বদলে যায় বদলে যায়— বদলে যেতে যেতে…

তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়

 


‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গানটির শব্দ বদলে দেওয়ার পেছনের উদ্দেশ্য এতটাই হীন এবং নিম্নরুচির, একে প্রশ্রয় দেওয়া অপরাধ হবে। শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট বর্গের মানুষের আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট আদায়ের যে নোংরা খেলা বঙ্গীয় রাজনীতির হাড়-মজ্জায় ঢুকে গেছে, এ তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এর প্রতিরোধ জরুরি এবং অনিবার্য

 

জর্জ অরওয়েল-এর বিশ্ববন্দিত উপন্যাস 1984-এ (১৯৪৯ সালে প্রকাশিত) এক চমৎকার পরীক্ষার বিবরণ রয়েছে। এই পরীক্ষা মূলত ভাষা নিয়ে পরীক্ষা। আরও স্পষ্ট করে বললে ভাষার ধারণক্ষমতাকে ক্রমশ কমিয়ে আনার এক ভয়ানক পরীক্ষা। এই প্রক্রিয়ায় কী ঘটে? একটি নির্দিষ্ট ভাষার যে ধারাবাহিকতা, ইতিহাস, অন্তর্বৈশিষ্ট্য, তার সবটা খুব যত্ন করে তছনছ করা হয়। এর ফলে যে অদ্ভুত ভাষার সৃষ্টি হয়, তা উক্ত উপন্যাসে Newspeak নামে বহুবার উল্লেখিত, এবং কালক্রমে মিথে পরিণত হয়। এ-ঘটনা তো ভাষার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পড়ে, শব্দের অর্থ কালক্রমে পাল্টে যায়, শব্দে শব্দে সন্ধি ঘটে, কখনও অঞ্চলভেদে উচ্চারণের কারণে মূল শব্দে পরিবর্তন ঘটে নতুন শব্দের উৎপত্তি হয়, এমনকি একই ভাষার বিভিন্ন উপভাষায় যে বিপুল পার্থক্য চোখে পড়ে তাও যে খুব অস্বাভাবিক, তা কিন্তু নয়। অথচ 1984 উপন্যাসে ভাষায় (ইংরেজি) যে পরিবর্তন ঘটে (পড়ুন ঘটানো হয়), তা ভীতি উদ্রেককারী এবং একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলা, সর্বোপরি, চিন্তা করা জনগোষ্ঠীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। যাঁরা এই উপন্যাস পড়েছেন, তাঁরা জানেন, এই বদল কোনও শুভ বদল নয়। ভয়াবহ স্বৈরাচারী শাসকের অত্যন্ত ধূর্ত মস্তিষ্কের লালসা এই বদলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

যে তীব্রতা ও বিস্তারের সঙ্গে Newspeak ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষাটাকেই আস্তে আস্তে গিলে খেয়ে ফেলে 1984-এ, ততটা না হলেও ভাষা নিয়ে সচেতন খামখেয়ালি আচরণ স্থানভেদে কালভেদে ক্ষমতাসীন শাসকেরা করেছেন, করেন, করবেনও। ভাষায় আক্রমণ করতে গেলে শুরুতেই যা ধূলিসাৎ করে দিতে হয়, তা সাহিত্য। পৃথিবীর হেন দেশ নেই, যেখানে সাহিত্য শাসকের রক্তচক্ষুর আওতায় আসেনি; বই নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া, লেখকের ফেরার হয়ে যাওয়া, প্রকাশ্যে বই পোড়ানো, লেখককে রাষ্ট্রদোহীর তকমা দিয়ে হয় গৃহবন্দি নয়তো কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া— এসব ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে বিধৃত রয়েছে। অরওয়েলের 1984-এ যদি আবার ফেরা যায়, তাহলে আমরা দেখতে পাব, সেখানে এসবের চেয়েও গভীর, ভয়ঙ্কর এক অনুশীলন নিয়ম মেনে, লোকচক্ষু থেকে দূরে পালিত হয়। খুব সন্তর্পণে পাল্টে ফেলা হয় সেই সমস্ত বই, পত্র-পত্রিকা, এমনকি নিতান্তই মামুলি কোনও কাগজে লিখিত বা মুদ্রিত বয়ান যা শাসকের স্বার্থের পরিপন্থী বা স্বার্থসিদ্ধিতে খুব একটা সহায়ক নয়।

আমাদের বঙ্গে বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিসর তার সঙ্গে অরওয়েলের এই ডিসটোপিয়ান উপন্যাসের বেশ কিছু ঘটনা, বেশ কিছু প্রক্রিয়া, চরিত্র, নীতির আশ্চর্য সাদৃশ্য বিভিন্ন সময়, বিভিন্নভাবে মিলে যায়।

সদ্য অনুষ্ঠিত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে গীত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির দ্বিতীয় স্তবকে সরকারি (এখানে একজনই সরকার, বাকিরা অনুপ্রাণিত) নির্দেশ একটি শব্দ পাল্টে গাওয়া হয়। ছিল ‘বাঙালি’, হয়ে যায় ‘বাংলা’। গানটির মূল রূপ এখানে উদ্ধৃত করলাম, যাতে আসলে গানটি কী ছিল এবং সরকারি নির্দেশে গানটি কী হয়েছে তা বোঝা যায়।

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল–
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ–
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান॥

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা–
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন–
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান॥

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই গানটির প্রথম স্তবকে ‘বাংলার’ শব্দটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। দ্বিতীয় স্তবকে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ‘বাঙালির’ শব্দটির। সরকারি নির্দেশে দ্বিতীয় স্তবকের ‘বাঙালির’ শব্দটিকে সরিয়ে দিয়ে ভরা মঞ্চে গীত হয়েছে ‘বাংলার’। এর পেছনে যে কারণ দেখানো হয়েছে, তা হল এই, যে, বাংলার মধ্যে যেহেতু বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বৃত্তির মানুষ— যাদের শিকড় হয়তো অন্য কোনও রাজ্যে অবস্থিত— বসবাস করে, রাজ্যসঙ্গীত হিসাবে নির্বাচিত (কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে এটি নাকি ‘রাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত’ মার্কা বকচ্ছপ কিছু হিসেবে মনোনীত হয়েছে) এই গানটির ওই ‘বাঙালির’ শব্দটি তাদের প্রতি ঠিক সুবিচার করে উঠতে পারছে না। ফলত ‘বাঙালির’ স্থানে ‘বাংলার’ শব্দটি অধিক উপযুক্ত মনে হয়েছে সরকারের (আবারও মনে করিয়ে দিই, এই মুহূর্তে রাজ্যে একজনই সরকার, বাকিরা অনুপ্রাণিত)। এক্ষেত্রে দুটি সমস্যা ঘটে বসে আছে। প্রথমত, এর আড়ালের রাজনৈতিক অভিসন্ধি একটু বেশিই স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া গেছে; দ্বিতীয়ত, গানটি যিনি লিখেছিলেন তিনি বাঙালির চিরকালীন একমেবদ্বিতীয়ম আইকন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে আপাতভাবে বিস্মৃত হলেও হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের কোনও কাজ নিয়ে কেউ একটু নিজের মতো নেড়েচেড়ে দিলে বাঙালির সামগ্রিক সংস্কৃতিচেতনা পুরনো, গোঁয়াড়, তেলচিটে স্টোভের মতো দপ করে জ্বলে ওঠে, এক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবং ভাগ্যিস ঘটেনি!

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে, গান নিয়ে, কবিতা, গল্প, উপন্যাস নিয়ে এর আগেও অনেকেই নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেষ্টা করেছেন, কেউ কালক্রমে মান্যতা পেয়েছেন, কেউ পাননি, কেউ আবার তিরস্কৃতও হয়েছেন। যে গুটিকয়েক জিনিয়াস তাঁদের ভাগ্যদোষে বাঙালিদের মাঝে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করেছেন, তাঁদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে সফট টার্গেট, সবচেয়ে লোভনীয় টার্গেট রবীন্দ্রনাথ। ফিজ়িক্স নিয়ে, ভূগোল নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে, মায় ইতিহাস নিয়েই যদি উনি ওঁর সারাজীবনের কীর্তি স্থাপন করতেন, তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের থেকে বাঙালি সচেতন দূরত্ব বজায় রাখত। কিন্তু সাহিত্য, যা কিনা বাঙালি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সাহিত্য-সমালোচকদের চেয়ে অনেক নিপুণভাবে বোঝ, তা নিয়েই রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রায় সবটাই অতিবাহিত ও আবর্তিত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ— আমাদের সৌভাগ্যক্রমে এবং ওঁর দুর্ভাগ্যক্রমে— বাঙালির আত্মার আত্মীয়, আদরের নাড়ুগোপালে পরিণত হয়েছেন। ২৫ বৈশাখ এবং ২২ শ্রাবণ (সৃজিতের সিনেমার কথা বলছি না) বাঙালি যতখানি আবেগবিহ্বল এবং উৎসবমুখর হয়ে ওঠে, নিজের বিবাহে বা সন্তানের অন্নপ্রাশনেও ততখানি হয় কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো তারই extended উচ্ছ্বাস দোলা দিয়েছে বাংলার সর্বময়ী কর্ত্রীর হৃদয়ে। “বদলা নয়, বদল চাই”-এর অ্যাজেন্ডার অংশ হিসেবেই হয়তো এই বদল অবশ্যম্ভাবী মনে হয়েছে তাঁর। এমন সংস্কৃতিসচেতন অভিভাবক বাঙালি এর আগে পায়ওনি বিশেষ। ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’-র উদ্ভাবন কি আর যার-তার পক্ষে করা সম্ভব?

এসবের মাঝে ‘বাঙালির’ পাল্টে গেল ‘বাংলার’-এ, এবং জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে উদাত্ত কণ্ঠে সমবেতভাবে গাওয়াও হল সেই সরকারি গান। কিন্তু আদপে এই পরিবর্তন যে পাকেচক্রে প্রকাশ করে ফেলল ক্ষমতাসীনের চিন্তার দীনতা, তা আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। বরং ‘বাংলা’ শব্দটির ভৌগোলিক মাহাত্ম্য দিয়ে ‘বাঙালি’ শব্দটির জাতিগত পরিচয়কে ধামাচাপা দেওয়ার অপপ্রয়াস বড় বেশিই প্রকট হয়ে গেল। এ-প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক তপোব্রত ঘোষ মহাশয় চমৎকার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন ওঁর ফেসবুক পোস্টে। কিয়দংশ উদ্ধৃত করা গেল।

আমি শুধু আপনাদের এইটুকু বুঝে নিতে বলি যে, লক্ষ করুন— এই গানের প্রথমার্ধের একটিই শব্দ এই গানের দ্বিতীয়ার্ধে পুনরুক্ত হয়েছে এবং সেই শব্দটি হচ্ছে ‘ঘর’। প্রথমার্ধের ‘বাংলার ঘর’ কাঁচা (কাঁচা হলে কিছু আঞ্চলিক শৈলীযুক্ত) এবং পাকা চারটি-দেয়াল-একটি-ছাদবিশিষ্ট জানলা-দরজাওয়ালা গঠন মাত্র; কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের ‘বাঙালির ঘর’-এর উপর একটি নৈতিক মূল্য (value) আক্ষিপ্ত হয়েছে। সেটি কী? সেটি এই যে, বাঙালির এই ঘর বাঙালিরই ঘর হয়ে উঠেছে সেই ঘরে বাঙালির ‘যত ভাই বোন’-এর সহাবস্থানে। বাংলা ভাষার বৃহৎ দুটি অভিধানে দেখুন— জ্ঞানেন্দ্রমোহন ‘ভাই’ শব্দের প্রথম অর্থ ‘সহোদর’ বললেও তৃতীয় অর্থ বলেছেন, ‘ভ্রাতৃস্থানীয় ব্যক্তি’; পুনরপি, ‘ভ্রাতা’ শব্দের প্রথম অর্থ ‘সহোদর’ বললেও দ্বিতীয় অর্থ বলেছেন, ‘সহোদরস্থানীয় ব্যক্তি’; ‘ভগিনী’ শব্দের প্রথম অর্থ ‘সহোদরা’ বললেও একইসঙ্গে বলেছেন, ‘সহোদরাস্থানীয়া’; এবং তুলনায় রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও এমনকি হরিচরণ পর্যন্ত ‘ভাই’ শব্দের প্রথম অর্থ ‘সহোদর’ বলেও চতুর্থ অর্থ বলেছেন, ‘ভ্রাতৃতুল্য ব্যক্তি, বন্ধু’, পঞ্চম অর্থ বলেছেন, ‘স্বদেশবাসী ব্যক্তি’, আর সপ্তম অর্থ বলেছেন, ‘এক জাতি এক সম্প্রদায় বা এক সমাজের ব্যক্তি’; ‘ভগিনী’ শব্দের তৃতীয় অর্থ করেছেন ‘স্ত্রীমাত্র’।

তাহলে ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন’ সবাই ‘এক’ হোক— গানটির এই অন্তিম প্রার্থনা-কি শুধুই বঙ্গজননীর গর্ভজাত বাঙালির সহোদর ভাইবোনদের ঐক্যলাভেরই প্রার্থনা? ‘যত’ শব্দের সংস্পর্শে কি ‘ভাই বোন’ সহোদরত্বের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করেনি? ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (১৮৯৫) বইয়ে ভূদেব মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘এক মাতারই একটি গর্ভজাত ও অপরটি স্তন্যপালিত দুইটি সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়— সকল শাস্ত্রমতেই হয়।’ রবীন্দ্রনাথের শুধু ভারতবোধই নয় বঙ্গবোধও ভূদেবের এই উদার মানবতাবোধের ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে বলেই রবীন্দ্রনাথের ‘মর্মে গাঁথা’ বঙ্গজননীর ‘শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি’-র আঁচলটি ‘বিশ্বমায়ের’ আঁচলই বটে, সেখানে কোনো প্রাদেশিকতা (parochialism)-র স্থান নেই।

তপোব্রতবাবুর লেখাটি থেকে এ-বিষয় স্পষ্ট, ‘বাঙালি’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এই গানটিতে, তা স্পর্শ করার ক্ষমতা বা বোধ কোনও কিছুই শাসকের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এই পোস্টেই তপোব্রতবাবু জিজ্ঞাসা করেছেন, উক্ত গানটির শব্দ নিয়ে এহেন উদ্ভট স্বৈরাচার প্রদর্শনের অধিকার কে দিয়েছে? আমার বিনীত উত্তর: বাঙালি। গানে যে ‘বাঙালি’-কে নির্দ্বিধায় পাল্টে দেন মাননীয়া, সেই বাঙালিই এই অধিকার দিয়েছে। সেই যে Thomas Jefferson-এর বিখ্যাত উক্তি: “The government you elect is the government you deserve.”

এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ীর নোবেল আমাদের রাজ্য থেকেই চুরি হয়ে যায়, যে মানুষটা তাঁর সারাজীবনের পরিশ্রম দিয়ে বাংলা ভাষাটাকে এক অভাবনীয় উচ্চতায় নিয়ে গেলেন বাঙালি দুপুরবেলা ভাতঘুম থেকে চমকে উঠে হঠাৎ এক রঞ্জিত মোহে আবিষ্কার করল, ভদ্রলোক নাকি বাঙালির আদি দুপুর ঠাকুরপো! যে অভাবনীয় প্রতিভার প্রতি পরম শ্রদ্ধায় নত হওয়া আমাদের কর্তব্য ছিল, তাকে আমরা সিগন্যালে সিগন্যালে সস্তা করে দিয়েছি, ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’-র আগে তুমুল পুলকে লটকে দিয়েছি পুংলিঙ্গের স্ল্যাং ভার্সন। ফলত, শেষ অবধি যা হচ্ছে বা হয়েছে, তার দায় সরকার নয় বরং আমাদের ওপরেই সবচেয়ে বেশি বর্তায়।

তবে কি রবীন্দ্রনাথ এমন কোনও ভয়ঙ্কর বস্তু যা পরিবর্তনের বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে? বাঙালিকে প্রতিহত করার যে টিমটিমে অস্ত্র রবীন্দ্রনাথের ছিল, সেই কপিরাইটও কালের নিয়মে গত হয়েছে। তাহলে? রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি তবে গর্হিত অপরাধ? না, তা মোটেই নয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের রচনা চিরকালই বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে তাঁদের রচনাকে নতুন আঙ্গিকে দেখার, নতুনভাবে গড়ে-পিটে নেওয়ার। সমালোচনাসাপেক্ষ সেই সব প্রয়াস, কিন্তু তা দোষের কিছু নয়। বরং একজন জিনিয়াস কাল অতিক্রম করে এভাবেই বেঁচে থাকেন, এই নিয়মের ভেতর দিয়েই তাঁর সৃষ্টিকে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তার আড়ালের উদ্দেশ্য এতটাই হীন এবং নিম্নরুচির, একে প্রশ্রয় দেওয়া বরং অপরাধ হবে। শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট বর্গের মানুষকে আবেগের সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট আদায়ের যে নোংরা খেলা বঙ্গীয় রাজনীতির হাড়-মজ্জায় ঢুকে গেছে, এ তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এর প্রতিরোধ জরুরি এবং অনিবার্য। অবশ্য যাদের থেকে প্রতিরোধ বেশি করে আশা করেছিল বাঙালি, সেইসব মিডিয়ালালিত বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে প্রতিরোধ তো গড়ে ওঠেইনি, উল্টে মঞ্চ আলো করে অনেকেই ওই পাল্টে যাওয়া গানটি একত্রে মঞ্চে গেয়েছেন। এঁদের প্রতি রাগ করা অনেকটা চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো। চিরকালই শাসক কিছু পরান্নভোজীকে নিজের প্রয়োজনে লালন-পালন করে, তাদের দিকে ঘুরিয়ে দেয় মিডিয়ার আলো, ঝকমকে মঞ্চে তাদের পুরস্কৃত করে, তাদেরকে দিয়েই বানিয়ে নেয় মেইনস্ট্রিম। এই বিশিষ্ট শিল্পীদের সবাই যে ক্ষমতার নিকটবর্তী হওয়ার লালসা থেকেই এহেন কাজে লিপ্ত হয় তা কিন্তু নয়, এদের ভিতরেই এমন অনেকে আছেন যাঁদের ইনসিকিয়োরিটি এক্সপ্লয়েট করার ব্লু-প্রিন্ট যত্নে সাজানো আছে শাসকের কাছে। ক্রমশ বশংবদ পুতুলে পরিণত হওয়া ছাড়া এঁদের আর উপায় থাকে না। এঁদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কীই বা দর্শানো যায়, বলুন!

বরং এত কিছুর ভেতরেও যা আশার, যা বিস্ময়ের, তা এই, যে, এত নষ্টামির ভিড়েও এক ঐশী নিষ্কলুষ পরিচয় নিয়ে ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে অবস্থান করেন যে মানুষ, তিনি রবীন্দ্রনাথ। লক্ষ অপপ্রয়াসের পরেও তাঁর আসন এতটুকু টলে না। তাঁর মূর্তির গর্দান নেওয়া হয়, তাঁর চরিত্রহননের চেষ্টা হয়, নানারকম কিম্ভুতকিমাকার সিনেমা বানানো হয় তাঁর ও তাঁর বৌদির রসায়ন নিয়ে, অথচ রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই থেকে যান। জীবৎকালেও বিপুল আঘাত সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয়েছে তাঁকে, সেই আঘাত তাঁর ক্ষয় তো ঘটায়ইনি বরং তাঁকে সেই উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে যেখানে আমাদের হীনতা পৌঁছায় না। আমরা তাঁকে নিজেদের দীনতা ঢাকতেই দেবতা বানিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছি, তাঁকে ধারণ করার জন্য যতখানি পরিশ্রম দরকার, যতখানি নিষ্ঠা দরকার তার লেশমাত্র অর্জন করে উঠতে পারিনি।

ফলত কিছু শুষ্ক ফেসবুকীয় প্রতিবাদে আমাদের কর্তব্যের বন্যার জল শুকিয়ে যায়। আমরা ভাবি, এই বুঝি দায় মিটল আমাদের! অথচ পাল্টায় না কিছুই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একই রেখায় এহেন জিনিয়াসের, এহেন মনীষীর ছবির পাশে জ্বলজ্বল করতে থাকে মূর্তিমতী অনুপ্রেরণার আবক্ষ হাস্যমুখ চিত্র। স্বৈরাচারী তৈরিই হয় জনসাধারণের পরোক্ষ সমর্থনে, জনসাধারণের ঔদাসীন্যই তাকে পুষ্ট করে, দীর্ঘায়ু করে তার দাম্ভিক অবস্থা। আমরা প্রতিবাদের পাশাপাশি যদি বুকসেলফে সাজিয়ে রাখা রবীন্দ্র রচনাবলি নামিয়ে পড়ার প্রয়াস করতাম তাহলে হয়তো এই ঠুনকো প্রতিবাদ অর্থবহ হতে পারত। রবীন্দ্রনাথ যে দূরের কোনও সত্তা নয়, আমাদের মধ্যে থেকেই যে তাঁর যাবতীয় কীর্তি নির্মিত হয়েছিল এই সত্যের প্রতি যদি আমরা ন্যূনতম শ্রদ্ধা বজায় রাখতে পারতাম তাহলে হয়তো তাৎপর্যপূর্ণ হত আমাদের ক্ষোভ। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি, ঘটবে বলে মনেও হয় না। বরং রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রেখে জাতিগতভাবে আমরা আমাদের অবক্ষয়কেই ত্বরান্বিত করছি। এই আত্মঘাত অপমানেরই দাবিদার, এর কোনও ক্ষমা হয় না।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...