সাম্রাজ্যবাদীদের মদতপুষ্ট দেশীয় লুটেরাদের লোভের বলি সুদানের মানুষ

শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়

 


নিবন্ধকার, সমাজকর্মী

 

 

 

 

সুদানে এখন যা চলছে, তা আসলে একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অপরদিকে রুশ ও চিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ভয়াল দ্বন্দ্ব, নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে যার মূল্য চোকাতে হচ্ছে সুদানের সাধারণ মানুষকে

 

কথার কথা হয়েই থাকছে সংঘর্ষবিরতির ঘোষণা। গত ১৫ এপ্রিল থেকে রাজধানী খারতুম সহ সুদানের দারফুর এলাকায় বিরাম নেই গোলাগুলির, বাতাসে ভাসছে বারুদের গন্ধ৷ জ্বলছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট৷ খাদ্য-পানীয় অপ্রতুল। বিপন্ন মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে দিন গুজরান করছেন। দেশের রাজনৈতিক-সামরিক ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, এই নিয়ে সশস্ত্র সংঘর্ষ বেধেছে সুদানের বর্তমান শাসক, সামরিক বাহিনি ‘সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস’–এর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল-বুরহানের সঙ্গে আধাসেনা বাহিনি ‘রাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’-এর প্রধান জেনারেল মহম্মদ হামদান ডাগালো ওরফে হেমেদতি–র। ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচশোর বেশি নাগরিক। আহতের সংখ্যা বিপুল। ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

জন্মলগ্ন থেকেই আফ্রিকার দেশ সুদানের সঙ্গী রাজনৈতিক অস্থিরতা। তেল, গ্যাস, সোনার মতো দামী প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি লোহিত সাগরের তীরে অবস্থানের কারণে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব— এই দুয়ে মিলে সুদানের উপর গোড়া থেকেই আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও প্রতিবেশী দেশগুলির লোভের কুনজর। ১৯৫০-এ স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে সুদান উপজাতিগত সংঘর্ষ, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদিতে বিধ্বস্ত হয়েছে বারবার। সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ১৯৮৯ সালে সুদানের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন জেনারেল ওমর আল বশির। দীর্ঘ ২৯ বছর শাসন চালান তিনি। বিশ শতকের প্রথম দশকে ডারফুরে আরব এবং অ-আরব উপজাতি সংঘর্ষ সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট বশিরই তৈরি করেছিলেন আরএসএফ নামে আধাসামরিক বাহিনি। এর মাথায় বসিয়েছিলেন হেমেদতি–কে। চিন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে বরাবরই আমেরিকার বিরাগভাজন ছিলেন প্রেসিডেন্ট বশির। নাগরিকদের ওপর তিনি নির্মম দমনপীড়ন চালাচ্ছেন— এই অভিযোগে পশ্চিমি দেশগুলি বশিরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ তোলে। নানা ঘটনাপ্রবাহে ২০১১ সালে দেশটি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। অধিকাংশ তেলের খনির দখল নিয়ে জন্ম নেয় দক্ষিণ সুদান।

জেনারেল বশির যখন প্রেসিডেন্ট, সেই সময়েই লোহিত সাগরে নৌঘাঁটি তৈরির বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কথা শুরু হয় সুদানের। এতে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি, বিশেষত আমেরিকা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এদিকে চলতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিণামে সুদানের মানুষের জীবন জর্জরিত হতে থাকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের প্রবল সমস্যায়। ঘটতে থাকে ধর্ম ও উপজাতিগত নানা সংঘর্ষ। ২০১৮–র ডিসেম্বরে সুদানের সাধারণ মানুষ দেশে গণতন্ত্র কায়েম ও প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে পথে নামে। আন্দোলন ব্যাপক রূপ নেয়। সামরিক বাহিনির একটি গোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়। প্রেসিডেন্ট বশির পদত্যাগ করেন। কয়েকটি রাজনৈতিক দল, সামরিক বাহিনির ওই গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীদের জোটের একটি সার্বভৌম কাউন্সিল অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করে শাসনক্ষমতায় বসে। প্রধানমন্ত্রী হন আবদুল্লা হামদক। সিদ্ধান্ত হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকার ২০২২–এর মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গড়ার দিকে এগোবে।

ইতিমধ্যে ২০২১ সালের অক্টোবরে সামরিক বাহিনির কর্তা বুরহান আরএসএফ-এর কর্তা হেমেদতির সহযোগিতায় অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হামদককে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে সার্বভৌম কাউন্সিলের প্রধান হয়ে বসেন। অভ্যুত্থানের সমর্থনে এগিয়ে আসে আমেরিকা এবং সুদানের প্রতিবেশী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ইত্যাদি দেশ। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল নিরস্ত্র জনতার আন্দোলন। তাদের উপর নির্মম হামলা চালায় বুরহান সরকার, পাশে থাকে হেমেদতি বাহিনি। এখন সুদানে ক্ষমতার দখল নিয়ে এই বুরহানের সঙ্গেই দ্বন্দ্ব বেধেছে তাঁর প্রাক্তন সহযোগী হেমেদতির।

২০২১ সালে সরকার তৈরির সময় থেকেই সেনাপ্রধান বুরহান ও আধাসেনা কর্তা হেমেদতির মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু। এলাকায় জায়গা করে নিতে এই দ্বন্দ্বে প্রথম থেকে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা সহ পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। সঙ্গে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, সৌদি আরব, মিশর, লিবিয়া ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশ।

দীর্ঘদিন ধরেই চিন ও রাশিয়ার প্রভাব রয়েছে সুদানের উপর। অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ ছাড়াও সুদানের খনিগুলির নিরাপত্তার কাজে ভাড়াটে সেনা নিয়োগ করে রাশিয়া। আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী আজকের সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ইদানীং সেই ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি সুদানে এসে বুরহান ও হেমেদতি, দুজনের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা করেছেন রুশ বিদেশমন্ত্রী। লোহিত সাগরে রুশ নৌঘাঁটির চুক্তিটি পরিণতির দিকে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে। এছাড়া, রুশ বেসরকারি পুঁজির ব্যবসাক্ষেত্র মধ্য আফ্রিকায় যাতায়াতের জন্য সুদানের আকাশপথ ব্যবহার রাশিয়ার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। চিন দেশটিও দীর্ঘদিন ধরে সুদানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রেসিডেন্ট বশিরের সময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সুদানকে অস্ত্র বিক্রি করেছে চিন। এখন তার লক্ষ্য আরব দুনিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করা। সেই পথে পা বাড়াতে সুদানকে পাশে চাই চিনেরও।

ফলে চিন এবং রাশিয়া, উভয়েরই নিজস্ব অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে প্রয়োজন সুদানের স্থিতাবস্থা। এর বিপরীতে সেখানে অস্থিরতা জিইয়ে রাখাটাই উদ্দেশ্য পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী ও তার অনুগত সুদানের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের। কারণ এর সুযোগে কখনও বুরহান, কখনও হেমেদতির পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের বিরোধ উস্কে দিয়ে রাশিয়া-চিনকে হঠিয়ে সুদানে নিজেদের জায়গা করে নিতে সুবিধা হবে তাদের।

সব মিলিয়ে সুদানে এখন যা চলছে, তা আসলে একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অপরদিকে রুশ ও চিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ভয়াল দ্বন্দ্ব, নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে যার মূল্য চোকাতে হচ্ছে সুদানের সাধারণ মানুষকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...