অনিমিখ পাত্র-এর পতনমনের কুর্সি: একটি নিত্যনতুন কবিতার বই

প্রীতম বসাক

 

অনেক প্রকার দেখি। ভাল থাকা সোজা মনে হয়

মনের মতোই দেখি। পেখম হয় চোখে

মৃদুমন্দ রান্নায় ভরে উঠছে ঘ্রাণকোরক
শিশিরে ভরে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা

উঠোন সেলাই দেখি। টিপসই দেখি
কারও ভাঙা ঘরে আজ বন্ধকীদ্রব্য ফিরে এল

কেউ কান্নায় ভাল হয়ে আছে
কেউ কাউকে না বলছে না

আমি একটু ছোট হয়ে বসি
আমি একটু বাবা হয়ে যাই।

(সকালবেলা)

এই কবিতাটি অনিমিখ লিখেছে। এই কবিতাটি অনিমিখ লিখে ঠিক করেনি। কেননা এই কবিতাটি আমার লেখার কথা। সুতরাং আমি এই কবিতার বিরুদ্ধে অনিমিখের বিরুদ্ধে পুলিশে কেস ঠুকে দিতে পারি, ওর পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিতে পারি কিংবা ওকে প্রেম নিবেদন করতে পারি। বলতে পারি এসো চপ-ঘুগনি খাও। না আমি সেসব কিছুই করব না। জাস্ট লেখাটা আমার পিতা-পুরাণে ঢুকিয়ে দেব। আমার নামে। কবিতাচুরি পৃথিবীর সবচেয়ে শিল্পময় চুরি। কেউ আমার গায়ে থুথু ছেটালেও আমি নির্বিকল্প সমাধি নেব। কেননা এই কবিতা আমারই লেখার কথা ছিল। এবং এই কবিতাটি আমার হয়ে অনিমিখ লিখেছে। ও পেখম নামটা জাস্ট ঝেড়েছে আমার মেয়ের লালা থেকে। এমনকি বাবা শব্দটাও ও ঋণ করেছে আমার জোব্বা থেকে। বন্ধুরা ওর এই অবিমৃষ্যকারিতা ক্ষমা করুন। ওকে শাস্তি দিন। ওকে আমার তরফ থেকে একগাল ভালবাসা দিন। এই কবিতাটি আমার লেখার কথা ছিল। এবং এই কবিতাটি অনিমিখ পাত্র লিখেছে।

এবং এই কবিতাটি আমি লিখতে পারিনি বলে নিজেকে ধিক্কার দিই। আসলে এই বইয়ের কবিতাগুলো কেন আমি লিখতে পারিনি তাতেও নিজেকে বেশ বদরাগী করে তুলি। কেন আমি লিখতে পারিনি এমন পংক্তি—

পাখির উপরে ভর করেছে ছয়লাপ
তার টিকে থাকা এমন হেমন্ত
যে ব্যথা পর্যন্ত পৌঁছতে মলম ফুরিয়ে যায়
সমবেত গাছেদের জনগণমন
খুন অবধি চেপে যায় মোটর আরোহী

(পাখি)

কিংবা এইভাবে দেখতে পারাটা আমি কেন পারিনি—

আলোর জ্যামিতি শুঁকে এই যে এতটা আসা
যেন অপেক্ষায় আমাকে করে
যেন অকালে, বৃষ্টির দিনে
হারিয়ে ফেলি দু-একটা ইচ্ছের মেগাপিক্সেল

(ইচ্ছে)

ইংরেজি শব্দ তো আমরা আকছার ব্যবহার করছি কিন্তু তার এই নতুনরকম কয়েনেজ আমাকে মুগ্ধতা অবধি হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অনিমিখ কত সাবলীল হয়ে উঠছে এই লাইনদুটি লিখতে—

যখন আশা ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙেই যাচ্ছে, রিস্টওয়াচ বন্ধ করো
নৌকা থেকে ফেলে দাও চিৎকারগুলোকে

(চিৎকারগুলো)

আরও যা ভাল লাগার অন্ততপক্ষে আমার মতো পাঠকের কাছে যে কিনা কবিতা পড়তে পড়তে হদ্দ হয়ে গেছে কিংবা নতুন কবিতার খোঁজে হাপিত্যেশ করে বাজার করতে যাচ্ছে, তার কাছে অনিমিখ টাইগার হিলের সকাল। চিরপুরাতন চিরনতুন। আশ্চর্য, ‘নতুন কবিতা’ শব্দযুগল লেখার পরই নজর পড়ল এই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে ‘সপ্তর্ষি’ থেকে ২০০৯-এ। সহসা চলকে উঠল নতুন কবিতা নিয়ে বারীণ ঘোষালের ভাবনাগুচ্ছ। অনিমিখও নিশ্চয়ই সেইসব ভাবনা দ্বারা জারিত হয়েছে। তবে অনিমিখ নিজের কবিতা নিয়ে অযথা জোর খাটায়নি। নতুন শব্দজোট নির্মাণ করেছেন চাষির দক্ষতায়। পরিশ্রমের ঘামগন্ধ তাতে লেগে নেই। অনাবিল হাওয়া যাতায়াত করে ঘুলঘুলি দিয়ে। বাংলা কবিতার পাঠক হিসেবে আমাকে তা আশ্বস্ত করে। ‘বুকের জায়গা’ কবিতায় অনিমিখ যখন লেখে “পাহাড় দিয়ে গুণ করো যেকোনও অভাব, দেখো কেমন পুরুলিয়া হয়”, তখন একইভাবে নতুন লাগে, আবার আমাকে ভাবতে বাধ্য করে।

যেমন এই অংশটুকু—

শব্দই পায়ে পায়ে ভারতীয় কায়দার শ্রদ্ধা বানায়
রোদ নামিয়ে হত্যা নামায়
তৈরি করে রাখা কল্পনা
আনন্দের নামে কয়েকটা ভ্রমণপথ
অর্কিডের নামে একটু বিশ্বাসের ছায়া।

(অর্কিড)

বোধগম্যতা আজ আর কবিতার শর্ত নয়। নির্মাণ যদি সাবলীল হয়ে ওঠে তা পাঠকের কাছে সেই আমলকি হয়ে ওঠে, যা মুঠোয় ভরে নিলে, দূরে কোথাও সেতার বেজে ঊঠে। না হলে, কবিতায় আর কসরত দেখতে কে রাজি হবে! পোয়েটিক হওয়া ছাড়া কবিতার আর কোনও মাথাব্যথা থাকতে পারে না। দুঃখিত করতে না পারলে আমি অন্তত সে কবিতার কাছে যাব না। অনিমিখ আমাকে বিষাদের দাঁত দিয়ে মৃদু কামড়ে দিয়েছে। আমাকে একাকী করেছে আঙুলে আঙুলে।

এসব প্রত্ন নিয়ে বেশ থাকছিল চোখের সমাজ
ঘনঘটা’র ঘটা’টি আজ বারণ হয়েছে
ঈশানে বেড়েছে প্লাস্টিক
নতুন দিনের টবে কেমনভাবে জল পাচ্ছ
কীভাবে এমন থাকছ, বাজে কবিতার মতো দুঃসাহসী
গ্রামোফোনের মতো দূরত্বময়

(গ্রামোফোন)

এখন এই একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ সিঁড়িতে পা রেখে ‘ঈশান’ শব্দটা কোনও কবি ব্যবহার করার সাহস দেখাচ্ছেন এবং তার পাশেই ‘প্লাস্টিক’ রেখে তাকে নতুন টোন দিচ্ছেন— তাতেই একজন পাকা কবির কেরামতি নকশা হয়ে যাচ্ছে।

ওই যাঃ, ভাটাতে ভাটাতে এখন পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থের নাম ঘোষণা করতে বেমালুম হয়ে গেছি। ‘পতনমনের কুর্সি’। বেশ অদ্ভুত একটা নাম। আমি তো মনেই রাখতে পারি না। ৬৪ পাতার বইটিতে কবিতারা তিনটি ভাগে বিভাজিত—

১) প্রাণপাখি
২) ভয়ের বিবেক
৩) চেনা ভাষার আবহবিকার

আবার প্রতিটি বিভাগের শুরুতে রয়েছে বিভাব পত্রিকা এবং এবং এবং এই তিনটি ক্ষুদ্রকায়া যে কি বিভীষণ কবিতা তা না পড়লে বোঝা যায় না। লোভ সামলাতে পারছি না, অনিমিখ। পারলে সব কবিতাই আমি তুলে দিই।

প্রথম বিভাব—

হাওয়া নিয়ে খেলেছিল যারা সব ম্যাপের শ্রমিক

প্রশ্নপাতা নিয়ে গেছে তারা

শুধু আত্মপ্রতিকৃতি

আয়নার ভেতরে স্থায়ী, রক্তের ভেতরে বুদ্ধিমান

জয় গোস্বামী হতাম যদি। ভেঙে ভেঙে তৈরি করতাম পিরামিড। শুধু বলি রক্তের ভেতরে আমাদের বুদ্ধিমান হওয়াই কি আমাদের ক্লান্তি আর ভয়ের যুগলবন্দি নয়?

‘ভয়ের বিবেক’ আসলে কবির নিজের ভয়ের কাছে গুটিশুটি হয়ে বসা। ভয় সামাজিক-আমির কাছে ব্যক্তি-আমির, ভয় বন্ধু-আমির কাছে ব্রুটাস-আমির, ভয় সাংসারিক-আমির কাছে ভুল-আমির। এই এতরকমের ভয় নিয়েই তো আমাদের চলা এবং চলে যাওয়া। কিন্তু তা বলার ধরন কত আনকোরা—

কত যে রকমভাবে মরে যায় গাছ

আমাকে আর ভাবতে হয় না
ঘন ঘন ঘটনায় থাকি
ওই তো দেখছি হাত-পাগুলোকে, চতুর্দিকে ভয় দিয়ে ঘেরা
যে কোনও সময় জড় হয়ে যেতে পারে

শরীরের মানচিত্রে কতখানি ঘর আঁকতে পারি
কতখানি রসক্রিয়া টের পাই
বেড়ে উঠি, হলুদ পাতাকে ত্যাগ করি

ঘরের ভেতরে হাওয়া পিণ্ড হয়ে আসে

যে কোনও রকমভাবে ভয় হয়

আমি

এই যে ‘আমি’তে এসে কবিতা শেষ হল, এই আমি আদিকাল থেকে শুরু করে উত্তরাধুনিক আমি। যন্ত্রণা কিন্তু একই। ভয়ও। আর ভয়ে কী কী কাজে লাগে। কবি তাও জানিয়েছে। পাঠক নিজেই পড়ে নেবেন।

এই বইয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতাগুলি আছে তৃতীয়ভাগে অর্থাৎ ‘চেনা ভাষার আবহবিকার’ অংশে। ছোট ছোট ছাত্র ঠেঙিয়ে খাওয়ার সূত্রে আবহবিকার শব্দটির সঙ্গে আমার রোজকার ওঠাবসা। আমার চমৎকার লাগে এই শব্দটি। আসলে আবহাওয়ার যে কোনও উপাদান, এই যেমন ধরুন উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা প্রভৃতির দ্বারা শিলায় যে বিকার ঘটে মানে শিলার যে ক্ষতি হয় তাকেই আবহবিকার বলে। শল্কমোচন, প্রস্তরচাঁই বিচ্ছিন্নকরণ, ক্ষুদ্রকণা বিসরণ— কীসব কাব্যিক নাম তাদের। কিন্তু ওই ক্ষত। অনিমিখ যাকে বিশেষ থেকে নির্বিশেষ করেছে। ব্যবহৃত হতে হতে যে ভাষার পাথরে স্টোন আলসার দেখা গিয়েছে তাকে শুশ্রূষা দিয়েছে অনিমিখ। তীব্র কুঠার হাতে তাকে সার্জিকাল স্ট্রাইক করেনি। গভীর মমতায় তার সেবা করার চেষ্টা করেছে। দাবিহীনভাবে। ‘পতন মনের কুর্সি’-র লেখাগুচ্ছ কিংবা ‘মা’ তার দারুণ উদাহরণ। কয়েক টুকরো আপনাদের জন্য—

ক) ‘রাগপ্রধানের গলায় সে স্কার্ফ লাগিয়েছে। আর বয়সের কেবিন হু হু করে’
খ) ‘কোহলময় টপ্পা মারে। ভাঙা পায়ের আত্মাকে সেলাই করে দেয়।
তার অনন্তকালের জামা থরে থরে বিপ্লব ফোটায়’
গ) ‘একগাদা ফিজিক্সেও কুয়াশারা আর্বান হল না’
ঘ) ‘ক্রিয়াপদের নব ঘুরিয়ে অহরহ বাতাস গোটায়।’
ঙ) ‘এল কুসুমের বায়োলজি। আশা এল। রোদের জাফরি এল মানানসই টবে।’

এবং ‘মা’ কবিতাটি পুরো তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। এই কবিতাটিতে অনিমিখ নিজেকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে যেখান থেকে ওকে ঈশ্বরের মতো লাগে।

গাছ আমাদের অহঙ্কার শেষ করে দিচ্ছে
যেন অনুবাদের ঝড় বয়ে গেছে এই সকালবেলা
মানুষগুলো গতর খাটাতে গিয়ে কবি নিয়ে ফিরেছে সবাই
গাছ তাদের কাহিনি দিয়েছে। পুলিশ দিয়েছে।

মাত্রার খোসা ছাড়িয়ে বেরিয়েছে তার ভেতরের কলাটি যা শিল্প নয়
কিংবা কে বলতে পারে সমস্তটাই শিল্পের ভেতর
শিল্পের মা হয়তো তত কোমল নয়

সাদা ভ্রূণের পৃথিবী দুলছে অথচ গাছের কোনও বিকার নেই

না, এর পর আমার আর কোনও কথা থাকতে পারে না। কবিতাপাঠের অহঙ্কার ধরা পড়ার আগেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাই। যে নতুন চামড়া গজাল তা সদ্যোজাত আমার মেয়ের মতো। ‘এরকম গাছপালা/ চারপাশে টাঙিয়ে আমি/ ক্রমশ মানুষ হয়ে যাব।’

পতনমনের কুর্সি। অনিমিখ পাত্র
প্রথম প্রকাশ
২০১৬। দ্বিতীয় সংস্করণ ২০২৩
প্রকাশক-সপ্তর্ষি প্রকাশন। প্রচ্ছদশিল্পী-বিপ্লব মণ্ডল
বিনিময় মূল্য- ১৫০ টাকা

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...