গ্লফ— হ্রদভাঙা বিপর্যয়

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


চুংথাং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি তিস্তার জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০টি সেতু ভেঙে পড়েছে, সড়কপথের অবস্থাও তথৈবচ, বহু সংখ্যক মানুষের কোনও খোঁজ নেই, সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত সেনাছাউনি বিধ্বস্ত, নিখোঁজ দেশের বীর সেনানীদের বেশ কয়েকজন। এই ক্ষতির দায় কার? ভঙ্গুর হিমালয় নিয়ে আর কত উন্নয়নের খেলা চলবে? সিকিমে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সময় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আপত্তি জানিয়েছিল। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল আগামীদিনে সিকিম সহ দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থা হবে উত্তরাখণ্ডের মতো। কেউই তাতে কান দেয়নি

 

গ্লফ— এই শব্দটির সঙ্গে সমসাময়িক ঘটনা সচেতন মানুষের পরিচয় সম্ভবত সিকিমের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের সূত্রে। এ-জাতীয় বিপর্যয় মহাবিপর্যয়ের রূপ পেতে চলেছে এমন আশঙ্কা তৈরি হলে তড়িঘড়ি নানারকম প্রতিবেদন তৈরির মহা ধূম পড়ে যায় সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের মধ্যে, তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিষয়টি সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান উজাড় করে দিতে, বৈদ্যুতিন মিডিয়াগুলো অকুস্থলে সাংবাদিক-সহযোগী আলোকচিত্রীদের পাঠিয়ে নাগাড়ে পরিবেশন করতে থাকে এক্সক্লুসিভ সব ‘আঁখো দেখা হাল’। এমনটা করা বিধিসম্মত নয় একথা আমি বলছি না, তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব খবরের টিআরপি সবসময়ই খুব উঁচুতে বাঁধা থাকে তেমন‌ও কিন্তু নয়। অন্য অনেক বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্নতা, রয়েছে সামাজিক উপলব্ধির স্তরায়ন। আমজনতা, যাদের অনেকেই ছুটি কাটাতে ছুটে যেতে চেয়েছিলেন এইসব জায়গায়, তাঁরা কপাল চাপড়ে হা-হুতাশ করেন খানিকটা বিপর্যয়ের ভয়ালতা দেখে, কিছুটা মানুষের যন্ত্রণাকে নিজের যন্ত্রণা মনে করে, আর হতাশ হন তাঁরা, যাঁদের ছুটির ‘পোগ্গামটা’ বরবাদ হয়ে যাবে এহেন বিপর্যয়ের কারণে। গ্লফ নিয়ে তাঁদের খুব একটা শিরঃপীড়া আছে বলে মনে হয় না। অথচ যার অঙ্গুলিহেলনে এমন সব অনাসৃষ্টি নিয়ত‌ই নিয়তি হয়ে নেমে আসছে এই বসুধার বুকে, সেই প্রকৃতি মুচকি হাসি হেসে বলেন— আরে বাপু! এত ভয় পাচ্ছ কেন? এটা তো সবে ট্রেলার দেখছ। অসলি পিকচার ঈস্ সে ভি ধমাকাদার হোঙ্গে। ভায়া, এসব তো রুটিন বদলির বিষয়!

থাক, এসব তির্যক মন্তব্য ছেড়ে বরং অসলি কাহানি শুরু করি।

 

গ্লফ কী?

এই দুদিনে কথাটা কমবেশি সবাই জেনে গিয়েছেন যে গ্লফ শব্দটি আসলে একটি শব্দ-সংক্ষেপ যাকে ইংরেজিতে বলা হয় অ্যাবরিভিয়েশন্। মোট চারটি ইংরেজি শব্দের আদ্যাক্ষরকে নিয়ে এই শব্দটির সৃষ্টি। শব্দগুলো হল, নির্দিষ্ট অনুক্রমে, Glacial Lake Outburst Flood। বাংলায়‌ বললে বলতে হয়— হিমবাহ হ্রদ বিস্ফোরণজনিত বন্যা। ইদানিং মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বান ভূমিধস জাতীয় শব্দবন্ধ আমাদের একান্ত মানসিক অভিধানে খুব দ্রুতহারে পাকাপাকি জায়গা করে নিলেও গ্লফ এখনও খুব পরিচিত হয়ে উঠেছে এমন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দুরন্ত তিস্তার কল্যাণে বোধহয় সেটাও হয়ে গেল। যদিও মাথায় রাখতে হবে এটি খুব নতুন বিপর্যয় নয়।

ভারতের সবচেয়ে পুরনো নথিভুক্ত গ্লফের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯২৬ সালে কাশ্মিরের শিয়ক নদীতে। ২০১৩ সালে কেদারের মহাবিপর্যয়ের পেছনেও ছিল হ্রদভাঙনের ঘটনা। আসলে যেকোনও পার্বত্য হিমবাহ অধ্যুষিত এলাকায় গ্লফের সম্ভাবনা বেশি। তবে হ্রদগুলোর দুর্গম অবস্থানের কারণে সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না। আমাদের দেশে এমন সচেতনতা আশা করাও বোধহয় যায় না।

ভারতের উত্তর প্রান্তসীমা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হিমালয়ের বুকে রয়েছে অসংখ্য হিমবাহসৃষ্ট হ্রদ। এইসব হ্রদের জল যদি উপচে পড়ে তাহলে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়। উত্তর সিকিমের দক্ষিণ লোনক হ্রদের ক্ষেত্রেও এমন‌ই ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক অনুমান।

বিষয়টিকে আরও একটু খোলসা করা যাক্।

একটা পাত্র নেওয়া হল। ধরি পাত্রটি এক লিটার জল ধরে রাখতে পারে। যতক্ষণ না এই জলধারণ ক্ষমতা তার সর্বোচ্চ ধারণসীমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে ততক্ষণ বিপদের আশঙ্কা কম। কিন্তু কোনওভাবে যদি জলের পরিমাণ হঠাৎ করেই বেড়ে যায় তাহলে সেই অতিরিক্ত জল উপচে পড়বে এবং জল থৈ থৈ অবস্থার সৃষ্টি হবে। সিকিমের দক্ষিণ লোনক হ্রদের ক্ষেত্রেও হয়তো এমন‌ই ঘটেছে।

 

গ্লফের কারণানুসন্ধান

হ্রদ বিস্ফোরণের একটি কারণ যদি হয় প্রাকৃতিক নিয়মে হ্রদে জলের জোগান বেড়ে যাওয়া, তাহলে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল হ্রদের বাঁধ ভেঙে জল চলকে পড়া— প্রথমটি যদি হয় কারণ তাহলে দ্বিতীয়টি তার অব্যবহিত ফল। হিমবাহ তার গতিপথের নানা অংশে ক্ষয়িত উপাদানগুলোকে জমা করে। এই অবক্ষেপকে বলা হয় গ্রাব বা মোরেন। উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হিমবাহ গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে আসার সময়ে অবস্কর সমূহকে তার গতিপথের প্রান্তসীমায় এনে আড়াআড়িভাবে জমা করলে একটি উঁচু বাঁধের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই প্রাকৃতিক বাঁধটিকে পারিভাষিক অর্থে বলা হয় প্রান্ত গ্রাবরেখা বা Terminal Moraine. এটাই হিমবাহের চলনের শেষ সীমানা— টার্মিনাস। এই বাঁধের পিছনে বরফগলা জল জমা হয়ে তৈরি হয় গ্লেসিয়াল মোরেন লেক বা হিমগ্রাব সৃষ্ট হ্রদ। সিকিমের দক্ষিণ লোনক হ্রদটি এভাবেই তৈরি হয়েছে। এখন প্রাকৃতিক কোনও কারণে ওই গ্রাব বাঁধটি ভেঙে গেলে পেছনে জমে থাকা জল প্রবলভাবে আঁছড়ে পড়বে নিচের দিকে। সৃষ্টি হবে গ্লফ বা হ্রদ-বিস্ফোরণজনিত মহাবিপর্যয়ের। লোনক হ্রদের ক্ষেত্রেও হয়তো এমন‌ই ঘটেছে। হ্রদের উপচে পড়া জল তিস্তার নদীখাত বরাবর নেমে এসে পর্বতের নিম্নতর অংশে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। বিপর্যয়ের অভিঘাত কেবল সিকিমের পরিসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিপর্যয়ের বাহিকা হিসেবে তিস্তা তাকে পৌঁছে দিয়েছে উত্তরবঙ্গের উঠোনে। হিমালয়ের বুকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এভাবেই প্রভাবিত করে পর্বতের দক্ষিণভাগের রাজ্যগুলোকে।

 

আরও একটু খতিয়ে দেখি

চলুন, আমরা আবার সেই জলভর্তি পাত্রটিকে নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু আলোচনা সেরে নিই।

আচ্ছা,পাত্রটি থেকে জল উপচে পড়তে পারে আর কী কী সম্ভাব্য কারণে? ভাবছেন তো? আমিও আপনাদের সঙ্গে ভাবছি।

১) জল উপচে পড়তে পারে যদি— পাত্রটিতে আরও খানিকটা জল ঢালা হয় যা পাত্রের জলধারণ ক্ষমতার তুলনায় অনেকটাই বেশি। প্রাকৃতিক পরিবেশে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটে?

উপত্যকার উজানে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লে অথবা উষ্ণতার কারণে হিমবরফের একটা বড় অংশ গলে গেলে হিমহ্রদে জলের জোগান আকস্মিকভাবে বেড়ে গিয়ে উপচে পড়ে হড়পা প্লাবনের সৃষ্টি করতে পারে। তবে লোনক হ্রদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞদের একাংশ। কেন একথা বলেছেন তাঁরা?

সিকিমের বৃষ্টির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান যাচাই করে তাঁরা দেখেছেন যে দক্ষিণবঙ্গ নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টিক্লান্ত হয়ে পড়লেও উত্তর সিকিমের পার্বত্য অংশে বৃষ্টি হয়েছে নগণ্য পরিমাণে— মাত্র ৩৬ মিলিমিটার। এই বৃষ্টি গ্রাব-বাঁধটিকে ভাঙার মতো যথেষ্ট মনে না হলেও ধারাবাহিকভাবে গত কয়েকদিনের বৃষ্টির জল হ্রদে জমা হয়ে জলের চাপ বাড়াতে পারে যা হয়তো গ্লফের অন্যতম প্রধান কারণ।

২) এবার আসি আরও একটি কারণের আলোচনায়। ওই পাত্রের জল উপচে পড়ার কারণ খুঁজতে আমরা ঈশপের আখ্যানমালার সেই বুদ্ধিমান বায়সের দ্বারস্থ হতে পারি। তৃষিত বায়স তৃষ্ণা মেটানোর মতো পরিমিত জল খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে অবশেষে এক প্রায়শূন্য কলসির দেখা পায়‌। কলসির একদম তলায় থাকা সামান্য জলের নাগাল পেতে বায়স নানান রকম চেষ্টা করে। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে যায়। ভগ্ন মনোরথে বায়সটি যখন অন্যত্র উড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে তখন হঠাৎ তার নজর পড়ে কিছু দূরে পড়ে থাকা ছোট ছোট নুড়িপাথরের প্রতি। বায়সের মাথায় এক চমৎকার মতলব খেলে যায়। তৃষ্ণাকাতর বায়স নতুন করে জলের নাগাল পেতে প্রয়াসী হয়। ঠোঁটে তুলে একটা একটা করে নুড়ি এনে ফেলতে থাকে কলসির ভেতরে। বাইরের নুড়ি যত কলসির শূন্যতা পূরণ করে তত‌ই জলের উচ্চতা একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে একসময় বায়সের নাতিদীর্ঘ চঞ্চুর নাগালের মধ্যে উঠে আসে। বায়স খুশি মনে জল পান করে নতুন ঠিকানায় উড়ে যায়। এই গল্পের মূল নীতি কী? সমস্বরে চিৎকার করে আমরা হয়তো বলে উঠব— বুদ্ধি যার বল তার।

মাননীয় সুধীজন, আমার কিন্তু গল্পের মরাল বা নীতিকথায় খুব মনোযোগ দেওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি কলসির সামান্য জল উপচে ওঠার বিজ্ঞান বা কার্যকারণের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। উপত্যকার উজানে বৃষ্টির পরিমাণ যথেষ্ট না হ‌ওয়া সত্ত্বেও যদি বিপুল পরিমাণ হিম অবস্কর এসে দক্ষিণ লোনক হ্রদে জমা হয় তাহলেও জল উপচে পড়তে পারে। বৃষ্টি কম হলেও ওই সামান্য আর্দ্রতা পর্বতের ঢালকে পিচ্ছিল করে তুলতে সক্ষম। এর ফলে পর্বতের উচ্চতর অংশ থেকে বিপুল পরিমাণ নুড়িপাথর ঢাল বরাবর গড়িয়ে এসে হ্রদের জলে জমা হয়ে জলকে চলকে দিতে পারে। এই সম্ভাবনাকেও বাতিল করা যাচ্ছে না।

৩) আরও একটি কারণের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। জল ভরা একটি পাত্রের মধ্যে একটা কিছু হঠাৎ করে ফেলে দেখুন কী হয়। বেশ কিছুটা জল উপচে পড়ল তো! বিজ্ঞানীরা মনে করেন হিমানীসম্প্রপাত বা avalanche-এর ফলে হিমবাহ থেকে স্খলিত কোনও বড় মাপের হিমখণ্ড হ্রদের জলে এসে পড়ায় যে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি হবে তার অভিঘাতের কারণেও হ্রদভাঙা বন্যার সৃষ্টি হতে পারে।

৪) সিকিমের এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার দুই দিন আগে নেপাল সহ উত্তরপূর্ব ভারতের একটা বড় অংশে ভূমিকম্প হয়েছে। পীঠভূমি কেঁপে উঠলে সবকিছুই বেসামাল অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে। কম্পনের ফলে শিলাস্তর বেঁকে বা ভেঙে গেলে হ্রদের জল উপচে পড়ে প্রান্তীয় বাঁধের সীমারেখা পেরিয়ে প্রবল গ্লপের সৃষ্টি করতে পারে। লোনক হ্রদের বেলাতেও এমনটা ঘটার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। ইসরোর উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ সূত্র থেকে এমন সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইনস্যাট 1A গৃহীত ২৮ সেপ্টেম্বরের উপগ্রহচিত্রে লোনক হ্রদের আয়তন দেখা যায় ১৬৭.৪ হেক্টর যা ৪ অক্টোবর তারিখে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬০.৩ হেক্টরে। এই চিত্রতথ্য স্পষ্টত‌ই ইঙ্গিত করে যে এই সময়ে হ্রদের গ্রাব-বাঁধ অতিক্রম করে বিপুল পরিমাণ জলরাশি উপচে পড়েছে যা তিস্তার নদীখাত বরাবর প্রবলভাবে বয়ে এসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে চুংথাঙে তিস্তার ওপরে ১৪০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নদীবাঁধটিকে। ফলে তিস্তার কুলপ্লাবী ভয়ঙ্করী হয়ে উঠতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। যে নদীকে নিজেদের ঘরের মেয়ের মতো আগলে রেখেছে সিকিমবাসী মানুষজন, সেই আদরিণী নদীই আজ কান্নার রোল তুলেছে সিকিম সহ উত্তরবঙ্গের এক বড় অংশ জুড়ে। সিকিমের দক্ষিণ লোনক হ্রদের এই বিপর্যয়ের কারণে আমরা হয়তো কিছুদিনের জন্য হিমালয়ের হ্রদগুলো নিয়ে সাময়িক হইচই করব, কিন্তু প্রত্যাসন্ন শীতকালে জল জমে বরফে পরিণত হলে সব সমীক্ষা, সব আলোচনাকে হিমঘরে পাঠিয়ে দিতে যে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করব না একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।

 

কেমন আছে হিমালয়ের হ্রদগুলো?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটা চেষ্টা করা যাক্ আমাদের নিজেদের চর্চার তাগিদ থেকে। হিমালয়ের সুবিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট বড় নানা আকারের অসংখ্য হিমবাহসৃষ্ট হ্রদ। এক সিকিম রাজ্যেই রয়েছে এমন ২৬৬টি হ্রদ যেগুলো হিমবাহের সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য হ্রদের প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়ে অনেক বেশি (৪৭২) এমন দাবিও করেন অনেকে। সীমিত সামর্থ্য ও জনবল নিয়ে এই হ্রদগুলোর ওপর সমীক্ষা চালায় ভারতীয় ভূ সর্বেক্ষণ সংস্থা। পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তরফেও এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয় নানা সময়ে, দেখা হয় হ্রদের জলস্তর বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে কিনা। ২০১৯ সালে করা এমন‌ই এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে লোনক হিমবাহ দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে। ওই সময়ে লোনকের দৈর্ঘ্য ছিল ৬.৪ কিলোমিটার, বর্তমান সময়ে তার দৈর্ঘ্য এসে ঠেকেছে ৫.১ কিলোমিটারের মতো। হিমবাহের এভাবে ছোট হয়ে যাওয়া মোটেই সুখকর লক্ষণ নয়, কেননা হিমবাহের সঙ্কোচন মানে উষ্ণতা বৃদ্ধি, এর ফলে বরফের গলন, জলের পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা তৈরি হ‌ওয়া, বন্যা, ভূমিধস‌, বিপর্যয়, লোক ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি। এই সমীকরণ কেবলমাত্র সিকিমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, হিমালয় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত হিমবাহপুষ্ট হ্রদের ক্ষেত্রেও এই নিয়মটি সমানভাবে খাটে। গবেষকেরা জানিয়েছিলেন যে সিকিমের ১৪-২১টি হ্রদ অত্যন্ত বিপর্যয়প্রবণ, যার শীর্ষে ছিল লোনক হ্রদের নাম। সেই সতর্কবার্তায় কেউই কান দেয়নি‌‌। হচ্ছে-হবে, টরেটক্কা করে কালহরণ করা হয়েছে। এখন কপাল চাপড়ে, কম্পিত কণ্ঠে বহুত দুখ কী বাত বলে মেকি সমবেদনা জানালে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

হিমালয়ের হ্রদগুলো যে ক্রমশ জলভারে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সে-কথা বারবার করে বলে আসছেন বিশেষজ্ঞ মানুষজন। বিশেষ অনুসন্ধানের পর তাঁরা জানিয়েছিলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের হিমবাহরাজি দ্রুতগতিতে গলছে। এই বিষয়টি গভীর উদ্বেগের। কেননা হিমবাহের দ্রুত হারে গলে যাওয়ার অর্থ‌ই হল মিঠা পেয় জলের আবদ্ধ ভাণ্ডার নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া যার কারণে আগামী দিনে এই উপমহাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের পানীয় সহ ব্যবহার্য জলের জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। পাশাপাশি বাড়বে হড়পা বানের ঘটনা এবং গ্লপের মতো বিপর্যয়। হিমবাহ গলনের ফলে হ্রদগুলোর আয়তন বেড়ে যাওয়ায় পার্বত্য অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক সুস্থিতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিতির কারণে হ্রদগুলোর সরেজমিন হালহকিকত সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাও খুব সহজসাধ্য নয়। ইদানিং দূর সঞ্চার প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার সুবিধা উপলব্ধ হলেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের সদিচ্ছায় ঘাটতি রয়েছে। বিপদ এখানেই।

 

উন্নয়নের ডঙ্কা, মনে জাগায় শঙ্কা

উন্নয়নের মহিমা অপার, বিশেষত এই গরিবগুর্বো মানুষে ঠাসা ভারতবর্ষে। কীভাবে উন্নয়ন হবে, কাদের উন্নয়ন হবে, কতটা গভীর উন্নয়ন হবে এই সবকিছু ঠিক করার দায়িত্ব, যাঁরা দেশের হত্তাকত্তাবিধাতা তাঁদের। জনমুখী তকমা এঁটে যেসব প্রকল্পের কথা ভাবা হয় তার অনেকগুলোই বুমেরাং হয়ে যায়। সড়ক পানি বিজলির চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রেই পরিবেশ বিনষ্টির বিষয়টি উপেক্ষিত হয়। সুদূর অতীতের ঘটনাগুলোকে ছেড়ে কেবলমাত্র নিকট অতীতের ঘটনাক্রমের দিকে নজর দিলেই এর সত্যতা বিলকুল মালুম হবে। যে সিকিম রাজ্যটি এই মুহূর্তের জল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে সেখানেও চলছে বিশৃঙ্খল উন্নয়নের চাকা ভাঙা রথ।

চুংথাং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি তিস্তার জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০টি সেতু ভেঙে পড়েছে, সড়কপথের অবস্থাও তথৈবচ, বহু সংখ্যক মানুষের কোনও খোঁজ নেই, সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত সেনাছাউনি বিধ্বস্ত, নিখোঁজ দেশের বীর সেনানীদের বেশ কয়েকজন। এই ক্ষতির দায় কার? ভঙ্গুর হিমালয় নিয়ে আর কত উন্নয়নের খেলা চলবে? সিকিমে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সময় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আপত্তি জানিয়েছিল। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল আগামীদিনে সিকিম সহ দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থা হবে উত্তরাখণ্ডের মতো। কেউই তাতে কান দেয়নি। পর্যটন শিল্পের দোহাই দিয়ে পরিষেবা প্রসারের নামে যথেচ্ছভাবে হোটেল রিসর্ট বিনোদনকেন্দ্রের স্থাপনা হয়েছে ভঙ্গুর হিমালয় পর্বতকে ঘিরে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে জালের মতো সড়কপথ। এখন সব‌ই তিস্তার গ্রাসে। এবার সেবকের পাহাড় কেটে টানেল তৈরি করে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছে। উন্নয়নের নেশায় মশগুল শাসকদের অবস্থা এখন বল্গাহীন অশ্বের মতো। তাকে থামায় এমন সাধ্য কার?

 

পুনশ্চ

লেখাটা সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠানোর তোড়জোড় করছি, এমন সময় নজরে পড়ল সিকিমের আরও একটি হ্রদ-বিস্ফোরণের সম্ভাবনার খবর। এবার হয়তো পালা উত্তর সিকিমের মাঙ্গান জেলার ১৬,৪০৪ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ‘সাকো চো’ হ্রদটির। আয়তনে দক্ষিণ লোনক হ্রদের তুলনায় খানিকটা ছোট হলেও এটির গভীরতা প্রায় ৬০০ ফুট। ইতোমধ্যেই খবর পাওয়া গিয়েছে যে এই হ্রদের জলস্তর বিপদসীমার ওপরেই রয়েছে। সাকো চো সংলগ্ন হিমবাহটি উষ্ণায়নের ফলে গলছে, ফলে বাড়ছে জলের পরিমাণ। এই হ্রদটি গ্লপ প্রভাবিত হলে সিকিমের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই রাজ্যের ডুয়ার্স অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। আতঙ্কিত সবাই। আতঙ্কিত আমরাও।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. লিখে যেতে হবে চেতনার ঘুম ভাঙার আশায়। ভালো লাগলো।

আপনার মতামত...