প্রাগের গবলিনের গল্প

নিরুপম চক্রবর্তী

 

রুশ দূতাবাস থেকে ঢিলছোঁড়া পথ দূরে
প্রাগ-৬ এ বসে আছে পুতিনের গবলিন স্ট্যাচু।
দীর্ঘপুচ্ছ জড়িয়েছে গ্যাসের পাইপ জুড়ে,
উত্তোলিত দৃঢ়হাতে জানিয়েছে নাৎসি স্যালুট!
(চলার পথেতে তাকে দেখেছ কি, ডিয়ার ওয়াটসন?)
সেদিন তুষারপাতে ঢেকে গেলে সমস্ত শহর
কোনও এক আগন্তুক তাকে এসে দেখে গেছে
বরফে জুতোর ছাপ রেখে।
(নতুন জুতোর ছাপ, বুঝেছ ওয়াটসন,
লোকটা বিদেশি আর
সদ্য কিনেছে এই শীতের নতুন বুট
মুস্টেকের টোমাস বাটার বিপণীতে!)

লোকটা বিদেশি সে তো জানা গেল,
কিন্তু তাকে খুঁজব কোথায়?
বরফের স্তূপে আজ ঢেকে গেছে রানওয়ে,
তাপমাত্রা নেমে গেছে হিমাঙ্কের চোদ্দ ডিগ্রি নিচে,
তবু সে নাছোড়বান্দা? তবু সে উত্তরে উড়ে যাবে?
(সঠিক জানি না আমি হে বন্ধু ওয়াটসন,
চলো তাকে খুঁজে আসি
লিসোলায়ে গিয়ে)

শহরের শেষপ্রান্তে লিসোলায়ে, এর পরে শহরের শেষ।
হে প্রাগ!, হে প্রাহা দেব!, অপূর্ব সুন্দর এই লিসোলায়ে জনপদে
আন্দোলিত উপত্যকাগুলি
আকণ্ঠ বরফ গিলে শুয়ে আছে আজ।
রাত্রি গভীর হয়, নিঝুম নৈঃশব্দ্য নামে,
জনমানবের সাড়া নেই।
সেইখানে শীতরাতে সে বিদেশি একা হেঁটে গেছে
তুষারের স্তূপে এঁকে ক্ষতচিহ্ন বাটার বুটের!

দিশাহীন, নিদ্রাহীন, সে বিদেশি কী যে চেয়েছিল
সঠিক জানে না কেউ, জানা গেছে শুধু এইটুকু:
অনেক বিষণ্ণ পথ অন্ধকারে একা পার হয়ে
অকস্মাৎ দেখেছিল পথপ্রান্তে জ্বলে এক
আলোকিত অপার্থিব তরু!
সে তরু কি প্রকৃতই অপার্থিব? অলৌকিক?
মহাজাগতিক? নাকি কেবলই বিভ্রম কিংবা
কপোলকল্পনা?
(বিষদ খবর নেই কারও কাছে, শুনেছি ওয়াটসন, তবে,
নিরুপম চক্রবর্তী প্রাগ-ঐতিহাসিক নামক
কবিতায় লিখে গেছে, এরই আশেপাশে আছে
হিটলারের প্রতিরোধে মৃতদের স্মৃতির ফলক!)
শুধু জানা গেছে:
অবাক বিস্ময়ে সেই আলোকিত তরুমূলে
অনিকেত সে বিদেশি
দাঁড়িয়ে দেখেছে তার পাশে
টুঁটিচাপা অন্ধকার,
পুতিনের গবলিন সেখানে নিঃশব্দে হেঁটে আসে।।

 

দাস্‌ প্রাগ কাপিতাল

দেভিস্কা মেট্রোর কাছে বসে আছে ২০২৩-এ কার্ল মার্ক্স।
অবিন্যস্ত শ্মশ্রু-কেশ ধূসরিত অযত্নের আলিঙ্গন মাখা,
তাপ্পিমারা কোটপ্যান্ট, শতচ্ছিন্ন জুতো,
বোহেমীয় সর্বহারা, শৃঙ্খল মোচন করে হারাবার ভয়ে শুধু
আঁকড়িয়ে ধরে আছে গুটিকয় মদের বোতল আর
এক প্যাক বাসি পাউরুটি।
এভাবেই দেখি তাকে রোজ। এভাবে সে আনন্দেই থাকে।

তার বন্ধু রোমানী জুকোভা। ‘জিপসি মাগী দাগী চোর’
(আমাকে সতর্ক করে বলেছিল একজন প্রকৃত সুহৃদ!)
বেজায় গরীব আর বাকিসব অধিকাংশ জিপসিদের মতো:
একরাশ ঘৃণা সয়ে সমাজের প্রান্তে বেঁচে থাকে।
বোহেমীয় কার্ল মার্ক্স তবু কেন স্মিত অনুরাগে, তার দিকে চেয়ে আছে?
আমি তার কিছুই বুঝি না!

আজ সাত সকালেতে দুজনে মেতেছে বুঝি সমাজতাত্ত্বিক কোনও
দীর্ঘ অন্বেষণে।
ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষেরও আগে, জুকোভা বংশের নাকি বাস ছিল
ভারতীয় উপমহাদেশে। তাদের ভাষায় নাকি আজও খুঁজে পাওয়া যায়
বাংলা ব্যাকরণে লেখা প্রথাগত রীতিনীতিগুলি
(জুকোভা বলেনি সেটা, নিজেই দেখেছি খুঁজে উইকিপিডিয়াতে!)
বাদামী ত্বকের মেয়ে: অস্নাত, অভুক্ত আর অসুন্দর মুখে মৃদু হাসি।
উত্তেজিত মার্ক্স বলে চলে:
‘জানা গেছে সাম্প্রতিক জনগণনায়
চেকদেশে দু’ শতাংশ জিপসি আর
কারাগারে তারা ষাট ভাগ!’
কেন যে এমন?
ভেবে ভেবে হতভম্ব দুজনেই,
বোহেমীয় কার্ল মার্ক্স, আর তার জিপসি বান্ধবী।

আমি তো লিখতে চাই জিপসি ব্যালাড
যেরকম লোরকা লিখেছিল,
আমি তো বুঝতে চাই প্রাগ শহরের এই অতিনব্য দাস্‌ কাপিতাল:
বেজায় আওয়াজ করে পুলিশের গাড়ি এসে
থেমে যায় দেভিস্কায়, যেখানে মার্ক্সের সঙ্গে
রোমানী জুকোভা বসে আছে।

সেখানে রাস্তার মোড়ে একরাশ অবজ্ঞায়
সেইদিকে চেয়ে থাকে চু-দা-খাই, ভিয়েতনামী অভিবাসী
তার গল্প লেখা আছে এই নব্য দাস্‌ কাপিতালে।
তার বাবা ভিয়েতকং, হ্যানয়ের, এককালে দুর্ধর্ষ গেরিলা;
এইদেশে ইমিগ্র্যান্ট (দীর্ঘদিন!), ইদানীং বিপ্লবের স্বপ্নহীন,
ছেলের গ্রোসারি স্টোরে মাঝেমধ্যে এসে বসে থাকে।
চু-দা-খাই দিনরাত খাটে:
কলাটা মুলোটা ঠিক কোনভাবে বেচে দিলে
আসল দামের চেয়ে ঢের বেশি লাভ করা যায়
এটা নিয়ে সে এবং তার বউ করে যায় দীর্ঘ গবেষণা!
দুরত্ব বজায় রেখে চু-দা-খাই চুপচাপ দ্যাখে:
জেরা শেষ। পুলিশের গাড়ি চলে যায়।
জুকোভা বিদায় নেয়। একমাত্র চু-দা-খাই জানে
কীভাবে নিপুণহাতে বিদায়ের ঠিক আগে
যুবক পুলিশটির পকেটের ওয়ালেট
চলে আসে জুকোভার আঙুলের ভাঁজে!

চু-দা-খাই অনেক দেখেছে আর শিখেছে অনেক আজ।
এবার ভাবতে থাকে প্রাগের নবীন এই দাস্‌ কাপিতাল
তার ব্যবসায় ঠিক কোন কোন কাজে এসে যাবে!


*হেডার-কোলাজে বাঁদিকের ছবিটি পুতিনের নাৎসি গবলিন রূপ; মাঝের ছবিটি নাৎসি প্রতিরোধে নিহত পার্টিসানদের স্মৃতিফলকের কাছে গভীর রাতে আলোকিত তরু; এবং ডানদিকের ছবিটি দেভিস্কা মেট্রো স্টেশনের ছবি। সমস্ত ছবিই কবির তোলা

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...