কিছুই সে শুনতেও পায় না। খায়-দায়, রেচন করে, আর ঘুমায়। মা মাসি পিসি ঠাকুমা দিদিমারা তাকে তখন যতই মনভুলানো গান বা ছড়া শোনান না কেন, সে হাসেও না, শুধু চেয়ে থাকে।

কিন্তু এক মাসের মধ্যেই নবজাতকের সেই চিৎকারটা কান্নায় পরিণত হয়, অর্থাৎ, এক ধরনের জ্ঞাপন শুরু হয় শিশু ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, প্রধানত মায়ের সঙ্গে। এবং/অথবা তার এবং তার তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যে। খিদে পেলেই সে যখন চিৎকার করে, মা এসে তাকে স্তন্যপান করান। ক্ষুধার অনুভূতি দুর্বল হতে থাকলে সে কান্না থামিয়ে দেয়। আবার অন্য কোনও অসুবিধা হলেও সে যখন কাঁদে, তার মা বাবা বা অন্য কেউ এসে তাকে ধরেন, কাঁথাকাপড় পালটে দেন, গরম লাগছে মনে হলে পাখার হাওয়া দেন, কিংবা, শীত করছে বুঝলে গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেন, তাঁর কান্না থেমে যায়। এই সময় থেকে ধীরে ধীরে চিৎকারটা আর নিছক আওয়াজ নয়, তার তাৎপর্যে একটা তফাৎ ঘটে গেছে। কান্নার আকারে সেটা একরকম অর্থবহ উদ্দেশ্যমুখী ক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। দাবি পেশ এবং আদায়। একেবারে আদি বুনিয়াদি পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক জ্ঞাপনের সূচনা হয়েছে। এখন থেকে শিশুকে তার পরিচিত কেউ কোলে নিলে, মশারি থেকে বের করে আনলে, ঘরের বাইরে নিয়ে গেলে সে খুশি হয়, হাসে। আর এর উল্টোটা করলে সে কাঁদে।

তিন মাস থেকে শুরু করে কম বেশি এক বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটি শিশুই মুখ দিয়ে একরকম একঘেয়ে শব্দ বের করে। তখন সে একটু একটু করে আশপাশের লোকজন, মা বাবা ও অন্যান্যদের বহুব্যবহৃত দুচারটে শব্দ— যেমন, তাকে যেসব নামে ডাকা হচ্ছে— বুঝতে পারে। কিন্তু বলতে পারে না। কেন না, তখনও তার স্বরযন্ত্রটি তৈরিই হয়নি। ধ্বনিকারক পেশিগুলির সঙ্গে বাক্‌সঞ্চালন কেন্দ্রের এবং বাক্‌সঞ্চালন ও বাক্‌শ্রবণ কেন্দ্রদ্বয়ের পরস্পরের মধ্যে তখনও পর্যন্ত প্রত্যক্ষ স্নায়বিক সংযোগ স্থাপিত হয়নি। এই সময়কার শব্দকে বলা হয় আবোলতাবোল (babbling/lallation)। এই শব্দগুলি উৎপাদন করে করেই ধ্বনিকারক পেশিগুলি কম্পন ও আন্দোলনে অভ্যস্ত হতে থাকে। মস্তিষ্কের সঙ্গে এদের স্নায়বিক যোগাযোগ স্থাপিত ও পাকাপোক্ত হতে থাকে। এই সময়কার কম্পন ও আন্দোলনে কোনও সুনির্দিষ্ট ছন্দ নেই। কম্পাঙ্ক ও বিস্তার অনিয়মিত ও এলোমেলো। তাই এই সময় স্বনিম (phoneme)-ও উৎপন্ন হতে পারে না। কিন্তু তার জন্য শারীরিক প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে।

এক বছর বয়সে বা কিছু আগে পরে একটি মানবশিশু প্রথমে দু-চারটে শব্দ বলতে শুরু করে। যারা মূক এবং/অথবা বধির তাদের সমস্যা এই সময় থেকেই ধরা পড়তে থাকে। এই দুটো সরাসরিভাবে একে অপরের সঙ্গে কারণ-কার্য সম্বন্ধে আবদ্ধ। কোনও শিশুর ব্রোকার অঞ্চলের ক্ষতির জন্যই হোক, বা স্বরযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্যই হোক, সে নিজে কথা বলতে না পারলে তার হ্বার্নিকের অঞ্চল কোনও অভ্যন্তরীণ বাক্‌-সংবেদন লাভ করবে না। তার ফলে শ্রবণব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে থাকে। আবার যে শিশুর শ্রবণযন্ত্র বা মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত সে ধ্বনিবহ শব্দ শুনতে না পারার ফলে পরিবারের ভাষার স্বনিম উচ্চারণ করতে শেখে না। এর দরুন তার স্বরযন্ত্র কী কী শব্দ উৎপাদন করতে হবে তার কোনও নির্দেশ পায় না। কালক্রমে সে বোবা হয়ে যায়।

কিন্তু স্বাভাবিক শিশুর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্নায়বিক সংযোগ সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর এক বছর বয়সের কাছাকাছি সময় থেকে তার স্বরযন্ত্র চারদিক থেকে শোনা ধ্বনিবহ শব্দগুলির কিছু কিছু উৎপাদনের চেষ্টা করতে থাকে। স্বভাবতই যে সমস্ত শব্দ সে চারপাশে শোনে, তার মধ্যে যেগুলির পরিসংখ্যা বেশি এবং তুলনামূলকভাবে উচ্চারণ করা সহজ, সেগুলোই সে বলতে চেষ্টা করে। যেমন, মা বাবা মাসি পিসি দাদু দিদা দাদা দিদি ম্যাও ঘেউ ইত্যাদি। আমরা বাংলা ভাষার কথা বলছি। অন্য ভাষার ক্ষেত্রেও একইরকম ব্যাপার ঘটে।

এখানে দুটি জিনিস লক্ষণীয়।

প্রথমত, প্রথমদিকে বেশিরভাগ শব্দই শিশুটি পরিষ্কার উচ্চারণ করতে পারে না। বিশেষ করে দুই ব্যঞ্জনের যুক্তাক্ষর বা যুক্ত উচ্চারণ। তাতে নানা ধরনের অস্পষ্টতা থাকে। এর অর্থ হল, স্বর-উৎপাদক পেশিগুলির স্পন্দন পুরোপুরি নিয়মিত, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুসংযোজিত হতে এবং জিহ্বার সঠিক অভিসরণ আয়ত্ত করতে অনেক সময় লাগে। দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত শব্দ স্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবে সে বলে তার সবগুলোর অর্থ তার কাছে পরিষ্কার নয়। অর্থাৎ, কোন শব্দের সঙ্গে কোন বস্তু বা ঘটনার পরিমেল, তা সে সব সময় ধরতে পারে না। তার জন্য আরও সময় লাগে।

এই পর্যায় থেকে শিশুটি চারদিকের নানা লোকজন ও জিনিসপত্র থেকে নিজের অস্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন হতে শুরু করে। স্নায়ুবিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক তথা সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাগত আদানপ্রদান (transaction) করতে করতেই, অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সংবেদন লাভ ও আনুষঙ্গিক অঙ্গ সঞ্চালন করতে করতে একটা শিশুর স্বসত্তা (self-identity/personality)-র বিকাশ ঘটে, পরিবর্তন হয়, তার মধ্যে ভালমন্দ সুখদুঃখ আরামকষ্ট ইত্যাদির অনুভূতিগুলি স্পষ্টতা লাভ করে, চারপাশের লোকজন ও বস্তুজগতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, সম্পর্ক স্থাপন চলতে থাকে।

ঠিক এই সময় থেকেই মন জন্ম লাভ করে।[2]

বর্তমানে জানা গেছে, বাইরে থেকে প্রাপ্ত সংবেদনে সাড়া দিতে গিয়ে মস্তিষ্ক ক্রিয়া করার মধ্যে দিয়েই শিশুমস্তিষ্কের উচ্চতর অংশগুলি গঠিত, বিকশিত ও ক্রিয়াশীল হতে থাকে। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, জন্মমুহূর্তে সদ্যোজাত শিশুর গুরুমস্তিষ্কের কর্টেক্স প্রায় অগঠিত অবস্থায় থাকে। জন্মের পর থেকে গুরুমস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলির কোষদেহ উপরের এবং বাইরের দিকে বিন্যস্ত হয়ে কর্টেক্স বা আবরণী তৈরি করতে থাকে এবং স্নায়ুতন্তুগুলি গুরুমস্তিষ্কের নিচের বাকি অংশ গঠন করে। তখন পর্যন্ত গুরুমস্তিষ্কের সমস্ত কোষই অবিশেষায়িত। তারপর পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া করতে করতে এবং বিশেষ বিশেষ ইন্দ্রিয় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে বিশেষ ধরনের সংবেদন বিশেষ বিশেষ জায়গার কোষগুলিকে উদ্দীপিত করার মাধ্যমে সেই সেই অনুভূতি গ্রহণক্ষম ও তাতে সাড়া দেবার নির্দেশক্ষম করে তোলে। স্নায়ুবিজ্ঞানী জোসে দেলগাদো (১৯১৫-২০১১)-র মতে, “এইদিক থেকে বলা যায় যে বিকাশমান মস্তিষ্কের মধ্যে স্নায়ুকোষগুলির কাঠামোরূপেই যেন বাইরের পরিবেশ সন্নিবদ্ধ হতে থাকে।”[3]

তাহলে একটি মানবশিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যে দুটি পর্ব দেখতে পেয়েছি। একটি হল বাক্‌পূর্ব স্তর (preverbal stage) আর তারপরে এল সবাক্‌ স্তর (verbal stage)। শারীরিক কোনও বিপর্যয় থেকে বাক্‌শক্তি না হারালে এই পর্বেই সে আমৃত্যু থেকে যাবে। সবাক্‌ স্তরের প্রথমদিকে শিশুদের ভাষায় শব্দভাণ্ডার থাকে দুর্বল। যে সমস্ত শব্দ সে বলতে শিখছে, তারও বেশিরভাগেরই সঠিক ব্যবহার সে তখনও জানে না। তাই ধাপে ধাপে অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন ও উচ্চারণ তার পক্ষে তখনও সম্ভব নয়। এই অবস্থাটা হল জ্ঞানন-পূর্ব (precognitive) স্তর। এই সময়ে সে হয়ত একটা মাত্র শব্দ দিয়ে একটা বাক্য বোঝাতে পারে। যেমন ধরা যাক, সে হয়ত বলছে “ভাত”। ভাল করে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সে সম্ভবত বলতে চাইছে, “আমাকে ভাত দাও”। এরকম একটা পূর্ণ অর্থবহ বাক্য বলার জন্য তার যে ভাষাজ্ঞান এবং ব্যাকরণবোধ দরকার, কর্তা কর্ম ক্রিয়ার আপেক্ষিক অবস্থান এবং রূপভেদগুলি জানা দরকার, সেটা সে এখনও আয়ত্ত করেনি। শুধু ক্ষুধার অনুভূতির সঙ্গে ভাত পাওয়া ও খাওয়ার অর্থে শব্দটার সম্পর্ক সে ধরতে পেরেছে। সুতরাং এই বয়সের শিশুদের উচ্চারিত অধিকাংশ শব্দই হল বাক্যের অস্পষ্ট বা অবিকশিত রূপ।

দেড় থেকে দুবছরের মাথায় গিয়ে মানবসন্তান তার পরিবেশ থেকে বেশ কিছু শব্দ শিখে ফেলে। শব্দগুলোর সঙ্গে বাস্তবের সম্বন্ধ অনুভব করতে পারে এবং শব্দের ব্যবহার ও বিভিন্ন শব্দের পারস্পরিক ব্যবহারিক সম্পর্ক শিখতে থাকে। ছোট ছোট বাক্য গঠন করতে পারে। তিন বছর বয়সের কাছাকাছি গিয়ে সে ভাষার মাধ্যমে কিছু কিছু বিষয় বেশ গুছিয়ে জ্ঞাপন করতে চেষ্টা করে। এই বয়স থেকে তার দেশ-কাল বোধ গড়ে উঠতে শুরু করে। সে দূরত্ব, উচ্চতা, গভীরতা ইত্যাদি বুঝতে শেখে। বেশি উঁচু বা খুব গভীর কিছু দেখলে সে ভয় পায়। এখন সে প্রবেশ করেছে জ্ঞানন (cognitive) পর্যায়ে। আবারও বলি, শারীরিকভাবে পঙ্গু না হলে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মানুষ এই জ্ঞানন পর্যায়েই অবস্থান করে। যদিও শিক্ষাগত অর্জনের দিক থেকে এর মধ্যেও আবার যুক্তিপূর্ব (pre-rational) স্তর, যুক্তিপূর্ণ (rational) স্তর, ইত্যাদি বৌদ্ধিক বিকাশের একাধিক স্তর ভাগ করা যায়।

শিশুরা সবাক্‌ স্তরে প্রবেশের সঙ্গে শুনে শুনে খুব দ্রুত নতুন নতুন শব্দ আয়ত্ত করতে পারে। এক বা একাধিক ভাষায়। শুধু শুনবার ও বলবার অনুকূল বাতাবরণ থাকা চাই। “একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে— একটি শিশু এক বছর বয়সে জানত তিনটি শব্দ, দুই বছরের মাথায় সে ২৭২টা শব্দ শিখে ফেলেছে। ম্যাক্‌কার্থি দেখেছেন, শিশুদের ব্যবহৃত শব্দসংখ্যা ১৮ মাসে ২০টা থেকে বেড়ে ৫০ মাসে ২৩০টা হয়। স্মিথের মতে, ৬ বছর বয়সের মাথায় শিশু প্রায় ২৫০০ শব্দ শিখে ফেলতে পারে। ক্রাউট দেখিয়েছেন— শিশুদের শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির সময়ে বছরে তারা গড়ে প্রায় ৬০০টি করে নতুন শব্দ শিখতে পারে।”[4]

নতুন নতুন শব্দ শিখতে পারার ফলে শিশুদের ভাষাজ্ঞানও দ্রুত বর্ধিত হয়। ভাষাশিক্ষার অগ্রগতির সঙ্গে শিশুদের চিন্তা করার ক্ষমতার উচ্চমাত্রার একটা ধনাত্মক সহসম্পর্ক (positive correlation) দেখা যায়। ভাষাজ্ঞান যত বাড়তে থাকে, চিন্তনক্ষমতাও ততই বিকশিত হতে থাকে। যখন সে বাক্‌পূর্ব স্তরে আছে তখন তার মধ্যে চিন্তাশক্তির কোনও স্ফূরণই হয়নি। তখনও তার অবস্থান অনেকটা প্রাক্‌মানব স্তরে। এই সময়কার একটি মানবশিশুর সঙ্গে সমবয়স্ক বানরের বাচ্চার জটিল কাজ করার ক্ষমতায় খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। বরং কিছু কিছু কাজ বানরের বাচ্চা একটু বেশি দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে। কারণ, তার মস্তিষ্ক তখনই অনেকটা পরিণত। যদিও মানবশিশুর তখন পর্যন্ত অপরিণত মস্তিষ্কের বিকাশের যে বিরাট সম্ভাবনা বিদ্যমান, বানরশাবকের মধ্যে তার কিছুই নেই। তার মস্তিষ্ক বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরের কাছে তখনই প্রায় পৌঁছে গেছে। আর মানবমস্তিষ্ক তখন নির্মীয়মান।

কিন্তু যেই শিশুটি সবাক স্তরে পৌঁছায়, অমনি বাঁদর বাচ্চার সঙ্গে তার একটা গুণগত পার্থক্য ঘটে যায়। একটা যেন উল্লম্ফন ঘটে। শব্দের বিমূর্ত সঙ্কেত তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপে একটা বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। আর যখন সে জ্ঞানন পর্যায়ে উন্নীত হয় তখন থেকে গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি ও কল্পনাশক্তি পাল্লা দিয়ে বিকাশ লাভ করতে থাকে। তার ফলে শিশুটি ধীরে ধীরে যুক্তি দিয়ে কাজ করা, চিন্তা করা, স্মৃতি বা পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে এবং ভবিষ্যৎ ফলাফল কল্পনা করে কোনও নতুন জিনিস গ্রহণ ও বর্জন করা, ইত্যাদির ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ভাইগতস্কি বলেছেন:

অন্যান্য প্রাণীর অভিযোজন ও বিকাশের সঙ্গে মানুষের অভিযোজন ও ঐতিহাসিক বিকাশের যে পার্থক্য, সেইরকমই গুণগতভাবে পশুপাখির আচরণ থেকে… মানুষের আচরণ একদম আলাদা। কেন না, মানুষের মনের বিকাশ তার সমগ্র ঐতিহাসিক বিকাশের প্রক্রিয়ারই অংশ।… মানুষের আচরণের বিশেষত্ব হল কৃত্রিম সাঙ্কেতিক উদ্দীপক, প্রধানত এক ব্যাপক ভাষা সঙ্কেত তন্ত্র তৈরি করার ক্ষমতা, যার সাহায্যে সে মস্তিষ্কের সঙ্কেত গ্রহণ প্রক্রিয়াকেই নিয়ন্ত্রণ করে। পশু এবং মানুষ উভয়ের মস্তিষ্কেরই মূল এবং সাধারণ কর্মরীতি হল সঙ্কেত গ্রহণ, কিন্তু মানবমস্তিষ্কের মূল এবং সাধারণ কর্মরীতি, যা দিয়ে পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য নিরূপিত হয়, সেটা হচ্ছে সঙ্কেত আরোপন (signification), অর্থাৎ, চিহ্ন তৈরি ও ব্যবহার।… সঙ্কেত আরোপন হল চিহ্ন বা কৃত্রিম সঙ্কেত নির্মাণ ও ব্যবহার।[5]

এই কৃত্রিম সঙ্কেতগুলি মানুষ প্রজাতিগতভাবে তার সমগ্র জৈব সাংস্কৃতিক ধারায় সৃষ্টি করে চলেছে। একজন ব্যক্তিমানুষও তেমনই শিশু বয়স থেকে ধীরে ধীরে পারিপার্শ্বিক সমাজ পরিমণ্ডল থেকে তা আয়ত্ত করে। শুধু জৈব বৈশিষ্ট্য হিসাবে নয়— কেন না, শিশু কোন ভাষা শিখবে সেটা জীবগতভাবে নয়, সামাজিকভাবে নির্ধারিত হয়। বাঙালি পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশু বাংলা শিখবে, আবার হিন্দিভাষী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশু হিন্দি শিখবে। সেই বাঙালি পরিবারটি যদি পুনায় থাকে, সেখানে জন্মগ্রহণ করার পরে শিশু ঘরে বাংলা এবং বাইরে থেকে মারাঠি শিখতে থাকবে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে। আবার শুধু অনুকরণ হিসাবে নয়— কেন না, কোনও শিশুই তার পরিবারের লোকদের কথার একেবারে হুবহু পুনরাবৃত্তি করতে শেখে না। সামান্য হলেও তফাত হতে থাকে। এই শেখার প্রক্রিয়াটাও সৃজনশীল। সামাজিকভাবে সামনে উপস্থিত কৃত্রিম ভাষা-সঙ্কেতগুলিকে সৃজনশীলভাবে আয়ত্ত ও ব্যবহার করতে করতেই একটি শিশু ধীরে ধীরে চিন্তন ক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

এই বিষয়টা একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে ভাইগতস্কি বুঝিয়েছেন।

একটা বাক্‌পূর্ব স্তরে থাকা শিশুর কথা ভাবা যাক। সে তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বল হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে। এটা একটা বিশুদ্ধ দৈহিক ক্রিয়া, পেশিসঞ্চালন। এ ছাড়া এর মধ্যে আর কোনও তাৎপর্য নেই। এবার একজন ব্যক্তি এসে হয়ত শিশুটির কাণ্ড দেখে বলটা তার হাতে ধরিয়ে দিলেন। এর পর বলটা আবার হাতছাড়া হয়ে গেলে শিশুটি আবারও সেটা হাত বাড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করবে। না পারলে চেঁচামেচি জুড়ে দেবে।

ব্যাপারটা কি এখনও একই রইল?

না। ভাইগতস্কি বললেন, দ্বিতীয় একজন যুক্ত থাকার ফলে একই শারীরিক ক্রিয়ার এখন একটা ভিন্ন তাৎপর্য দেখা দেবে। এখন এই বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় হাত নাড়ানোর মধ্যে একটা আন্তর্ব্যক্তিক জ্ঞাপন (interpersonal communication) ঘটে গেল। শিশুটি যেন বয়স্ক ব্যক্তিকে বলটা তুলে এনে দিতে নির্দেশ দিচ্ছে। এটা একটা সামাজিক অন্তর্ক্রিয়া (social interaction)। শিশুটির মতো সেই বয়স্ক ব্যক্তিও হয়ত জানেন না, তিনি এই বলটা কুড়িয়ে এনে দিয়ে শিশুটির জীবনে এক নতুন নাটকের সূত্রপাত করে ফেললেন। এর পর শিশুটি আরও নানা ক্ষেত্রে, নানা ব্যাপারে, নানা ব্যক্তির সঙ্গে এই একইরকমের জ্ঞাপন করতে থাকবে।

শিশুটি সবাক্‌ স্তরে পৌঁছনোর পরে এই ব্যাপারটা আরও বৈচিত্র্য ও গতিবেগ অর্জন করবে। তখন তার সঙ্গে আশপাশের লোকজনের যত আন্তর্ব্যক্তিক জ্ঞাপন হতে থাকবে, যতই সে সামাজিক আদানপ্রদান ক্রিয়ার মধ্যে ঢুকবে, ততই সে নিজে আরও ভাষা শিখে নিয়ে এই প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং করতে থাকবে। শিশুটি একটি ভাষা-পরিবেশের মধ্যে রয়েছে। এটা তার কাছে বাহ্যিক ভাষা বা সামাজিক ভাষা (social speech)। এর মধ্যে থেকে সে একটা-দুটো করে শব্দ শিখছে, বলছে— প্রথম প্রথম হয়ত অনেকবার ভুলভাবে উচ্চারণ করছে— আর অন্যরা তাকে খুব উৎসাহ দিচ্ছে, প্রশংসা করছে, আদর করছে। তার কৃতিত্বের জন্য তাকে পুরস্কৃত করছে। তার ফলে সে শব্দগুলো বারবার বলে বলে সংশোধনের চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং এক সময় সঠিক উচ্চারণ শিখে ফেলছে। এইভাবে সে সামাজিক ভাষার এক একটা স্বনিম, শব্দ, বাক্য, বাক্যাংশ এবং নানারকম কথনভঙ্গি ধীরেসুস্থে নিজের মধ্যে ব্যক্তিকৃত করছে, স্বান্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে। তার ফলে চিন্তা করতে শিখে ফেলছে।

এই প্রসঙ্গে ভাইগতস্কির ব্যাখ্যা হল:

আমরা অন্যদের মধ্যে দিয়েই আপন সত্তা নির্মাণ করি। এটা শুধু আমাদের সমগ্র ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গে নয়, এমনকি প্রতিটি আলাদা আলাদা মানসিক ক্রিয়ার প্রসঙ্গেও সত্য।… প্রতিটি উচ্চতর মানসিক ক্রিয়াই বাইরে থেকে শুরু হয়, কারণ শুরুতে সেটা একটা সামাজিক ক্রিয়া হিসাবে থাকে।… শিশুর মধ্যে এই [সামাজিক ক্রিয়ার ব্যক্তিকরণের] তিনটি ধাপ লক্ষ করা যায়। প্রথমে শব্দের একটা অর্থ, অর্থাৎ, বাস্তবের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে হবে।… তারপর শব্দের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ককে ধরে কোনও বয়স্ক ব্যক্তি শিশুর সঙ্গে জ্ঞাপন মাধ্যম হিসাবে সক্রিয়ভাবে আচরণ করবেন। তার ফলেই শব্দটি শিশুর কাছেও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর মানে হল, শব্দটির বাস্তব অর্থ অন্যদের কাছে আগে থেকে থাকলে তবেই শিশুটির জন্যও তা অর্থপূর্ণ হবে। বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুর মধ্যে সমস্ত ভাষা সংযোগই পরবর্তীকালে মানসিক ক্রিয়ায় পরিণত হয়।[6]

এর ভিত্তিতেই তার সিদ্ধান্ত: “সমস্ত মানসিক ক্রিয়াই সামাজিক প্রক্রিয়া সমূহের স্বান্তর্ভুক্ত পরিণতি।” অর্থাৎ,

…man’s psychological nature is a totality of social relations which have been transferred within and have become functions of the personality and forms of its structure.[7]

সরলতর ভাষায় বলা যেতে পারে, সামাজিক ভাষা ও ভাষাশ্রিত সংস্কৃতি আত্মস্থ করার মধ্যে দিয়েই ব্যক্তিমনন গড়ে ওঠে ও বিকাশ লাভ করতে পারে।

এই কারণেই স্নায়ুবিজ্ঞানী ও ভাষাবিজ্ঞানীরা অধিকাংশই মনে করেন, মানুষের ভাষাশিক্ষা ও চিন্তনক্ষমতা সম্ভাবনার অর্থে সহজাত হলেও সম্ভাবনার বাস্তবায়নটা আপনাআপনি ঘটে না। তার জন্য প্রয়োজন সমাজ পরিবেশ থেকে শিশুমস্তিষ্কে নিরবচ্ছিন্ন ভাষাগত সংবেদনপ্রবাহ প্রেরণ। দেলগাদোর ভাষায়:

The potential of verbal communication is not enough to learn to talk, and it is necessary to be repeatedly exposed to sensory inputs from an environment which includes family and friends. The baby brain does not invent language nor can it choose to learn English or Chinese. It is entirely dependent on information which must come from the outside.[8]

কোনও শিশু যদি দুর্ঘটনাবশত মানবসমাজের বাইরে বড় হয়ে ওঠে তবে মানুষের আকার পেলেও আচরণগত কোনও মানবিক বৈশিষ্ট্যই সে লাভ করবে না। কথা বলা তো দূরের কথা, এমনকি সোজা হয়ে দাঁড়াতেও শিখবে না। পক্ষান্তরে, শিশুটি বাংলা শিখবে না তামিল, নাকি দুটোই, তাও নির্ভর করবে তাকে কী অথবা কী কী ভাষাগত উদ্দীপকের মধ্যে থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে তার উপর। কিছু কিছু পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, খুব অল্প বয়সেই, হয়ত সবাক স্তরের শুরু থেকেই, শিশুদের এক বা একাধিক ভাষা বলতে এবং সঠিক উচ্চারণ করতে শেখানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন পারিবারিক ভাষা-পরিবেশের পাশাপাশি স্পষ্ট উচ্চারণযুক্ত আবৃত্তি ও গানের রেকর্ড দিয়ে নির্মিত একটি অতিরিক্ত এবং কৃত্রিম ভাষা পরিবেশ সংযোজন। এর দ্বারা কঠিন শব্দ, এমনকি যুক্তাক্ষরও খুব ভালভাবে বলতে শেখানো সম্ভব। এই ব্যবস্থা একাধিক ভাষার জন্য করতে পারলে, যে যে ভাষার জন্য করা হবে, শিশুটিও সেই সেই ভাষাই আয়ত্ত করে ফেলবে।

যদিও একথার অর্থ এই নয় যে দরকার না থাকলেও প্রতিটি শিশুকেই দুটি বা তিনটি ভাষা শেখাতেই হবে।

অনেকে মনে করেন, শিশুর মনের বিকাশের শুরুতে বাহ্যিক সংবেদন আবশ্যক হলেও বয়স্কদের জন্য তা আর তেমন জরুরি নয়। যেমন, প্রাচীনকালে তো বটেই, এখনও কেউ কেউ দাবি করেন, নিবিষ্ট ধ্যানের দ্বারা মনকে বাইরের সমস্ত প্রক্ষোভ থেকে মুক্ত রাখতে পারলে খুব গভীর চিন্তা করা এবং গূঢ় তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন, ব্যাপারটা একেবারেই সত্য নয়। পরীক্ষাগারে কয়েকজন ব্যক্তিকে মাত্র তিন ঘন্টা দর্শন ও শ্রবণ সংবেদন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দেখা গেছে, সুস্থ ও সবল মনের অধিকারী ব্যক্তিও এতে মানসিক অস্বস্তি অনুভব করতে থাকেন, নানা ধরনের উল্টোপাল্টা ছবি বা চিন্তা তাদের কল্পনায় হানা দিতে থাকে, কেউ কেউ ভীত হয়ে পড়েন, কারও দিব্যানুভূতি হয়, ইত্যাদি।

বাস্তবেও আমরা জানি, জেলে যে সব অপরাধী বা রাজনৈতিক বন্দিকে দীর্ঘদিন নির্জন কক্ষে রাখা হয়, তাদের অনেকেরই মানসিক জোর কমে যায়, কেউ কেউ পাগল হয়ে যায়। একজন পোড়খাওয়া রাজবন্দিও এই অবস্থায় বেশিদিন থাকলে দিশাহারা, অস্থিরচিত্ত বা আদর্শভ্রষ্ট হয়ে পড়তে পারেন, যদি তাঁর মনোবল খুব শক্তিশালী না হয়। কেন না,

মস্তিষ্কের কার্যকলাপ যে বহির্পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সংবেদনপ্রবাহের উপর নির্ভরশীল, সেটা শুধু শৈশবে নয় সারাজীবন ধরেই থাকে। বহির্জগৎ থেকে সংবাদপ্রবাহের অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিক মনন ধরে রাখা যায় না। বয়স্ক লোকের অতীত অভিজ্ঞতা ও অর্জিত দক্ষতার যতই সম্পদ থাকুক না কেন, তার মস্তিষ্কের পক্ষে শুধু তাই দিয়ে সংবেদনবঞ্চিত অবস্থায় চিন্তনপ্রক্রিয়া ধরে রাখা সম্ভব নয়। একক ব্যক্তির মনন কখনওই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।[9]

এত সব আলোচনার শেষে একটা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গেলে হয়ত সপ্তকাণ্ড রামায়ণ পাঠের পর জনৈক শ্রোতার জিজ্ঞাসা— “সীতা কার বাবা”— সেইরকম কিছু মনোভূমিকম্প ঘটানোর মতো প্রশ্ন উঠে যেতে পারে।

প্রশ্নটা হল: মন ব্যাপারটা তাহলে কী?

প্রথমেই বোঝা দরকার, মন কোনও জিনিস নয়, দ্রব্য নয়, মন একটা ক্রিয়াত্মক সত্তা। এই বিষয়টা নিয়ে দর্শনের প্রেক্ষিতে আমরা গোড়ার দিকে কিছুটা আলোচনা করেছিলাম। এখন প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকেই কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে। গতি যেমন একটা গতিশীল বস্তুর ক্রিয়াত্মক সত্তা, প্রাণ যেমন জীবন্ত বস্তুর একটা ক্রিয়াত্মক সত্তা, মনও তেমনই বস্তুনির্ভর হলেও কোনও বস্তুসত্তা নয়, এ হচ্ছে সচেতন মানুষের মস্তিষ্কের তরফে একটি ক্রিয়াত্মক সত্তা। দেলগাদোর অনুপম ভাষায়,

…the mind is a functional entity which cannot be preserved in formalin or analyzed under the microscope. It is not autonomous but depends on the cerebral reception of a temporal sequence of phenomena and a continuous exchange of information with the environment in order to function properly…[10]

মনের সংজ্ঞাও বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাঁরা এইভাবেই নির্ধারণ করেন:

Because of its essential dependence on sensory inputs both at its birth and throughout adult life, the mind may be defined as the intracerebral elaboration of extracerebral information… The basis of mind is cultural, not individual.[11]

অর্থাৎ, মন এবং চিন্তা হল মানবমস্তিষ্কের এক বিশেষ ধরনের ক্রিয়া করার ক্ষমতা যা বহির্বিশ্ব বা প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে নিরন্তর সংবাদগ্রহণ ও তাতে সাড়া দিতে গিয়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণা-অভ্যাস-আচরণকে স্বাঙ্গীভূত করার সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে ও বিকশিত হয়।

 

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]


[1] Cited, Leontyev 1981, 135.
[2] Cantril and Livingstone. 1963.
[3] Delgado. 1965, 49.
[4] Prasad. 1979. 34-35.
[5] Vygotsky. 1966. 22-23 and 27.
[6] ibid, 43-44.
[7] ibid, 45.
[8] Delgado. 1965. 60.
[9] ibid, 61.
[10] ibid, 31.
[11] ibid, 27. emphasis added.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘ভাষা, চিন্তা মন’ একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লেখা।ওনার সর্বাভিমুখী বৌদ্ধিক বিকাশ সাধারণ মানুষের চিন্তা-ধারণা কে অনেকটা স্বচ্ছ ও ঋদ্ধ করে ।

Leave a Reply to Sukanta Das Ghosh. Cancel reply