উলঙ্গ শহর

মামণি রয়সম গোস্বামী

 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস

অসমিয়া সাহিত্যে দ্বিতীয় জ্ঞানপীঠ বিজয়িনী ইন্দিরা গোস্বামী ওরফে মামণি রয়সম গোস্বামী ১৯৪২ সালে অসমের গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগে অধ্যাপনাকালে এই অধ্যাপিকার রামায়ণী সাহিত্যের গবেষক হিসেবে সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। গল্প এবং উপন্যাস দুটিতেই সমান দক্ষ লেখিকা ‘মামরে ধরা তরোয়াল’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ সালে জ্ঞানপীঠ সম্মানে ভূষিত লেখিকার অসংখ্য গল্প উপন্যাস ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০১১ সালে লেখিকার মৃত্যু হয়।

প্রকাণ্ড ঘরটির এক কোণে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে দেখে ঊর্মিলা ভট্টাচার্যের বন্ধুমহল চিৎকার করে উঠল।

—ইস, একেবারে প্রেতের মতো মনে হচ্ছে!
—কোথা থেকে আসা হয়েছে?

…এই সমস্ত প্রশ্ন অবশ্য ছেলেটির মনে কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারল না।

দিল্লির প্রখ্যাত সাংবাদিক রূপচন্দ্র প্রশ্ন করল— গতকাল উখলাতে গিয়ে তাহলে তুমি কিছু সমাজসেবা করে এলে?

ঊর্মিলা বলল— আপনি কীভাবে জানলেন?

—কফি হাউসে তুমি ডক্টর ইসমাইলি এবং কৃষ্ণা কাপুর নামে মহিলাটিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে। ওদের নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে স্লামে যাওয়ার কথা ছিল। তুমিও ওদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলে।

ঊর্মিলা মাথা নাড়ল। গম্ভীর হয়ে বলল— শোনা যায় ভারতের লোকসংখ্যার নাকি শতকরা পঁচিশ ভাগ হরিজন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমরা প্রত্যেকেই যদি একটি ক্ষুদ্র উপকার করি।

—ক্ষুদ্র উপকার!— সাংবাদিক রূপচন্দ্র বলল।
—শুনুন রূপচন্দ্রবাবু, আপনি সবসময় বলেন এসব করে দেখানোর মানুষ কম, কথা বলার মানুষ অনেক। আপনি দেখতে থাকুন আমি করে দেখাব। অর্থাৎ আমি ছেলেটিকে পড়াব এবং মানুষ করে দেখাব!

অধ্যাপক ঠাকুর চিৎকার করে উঠলেন— মানুষ করে দেখাবে? কিন্তু তুমি আমাদের দেওয়া সময়টুকু নিয়ে যেন কৃপণতা কোরো না!

ঊর্মিলা হাসল। বলল— না না সেই বিষয়ে ভয় করতে হবে না, দুদিন পরে সে-ই সবাইকে মিষ্টি পান, সিগারেট এনে দেওয়া শুরু করবে…।

সাংবাদিক রূপচন্দ্র নিজের স্বাভাবিক কৌতূহলে বলল— এখন বলো তো জিনিসটা কোথায় পেলে? দক্ষতার সঙ্গে বর্ণনা করা তোমার একটি বিশিষ্ট গুণ… তবে…

—শুনুন, ওকে নিয়ে আসার অনুপ্রেরণা আমি অনেকদিন আগেই পেয়েছিলাম!
—অনেকদিন আগে?
—হ্যাঁ অনেকদিন আগে! সেই সময়ে আমার বাবা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। একদিন বিকেলে খেলে এসে দেখলাম মেঝেতে বাবার পুরনো বন্ধু ডিআই তৌফিক হোসেন বসে আছেন। মেঝের এক কোণে আমাদের কাজের ছেলে লক্ষণ কাঠকয়লা নিয়ে কিছু একটা লিখছিল।… বাবার আমি বড় আদরের মেয়ে ছিলাম। সেদিন বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম— ওই যে লক্ষণের দিকে তাকাও বাবা, কাঠকয়লা দিয়ে সে কী সব লিখছে। আজ পর্যন্ত সে তার নিজের নামটাও ভালভাবে লিখতে পারেনি, দেখছ কীভাবে যুদ্ধ করছে।

তৌফিক হোসেন আমার দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন— মা আমার কাছে এসো, এদিকে এসো। এখনই তুমি কী বলছিলে, সেই কাজের ছেলেটি নিজের নামটাও লিখতে পারে না, তাই না?

—হ‍্যাঁ!
—এটা তোমার দোষ, মা!
—আমার দোষ?
—হ্যাঁ তোমার দোষ!

চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে তৌফিক হোসেনের কথা ভালভাবে বুঝতে পারিনি যদিও, কিন্তু তার কথা আমি ভুলতে পারিনি।

সাংবাদিক রূপচন্দ্র বলল— আজকাল আইন এভাবে ছেলেমেয়েদের রাখতে নিষেধ করেছে।

অধ্যাপক বলল— এই আইনেরও কিছু পরিবর্তন হওয়া দরকার। আচ্ছা তুমি ছেলেটিকে কোথায় পেলে?

ঊর্মিলা বলল— কাল আমি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা কৃষ্ণার সঙ্গে ওখলার স্লামে কাজ করতে গিয়েছিলাম। আপনারা তো জানেন অবসর সময়টা কখনও কখনও আমার কাছে ভয়ের জিনিস হয়ে পড়ে। এমনকি কখনও কখনও আমি নেশা করার কথাও ভাবি। গতকাল একটা সময়ে ছেলেমেয়েরা কাজ করে বাড়ি ফিরে গেল। কৃষ্ণা এবং আমি একটি ধাবার দিকে এগিয়ে গেলাম। হরিয়ানায় আসাযাওয়া করা ট্রাকড্রাইভারদের ধাবা ছিল সেটা। দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লাম। একটা সময়ে চা এল। আমরা দুজনে নিশ্চিন্ত মনে চা খেতে লাগলাম। ঠিক এরকম একটা সময়ে আমাদের সামনে একজন প্রেতিনী এসে দাঁড়াল।

—প্রেত? সাংবাদিক রূপচন্দ্র চিৎকার করে উঠল।
—ওকে মানুষ বলতে এক ধরনের লজ্জাবোধ হয়েছিল। জনকপুরি নিজামুদ্দিন স্টেশনের আশেপাশে এবং ডাবল ডেকারে— গুরদোয়ারা রোডে যাওয়া আলিতে এই ধরনের অস্থিপুঞ্জের অনেক সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়… কিন্তু আমাদের সামনে উপস্থিত হওয়া প্রেতাত্মাটা একটা অন্য জিনিস ছিল…।
—কী ধরনের জিনিস?

রূপচন্দ্রের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে ঊর্মিলা বলল— তার একটা অদ্ভুত রূপ ছিল। হাত পা ইকরার মতো অথচ সামনের দিকে বেড়ে আসা একটা কুৎসিত পেট— গুড়ের বস্তার মতো একটা পেট…। শরীরের কোথাও মাংস নেই, অথচ সেই জায়গায়…

—ছিঃ ছিঃ!
—কেবল সেই নয় তার সঙ্গে আরও দুটো প্রেত ছিল। দুজনেই ক্ষুধার্ত। মহিলাটি আমাদের কাছে দৌড়ে এসে ঘ্যানঘ্যান করছিল— ওদের বাবা হরিয়ানা রোডওয়ের  ড্রাইভার! রোশনারা রোডে একটা মানুষকে ধাক্কা মেরে গায়েব হয়ে গেছে, দুটো পয়সা দাও…..।

দুটো পয়সা চাই।

কৃষ্ণাকে কী আর দোষ দেব— আজকালকার পণ্ডিতরা চিৎকার করছে নাকি ভিক্ষা দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য এবং লজ্জাজনক ব্যবসাটাকে শিক্ষিতদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়। কিন্তু চোখের সামনে এরকম ভূত এসে উপস্থিত হলে কী করা যেতে পারে? এই আমড়ার আঁটির মতো চোখ। গুড়ের বস্তার মতো পেট!

আমি মহিলাটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। মহিলাটি ইতিমধ্যে বাস ড্রাইভারগুলির জন্য পেতে রাখা একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ল। নাকের পাটা ঘামে ভিজে গিয়েছিল, সে তখন ফোঁপাতে শুরু করেছিল। অন্যদিন হলে ধাবার মালিক তাকে কুকুর দিয়ে তাড়িয়ে দিতেন, কিন্তু এই মুহূর্তে কেউ তার কাছে যেতে ইচ্ছা করল না। এই কংক্রিটের নগরে যেখানে সমব্যথা এক দুরূহ জিনিস হয়ে উঠেছে, যেখানে মানুষ একক আর ক্রূর হয়ে পড়েছে সেই সব জায়গাতেও কখনও এক একটি দৃশ্য মানুষকে বাঙ্ময় করে রেখে যায়। এটি ঠিক সেই ধরনের দৃশ্য ছিল।

সাংবাদিক রূপচন্দ্র আর্তনাদ করে উঠল— তারপরে?

—মেয়েটি এবার ফোঁপানো ছেড়ে আমাদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল— তোমাদের হাতে বই, কাঁধে বেগ— নিশ্চয় তোমরা ছেলেমেয়েদের পড়াও, তাই না? নাও, আমার এই ছেলেটিকে নিয়ে নিজের নামটা লিখতে পারার মতো করে দাও।… তোমরা শিক্ষিত মানুষ আমাদের মতো হরিজনদের হাতে নিশ্চয় তোমরা জল খেতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। রাষ্ট্রভাষা শেখাতে আসা খাদি কাপড় পরা মানুষটা আমার হাতে গরমজল খেয়েছিল… নাও, সে তোমাদের স্নান করার গরম জল করে দিতে পারবে!

ধাবার মালিক এবং তার কর্মচারীরা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল। মহিলাটি প্রচণ্ড রেগে গেল। আঘাত খাওয়া অসুস্থ কুকুরের মতো সে খ্যাক খ্যাক করে উঠল— তোদেরকে মানুষ বলতে লজ্জা হয়। তোরা কি সত্যিই মানুষ? তোদের কি ভাইবোন নেই? ভাইবোন যদি থেকে থাকে আর ওদের যদি এই লবণের বস্তা একটা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়— তাহলে তোরা কী করবি? তোরা নপুংসক। তোরা মানুষ হতে পারবি না!

কথাটা বলে কিছুক্ষণ সে আবার ফোঁপাতে লাগল। তারপর সে বসা থেকে উঠতে চেষ্টা করল।

আমরা সবাই নীরব হয়ে বসেছিলাম। তারপর আমি বললাম— দাও ছেলেটি আমাকে দাও। অন্য কিছু করতে না পারলেও আমি তাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ শেখাব। কিংসওয়ে ক্যাম্পের হরিজনদের সঙ্গে বসে সে পরীক্ষা দিতে পারবে।

কৃষ্ণা আর্তনাদ করে উঠল— কী করছ? রাস্তা থেকে এভাবে মানুষ কুড়িয়ে আনা দিল্লির মতো শহরে কী মারাত্মক কথা তুমি জানো না?

কৃষ্ণার কথা শোনার জন্য আমি তখন প্রস্তুত ছিলাম না। আমি এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির হাত খপ করে ধরে ফেললাম। সে মায়ের আঁচলে মুখ লুকোতে চেষ্টা করল। আমার ভাবার মতো সে অবশ্য একেবারে বাচ্চা ছেলে ছিল না। ধাবার জবরদস্ত পাঞ্জাবি মালিক বলল— কাছেই থানা আছে। লেখাপড়া করে নিন। রাস্তা থেকে এভাবে মানুষ কুড়িয়ে নেবেন না!

পুলিশের নাম শুনে মহিলাটি বলল— সাদা সাহেব হরিজন বলে আদর করে গাড়ি চালানো শিখিয়েছিল। মানুষকে ধাক্কা মেরে সে উধাও হয়েছে। পুলিশ ঝুপড়িতে গিয়ে গিয়ে দু-তিনবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে খবর নিয়ে এসেছে।

পাঞ্জাবি ধাবাওলা চিৎকার করে করে বলল— হঠ হঠ… ওর কথা আপনারা শুনবেন না… শেষপর্যন্ত ওকে এখানে আনা— সে এক অন্য কাহিনি।

রূপচন্দ্র এবং ঠাকুর পুনরায় একবার মাথা তুলে ছেলেটির দিকে তাকাল।

সাংবাদিক রূপচন্দ্র বলল— শুধু কলকাতা শহরে এক লাখ কুড়ি হাজার মানুষ ফুটপাতে ঘুমোয়। আপনি দলিত সাহিত্য পড়েছেন কি?

ঠাকুর মাথা নাড়ল।

—ঊর্মিলা তুমি নিশ্চয় দলিত কবি নারায়ণ সুরভে, অরুণ এবং নামদেও ধাসালের কবিতা পড়োনি…। ওরা এখন উদিত সূর্যের স্বপ্ন দেখছে…। হরিজন কবি গাইছেন—

How will they stop minds
Gone ablaze?
No more reasoning now.
Unreason helps a lot
Once the horizon is red
What’s wrong in keeping doors open?

…অধ্যাপক ঠাকুর এবং সাংবাদিকের কথা অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকল।


 

অধ্যাপক ঠাকুর, সাংবাদিক রূপচন্দ্র এবং ঊর্মিলার ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। লোকে বলে শ্রীনিবাস মিলে কাজ করা সেই রূপসী মহিলাটি চালচুলোহীন সাংবাদিকের যোগ্য ছিল না। পাহাড়গঞ্জের বরসাতি এবং মিয়ানি-তে থাকা তার ফুলের চেয়েও কোমল শরীর সূর্যের তাপ কালো করে ফেলেছে। মার্চ মাসের ধুলো তার শ্যাম্পু করা মোলায়েম চুল… আঃ বেচারা সাংবাদিক।

অধ্যাপক ঠাকুরও রোশেনারা রোডের একটি বরসাতিতে বাস করেন। ছেলেমেয়ের সঙ্গে দুটো ঘরে তাঁকে শুয়োরের খোঁয়াড়ের মতোই থাকতে হয়, তাছাড়া মা-বাবাকে নিয়মিত খরচ পাঠাতে হয়। এই শহরে অধ্যাপকদের প্রতি সমীহের ভাব কমে এসেছে। ঘরের বৃদ্ধ মালিকের মৃত্যুর পরে নতুন মালিক তাকে উঠে যাওয়ার জন্য প্রতিদিনই মনে করিয়ে দেয়। পুরনো ঘর ভেঙে নতুন ঘর তৈরি করানোর জন্য ওরা উন্মুখ হয়ে উঠেছে। দালালের কাছে বাড়ির খোঁজে যাওয়ার সামর্থ্য অধ্যাপকের নেই। বাড়ির খোঁজে দিল্লি শহরে টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর সময় সুযোগ বুঝে একবার ঊর্মিলার কাছে বসতে পারলে তিনি এক অনন্য সুখ অনুভব করতেন। এই সময়ে তিনি লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্থান লাভ করার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন— সেই স্বপ্ন যেন একটা গাছ হয়ে পড়েছিল। বিচিত্র ছায়া দান করা এই গাছের নিচে তিনি যেন একেবারে সহজ হয়ে বাস করেছিলেন। ক্লাসের প্রতিদিন তিনি একদল অমনোযোগী ছাত্রের সঙ্গে মুখোমুখি হন। ওরা তাঁর ক্লাসে বসে চুরুট ফোঁকে। কয়েক বছর আগে ছাত্ররা তাঁর সঙ্গে কামুর দার্শনিক তত্ত্বের সাঙ্কেতিক শব্দের অর্থহীনতার বিষয়ে প্রচণ্ড তর্ক করেছিল। আজকালকার এই দলটি তাঁর সঙ্গে কোনও বিষয়ে আলোচনা করে না। তাঁর অস্তিত্বকেই ওরা স্বীকার করা ছেড়ে দিয়েছে। একদিন ক্লাসের দরজার সামনে একটা বিয়ারের বোতলে অধ্যাপক হোঁচট খেয়েছিলেন। শোনা যায় ফ্রাস্টেশন, অ্যাংজাইটি, প্লেজেন্ট এক্সপেরিয়েন্স এবং নাকি to be in with friends and fashions— এইসবের জন্যই নাকি ওরা নেশা করে।

ঊর্মিলার দিল্লি আসার তিন বছর হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগে লেকচারারের কাজ করে। এখনও তার প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হয়নি। এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা তার জীবন ওলটপালট করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে কাজ করা স্বামী উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। একই জায়গা থেকে ফিরে আসা দুই-একজন বন্ধু একজন ফরাসি মহিলার সঙ্গে তার লেনদেনের এক কুৎসিত কাহিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচার করেছিল। বড় সুন্দরভাবে সাজিয়ে নেওয়া সংসার ছারখার হয়ে যাওয়ার পরে ভাইবোনদের বাড়িতে সে এখানে কিছুদিন ওখানে কিছুদিন ঘুরে বেরিয়েছিল। বাবা মা কবেই স্বর্গগামী হয়েছিল।

শেষে পড়াশোনা করে দিল্লিতে চাকরি আরম্ভ করা— সে অন্য এক কাহিনি।

অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভারাক্রান্ত হয়ে শেষে ঊর্মিলা একটা সিদ্ধান্তে এসেছিল। যে কোনও উপায়ে সে ছারখার হয়ে যাওয়া এই সংসারকে নতুন করে গড়ে তুলবে। তার মন একটা শিকারির মনে রূপান্তরিত হয়েছিল। সাক্ষাৎ করা প্রতিটি পুরুষের মধ্যে সে নিজের প্রিয়জনকে খুঁজে বেড়াতে গিয়ে ছটফট করত।

অনেকক্ষণ ধরে সাংবাদিক রূপচন্দ্র ভাবছিল অধ্যাপক ঠাকুর উঠে যাবে, ঠাকুর ভাবছিল রূপচন্দ্র উঠে যাবে। কিন্তু কেউ উঠে গেল না। এই সময়ে যেন দুজনেই দুজনের প্রচণ্ড শত্রু হয়ে পড়ল। এমনিতে দুজন দুজনের বন্ধু, যদিও সবসময় এই সময়টায় দুজন দুজনের শত্রু হয়ে পড়ে। রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত গল্পগুজব চলছিল। পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবার থেকে আরম্ভ করে যশপাল, সদত হসন মন্টো এবং সমসের বাহাদুরের কবিতা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক চলল। তারপরে দুজনেই একসঙ্গে নিচে নেমে গেল।

এটা ১৯৭৪ সালের দিল্লি। ইতিমধ্যে দিল্লিকে এক কুখ্যাত শহর বলে জারি করা হয়েছে। দুজনকেই এগিয়ে দেওয়ার জন্য নিচে নেমে এসে ঊর্মিলা পুনরায় ওপরে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

একদিন ঊর্মিলা কিংসওয়ে ক্যাম্পের হরিজন বিদ্যালয়ে জগন্নাথের পড়াশোনার বন্দোবস্ত করার জন্য যেতে প্রস্তুত হল। সে কিছুদিন জগন্নাথের মা খবর নিতে আসবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু তার খবর নিতে কেউ এল না।

স্লামগুলিতে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা শেখানো হিন্দি ভাষার পণ্ডিত বিষ্ণুপ্রভাকরের সঙ্গে ঊর্মিলার পরিচয় হয়েছিল। কিংসওয়ে ক্যাম্পে গিয়ে দুজনেই এই হিন্দি পণ্ডিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল।

পণ্ডিত বললেন— বড় ভাল কথা। আমরা শিক্ষিত মহিলার কাছ থেকে ঠিক এই ধরনের কাজ চাই। এই সেদিন ভবনগরের হরিজন মহাসভায় প্রধানমন্ত্রী বলে গেলেন তিনি হরিজনদের দাবি পূরণের জন্য ওদের সঙ্গে সত্যাগ্রহ করতে প্রস্তুত আছেন…।

আমি সপ্তাহে দুদিন গিয়ে ওকে পড়িয়ে আসব। তুমি বইপত্র তৈরি রেখো। দেখো, এই আমার হাত পা দেখো। স্লাম অঞ্চলে গিয়ে হরিজন বালককে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে আমার হাতে পায়ে এই দেখো এক বিচিত্র ধরনের আস্তরণ পড়তে শুরু করেছে। তুমি ভয় কোরো না, তোমার শরীরে অবশ্য এই ধরনের আস্তরণ পড়বে না। বিষ্ণুপ্রভাকর এবার হাসতে লাগলেন। ঊর্মিলা বিষ্ণুপ্রভাকরের কথার অর্থ ভালভাবে বুঝতে পারল না।

একান্ত বাধ‍্য ছাত্রের মতো জগন্নাথ পড়তে শুরু করল। বিষ্ণুপ্রভাকর সপ্তাহে দুবার এসে তাকে পড়িয়ে যেতে লাগলেন। এক অনন্য উৎসাহে ঊর্মিলাও তাকে অবসর সময়ে পড়াতে শুরু করল। বিস্ময়ের কথা এই যে এই এক মাস কেউ তার খবর নিতে এল না। ঊর্মিলা ওদের এই নির্লিপ্ততায় অবশ্য খারাপ পেল না।

একদিন অধ্যাপক ঠাকুর বললেন— আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে তুমি তাকে মানুষ করতে পারবে। আমাদের এই ছোট ছোট দেহগুলিতে এরকম কিছু দুর্দমনীয় শক্তি লুকিয়ে থাকে জানো কি, যাকে আমি নিজেও জানি না!!

ঊর্মিলা কিছুটা রসিকতা করার মতো বলে উঠল— রাস্তার সোনাকে সোনা বলে চিনতে অনেক সময় লাগবে। যখন সে আমাদের ভালভাবে চিনতে পারবে তখন এই বাড়িতে সে আপনার আসা হয়তো পছন্দ করবে না!

অধ্যাপক এক গভীর দৃষ্টিতে ঊর্মিলার মুখের দিকে মাথা তুলে তাকাল। দুজনের এই অন্তর্ভেদী চাহনি দুজনেরই হৃদয়ের এক গভীর ক্ষতস্থান স্পর্শ করে স্তব্ধ হয়ে রইল।

দুমাসের মাথায় একদিন ক্লাসে এসে ঊর্মিলা সিঁড়ির কাছে জগন্নাথের মাকে বসে থাকতে দেখল! ঊর্মিলা একপ্রকার চিৎকার করে বলল— এতদিন কোথায় ছিলে? জগন্নাথ তোমার পেটের সন্তান নয় কি?

—কেন হবে না মেমসাহেব!
—তাহলে তাকে নিয়ে যেতে এসেছ?
—নিয়ে যেতে কেন আসব মেমসাহেব!

উত্তর শুনে ঊর্মিলা যথেষ্ট আশ্বস্ত হল।

সে লক্ষ করল এই ছয় মাসের মধ্যে মহিলাটির যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে! সাজপোশাক শতচ্ছিন্ন যদিও পরিচ্ছন্ন! সেইদিনের হাহাকারের কোনও স্মৃতিই এখন নেই। পেট খালি। ছেলেমেয়ে কিছু একটা বোধহয় হয়েছে।

—জগন্নাথের বাবা ফিরে এসেছে কি?

সে মাথা নাড়ল।

তাহলে আর কী জিজ্ঞেস করবে?

—কোথায় থাকো? কোথায় থাকো আজকাল?
—মিন্টুব্রিজে কাজ চলছে। আমি ঠিকাদারের অধীনে থাকি। ব্যস্ত মানুষের মতো সে বলল। আমার সময় নেই। ফাটা-ছেঁড়া কোনও চাদর-টাদর আছে কি? তাছাড়া কিছু টাকাপয়সাও দিন!

ঊর্মিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে মেইন রাস্তায় পা রাখল। তার পেছন পেছন জগন্নাথও দুধের বুথের কাছাকাছি পর্যন্ত এগিয়ে গেল। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে ঊর্মিলা লক্ষ করল সে জগন্নাথকে কাপড়চোপড়গুলি দেখানোর চেষ্টা করছে। সে যেন তাকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করছে যে আমি কি খুব সুখে আছি?

—শরীরে এখন শতচ্ছিন্ন পোশাক।

একটা সময়ে জগন্নাথ ফিরে এল। তারপরে সে ঊর্মিলার জন্য চা জলপান করল। তারপরে বলল— আপনার সেই অতিথিরা এসে পড়বে। তার আগেই আপনি আমাকে কিছুক্ষণ পড়ান।

ছাদের মুক্ত আকাশের নিচে দুজনেই বইপত্র নিয়ে বসল। ঊর্মিলার এই পরিবেশ বড় সুন্দর লাগল। টেলিভিশনের তারগুলিতে এখন কিছু কবুতর বসে আছে। রোশনারা বাগিচা থেকে এখন একঝাঁক বাদুড় বেরিয়ে এসে ওই যে ঊর্মিলার মাথার ওপরের আকাশটা একপ্রকার কালো করে ফেলেছে।

হঠাৎ ঊর্মিলা শুনতে পেল কেউ একজন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। জগন্নাথ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।

দুজনেরই সামনে দাঁড়াল ঊর্মিলার পুরনো বন্ধু অঙ্কের গবেষক যশোবন্ত। একসময়ে এই বন্ধুর সঙ্গে এক অভিনব সম্পর্ক ঊর্মিলার গড়ে উঠেছিল। এই বন্ধুত্ব ঊর্মিলাকে এতটাই অভিভূত করেছিল যে ঊর্মিলা নিজের ভেঙেচুরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া সংসারকে পুনরায় নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল।

আর্টস ফ্যাকাল্টিতেই এই অঙ্কের গবেষকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। ওরা লাহোরের রিফিউজি ছিল। ঊর্মিলার মনে আছে, তখন ছিল এপ্রিল মাস। দিল্লিকে গুলমোহর ফুলে সুবাসিত করে তোলা মাস ছিল সেটা। একদিন লেডি শ্রীরাম কলেজের সেমিনারে একটা পেপার পড়ে এসে গল্পগুজব করে যখন রাজপথে পা রেখেছিল তখন গোধূলি হয়ে এসেছে। বাস সার্ভিস কমে এসেছিল। সে ভাবল লিফট নিতে হবে। আজকাল প্রত্যেকেই লিফট নেয়। ছাত্রীদের অনেক রোমাঞ্চকর এবং লোমহর্ষক কাহিনি দিল্লির পথেঘাটে শোনা যায়। কিন্তু পথে দাঁড়িয়ে দিল্লির অন্ধকার রাতের ভয়াবহতার কথা ভেবে ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ল।

একটা ফিয়াট তার সামনে দিয়ে পার হয়ে গেল। সে হাত তুলে দেখাল। দাঁড়াল না।

ওই যে আরেকটা গাড়ি আসছে। দাঁড় করাবে নাকি? দাঁড় করাবে?

ঊর্মিলা হাত দেখাল। চালক ব্রেক কষে গাড়িটা তার খুব কাছেই দাঁড় করাল। কালো ফ্রেমের চশমা পরা, ঘন চুলের রুচিবান ভদ্রলোক।

সামনের দিকে দরজা খুলে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন— কোথায় যাবেন?

—মাল রোড…

বাড়ি কোথায়? কে আছে বাড়িতে?— এসব কোনও প্রশ্ন নয়। মহানগরের এই বাতাবরণের সঙ্গে ঊর্মিলার ভালভাবে পরিচয় আছে। মানুষের মনে আগ্রহ অনুভূতি— এসবই যেন শুকিয়ে কর্কশ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে প্রত্যেকেরই মন এক হয়ে রয়েছে।

আইটিও এবং ইন্ডিয়া গেটের সেই প্রচণ্ড ভিড় অতিক্রম করে গাড়ি রিং রোড দিয়ে যেতে শুরু করল। হঠাৎ ভদ্রলোক একবার সোজা হয়ে ঊর্মিলার বাহুটার দিকে তাকাল। ঘামে ভিজে আছে একটি নিটোল বাহু। ভদ্রলোক ঘনঘন এই বাহুটার দিকে তাকাতে লাগল। ঊর্মিলা ভাবল এখানটাতে নেমে যাবে বলবে নাকি? কিন্তু এই প্রচণ্ড ভিড়ে এখন বাস ধরাও অসম্ভব কথা হয়ে পড়বে।

—কী করবেন তাহলে? ম্যাডাম!
—হ্যাঁ হ্যাঁ এইখানে রাখুন।

ঘামে এবার তার শরীরের কিছু নির্দিষ্ট অংশ একেবারেই চকচকে হয়ে পড়ল।

—শুড আই ড্রপ ইউ হেয়ার!
—হ্যাঁ হ্যাঁ, বলে সে প্রচণ্ড জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল।
—কিন্তু…
—কিন্তু?

ব্রেক মারার সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মিলাকে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে হল।

অপরিচিত মানুষটিও বোধহয় গাড়ি থেকে নেমে কিছু দূর এগিয়ে এসেছিল। কারণ অনেক দূর পর্যন্ত সেই উত্তেজিত কণ্ঠস্বর তাকে একপ্রকার তাড়িয়ে নিয়ে চলেছিল। মহারানা প্রতাপের মূর্তিটির কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সে ফোঁপাতে লাগল। না না, গাড়ি আর তাকে অনুসরণ করছে না। ওই যে তার মাথার ওপরে অখণ্ড দর্পে রানা প্রতাপ পাহারা দিচ্ছে— না কোনও ভয় নেই। কোনও চিন্তা নেই।

পুনরায় এসে যখন সে বাস সেন্টারে দাঁড়াল দুই-তিনজন মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পুরুষমূর্তিও সে দেখতে পেল। আর্টস ফ্যাকাল্টি, কফি হাউস, রিসার্চ ফ্লোর, সব জায়গাতেই গত দুই বছর ধরে সে এই মানুষটিকে দেখতে পেয়েছে।

এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হওয়া সেও এক নাটকের মতো।

বড় আগ্রহের সঙ্গে সে তাকে এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। দুজনেই একসঙ্গে বাসে উঠেছিল। পুরনো পরিচিত মানুষের মতো সে রসিকতা করে বলেছিল— বাস থেকে নেমে তুমি তোমার বাড়িতে যাওয়ার পথে একটি ভয়ঙ্কর রেস্তোরা দেখতে পাও না কি?

—আজ পর্যন্ত রাস্তার পাশে কী আছে আমি ভালভাবে মাথা তুলে দেখিনি।
—সেই ব্রহ্ম রেস্তোরাতেই প্রতাপ সিং কাইরনের হত্যার ষড়যন্ত্র সূচিত হয়েছিল!

ঊর্মিলা চিৎকার করে উঠল— সেই রেস্তোরাঁটির দরজার সামনে দিয়ে আমি সবসময় যাওয়া আসা করি?!

এরপরে দুজনের মধ্যে এক আন্তরিক সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছিল। লাইব্রেরি, সেমিনার হল, রিসার্চ ফ্লোর, কফি হাউস, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ইত্যাদি সব জায়গাতেই দুজনকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল।

একদিন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিল— খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে আছে কিছু মানুষ মাতৃগর্ভে নপুংসক হয়ে আসে, কিছু মানুষকে স্বয়ং মানুষই নপুংসক করে তোলে। একথা  যে যেভাবে বোঝে, বুঝে নিক।

কথাটা বলে যশোবন্ত খুব হাসল। তার তখন দেড় কুড়ি বছর পার হয়ে গিয়েছিল‌। অথচ তখনও তার মাথার উপরে দুজন বোনকে  নগদ টাকা দিয়ে বের করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল।

সুদীর্ঘ দুটো বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে ঊর্মিলা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। যশোবন্তই একমাত্র পুরুষ যে তার ভেঙে যাওয়া সংসারকে পুনরায় নতুন করে গড়ে তুলতে পারবে। তার মুখ থেকে এ কথা শুনতে সে বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে রইল। এই অপেক্ষা ধীরে ধীরে হতাশায় রূপান্তরিত হল।

নিজের মনের সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করেই যশোবন্তকে পাওয়ার থেকে সে বিরত হয়েছিল।

তাই এই মুহূর্তে দরজার মুখে যশোবন্তকে দেখে ঊর্মিলা কিছু হতাশ হল। ক্ষণকালের জন্য। সেই হতাশাকে এক আশার ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

—দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো ভেতরে চলে এসো!’
—আগে এক কাপ চা দাও। ডিফেন্স কলোনি থেকে প্যালেস সিনেমা হয়ে রোশোনারা রোডে এতখানি রাস্তা স্কুটার চালিয়ে আসা এবং যুদ্ধে জিতে আসা একই কথা।

ঊর্মিলা চা করার জন্য ভেতরে চলে গেল। জগন্নাথ তাকে সাহায্য করল।

দুজনে মুখোমুখি বসে চা খাওয়ার সময় ঊর্মিলা লক্ষ‍ করল যশোবন্ত যেন কিছুটা চিন্তিত। সে কিছু বলবে নাকি?

হঠাৎ ঊর্মিলা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।

তারপরে চিৎকার করল— জগন্নাথ এখন দরজায় ধাক্কা দিবি না, আমাদের প্রয়োজনীয় কথা আছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে  যশোবন্ত অনেকক্ষণ ঊর্মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মুখ, এই চুল, নিটোল স্বাস্থ্য, চোখের গোড়ায় বয়স এবং যাতনার স্পষ্ট প্রমাণ…।

অনেক সময় দুজনেই মৌন হয়ে রইল। ধীরে ধীরে বাইরের হইচই কমে এল। নিচের দোকানপাট বন্ধ করার শব্দ শোনা গেল। ঊর্মিলা যেন কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়ল। তার ভেঙে পড়া জীবনকে নতুন করে তুলে ধরতে চাওয়া এই স্বপ্ন আজকেই ছারখার হয়ে যাক অথবা আজকেই উজ্জ্বল হয়ে উঠুক। কিছু একটা হোক— আজ এই মুহূর্তে কিছু একটা হোক।

সে বলল— আমাদের দুজনের এভাবে পরিচয় হওয়ার অনেকদিন হয়ে গেছে তাই না?

ঊর্মিলা কোনও উত্তর দিল না।

—একটা কথা, আমরা দুজনেই আরও একটু কাছাকাছি চলে আসতে পারি না কি?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঊর্মিলা যশোবন্তের মুখের দিকে মাথা তুলে তাকাল। তারপর সে বলল— তাহলে সব কথা পরিষ্কার হয়ে পড়েছে তাই না! আমরা মহিলারা যতই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠি না কেন আমাদের বুকের ভাষা বলে আমাদের আশ্রয় দাও!! আমাদের ভরসা দাও?

—ঊর্মিলা!! ঊর্মিলা!!

না না ঊর্মিলার আজ আর কোনও কিছু শোনার অবকাশ নেই।

প্রবল উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হওয়ার পরে ঊর্মিলার নয়ন সজল হয়ে উঠল।

যশোবন্ত তার কাছে চেয়ারটা টেনে নিয়ে এল। তার পিঠে মৃদুভাবে সে হাত বোলাতে লাগল।

—শোনো ঊর্মিলা, আমি ঠিক এই জন্য আসিনি!

ঊর্মিলা যেন দু হাত দূরে ছিটকে পড়ল। যশোবন্ত সহজে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নয়। সে এগিয়ে এল।

—আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাব বলে কে বলল? আমি এই বাঁধন আরও সুদৃঢ় করার জন্য এসেছি!
—সুদৃঢ়!!

হৃদয়ের এক গভীর গহ্বর নিনাদিত করে এই বাণী যেন বাইরে বেরিয়ে এল।

—কীভাবে এই বাঁধন দৃঢ় করবে?

হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল যশোবন্ত।

—ইউ গিভ মি সেক্স।
—সেক্স?
—অনলি সেক্স ক্যান ইমমরটালাইজ ইট!

মুহূর্তের মধ্যে ঊর্মিলার কী হয়েছিল এখন যেন ভালভাবে মনে পড়ছে না। যখন সে চোখ মেলে তাকিয়েছিল— টেবিলের কাছে একটা কাঁচের ফুলদানি ভেঙে ছারখার হয়ে পড়েছিল। কোন মুহূর্তে জগন্নাথ ভেতরে এসে এই ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলি কুড়াতে আরম্ভ করেছিল ঊর্মিলার মনে নেই, তার হাত কেটে রক্ত বইতে আরম্ভ করেছিল, কিন্তু সে সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করছিল না। একটা সময়ে এই রক্তের ধারা আরও প্রবল হয়ে উঠল। ঊর্মিলা পাগলের মতো শাড়ির আঁচলে তার কাটা আঙুলগুলি চেপে ধরল। ইতিমধ্যে তার চোখ দুটি সজল হয়ে পড়েছিল। এই ছোট ছেলেটির কাছে চোখের জল লুকানোর আর কোনও চেষ্টাই সে করল না। এই মুহূর্তে এই ছেলেটি যেন তার মাতার মতো মমতাময়ী হয়ে পড়ল। এই মাতার কাছে সে যেন বড় নিঃসঙ্কোচে কাঁদতে পারে।

এক আত্মগ্লানি এবং বিদ্রোহের ভাব তার অন্তরের গোপনকক্ষে বাসা বাঁধা দুঃসহ যন্ত্রণাকে একপ্রকার চেপে ধরে রাখল। এই হরিজন ছেলেটি এই মুহূর্তে যেন তার মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে পড়ল।

—আয় জগন্নাথ দৌড়ে আয়! কফি বানা আমরা দুজনে আবার একবার এই ব্যালকনিতে বসে কফি খাই। আয়। এই জগৎটা বড় নোংরা। তবু আমাদের বেঁচে থাকতে হবে… আয় কাছে আয়।

একটা সময় দুজনেই মুখোমুখিভাবে ব্যালকনিতে বসে কফি খেতে লাগল।

যেন কিছুই হয়নি। দিল্লি মহানগরীতে ঘটা কোনও একটি অ্যাক্সিডেন্টের মতোই যেন কথা ছিল। এই সময়ে পথের লাইটের আলোর সমারোহের মধ্যে দূরের রোশনারা বাগিচাটা যথেষ্ট অন্ধকার হয়ে পড়তে দেখা গেল।

হঠাৎ কারওকে চিৎকার করে বলতে শোনা গেল— ম্যাডাম আমরা যাচ্ছি, দরজা খুলে দাও।

সিঁড়ি বেয়ে সাংবাদিক ঠাকুর এবং অধ্যাপক ভিতরে প্রবেশ করল।

পুনরায় কফি এল। গল্পগুজব চলল। আজ ঊর্মিলাকে উৎসাহিত দেখে ওদের কেউ আর সহজে উঠে যেতে চাইল না। অধ্যাপক ঠাকুর তার অতীতের কাহিনি আরম্ভ করলেন।

—গয়ার যখন ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাবরণই ছিল অন্যরকম। আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার পরে গয়ার বোর্ডের অন্য একজন সদস্যের দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল— ইউ ওন্ট বার্গেন উইথ হিম।

ছোটখাটো মানুষটির প্রাণখোলা হাসি, সাগরের সমান গভীর পাণ্ডিত্য এবং শিশুর মতো সরলতার কী মণিকাঞ্চন সংযোগ। ইস একটা যুগ যেন পার হয়ে গেল।

১৯৫৮ সালের সেই সায়েন্স কংগ্রেস!

আইজেনআওয়ার এলেন। ডিউক অফ এডেনবাৰ্গ এলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান রেজিস্টারের অফিসের সামনে সামিয়ানা লাগানো হয়েছিল। এখন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ হয়েছে লক্ষ করেছ কি? আরডিইউটি-র জনসঙ্গী এবং কংগ্রেস দল ডিইউএসইউ ইলেকশনে। একবার কী কাণ্ড করেছে জানো? কমিউনিস্টরা বকের মতো ভাবনাচিন্তা করতে করতে গেল। অথচ লোকেরা বলে পার্টিশনের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে যদি নির্মল হৃদয়ে কেউ কিছু করে থাকে তাহলে তারা কমিউনিস্টরা। নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যকে রক্ষা করার কত উদাহরণ আছে।

সাংবাদিক রূপচন্দ্রের যেন কথার রথযাত্রা চলল—

—এই ল্যাঙ্গুয়েজলেস শহর দিল্লি এক সময়ে এরকম ছিল না। দিল্লির বুদ্ধিজীবী গ্রুপটা ছিল মথুরার মাথুর উপাধিধারী লোকেরা। অভিজাত ব্যবসায়ীশ্রেণিদের হাতে। ওরা পণ্ডিতের মূল্য বুঝতে পারত। সেই মুশাইয়ারা কোথায় বসত জানো কি? আঃ সেই লক্ষ্ণৌর আতর মুখে দিলেই গলে যাওয়া পান এবং মাথুর উপাধিধারী রমণীদের সেই কবিতাপ্ৰীতি!!

রূপচন্দ্র আরও কিছু উত্তেজিত হয়ে উঠল।

—ইস, সেই সিফন এবং জরির কারুকার্য করা শাড়ি হীরার নথ, রুপোর পানদান?
—কোথায় যে উধাও হয়ে গেল সেইসব দিন? ঠাকুরও চিৎকার করে উঠল— কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব দিন…। রাজনীতির দুর্গন্ধের মধ্যে কোথায় যে নিঃশেষ হয়ে গেল সেই আতরের সুগন্ধ!

প্রচণ্ড শব্দ করে নিচের বাকি থাকা দোকানের দরজাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। রাতে পাহারা দেওয়া চৌকিদারটার লোহার পাত লাগানো লাঠি পথে ঠুকে যাওয়ার শব্দ হল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো জায়গাটা শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ হয়ে পড়বে। এবার সাংবাদিক রূপচন্দ্র এবং ঠাকুরের আগের মতো প্রতিযোগিতা চলল। কে আগে উঠে যায়। এই মুহূর্তে দুজনেই দুজনের প্রচণ্ড শত্রু হয়ে পড়ে। ঠাকুর অবশ্য কিছু অধৈর্য হয়ে পড়ল। তাঁর পরিবার আছে। ছেলে-মেয়ে আছে। কিছুটা দেরি হলে হয়তো এখানেই খুঁজতে চলে আসবে। আজকাল পরিবারের মুখ বেশ সচল হয়ে উঠেছে—

—সেই নিঃসঙ্গ বঞ্চিতা মহিলার কাছে যাওয়ার চেয়ে দেখছি বিকেলের দিকে ছেলেমেয়েদের পড়াতে নিয়ে বসা অনেক ভাল।

দূর যত্তসব! কী প্রয়োজন এই মুহূর্তে সেই সব কথা ভাবার?

—শোনো ঊর্মিলা আমি সেই মরিস গয়ারের কথা বলছিলাম না?
—হ্যাঁ হ্যাঁ!
—দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের উপকূলপতি মরিস গয়ার অনারারি কাজ করতেন। ছোটখাটো ঋষিতুল্য মানুষ ছিলেন। আর মেয়ে মিরান্ডা…

সাংবাদিক রূপচন্দ্র বলল—

—আপনি ওল্ড এস্টাবলিশমেন্টের সামনের সামিয়ানার কথা বলছিলেন না?
—আরে, আরে সেসব কথা ছিল ভিকে এবং ভি রাও উপাধ্যক্ষ থাকার সময়ের কথা। ডিউক অফ এডিনবার্গ, আইজেনআওয়ার এসেছিলেন— আঃ তোমার সেই ছেলেটাকে আরও এক কাপ কফির অর্ডার দিতে পারো না?

রূপচন্দ্র অধ্যাপকের এই প্রস্তাবে খুব খুশি হল না। কারণ এই মুহূর্তে রূপচন্দ্রের দুর্বারভাবে ঊর্মিলাকে একা পেতে ইচ্ছা করছে।

আজ প্রথমবারের জন্য ঊর্মিলার এই মানুষ দুটিকে অত্যন্ত কুৎসিত বলে মনে হল। যেন দুটো শকুন তার সামনে বসে আছে আর সে এই মুহূর্তে তাদের সামনে এক খাবলা মাংস মাত্র হয়ে পড়েছে। সে একপ্রকার আর্তনাদ করে উঠল—

—জগন্নাথ যা আরও এক পট চা করে আন।

ঠাকুর এবার আরও পরম উৎসাহের সঙ্গে আরম্ভ করলেন—

—সেই সময় আমি হাডসন রোডে ছিলাম!

রূপচন্দ্র চিৎকার করে উঠল— সেই হাডসন! সেই ভয়ঙ্কর হাডসন!!
—আরে আরে সেই জেনারেল হাডসন! ভারতের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহকে তিনি গ্রেপ্তার করেছিলেন। দিল্লি গেটের কাছে সেই খুনি দরজার নাম শুনেছ তো তোমরা। মুমূর্ষ সম্রাট বাহাদুর শাহকে ডেকে আনা হয়েছিল।
—কোনও একটা আশা দিয়ে ডেকে আনা হয়েছিল অথবা বোঝাপড়া করার জন্য?
—বৃদ্ধ সম্রাট বুকে আশা নিয়ে এসেছিলেন— ছই দেওয়া উটের গাড়িতে এসেছিলেন। লালকেল্লা থেকে বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজের সামনে বৃদ্ধ সম্রাট এগিয়ে এসেছিলেন। এখানেই জেনারেল হাডসন সম্রাটকে একটা উপহার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন— সোনার থালার ওপরে রেশমের চাদর… সম্রাট সেই চাদর সরিয়ে কী দেখেছিলেন?

ঠাকুর ঊর্মিলা এবং রূপচন্দ্রের মুখের দিকে তাকাল। প্রত্যেকেই কৌতূহলের সঙ্গে শুনছে।

—সেটা একটি লোমহর্ষক উপহার। মৃত পুত্রের কাটা মাথা।

ঊর্মিলা নীরব হয়ে রইল। রূপচন্দ্রও।

—রেঙ্গুনের সদর বাজারের ৫৮ নম্বর বাংলোর এক কোণে এখনও জাফরের কবর পড়ে আছে— আগে এই বাংলোটিতে নাকি কোনও ইংরেজ ক্যাপ্টেন ছিলেন।

কফি এল। সঙ্গে সঙ্গে এই আড্ডাতেও যেন নতুন উৎসাহ এল। জাফরের শোকাবহ কাহিনিকে কফির উত্তাপে দূরে ঠেলে পাঠানোর আয়োজন চলল।

এবার পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনি আরম্ভ হল। এডুইনা মাউন্টব্যাটেনকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হল, বাড়িটার প্রসঙ্গ উঠল। বর্তমানে এই বাড়িটা ফাইনান্স ফাইভ হিসেবে ব্যবহার হওয়ার কথা উঠল।

ঠাকুর একটা হাত উপরে তোলে খিক খিক করে হাসছিলেন।

—তোমরা ফাইন্যান্স ফাইভে কখনও গিয়েছ কি? লাঞ্চ আওয়ারে একটা টেবিল থেকে অন্য টেবিলে লাফিয়ে বেড়ানো হুলোবেড়াল দুটিকে লক্ষ করেছ কি?
—ফাইন্যান্স ফাইভের হুলোবেড়াল? সবাই খিক খিক করে হাসতে লাগল।

ঊর্মিলার এই হাসি অট্টহাসির মতো শোনা গেল। রাত দশটা পর্যন্ত ঠাকুর এবং রূপচন্দ্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলল। কেউ উঠে গেল না।

ঠিক তখনই কেউ দরজায় প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি বসিয়ে দিল। একটা বিকট শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। একটা বুলেটের মতো এসে সে তিনজনের মাঝখানে দাঁড়াল। তারপরে ঊর্মিলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল— নিচের দোকানের মানুষগুলি তোমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলে। আমার মা পেটের ক্ষুধায় সেই ডেভেলপমেন্টের ঠিকাদার কয়েকজনের সঙ্গে বসে চা রুটি খায়। তোমার তো ক্ষুধার জ্বালা নেই। তুমি কেন এই হারামজাদাদের সঙ্গে রাত দুটো পর্যন্ত আড্ডা দাও? কেন? জুগগি ঝুপড়িতে বাস করা সেই খারাপ মেয়েগুলির সঙ্গে তোমার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

এরপরে যা হয়েছিল সে এক অন্য কাহিনি।

জগন্নাথ চলে গেল।

ঊর্মিলার পুরুষবন্ধুরা এই ঘটনাটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাল না।

অধ্যাপক ঠাকুর মাত্র প্রশ্ন করেছিল— তুমি শেষপর্যন্ত কী করতে? আরও একটু দূরে চোখ মেলে তাকাও। ধীরে ধীরে সে বড় হত একদিন, সে যুবক হত… তারপরে?

এই প্রশ্নটির সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে ঊর্মিলাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল।

হ্যাঁ শেষপর্যন্ত তাহলে তিনি কী করতেন?

রূপচন্দ্র একপ্রকার বিদ্রূপ করার মতোই বললেন— তুমি মোজাইক করা ফ্লোরে থাকা মানুষ। স্লামের ভয়াবহতার কথা কতটুকু আর বুঝতে পারবে? শোনো, জনকপুরী, টার্কমান গেট ইত্যাদি স্লামে ঘুরে বেড়িয়ে আমার জুতোর সোল ক্ষয় করে ফেলেছি। আমি সব কথা ভালভাবেই জানি। স্লাম বড় ভয়ানক জিনিস। তাছাড়া সেই জায়গা থেকে কুড়িয়ে আনা ছেলে….।

অসহায় হয়ে ঊর্মিলা সবার কথা শুনল সত্যি কথা, কিন্তু মনে মনে ভাবল দিল্লির রুক্ষ বাতাবরণের মধ্যে থেকে রূপচন্দ্র মহানগরের কর্কশতাকে আঁকড়ে ধরেছে। এই বাতাবরণ যখন শতকরা নব্বই জন মানুষকে গ্রাস করেছে— এরাই বা কেন বাকি থেকে যাবে?’

জগন্নাথ যাওয়ার পরে এক অন্য ধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করল ঊর্মিলা। এই নিঃসঙ্গতার কথা ভোলার জন্য সে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বেশিরভাগ সময় কাটাতে শুরু করল। তার সহকর্মী দুজন একদিন তাকে স্মরণ করিয়ে দিল।

—তোমার প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হয়ে এসেছে। ডিপার্টমেন্টের হেডকে ধরে কথাবার্তা বলা উচিত।

একদিন ঊর্মিলা ডিপার্টমেন্টের হেডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। ফাইলের একটা পাহাড় থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে ডিপার্টমেন্টের হেড প্রশ্ন করলেন— তুমি ঊর্মিলা ভট্টাচার্য? ডিপার্টমেন্টের সেমিনারগুলিতে কখনও অংশ নিয়েছ কি?

—অনেকবার স্যার।
—অনেকবার?

চোখ কপালে তুলে হেড তার মুখের দিকে তাকালেন। যেন বিশ্বাস করতে চাইলেন না।

—এখন কী কাজ করছ?
—রাম সাহিত্যে নারী।
—এসব কাজ অনেকেই করেছে….।

অনেকেই করেছে সত্যি কথা। প্রত্যেকের নিজের নিজের বলার কথা আছে। তাছাড়া সেই সময় ভারতবর্ষে নারীর ওপরে হওয়া কদর্য নির্যাতনের উদাহরণ নিয়েও…। হেড কিছু নতুন ফাইল বের করে নিল। সেও আর বেশিক্ষণ সেখানে বসে থাকা নিরর্থক বলে ভাবল। একটা সময়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল।

ডিসেম্বর মাস। ধুলোয় ধূসরিত দিল্লির রাজপথ। পথে দাঁড়াল সে। মনে হল হাত-পাগুলো যেন শুকিয়ে কর্কশ হয়ে গেছে। অথচ সেদিন পর্যন্ত নানাধরনের প্রসাধনসামগ্রী দিয়ে নিজেকে সাজিয়েগুছিয়ে রাখার কত যত্নই না ছিল তার! সেই আগ্রহ কোথায় গেল? সেই সৌন্দর্যবোধ? অসংলগ্ন সাজপোশাক, পুরনো জুতো, রুক্ষ মাথার চুল, ধীরে ধীরে যেন নিজের কাছে নিজেই অপরিচিত হয়ে পড়ছে।

আচ্ছা এখন কোথায় যাবে? এই মুহূর্তে কোথায় যাবে সে?

ধীরে ধীরে সে ওখলার বাসস্টপেজের দিকে এগিয়ে গেল।

ভিড়ের মধ্যে বসে ঊর্মিলার মনে হল সে একক ভয়জাগানো ধরনের নিঃসঙ্গ। অহরহ তার কানের কাছে মাত্র একটা কথাই যেন প্রতিধ্বনিত হয়। জগন্নাথ বলেছিল— ঝুপড়িতে বসবাস করা সেই খারাপ মেয়েদের সঙ্গে তার কোনও পার্থক্য নেই!

সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েটে বাস বদলি করার সময় ঊর্মিলার নিজেকে পাগল পাগল বলে মনে হল। কীসের এই উষ্মা? সে যখন শিশু ছিল বাবা তাকে রাস্তা পার হতে দিতে ভয় করত। আর আজ? আর আজকে? কত রাস্তা যে সে পার হয়নি!! নিঃসঙ্গতা দুরারোগ্য রোগের মতো অহরহ তাকে অনুসরণ করে চলেছে।

নামঠিকানা তার ভ্যানিটি ব্যাগে লেখা ছিল। এই সময়ে সে ওখলার সেই অবর্ণনীয় স্লামসাম্রাজ্যে পা রাখল। ভূতপ্রেতের মতো মনে হওয়া একটা দল একসময় তাকে ঘিরে ধরল। সেটা এমন একটি সময় ছিল যে সময়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে স্লামে টহল দিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলিকে স্লামবাসীরা গুপ্তচর বলে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল। টার্কমান গেট এবং ওখলার স্লামে বাস করা চালচুলোহীন ভিখারিরা মাথার উপরের ছাদটা যাওয়ার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকত।

একটা সময়ে একজন দুর্বল বৃদ্ধ ঊর্মিলাকে নিয়ে একটি কাঠের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। বুড়ো ভেতরে ঢুকে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে একজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ঊর্মিলার বুঝতে বাকি রইল না সেই মহিলাটিই জগন্নাথের মা।

গ্লানি এবং লজ্জা ঊর্মিলাকে কিছুক্ষণ যেন বিব্রত করে রাখল। অথচ নিজেই সে বুঝতে পারল না কেন এই গ্লানি।

মহিলাটি বলল— আপনি আমার ছেলেটিকে পড়াবেন বলে নিয়েছিলেন না? ভেতরে যাবেন কি? নাকি বাইরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

ঊর্মিলা বলল— বসব না। সে আবার যাবে কি?

—কীভাবে বলব সে যাবে কিনা? আপনাদের শপথ আর মাতাল মানুষের মদ খেয়ে নেওয়া শপথের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে কি?

দুর্বল বৃদ্ধটি গলাখাঁকাড়ি দিয়ে বলল— শপথ করাটা এই ধরনের লোকের বিলাসিতা মাত্র। অনেক তিক্ত কষায় অভিজ্ঞতা বোধহয় মানুষটিকে রুক্ষ করে তুলেছিল। তাছাড়া ছেলেটি এভাবে চলে আসার পরে কোনও প্রকারের ভাবানুভূতি আর বাকি ছিল না।

সে বলল— ভেতরে বসতে দেওয়ার মতো কোনও ব্যবস্থা নেই!

ঊর্মিলা ব্যস্ত হয়ে বলল— জানি, তোমাদের বর্তমানের অবস্থা খুব খারাপ। ছেলেদের বাবাও বোধহয় ফিরে আসেনি।

শাড়ির আঁচলটা চোখের সামনে নিতে চেয়ে মহিলাটি বলল— আপনার কাছ থেকে চলে আসার পরে সে জুগগি ঝুপড়ির অসৎ ছেলেদের সঙ্গ ধরল। এই ঠোঁট টিপলে দুধ বেরোনো ছেলেটি বলে, পৃথিবীর সব মানুষই নাকি খারাপ। যাদেরকে ভাল মানুষ বলা হয় তারা কেবল অভিনয় করে চলেছে মাত্র।

দূরের এক বিশৃঙ্খল দিগন্তে সূর্য অস্ত গেল। ওখলার স্লামখণ্ডের জোড়াতালি দেওয়া যুক্তিগুলিকে এখন কোনও এক মারাত্মক তুফান ছেড়ে দিয়ে যাওয়া ধ্বংসপ্রায় এক ভূমিখণ্ডের মতো মনে হল।

—এভাবে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?
—আমি যাই… সে যদি যেতে চায় পাঠিয়ে দিও। শোনো তার জন্য আমার বাড়ির দরজা সবসময় খোলা থাকবে।

তারপরে ঊর্মিলা মহিলাটির চোখের দিকে আঙুল দেখিয়ে একপ্রকার আর্তনাদ করে উঠল— আমি ওকে পড়াব বলেই নিয়েছিলাম। শপথ খাওয়া আমার কাছে কোনও ধরনের বিলাসিতার ব্যাপার ছিল না।

ডিসেম্বর মাসের সেই অসময়ের বৃষ্টি শুরু হল। একদিন সকালে ঊর্মিলা দরজা খুলে দেখল দরজার সামনে জগন্নাথ দাঁড়িয়ে আছে। গত চার মাসের ভেতরে তার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। রুক্ষ চুল। খসখসে শরীরের চামড়া। শতচ্ছিন্ন সাজপোশাক। মুখে বিড়ির গন্ধ।

—তোর অবস্থা এরকম হল কেন?

সে কোনও উত্তর দিল না।

তার বগলের কাছে পুঁটলিটা দেখে ঊর্মিলার অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না যে থাকবে বলেই এসেছে।

এই হরিজন বালকটি আর তার মধ্যে যে একটি প্রাচীরের সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রাচীর অবশ্য খসে পড়ল না। বরং এই প্রাচীরে যেন চুন তেল ঘষে আরও উজ্জ্বল করে তোলা হল।

—তাহলে আবার পড়াশোনা করবি বলেই এসেছিস?

সে উত্তর দিল না।

—এতদিন কোথায় ছিলি?
—নিগমবোধ ঘাটে।

বিদ্যুতের মতো একটা ভাবনা ঊর্মিলার মনে কাজ করে গেল। সেই নিগমবোধ! ভারতবর্ষের একমাত্র জায়গা যেখানে সাত মণ ওজনের কাঠ দিয়ে একটি নরদেহকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়। ভারতবর্ষের ওটাই একমাত্র জায়গা যেখানে আধপোড়া দেহ জলে ভাসাতে হয় না। সেখানে জগন্নাথ ছন্নছাড়া একদল ছেলের সঙ্গে দিন অতিবাহিত করে এসেছে।

ঊর্মিলা অনুভব করল তার গলাটা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে!

কী করবে? তাড়িয়ে দেবে নাকি?

না না কেউ একজন নিজের কাছে থাকুক।

এই নির্মম শহরে ঊর্মিলা যেন কাউকে চেনে না। বিদেশে পড়তে গিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া স্বামী, নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ভাই দাদা, বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসা রূপচন্দ্র এবং ঠাকুর… আর যশোবন্ত? ঊর্মিলার দুই চোখ সজল হয়ে এল। তার পিতামাতা সৎ ছিলেন। এক সুসংস্কৃত পরিবেশে সে বড় হয়েছিল। না না কি প্রয়োজন তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার? সত্যিই সে হয়তো এই রুক্ষ মহানগরে সোনা খুঁজে পেয়েছে!

সে মুখ-হাত ধুয়ে নিল। আগের রাখা জায়গাতে নিজের কাপড়চোপড় পরিপাটি করে রাখল। ঘরগুলি নিরীক্ষণ করে সে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

—আপনি ঘরদুয়ার পরিষ্কার করা বোধহয় ছেড়ে দিয়েছেন!

আপন মনে সে ঘরদুয়ারের ধুলোবালি পরিষ্কার করতে লাগল।

দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠা অদৃশ্য প্রাচীরটা কিন্তু একইরকম রইল।

দিল্লির এই অসময়ের বৃষ্টি তিনদিন পর্যন্ত চলল। এই তিনদিন ঊর্মিলার খবর নিতে অবশ্য কেউ এল না। সারাটা দিন বই পড়া এবং বিকেলবেলা ব্যালকনিতে বসে রোশনারা বাগিচা থেকে ডানা মেলা ভারি ভারি কাপড়ের পুঁটলির মতো মন্থরগতিতে উড়ে যাওয়া বাদুরগুলোকে দেখা এবং একপ্রকার শ্মশানের রূপ ধারণ করা চিন্তা সাম্রাজ্যের টহল দিয়ে বেড়ানো— এটাই ছিল তার কাজ।

সে মাঝেমধ্যে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল! ঊর্মিলার ভাত খাওয়ার সময়, চা খাওয়ার সময় সমস্ত কথাই সে জানত। উৎসাহের সঙ্গে সে বলেছিল এবার সে পরীক্ষায় সবাইকে চমকে দেবে!

চতুর্থ দিন তাকে কিছুটা অধৈর্য দেখা গেল। এই চতুর্থ দিনেও এই অসময়ের বৃষ্টি দিল্লি শহরকে পঙ্গু করে রেখেছিল।

একটা সময় যখন রোশনারা বাগিচার বাদুড়গুলি উড়তে আরম্ভ করল ঠিক তখনই সে গট গট করে বাইরের ব্যালকনিতে বেরিয়ে এল।

রুক্ষ কণ্ঠে সে বলল— নিগমবোধে বাস করা আমাদের হরিজন ছেলেগুলি হিন্দি শেখাতে আসা বিষ্ণুপ্রভাকরকে মেরে হাড় ভেঙে দিতে চেয়েছিল।

চিৎকার করে উঠল ঊর্মিলা—

—হরি হরি সেই নিরীহ মানুষটা তোদের কী করেছে?… নিরক্ষরদের মধ্যে সে দেবতার মতো কাজ করেনি কি? বেচারার সেই ক্ষয় হয়ে যাওয়া জুতো, শতচ্ছিন্ন খদ্দরের পোশাক! নিঃস্বার্থ সেবা নয় কি এটা?

জগন্নাথ একপ্রকার গর্জন করে উঠল—

—টাৰ্কমান গেট এবং নাজফগড়ে পড়ানো ছেলেগুলি এখন কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতে ওদের রাষ্ট্রভাষা পাশ করার প্রমাণপত্র।

তার নাকের পাটা দুটি ফুলে উঠল। বিড়ি টেনে কালো করা ঠোঁট দুটি এই সময়ে অত্যন্ত কুৎসিত রূপ ধারণ করল।

ঊর্মিলা নিশ্চুপ হয়ে রইল। সে কিইবা উত্তর দেবে? কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। ঊর্মিলার মনে হল সে যেন একটা ভয়ঙ্কর পুরুষের রূপ ধারণ করে ঘরের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিস্ময়কর! বিস্ময়কর!

সে পুনরায় বলল— এই তিনদিন আপনি বাড়ির ভেতর বসে আছেন, কেউ আসেনি আপনাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য! খুব খারাপ লাগছে তাই না?

কী বলছে সে? ঠোঁট টিপলে দুধ বের হওয়া এই বাচ্চাটা আজ অভিজ্ঞ মানুষের মতো কথা বলছে? দিল্লির নিগমবোধে সে শিক্ষা পেয়ে এল নাকি? সেই রহস্যময় নিগমবোধ?

বিকেলে একটা সময়ে সে অন্তর্ধান হয়ে গেল।

রাতদুপুরে সে ফিরে না আসায় ঊর্মিলা কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়ল। সে ছাদের উপরে উঠে গেল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। স্ট্রিটলাইটগুলিকে এখন বৃদ্ধের ছানি পড়া চোখের মতো দেখাচ্ছে। রোশনারা বাগিচার বাদুরের দল এই সময়ে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে, ওদের খণ্ড খণ্ড মেঘের মতো দেখাচ্ছে, যেন এক ভয়াবহ পরিবেশ। হঠাৎ ঊর্মিলার চোখে পড়ল দুটি ছায়ামূর্তি! পার্কের বাঁকটা পার হয়ে ওরা এদিকে এগিয়ে আসছে। এই রাজপথের বুকে আর কেউ নেই। শুধু এই দুটি ছায়ামূর্তি!

ঊর্মিলা ছাদ থেকে নিচে নেমে এল। দরজায় টোকা পড়ল।

দরজা খুলে ঊর্মিলা আর্তনাদ করে উঠল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্কের গবেষক যশোবন্ত রেইনকোটটা খোলার চেষ্টা করছে এবং এ যে জগন্নাথ! ঠোঁটে বিড়ির গন্ধ!

—নিগমবোধে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমার সঙ্গে যশোবন্ত সাহেবের দেখা হয়েছিল। আজ আমি কয়েদি ধরার মতো ধরে এনেছি যেন আর পালাতে না পারে। বললাম এই তিনদিন আপনি ভূতের মতো বসে আছেন।… শুনুন আপনি মজা করুন। আপনি ফুর্তি করুন। এই সিঁড়িতে বসে আমি পাহারা দিতে থাকব। কেবল যাওয়ার সময় আপনার কাছে আসা পুরুষদের আমার ভাঙা একটা টিনে দুই-একটি টাকা-সিঁকি ছুড়ে দিয়ে যেতে হবে। আমি সিঁড়িতে বসে পাহারা দিতে থাকব কিন্তু!!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...