ঘরের পাশে আর্শিনগর

ঘরের পাশে আর্শিনগর | বর্ণালী ঘোষ দস্তিদার

বর্ণালী ঘোষ দস্তিদার

 

নামটা চেনা নয়। চেহারা চেনার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ফেসবুকে ছবি দেখে জায়গাটা ভারি পছন্দ হয়ে গেল শমীর। মাটির কুঁড়ে ঘর। খোড়ো চাল। মোরামের রাস্তা ঢালু হয়ে গড়িয়ে চলে গেছে মেটাল রাস্তার থেকে। দূরে দূরে তাল -খেজুর পলাশ। শুকনো মাটিতে আমজামের ফলন সামান্যই । মাটির দেওয়ালের গায়ে সাঁওতাল শিল্পীদের আঁকা ফ্রেস্কো। কি অপরূপ রূপের বাহার। এসব জায়গায় নাগরিক উল্লাস নেই। চতুর্দিকে শান্ত  অনাবিল প্রকৃতি। ধূসর রুক্ষ প্রান্তরে ঢেউ খেলছে ঊষর অনুর্বর জমি আর নৈঃসঙ্গের শূন্যতা।

দুর্গাপুর ব্যারেজ পেরিয়ে ছাতনা হয়ে এসফল্টের কালো পথ ঢুকে গেছে বাঁকুড়া জেলার পেটের ভেতরে। গঙ্গাজলঘাটি কাশিপুর হয়ে পথ চলে গেছে খড়বোনা।খড়বোনা থেকে সিধুকানু মোড়। সেখান থেকে খানিক এগোলেই পুরুলিয়ার সীমানা ঘেঁষা প্রত্যন্ত গ্রাম “ঊষরডিহি”।

ডিঙি বললো সাঁওতালিতে “ডিহি” মানে দেশ বা ডাঙা। ডিহি থেকে ডি। “বুরুডি”। “মুরাডি”। “সাঁওতালডি”। পথে পড়ে “আড়ঢ়া” গ্রামের মোড়। লোকাল লোকজন বলে “আররা”। শমী বলে এ গ্রাম চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দরামের। সময়টা পাঠান আক্রমণের সমকালীন।ডিহিদার মামুদ শরীফের অত্যাচারে বিপন্ন হয়ে ভিটেমাটি ত্যাগ করে রাজা বাঁকুড়া রায়ের শরণ নিয়েছিলেন কবি মুকুন্দরাম।

গাড়ি চলছে। ফোন করল শমী। “আর কতোদূর?”

“এই তো প্রায় তো এসেই গেছেন… ছাতনা পেরিয়েছেন?”
“পেরিয়ে এসেছি ছাতনা। দুর্গাপুর ব্যারেজটা কেমন হয়ে গেছে ইন্দ্রজিৎবাবু।”
“কী আর  করা যাবে… এখন সব জায়গারই যে একই দশা… এখানে আসুন শান্তি পাবেন। লক্ষ রাখুন একটা মোবাইল টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমি।”

নাহ্… মোবাইল টাওয়ার আছে ঠিকই কিন্তু তার নীচে কেউ তো নেই। ফের ফোন করে শমী।

“ইন্দ্রজিৎবাবু……”
“আসুন আরও কয়েকগজ এগিয়ে আসুন…..”

‘চাষার বাসা’-র পাশটাতেই দাঁড়িয়ে ছিল ইন্দ্রজিৎ। ছোটখাট গড়নের হাল্কা পাতলা শরীর। একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে ঝলঝলে প্যান্ট আর ফুলহাতা সোয়েটার।

পিচঢালা রাস্তার ধারেই লোহার গেট। সেখান থেকেই গড়িয়ে নেমে গেছে মোরাম রাস্তা। ডানহাতে দাঁড়াল শমীদের দু’খানা গাড়ি। বেশ বড়োসড়ো দুধসাদা আর হাল্কা আকাশি রঙা। পাশেই দরমার  দরজা ভেজানো আস্তানা। শমীদের নিয়ে ইন্দ্রজিৎ চলে গেল ভেতরে।

“আসুন অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। আগে আপনাদের ঘরগুলো দেখে নিন। আমাদের ব্যবস্থাপনা খুবই সামান্য। যতটুকু না হলে নয় ততটুকুই।”
“আমাদেরও খুব বেশি কিছু চাহিদা নেই। শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতেই এরকম জায়গায় ছুটে আসা। দুদিন একটু নিরিবিলি তে আশ্রয় নিয়ে শান্তিতে কাটাতে চাই।” শমী জানায়।

দেখে খড় বাঁশ কাঠ মাটি ছাওয়া একটি ঘর। লাগোয়া বাথরুম। সাদামাটা কিন্তু সুবিধাজনক। গোটা অঙ্গনটিতে বাগান। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গাছের পাশেই আগাছা। আগাছা জমিকে জলদান করে পুষ্ট করে। খোলা জায়গায় ঘুরছে মোরগ মুরগি। তাদের ছানারা। রান্নাঘর -খাওয়ার জায়গা সর্বত্রই অনাড়ম্বর। বাহুল্যহীন। ছোট ছোট জায়গায় বাঁশ -কাঠ চাঁচারি দরমা মাদুরের কাঠামো দিয়ে আস্তানা করা হয়েছে। চতুর্দিকে উন্মুক্ত পলাশের জঙ্গল আর যতদূর চোখ যায় পাগল করা রিক্ততার ধূসর সৌন্দর্য। খেজুর নারকেল তাল আর পলাশ। পৌষমাস। ঘনঘোর শীতকাল। রহস্যের কুয়াশায় জড়িয়ে আছে দিগ্বিদিক প্রান্তর।খেজুর গাছে রসের কলসি বাঁধা। কাকভোরে কলসি কোথাও নামানো হয়েছে। হিমশীতল খেজুরের রসে স্নিগ্ধ হয় এলাকার মানুষের জীবন। প্রকৃতির শরীর থেকে অনায়াসে  প্রকৃতি জননীর দান সংগ্রহ করে নেওয়া যাবে। সেই লক্ষ্যেই তৈরি হয়েছে এই খামারবাড়ি।

প্রকৃতি তার অন্তহীন সৃষ্টির ভান্ডার সাজিয়ে রেখেছে তার সন্তানদের জন্য। আমরা দুর্ভাগা মানুষেরা তার অপব্যবহার করি সদ্ব্যবহার করতেই জানি না। এখানে ইন্দ্রজিতরা কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে মিলে প্রকৃতির পাঠশালা থেকে এই পাঠ গ্রহণ করছে। প্রকৃতির ভাঁড়ার থেকে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য ব্যবহার্য বস্তু সংগ্রহ করছে প্রকৃতিকে বিরক্ত এবং নষ্ট না করে। অনিঃশেষ প্রকৃতির অফুরান সম্পদে অবৈধ  লুঠতরাজ নৈরাজ্য না চালিয়ে কেমন করে তার অকৃপণ দান আকন্ঠ শোষণ করে সমৃদ্ধিহীন বৈভবহীন অথচ সহজ-সরল সুখী সমৃদ্ধ জীবনযাপন করা যায় ঊষরডিহি যেন তারই গবেষণাগার।

শমী লক্ষ করে “সিরজন খামার বাড়ি”-র শস্য তার নিজস্ব। রাসায়নিক সার ছাড়াই ধান হয়েছে। মোটা লাল চাল বস্তাবোঝাই। সারছাড়া গমে মিষ্টি রুটির স্বাদ। দানা খাওয়া মুরগিদের মাংসে ঝোলের আস্বাদ আলাদা। পুকুর থেকে ধরা মাছ আর বাগানের সব্জিতে অপরিচিত সুস্বাদ। কোনওকিছুতে যেন মেকি শহুরে স্বাদ নয়।

“আমরা একটু অতীতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছ… মানে অতীত থেকে ভালোটুকু সংগ্রহ করে জীবন-যাপনে কাজে লাগাতে চেষ্টা করছি। তোমার কেমন লাগছে শমীদি আমাদের এফর্ট?”

হঠাৎই ইন্দ্রজিতের মুখে শমীদি ডাক শুনে খানিক অবাক হয় শমী।

“অতীতের তো সবকিছুই ভালো হয় না। আবার সব যে মন্দ তা ও নয়… দুটোর মধ্যে ব্যালান্স করতে পারলে তো খুব ভালো কিছু রেজাল্ট পাবারই কথা।”
“আমাদের টার্গেট দূষণহীন বিশ্ব। নাগরিকতা থেকে দূরে গ্রামীণ পরিবেশে প্রকৃতিকে যতটা নিজেদের  মধ্যে গ্রহণ ও শোষণ করা যায়।”
“কিন্তু সবটা কি সেভাবে সম্ভব হবে? আধুনিক গ্যাজেট ছাড়া কতটা বাঁচতে পারব আমরা? এই যে তোমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করছ… তোমাদের আস্তানার পাশেই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল টাওয়ার… ইলেকট্রিক কনশাম্পশন হচ্ছে মানে এনার্জি ডেসট্রয়… সাবমার্সিবল পাম্প লাগিয়েছ… জলের সুবিধার জন্য…”
“না না শমীদি আমরা তো বিজ্ঞানকে, বৈজ্ঞানিক প্রসপারিটিকে পাস কাটিয়ে যেতে চাই না। সেটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব নেচারকে ব্যবহার করে জীবনকে সাজাতে। জীবনকে সমৃদ্ধ সুন্দর করে তুলতে। নেচারকে হত্যা করে নষ্ট করে তার বিপর্যয় ঘটিয়ে নাগরিক সভ্যতা যেভাবে আস্ফালন করে এগিয়ে চলে আমরা তার বিরোধিতা করছি।”
“হ্যাঁ। তার অবশ্য খুবই প্রয়োজন আছে। বাইরে থেকে কৃত্রিমভাবে ওষুধ রাসায়নিক প্রয়োগ করে জমির বিকৃতি ঘটানো, জলের নিজস্ব প্রাকৃতিক গুণকে নষ্ট করা… এর বিরুদ্ধে একটা সাসটেনেবল স্ট্রাগল খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।”
“কিন্তু ইন্দ্রজিৎ বড় পুঁজির সঙ্গে লড়াই করা কি অতই সোজা? কনজুমারিজম কি পাকে পাকে জাপ্টে ধরছে না আমাদের? তার চোখরাঙানি থেকে আমরা কতটা পারব নিজেদের মুক্ত রাখতে?”
“খুব কঠিন গো শমীদি। কিন্তু কঠিন হলেও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই……আমরা একটা চেষ্টা শুরু করেছি বলতে পার। একটা কঠিন লড়াই। তবে এই গ্রামে আমরা কিছুটা সাড়া ফেলতেও পেরেছি।”
“কী রকম?” শমী শুধোয়।
“এই যেমন ধরো এটা তো সাঁওতালপ্রধান গ্রাম। চোদ্দটি সাঁওতাল পরিবার। তারা নিজেদের মাতৃভাষাতেই  কথা বলে। স্কুল করেছি একটা। সাঁওতাল ছেলেমেয়েরাই নিজেদের ভাষা মাধ্যমে পড়ায়। পড়ায় এলাকার ছেলেমেয়েরা। আগে ফ্রি তেই পড়াত তারা।এখন টিচারদের আমরা মাসে চারহাজার টাকা বেতন দিতে পারছি।”
“কিন্তু হায়ার এডুকেশন নিতে কেউ যদি শহরে যায় তাদের কি কনজুমারিজম ছাড়বে?”
“কনজুমারিজম জোর করে ছাড়ানোর ব্যাপার নেই শমীদি…. আমরা ভাবি জেনারেশনটাকে যদি কনসাস করা যায় কনজুমারিমের ব্যাপারে……তাহলে এর কুফল সম্পর্কে তারা সতর্ক থাকতে পারবে। কনজুমারিজম আর পা মাথায় গ্রাস করে নেবে না তাদের।”

শমী আর ডিঙি ঘুরে দেখছিল এদিক সেদিক। এক টুকরো ছন্নছাড়া প্রকৃতিকে কিছুটা বেড়া দিয়ে বাঁধা হয়েছে। ছোট ছোট কুঁড়েঘরের তীর ঘেঁষে একফালি সরু ধুলোভরা পথ। গেরুয়া ধুলোয় রঙিন কিন্তু মলিন নয়। এত ধুলো চতুর্দিকে কিন্তু কোথাও এতটুকুও মালিন্য নেই। শমীর মনে পড়ে মর্ত্য পৃথিবীর  এই অমলিন ধুলোকে খুব ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতায় লিখেছেন “ধূলির তিলক পরেছি ভালে….”, মধুময় পৃথিবীর ধূলি…”।

নদীর মতো বয়ে যাওয়া পথে খালি পায়েই বহুদূর হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু শহুরে অভ্যাস তাদের। অবশ্য জুতো ছাড়া হাঁটা ডিঙির অভ্যাস ছিল একসময়। আদুল পায়ে  সাঁওতাল গ্রামের মধ্যে দিয়ে পারাপার করত একসময়। প্রায় তিরিশ বছর আগে এসেছিল পুরুলিয়ার মধুকুন্ডায় নিজের সাবজেক্টের ফিল্ড স্টাডি করতে। প্রায় পাঁচ পাঁচটা বছর এই এলাকা চষে বেরিয়েছিল। সাঁওতালদের পরিবারের  সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করতে করতে একসময় প্রায় ঝড়ের গতিতে সাঁওতালি ভাষা বলতেও পারত। সেও প্রায় কতদিন। আজ গাড়িতে আসতে আসতে পথে যখন মধুকুন্ডা স্টেশনটা দেখল টাইম মেশিনে চেপে মন পৌঁছে গেল তিরিশ বছর আগের পুরুলিয়ায়। মনে পড়ে গেল স্যারের সঙ্গে ফিল্ড করতে আসা। কী চমৎকার মানুষ ছিলেন ডঃ রেবতী মুখুজ্যে। কী স্নেহ! ছাত্রছাত্রীরা যেন তাঁর সন্তান। এমনিই গভীর ভালোবাসা। গ্রামবাংলায় এসে মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যেতেন মানুষটা। শীতের পড়ন্ত বেলায় জনজাতিদের হাতে লাল চালের ভাত খেয়ে যত্নে পেতে দেওয়া খাটিয়ায় শুয়ে রোদে পিঠ পেতে যখন অলস সময় যাপন করতেন তখন শহুরে জীবনের শ্রম ক্লান্তি অবসাদ যেন ধুয়ে যেত সব। তিরিশ বছর আগের বহু কথা বহু ঘটনা মনে পড়ে ডিঙির।

“কলকাতার লাইফ আর ভালো লাগে না রে শমী…”
“কী করবি? কলকাতা তো কর্মস্থল… ভালো লাগে। না বললে চলবে?”
“সেই তো হয়েছে মহা মুশকিল…”

এরা কিন্তু ভারি ভালো কাজ করছে এখানে। এ যেন প্রকৃতির অফুরন্ত ঐশ্বর্যকে নতুন করে আবিষ্কার করার অদম্য উৎসাহ। মৃত্তিকাকে নতুন করে জানা-চেনা। মাটির গভীর থেকে তার নিজস্ব স্পন্দনকে খুঁজে বাইরে আনা। প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন মানুষকে ফের প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে আনা। কি সুদৃঢ় সংকল্প এদের! ছোট ছোট ছেলেগুলোর কতই বা বয়েস। কিন্তু মনে আর চোখে স্বপ্নের কি গভীর মায়াকাজল। ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে এরা স্বপ্নকে সত্যি করতে। এত ভালো ভালো সব ছাত্র পারত না কি শুধু আত্ম-সুখের সন্ধানটুকু করে স্বার্থপরের মতো বাঁচতে? জীবনযাপন করতে? যেমন করে থাকে বাকি পাঁচজন। মাস গেলে মোটা টাকা মাইনে, গাড়ি-বাড়ি -ব্যাংকব্যালান্স বিদেশ ভ্রমণ… কিন্তু এরা কেন জানি কোন অজানাকে জানতে কোন আকাঙ্খাকে পূর্ণ করতে যেন পথে নেমেছে। সমাজ আর মানুষকে নিয়ে এক অন্য পথের সন্ধানে নেমেছে একদল যুবসমাজ।

“শাহেদ আজ চলে যাচ্ছে। দূর বাংলাদেশ থেকে এসে ছেলেটা কেমন একটি দিনেই মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল সব্বাইকে। কিন্তু ওকে আজ গ্রাম পরিক্রমা অসমাপ্ত রেখেই ফিরে যেতে হবে।  আজ তাকে রঙিন রুমাল উড়িয়ে বিদায় দেবার দিন।”

শমী মনে করায়…..

“বাংলাদেশের প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃত বাংলার আত্মাকে কে খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা যে সম্পদ যে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য হারিয়েছি ওরা তা সংরক্ষণ করেছে। সদাসর্বদা যত্ন করে লালন-পালন করে।”

এসব বিচিত্র কথা বলতে বলতে ইন্দ্রজিত আসে শমীর কাছে…

“তোমাকে তো আমরা কবে থেকেই চিনি শমীদি। তুমি আমাদের চিনতে পারোনি। তোমার ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না কোনওদিন।”
“আমাকে চেনেন অনেকদিন থেকে? কীরকমভাবে চেনেন ঠিক বুঝলাম না তো…” শমী জবাব দেয়।
“তোমার মনে নেই আমাকে। আমাদের কিন্তু সব্বার তোমাকে মনে আছে। সেই দিনগুলোতে যে মুষ্টিমেয় সহৃদয় মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিল পাশে ছিল পরোক্ষভাবে আমাদের স্বপ্নের শরিক ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম তুমি।”
“আবারও বুঝতে পারছি না আপনার কথা।” শমী বলে।
“শমীদি, আমাকে আপনি আজ্ঞে কেন করছ? আমরা একটা সময় তোমার বাড়িতে পড়ে থাকতাম… আমি, কাজল, তিথি, নির্মাল্য, অর্জুন, আঁখি……এদের কাউকে মনে পড়ছে না তোমার?”
“হ্যাঁ মনে পড়ছে… মনে আছে সব্বাইকেই। এরা কে কী করছে এখন? কেমন আছে সবাই? শিউপ্রসাদকে এখনকার দল কেমন নির্মমভাবে খুন করল। আর তারপরই সংগঠন এলোমেলো অগোছালো হয়ে গেল। নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে গেল।” শমী বলে।
“আমি তো এখানে এই কাজটাই করছি। গ্রামে এসে শিউপ্রসাদজীর স্বপ্ন সফল করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি অন্যভাবে। তবে এখন আর জনযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সমাজবদলের কথা রাষ্ট্র দখলের কথা নয়… জনজাতিদের জীবনের নিজস্ব সম্পদ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য স্বাতন্ত্র্য, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের আজন্ম অচ্ছেদ্য বন্ধনের জন্য কাজ করা– এগুলোই এখন আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। সেই ব্রতে সেই লক্ষ্যেই এখানে এসে জনজাতিদের সঙ্গে মিশে কিছু কাজ করার চেষ্টা করে চলেছি।” ইন্দ্রজিৎ জানায়।
“আর বাকিদের কী খবর কাজল তিথি আঁখি নির্মাল্য… এদের?”
“কাজল আর নির্মাল্য ব্যবসা করছে। আঁখি এনজিও র চাকরি, অর্জুন নেই। দুহাজার পনেরোয় এনকাউন্টারে খতম।”

এক নিমেষে বহু বছর অতীতে পিছিয়ে যায় শমী। তখন সদ্য পেয়েছে কলেজে চাকরিটা। মেয়ে তিতির বেশ ছোট। টু থ্রি হবে। আনন্দ তখনও বোহেমিয়ান জীবন যাপন করত। আজ পর্যন্ত ওকে কোনওদিনই ঘরমুখো করতে পারেনি শমী। সিনেমা বানাবে বলে মধ্যপ্রদেশে ক্রান্তিকারীদের ডেরায় ঢুকেছিল একবার। সে ও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। সহজে তাদের গোপন আস্তানায় তারা কাউকে ঢুকতে দেয় না অপরিচিত জনকে। অর্জুন ছেলেটা ঘনঘন বাড়িতে আসত। ওই বোধহয় শেষ পর্যন্ত আনন্দকে জঙ্গল মহলের গভীরে ঢোকার সুযোগ করে দেয়। সেই থেকে জানাশোনা। ক্রান্তিকারী দলের লোকেরা শহরে এসে গা ঢাকা দিত শমীর বাড়িতেই। কাউকেই তেমন ভালো করে চিনত না শমী। কিন্তু আনন্দর আব্দার……” শমী শ্রীনিবাসন দুদিন এসে এখানে থাকবেন। উনি ভেতরের ঘরটায় থাকবেন। সারাদিন পড়াশুনো করেন উনি। তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।”

ফের কদিন পর, “শমী রামানুজম আসবেন। কটা দিন থাকবেন। তোমার কোনও ঝামেলা হবে না। সাদাসিধে মানুষ। খাওয়া দাওয়ার কোনও বাছবিচার নেই। কদিন থেকেই চলে যাবেন।”

শমী কোনওদিন আনন্দকে জিগ্যেসও করেনি। জিগ্যেস করার প্রয়োজন অনুভব করেনি। কে রামানুজম, কে-ই বা শ্রীনিবাসন? কেন তারা আসবে? কোথা থেকে আসবে? তারা কী করে? তার বাড়িতেই বা কেন আসবে… কোনও প্রশ্ন জাগেনি মাথায়। কোনও সংশয় উঁকি দেয়নি মনে। কোনও নিরাপত্তার  আশঙ্কাও আকুল করেনি তাকে। শমী এর মধ্যেই তার নিয়মিত রুটিন চালিয়ে গেছে। কলেজের চাকরি, মেয়ের স্কুল শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশুনো, সংসারের যাবতীয়। একটি জবরদস্ত কাজের মেয়ে ছিল শমীর। অনেকটাই সামাল দিতো হাসিমুখে।

অবাধ গতিবিধি ছিল অর্ক সন্দীপ ঝিলিক মন্দার সবার। একটা পত্রিকা বেরোত মেয়েদের। মানবী তার নাম। শমী তার বেশ কটি সংখ্যায় লিখেওছে। একবার একটা সেমিনার হয়েছিল। শমী বক্তা। বিষয় ছিল “বঙ্গদেশ বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়”… অনেক কিছুই বলেছিল শমী নিজের অধীত প্রজ্ঞা অনুযায়ী। বলেছিল বাঙালি রক্তে অনার্য অস্ট্রিক প্রোটোঅস্ট্রালয়েড দ্রাবিড়দেরই প্রভাব ও মিশ্রণ বেশি।আর্য রক্ত প্রায় নেই বললেই চলে। বিপরীত শিবিরের একজন এসে ফালাফালা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল তার যুক্তি। আর্যরা যে আদতে বহিরাগত সেই তত্ত্বই তিনি মানতে চাননি। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সিনেমার মন্তাজের মতো শমীর চোখে সব ভেসে উঠতে থাকে।

একসময় প্রায় বছর বছর কুড়ি আগে খুব বড় অসুখ হয়েছিল শমীর। প্রায় দুরারোগ্য। ওই মানুষগুলোর গোপন যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল তখন। পরে শুনেছিল তাদের সবচেয়ে বড় নেতা সম্ভবত শিউপ্রসাদজীই নাকি বলেছিলেন “শমীদিকে আমরা জঙ্গলে আমাদের ডেরায় নিয়ে চলে যাব। দিদি ওখানেই বিশ্রাম নেবে। আমরা ওষুধবিষুধ সব শহর থেকে নিয়ে আসব। আর ডাক্তার হাসপাতাল এসব তো আমরা আদিবাসী এলাকায় করেইছি। কিছু অসুবিধা হলে দিদিকে সেখানে রাখব। দিদিকে আমরা কোলে করে আগলে রাখব।কোনও কষ্ট পেতে দেব না। দিদি আমাদের জন্য এত করেছে আর আমরা আজ অসুস্থ দিদির জন্য এতটুকু করতে পারবো না?”

তার অবশ্য আর দরকার হয়নি। বাসা বদল হতেই আর তারা বড় একটা আসত না। শহর থেকে শমী আর আনন্দ মাঝেমাঝেই খবর পেত পুলিশ এনকাউন্টারে শ্রীনিবাসন শেষ হয়ে গেছে। কার্তিককে জেলে পোরা হয়েছে তো হয়েছেই। কিছুতেই জামিন পাচ্ছে না কার্তিক। একবার  খবর পেল রামানুজমের স্ত্রীকে কিডন্যাপ করিয়ে নিয়ে গিয়ে মিলিটারি পুলিশ নাকি দারুণ অত্যাচার করেছে।

শমী ভাবতে থাকে এত ত্যাগ স্বীকারের সত্যিই কি কোনও অর্থ আছে? এই ঘরছাড়া সুখছাড়া শান্তিছাড়া প্রতিমুহূর্তে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে লড়াই করে প্রাণ হাতে করে নিয়ে  চলা আদর্শবাদী মানুষগুলোর স্বপ্ন পূরণ হবে কোনওদিন? কতকগুলো মানুষখেকো পুলিশ মিলিটারি জওয়ান সিআরপি দিয়ে গড়া রক্তচক্ষু রাষ্ট্রশক্তির কাছে ক্রান্তিকারীদের শক্তি কি নিতান্তই নগণ্য নয়? তবে রাষ্ট্রের বাঁধা বেতনের বান্দা পুলিশ-জওয়ানগুলোও যে ক্রান্তিকারীদের ভয় আর সমীহর চোখে দেখে তাতে ভুল নেই। অনেককেই বিবেক দংশন তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু কর্তব্যের টানে তাদের কখনও কখনও অমানুষিক জান্তব হয়ে যেতে হয়।

শিউপ্রসাদজী খতম হবার পর ভাটা পড়ে ক্রান্তিকারীদের ক্রিয়াকলাপে। তেমন যোগ্য নেতা প্রায় কেউই নেই যিনি অন্তরাল থেকে কর্মসূচি পরিচালনা করবেন।তাছাড়া ফ্যাসিস্ট শক্তির মুখোশকে না চিনে তাকে অন্ধের মতো  বিশ্বাস করার মতো বোকামি আর হয় না। শিউপ্রসাদের মতো বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা কি অপরিণত চিন্তা ও কাজের পরিচয় রাখলেন… শমীর স্মৃতির আকাশে অতীতচারণের সঙ্গে সঙ্গে অজস্র ছবি অসংখ্য প্রশ্ন পুরোনো ছবির অ্যালবামের মতো ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। স্মরণ মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে সাতাশ বছর আগেকার দিনগুলোয় পৌঁছে গেল শমী।

এই ইন্দ্রজিৎ বুঝি তাদেরই মধ্যে একজন? শমী পারেনি তাকে চিনতে।

“কিন্তু তোমার নাম… অন্য কী একটা ছিল না?”

ইন্দ্রজিৎ হাসে। “আমার সেই নাম ভুলে গেছ শমীদি? বেশ করেছ। ও ভুলে যাওয়াই ভালো। আমাদেরও ওই অতীতটাকে এখন অনেকটাই ভুল বলে মনে হয়।”

“কিন্তু ভুল যে ভাঙল অনেক পরে? কত প্রাণ ঝরে গেল……কত মা-র কোল খালি হয়ে গেল…..” শমী ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে।
“বেটার লেট দ্যান নেভার… বলো শমীদি? অন্যভাবে কাজ করছি এখন। জনজাতিদের থেকে তো মুখ ফিরিয়ে নিইনি। তাদের নিয়েই আছি।”
“তাই থাক। ওটা প্রতিবাদের খুব জোরালো ধরন।” শমী বলে।

সাঁওতাল যুবতী মুংলি তখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে মেয়েটা।

“রাত হয়ে গেছে… তুমরা এখন খাবে নাকি?”

লাল রঙের ঈষৎ শক্ত চালের ভাত, খেতের ডাল, কুঁদরির তরকারি আর পুকুরের ছোট মাছের ঝোল আর চুকোই (টক ঢ্যাঁড়শ)এর চাটনি– আজকের আইটেম।

“রাষ্ট্রের ভয়ে গা ঢাকা দিইনি। মেকি শহরের নকল আর শৌখিন প্রসাধন থেকে নিজেদের জীবনকে সরিয়ে রেখেছি গো শমীদি।”
“কদিন আর বাঁচব… এ গ্রামের সাঁওতাল জনজাতিকে একটু ভালো রাখা, তাদের সঙ্গে ভালো থাকার কাজ কিছু করে যাই…”

আজ দ্বিতীয়া। কাস্তের মতো বাঁকানো সোনালি চাঁদ উঠেছে জঙ্গলমহলের আকাশে। যেন পরিশ্রমী সাঁওতাল মেয়েদের হাতেনিকোনো পরিচ্ছন্ন তকতকে আকাশ। অজস্র তারা ফুটে আছে শলমাজড়ির ওড়নার মতো। জঙ্গলে যেন দীপাবলী উৎসব। বাতাসের হিমেল পরশ গায়ে মেখে ডিঙি শমীর হাত ধরে খাটিয়ায় বসে। অনেকদিন চলে গেছে খাটিয়ায় শোয়া-বসার অভ্যাস। ফের এই পবিত্র প্রকৃতি আর নিষ্পাপ মানুষগুলোর সন্ধানে যদি ফিরে ফিরে আসা যায় সভ্যতার প্রাচীন অভ্যাসে…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...