বসিরহাটের অগ্নিপুত্র দীনেশচন্দ্র মজুমদার

অনিন্দ্য রায়

 

—সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ডালহৌসি স্কোয়ারে সেদিন যখন বোমা ছোড়া হয় তখন অনুজাচরণ সেনগুপ্তের সঙ্গে তুমিও অকুস্থলে উপস্থিত ছিলে।
—আমি কোনও অনুজাকে চিনি না।
—বটে? ওয়েলেসলি প্লেসে কনস্টেবল যখন তোমার পিছনে তাড়া করে তখন তোমার হাতে একটা রিভলভার ছিল এ-কথা অস্বীকার করতে পারবে?
—আমার কাছে কোনও রিভলভার ছিলনা। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এছাড়া আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই।

আলিপুর স্পেশাল ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান রালফ রেনল্ডস গার্লিক সাহেবের মুখ কঠিন হয়। সশস্ত্র বিপ্লবীদের ওপর তিনি বরাবরই খড়্গহস্ত। কিন্তু বছর তেইশের বিচারাধীন যুবক ভাবলেশহীন।

 

ঘটনার সূত্রপাত ১৯৩০ সালের ২৫ আগস্ট। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে দিনেদুপুরে ঘটে গেছে এক দুঃসাহসিক কাণ্ড। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন নগরপাল দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্যার চার্লস টেগার্টের গাড়িতে বোমা ছুড়তে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন বিপ্লবীরা। অকুস্থলেই বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়েছে অনুজাচরণ সেনগুপ্তের। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন দীনেশচন্দ্র মজুমদার। বিস্ফোরক এবং অস্ত্র আইনে মামলা রুজু হয়েছে দীনেশের বিপক্ষে। যার পোশাকি নাম ‘এম্পেরর ভার্সেস দীনেশচন্দ্র মজুমদার’। সরকারপক্ষের কৌঁসুলি রায়বাহাদুর নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন দীনেশের বিরুদ্ধে জোগাড় হওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে। কিন্তু দীনেশের সেই এক কথা। “আমি নির্দোষ”।

বসিরহাট হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্র দীনেশ ছোট থেকেই অত্যন্ত সাহসী এবং প্রতিবাদী চরিত্রের মানুষ। ১৯২৪ সালে কলকাতায় সিটি কলেজে আইএসসি পড়েন তাঁর জ্যাঠামশাই হরিমোহন মজুমদারের ৭ নম্বর রামমোহন রায় রোডের বাড়িতে থেকে। কাছেই সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে যাতায়াতের সূত্রে ধীরে ধীরে লাঠি ও ছুরি খেলায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। বসিরহাট এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গড়ে তোলেন একাধিক ব্যায়াম সমিতি, যেখানে উৎসাহী তরুণের দল শরীরচর্চার পাশাপাশি অনুশীলন করে লাঠিখেলা। শৈশবের প্রাণের বন্ধু অনুজার হাত ধরেই ১৯২৬ সালে বিপ্লবী যুগান্তর গোষ্ঠীতে দীনেশের প্রবেশ। তাঁদের দুজনের উপর অগাধ আস্থা রসিকদার। যুগান্তর গোষ্ঠীর রসিকলাল দাশ। কলকাতার ৭১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটের বাড়ি তখন যুগান্তর গোষ্ঠীর গোপন আড্ডা। সংগঠনের সূত্রে সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় দীনেশের। যুগান্তর-এর ২৪ পরগণা ও বগুড়া জেলার সাংগঠনিক নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয় দীনেশের হাতে।

বিএসসি পাশ করে ১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর কল্যাণী দাশের অনুরোধে ‘ছাত্রীসঙ্ঘ’-এর মেয়েদের লাঠিখেলা শেখানোর দায়িত্ব নেন দীনেশ। যাঁর ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন কমলা দাশগুপ্ত। অতঃপর টেগার্ট নিধনের দায়িত্ব দেয়া হয় দীনেশ এবং অনুজাকে। সঙ্গী বিপ্লবী শৈলেন নিয়োগী এবং অতুল সেন। গাড়িতে বোমা ছোড়ার সময় অনুজার কয়েক সেকেন্ডের দেরি হওয়ার আগে কে-ই বা জানত দীনেশ-অনুজার যুগলবন্দিতে এই তাঁদের শেষ ‘অ্যাকশন’ হতে চলেছে।

স্পেশাল ট্রাইবুনালের বিচারে শেষপর্যন্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল দীনেশের। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে মাকে চিঠি লিখলেন— “তুমি কিছু ভেবো না মা। ব্রিটিশের জেলে পচে মরার জন্য তোমার মেনির (দীনেশের ডাকনাম) জন্ম হয়নি।” ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জেলের প্রাচীর টপকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন শচীন করগুপ্ত এবং সুশীল দাশগুপ্ত। ব্রিটিশ পুলিশ দীনেশের নামে ১৫০০ টাকা অর্থমূল্যের পুরস্কার ঘোষণা করল। ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন স্যার আলফ্রেড ওয়াটসন। সেইসময় সশস্ত্র বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদ্গার করে চলেছে এই পত্রিকা। ২৪ পরগণার বিপ্লবী সংগঠনগুলির সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা ছিলেন সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। বিপ্লবীদের প্রিয় সাতদা। তাঁর সহায়তায় ওয়াটসন হত্যা পরিকল্পনা শুরু করলেন দীনেশ। ১৯৩২ সালের ৫ আগস্ট প্রথম অ্যাকশন ব্যর্থ হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন বিপ্লবী অতুল সেন। পরের মাসের ২৮ তারিখ দ্বিতীয় অ্যাকশনও ব্যর্থ হয়। সায়ানাইড খেয়ে শহিদ হন দুই কিশোর বিপ্লবী ননী লাহিড়ী এবং অনিল ভাদুড়ী।

এরপর দলের নির্দেশে শুরু হল দীনেশের অনিশ্চিত পলাতক বিপ্লবী জীবন। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে তিনি চলে এলেন রানিগঞ্জ। টিঙ্কু মাঝি নামে সাঁওতাল কুলির ছদ্মবেশে কোলিয়ারিতে কাজ নিলেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সন্দেহ ঘনীভূত হওয়ায় শেষপর্যন্ত চলে এলেন চন্দননগর। ১৯৩৩ সালের ৯ মার্চ ফরাসি পুলিশ কমিশনার মসিয়ে ক্যাঁ সদলবলে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা ঘেরাও করলে নলিনী দাশ এবং ওয়াটসন হত্যা প্রচেষ্টার পলাতক আসামি বিপ্লবী বীরেন রায়কে নিয়ে দীনেশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। মসিয়ে ক্যাঁ সাইকেল নিয়ে তাঁদের পিছু ধাওয়া করলে দীনেশের গুলিতে তিনি নিহত হলেন। বীরেন রায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন। দীনেশ এবং নলিনী চলে এলেন কলকাতায়।

টালিগঞ্জের একটি গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিলেন দীনেশ। সেইসময় তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হলেন। অসুস্থ দীনেশকে শিয়ালদহ অঞ্চলে মুসলমান পাড়া লেনে নিয়ে আসা হলে এগিয়ে এলেন কল্যাণী দাশ। দীনেশের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও মাথায় ঘোমটা দিয়ে কূলবধূর ছদ্মবেশে নিয়মিত তিনি দীনেশকে পৌঁছে দিলেন ওষুধ এবং পথ্য। ক্ষুব্ধ দীনেশ একদিন তীব্র প্রতিবাদ করলেন— “আমার মতো যত পলাতক বিপ্লবী আছে, পারবেন সবার জন্য ব্যবস্থা করতে? নাহলে কাল থেকে এসব আর আনতে যাবেন না।” ইতিমধ্যে গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কের কর্মচারী কানাই ব্যানার্জীর সহায়তায় সই জাল করে কিছু টাকা সরানোর পরিকল্পনা করলেন দীনেশ, জগদানন্দ মুখার্জী এবং ফণী দাশগুপ্ত। সংগ্রহ হল সাতাশ হাজার টাকা। চেকগুলিতে জাল সই করলেন দীনেশ স্বয়ং। ১৩৬/৩ বি কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে নারায়ণদাস ব্যানার্জী নামে পুলিশের অজ্ঞাত এক কর্মীর নামে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। তিনি সপরিবারে থাকতে শুরু করলেন সেখানে। সেই বাড়িতে আশ্রয় নিলেন দীনেশ, নলিনী এবং জগদানন্দ। ২২ মে ১৯৩৩, ভোররাত্রে বাড়ি ঘেরাও করল ব্রিটিশ পুলিশবাহিনি। অকুতোভয় তিন বিপ্লবী রিভলভার নিয়ে যথাসাধ্য লড়লেন। কিন্তু গুলি শেষ হলে ধরা পড়লেন তাঁরা। স্পেশাল ট্রাইবুনালের বিচারে নলিনী এবং জগদানন্দের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হল। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা এবং হত্যার ষড়যন্ত্র-সহ একাধিক অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন দীনেশ।

 

আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীন নববর্ষের এক বর্ষণমুখর রাত্রে দাদা অবিনাশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠি লিখলেন “আজ ঝোড়ো হাওয়ার ভিতরেও এক শান্তি, গভীরতর শান্তি দেখছি। গর্জনের ভিতরেও এক নীরব, শান্তি ভরা সুর শুনছি।” ৯ জুন ১৯৩৪, ভোররাত্রে ফাঁসির মঞ্চে শহিদ হলেন দীনেশ। হতভাগ্য বৃদ্ধা মায়ের কাছে সরকারিভাবে সেই খবর পৌঁছাল দশ দিন পরে। সেই সঙ্গে পৌঁছাল মাকে লেখা দীনেশের শেষ চিঠি— “মা তুমি আমার জন্য দুঃখ কোরো না। তোমার জন্য শত শত সন্তান রইল, তাদের মা হয়ে তুমি আমার দুঃখ ভুলে যেও।”

বসিরহাটের অগ্নিপুত্র দীনেশচন্দ্র মজুমদারের মতো এমন অসংখ্য বিপ্লবী আত্মাহুতি দিয়েছেন দেশমাতৃকার চরণে। কেউ কেউ থেকে গিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের জনমানসে, অধিকাংশই চলে গিয়েছেন বিস্মৃতির অন্তরালে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...