মোসাব আবু তোহা

পাঁচটি কবিতা

 


অনুবাদ: সোহেল ইসলাম

 

 

 

মোসাব আবু তোহা গাজার বেইট লাহিয়ায় বসবাসকারী একজন তরুণ প্যালেস্তিনীয় কবি। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক। গল্প এবং কবিতা লিখতে ভালবাসেন। এডওয়ার্ড সাইদ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা, যা গাজার একমাত্র ইংরেজি ভাষার লাইব্রেরি। ইজরায়েলের দিনরাতের আক্রমণে গাজার অনেক কয়টা লাইব্রেরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায়, তিনি ২০১৪ সালে ইংরেজি বইয়ের অনুদান সংগ্রহের জন্য একটি প্রচারাভিযান শুরু করেছিলেন যা গাজায় ইংরেজি বইয়ের জন্য প্রথম পাবলিক লাইব্রেরির রূপ পায়। নোয়াম চমস্কি পর্যন্ত এই উদ্যোগকে ভালবাসা ও সম্মান জানিয়ে লাইব্রেরিতে বেশ কয়েকটি অটোগ্রাফযুক্ত বই দান করেছেন, মোসাবের জন্য দু-লাইন লিখে জানিয়েছেন— "এই লাইব্রেরি এক অনন্য সম্পদ, গাজার তরুণদের জন্য এক আশ্রয়স্থল, এক বিরল আলো এবং আশার ঝাঁকুনি।"



২০১৯-২০২০ সালে, মোসাব তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে হোস্ট করা একজন হার্ভার্ড স্কলার-অ্যাট-রিস্ক ফেলো হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। হার্ভার্ডে থাকাকালীন, তিনি "দেওয়াল জুড়ে সংলাপ" এই শিরোনামে একটা সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। এই সেমিনার আয়োজনের ফলে মোসাব অনেক অভিজ্ঞতা ও সত্যের মুখোমুখি হন। যা প্রভাব তাঁর পরবর্তী লেখায় উঠে আসতে থাকে। মোসাবের কবিতা প্যালেস্তাইনের কথা বলে, ধ্বংস হতে প্রায় মুছে যাওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা গাজার কথা বলে। মোসাবের সদ্যোপ্রকাশিত বইয়ের নাম: Things You May Find Hidden in My Ear: Poems from Gaza (2022, City Lights)

 

আমার ঠাকুরদা

আমার ঠাকুরদা আঙুলের কড়ে আঙুল ছুঁয়ে
বাড়ি ফেরার দিন গুনতেন
গণনার জন্য ব্যবহার করতেন পাথর
মেঘ
পাখি
মানুষ
কেউই বাদ যায়নি

ঠাকুরদার গণনা থেকে শিখেছি
শূন্যতা কতটা ভয়ানক
ঠাকুরাদকে দেখে শিখেছি
বাড়ি ফেরার অপেক্ষা
মৃত্যুর আগে তিনি ৩৬ বছর দরজা আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন
শেষের দিকে এসে
তিনি সব ভুলতে বসেছিলেন
গণনা
মানুষ
এমনকী বাড়ির রাস্তাটাও

 

দরজা

শরণার্থী শিবিরে কোনও দরজা থাকে না

বিস্ফোরণের পর
পড়ে থাকা দরজায় ধুলো জমে
লেগে থাকা রক্তের দাগ— শুকিয়ে যায়

ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া কাটা আঙুল
তখনও ধরে থাকে পুরনো চাবি
বাবার কাছ থেকে পাওয়া, ঘরের চাবি

ধ্বংস নিশ্চিত জেনেও আমরা দরজা বানাই
কান্না লুকোনোর জন্য বানাই দরজা

 

শিরোনামহীন

এক বাবা
মাঝরাতে জেগে উঠে
তার চার বছরের ছেলের হাতে রং করা
একটা দেওয়াল দেখছেন
গতকালের বোমা হামলায়
যে বাবা আজ মৃত
যে শিল্পী আজ মৃত

রঙিন দেওয়াল
এবছর চার ফুটের
পরের বছর পাঁচ কিংবা ছয় পার করে যাবে
শিল্পী তো মৃত
কে আর নতুন রঙের খেলা দেখাবে

 

আমার কানে লুকোনো যে জিনিসগুলো আপনি খুঁজে পেতে পারেন

১.

কানে আলতো স্পর্শ করে
ভেতরে তাকালে দেখতে পাবেন—
কোথাও কোথাও মায়ের ডাক লেগে আছে
মনোযোগের সমস্যায় মাথা ঘুরে উঠলে
মায়ের ডাক আমার ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে

কখনও সখনও গুনগুন করা আরবি গানের মুখোমুখি হতে পারেন,
ইংরেজিতে আবৃত্তি করা কবিতার মুখোমুখি হতে পারেন
এসব আমি বাড়ির উঠোনে পাখির কিচিরমিচির থেকে শিখেছি

আপনি যখন কাটা কান আবার সেলাই করবেন,
সব ফিরিয়ে দিতে ভুলবেন না
একে একে সাজিয়ে দেবেন সব
যেভাবে

আপনার বুক শেলফে সাজানো থাকে বই

 

২.

ড্রোনের শব্দ,
F 16-এর গর্জন,
জমিতে, বাড়িতে, শরীরে বোমা পড়ার চিৎকার,
উড়ে যাওয়া রকেট—
এ সব থেকে আমার কান পরিত্রাণ চাইছে

এরচে বরং কিছু মিষ্টি হাসির রেশ ছড়িয়ে দিন
আমাকে জাগানোর জন্য দিন দু-একটা জীবনের গান
আলতো করে ঢোল পেটানোর মুহূর্তও দিতে পারেন
ডাক্তারবাবু, আমি
দিনরাত নেচে বেড়াতে চাই

 

রাস্তা

আমার শহরের প্রতিটা রাস্তাই নামহীন
যদি কোনও প্যালেস্তিনীয়
ড্রোন হামলা কিংবা স্নাইপারের গুলিতে নিহত হন
তার নাম তখন রাস্তার হয়ে যায়
আমরা এভাবেই মৃতদের মনে রাখি

শিশুরা যতটা সম্ভব নম্বর গণনা শেখার পর
গুনে চলেছে
কতগুলো ঘর
কতগুলো স্কুল ভেঙে পড়ল
কতজনের বাবা-মা আজও জেলবন্দি

আর বয়স্করা
পকেটে আইডি নিয়ে ঘুরছে
নিজেদের নাম-ঠিকানা মনে রাখবে বলে

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...