যে লোকটাকে আমরা হত্যা করেছি

রোমেল রহমান

 

কুশীলব: তিন নারী। বয়স ১৭, ২৬ এবং ২১।

[তিনজন নারীকে দেখা যায় একটা লাশ বয়ে আনতে! কাপড়ে মোড়ানো কিংবা নয়! যাকে তারা একটু আগে হত্যা করেছে। লাশটা ভীষণ ভারী। মঞ্চে এনে ফেলে। তারপর নারীদের একজন একটা সিগারেট ধরায়, অন্যরাও ভীষণ ক্লান্ত! তারা হাঁফ ছাড়ে। লাশটাকে কীভাবে গায়েব করবে সে ব্যাপারে আলাপ চলে। সময় রাত, ধরা যাক ৩টা বাজে। রাস্তায় কুকুর আর ঝিমিয়ে যাওয়া প্রহরী আছে মাত্র।]

প্রথম নারী: জানোয়ারটা মানুষ না জলহস্তী?
দ্বিতীয় নারী: ভাল বলেছ! জানোয়ার তার উপর জলহস্তী! অবশ্য মানুষও জানোয়ার!
তৃতীয় নারী: ১০০ কেজির মতো হবে, না?
প্রথম: অবশ্যই। ১৩০/১৪০-ও হতে পারে!
দ্বিতীয়: ধ্যাৎ! অত না! তবে শুনেছি মানুষ মরলে ওজন বাড়ে!
প্রথম: ক্যানো ক্যানো?
তৃতীয়: ভূত ভর করে… তাই না?
দ্বিতীয়: জানি না, লোকেরা বলে।
প্রথম: আচ্ছা। এই লাশটাকে নিয়ে আমরা করব কী, বলো তো?
তৃতীয়: ফেলে দেব। খুনের কোনও প্রমাণ রাখা যবে না!
প্রথম: লোকটা একটা কুত্তা বুঝলা? কুত্তা কুউউত্তা! না না শুয়োর! যাকে-তাকে যখন-তখন চান্স পেলেই অ্যাবিউজ করত!
দ্বিতীয়: মেয়েদের গা হাতানো অভ্যাস ছিল খুউউব! এখন বোঝগ্যে! এখন পরকাল হাতড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে হাতাহাতি করে বেড়া!
তৃতীয়: উফফফ! লাত্থিটা যা দিছিলে না তুমি! অস্থির! এক লাথিতে ক্যাঁক করে উঠল!
প্রথম: আমার ধারণা ওই কিকে ওর হোল ফেটে ঝোল বেরিয়ে গেছিল… হি হি হি!
দ্বিতীয়: ফুটবল খেলতাম একসময়! তোমার বয়সেও খেলেছি। ক্লাবে খেলতাম! কিন্তু আগানো হল না! সেখানেও এক শুয়োরের বাচ্চা পয়সাওয়ালা ছিল। ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক! ক্লাব চালাত মূলত অল্পবয়সি খেলোয়াড় মেয়েদের নিয়ে মাখামাখি করার জন্য! বুঝে ফেলেছিলাম আমি! স্পোর্টসের মেয়েদের ভাল্লাগত ওর! আমার কোচকে বলেছিলাম। উনি পাত্তা দেননি! ক্লাবের ম্যানেজারকে বললাম, উনি বোঝালেন এগুলা ব্যক্তিগত ব্যাপার, এসব নিয়ে কথা বলা যাবে না। দিলাম ছেড়ে ক্লাব! আস্তে আস্তে খেলা শিকেয় উঠল!
তৃতীয়: তোমার সঙ্গে খারাপ কিছু করেছিল?
দ্বিতীয়: চেয়েছিল! সুযোগ দেইনি! গিফট দিয়েছিল একজোড়া দামি জুতা। যেটার অভাব ছিল আমার! তাকিয়ে থাকত বুকের দিকে। ঘেন্না লাগত খুউউব! ইচ্ছে হত কিক দিয়ে বসিয়ে দিই!
প্রথম: যেটা আজ করলে!?
দ্বিতীয়: ওই আরকি!
তৃতীয়: আচ্ছা লাশটা আমরা কীভাবে গায়েব করব?
দ্বিতীয়: বিক্রি করে দেব মাংসের দোকানে! কাল খাসির মাংসের ভাঁজে ভাঁজে লোকটার মাংস খাবে শহরের লোকেরা!
তৃতীয়: টের পেয়ে যাবে না? যখন পাতে লোকটার মাংসের পিস পড়বে। মানুষের মাংস তো খেতে খাসির মতো হবার কথা না।
দ্বিতীয়: ও বুঝবে না! ভাব্বে খাসির বডির এমন কোথাকার পিস যেটার স্বাদ একটু আলাদা! তাছাড়া কসাইরা সব পারে! এমনভাবে ছুলবে ওকে! টের পাওয়া যাবে না নলিটা খাসির না মানুষের!
তৃতীয়: আচ্ছা ওর শিশ্নটার কী হবে? হালুয়া!?
দ্বিতীয়: উঁহু! কুচিকুচি কুচিকুচি করে মিশিয়ে দেবে মাংসে। চাপাতি দিয়ে কোপাতে কোপাতে কিমা বানিয়ে মিশিয়ে দেবে!
প্রথম: এহ! গা শিরশির করে ভাবলেই! তবে হাত-পায়ের আঙুলগুলো কেটে ফেলে দিতে হবে! নইলে পাতে আঙুল পেলে নিশ্চয়ই চিনতে ভুল হবে না।
তৃতীয়: সে তো দেবেই! কসাইরা কি কম চালাক? খাসি বলে ভেড়া, ভেড়া বলে গাড়ল! গরু বলে মহিষ! সবই খাইয়ে দিচ্ছে! জ্যান্ত না মরা না অসুস্থ সেসব তো হিসেবের খাতায় নেই।
প্রথম: এই জন্যেই শকুন কমে যাচ্ছে বুঝলে? শকুনের জন্য মরা গরু খাসি না ফেলে উলটো বাজারে বিক্রি করে দেয়াতেই শকুন না খেতে পেয়ে মরছে!
তৃতীয়: ধুর! হাবিজাবি কথা বোলো না তো! শকুন কমছে অন্য সব কারণে!
প্রথম: আচ্ছা আমরা লোকটার লাশ শকুনের জন্য মাঠে ফেলে দিতে পারি না?
তৃতীয়: তিব্বতে এমনভাবে সৎকারের ব্যবস্থা আছে জানো?
দ্বিতীয়: তাতে শকুন আসবে কিনা জানি না, তবে পুলিশ আসবে! এবং তোমাদের আদর করতে নিয়ে যাবে!
প্রথম: দরকার নেই বাবা!
তৃতীয়: তাহলে কি বিক্রি করব আমরা ওর লাশ?
প্রথম: আচ্ছা বিক্রি করে যে টাকা পাব তা দিয়ে কী করা হবে? পার্টি?
তৃতীয়: ধুর! হয় নাকি! বরং কোনও নিপিড়ীত নারীর সহায়তায় ব্যয় করা ভাল হবে!
প্রথম: ভাল প্রস্তাব! কিন্তু কসাই কে? কে কিনবে এই বডি?
তৃতীয়: জানি না! কোনও কসাইয়ের সঙ্গে আমার চেনাজানা নেই!
প্রথম: আচ্ছা যারা কঙ্কালের ব্যবসা করে ওদের কাছে বিক্রি করলে সবচেয়ে নিরাপদ হয় না? কসাই যেহেতু আমাদের চেনাজানা নেই, এটা বেস্ট! কী বলো?
দ্বিতীয়: ওরে! এতসব কঠিন প্ল্যান না করে, চলো ব্রিজের উপর উঠে নদীতে ফেলে দিই!
তৃতীয়: কিন্তু লাশটা ব্রিজ পর্যন্ত নেয়ার জন্য একটা গাড়ি বা ভ্যান প্রয়োজন! এত রাতে পাব কোথায়? তাছাড়া ভ্যানওয়ালা এই জিনিস দেখলে নিশ্চয়ই চুপ থাকবে না। জানাজানি করে দেবে!
দ্বিতীয়: তা অবশ্য ঠিক! ধরা পড়ে যাব আমরা!
প্রথম: একটা কাজ করলে হয় না? লাশটাকে দলামোছা করে একটা ফ্রিজে রেখে শক্ত বানিয়ে তারপর একটা লাগেজে ভরে কাল-পরশু কোথাও ঝেড়ে দিলেই হয়?
তৃতীয়: তোমার বাসায় বড় ডিপফ্রিজ আছে?
প্রথম: আরে আমি তো হস্টেলে থাকি! ডিপফ্রিজ পাব কেম্নে? সব পাবলিক!
তৃতীয়: আমি থাকি মেসে! পুরো মেসে একটা ফ্রিজ আছে এজমালি! সম্ভব না! তাছাড়া ওটার ডিপ মানুষ রাখার মতো বড় না!
দ্বিতীয়: আমি থাকি সাবলেট! কোনও চান্স নেই! আস্ত লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার!
তৃতীয়: ফ্রিজে রাখার পরিকল্পনা বাদ! তারচে মাটি খুঁড়ে গেঁড়ে ফেলা সবচেয়ে ভাল!
দ্বিতীয়: কোদাল পবে কোথায়?
তৃতীয়: ধুর!
প্রথম: তিন টুকরো করে তিনজন নিয়ে যাই চলো!
দ্বিতীয়: তারপর?
তৃতীয়: ফ্রিজে রেখে একটু একটু করে রান্না করে খাব তাই তো?
দ্বিতীয়: হি হি হি
প্রথম: হা হা হা
তৃতীয়: আমরা কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি? এই জরুরি হত্যাটা করে আমরা কি গ্লানিতে পাগলামো করছি?
প্রথম: যে মানুষটা রোজ বাসে ট্রামে ভিড়ে রাস্তায় কিংবা অফিসে আমাদের চেপে ধরে, চোখ দিয়ে নাক দিয়ে গিলে খায়, ফাঁকা পেলে রেপ করে, বাজে প্রস্তাব দেয়— তাকে জ্যান্ত রাখা অন্যায়!
দ্বিতীয়: আইন নামক ব্যাপারটা আসলে এইসব ক্ষেত্রে তোমাকে বাঁচাবে ঘটনা ঘটে যাবার পর! তাই ঘটনা ঘটার সুযোগ দেখলেই সেটাকে প্রতিহত করা চাই! আত্মরক্ষার কায়দাকানুন জানা জরুরি! পুলিশ তোমাকে উদ্ধার করতে করতে তার মধ্যে নিজেকে নিজের উদ্ধার করা চাই! নইলে সর্বনাশ হয়ে যায়! তবে লজ্জার কিছু নেই, মার দেওয়া জরুরি! মেরে ফেলা জরুরি!
তৃতীয়: তাহলে লাশটাকে আগুন দিয়ে ঝলসে দিই? কয়লা বানিয়ে দিই?
দ্বিতীয়: সে পরিমাণ কাঠ, কয়লা বা তেল নেই আমাদের হাতে!
তৃতীয়: আচ্ছা আমরা ওকে ফেলে চলে যাচ্ছি না কেন?
দ্বিতীয়: কারণ আমরা ভয় পাচ্ছি না! তুমি যখন ন্যায় করবে তখন রক্তারক্তি হলেও তোমার ভয় লাগবে না!
প্রথম: আচ্ছা আলো ফুটছে কিন্তু! ভোর হয়ে আসছে! লোকেরা বের হবে! দেখে ফেলবে আমাদের!
দ্বিতীয়: দেখুক না! দেখুক! লোক জড়ো হোক! পুলিশ আসুক, সাংবাদিক আসুক! পত্রিকায় ছবি ছাপা হোক আমাদের! শিরোনাম হবে, ধর্ষক হত্যা করে লাশ নিয়ে বসে আছেন তিনজন নারী! কিংবা একজন ধর্ষককে খুন করে দায় স্বীকার করে দুনিয়াকে বার্তা দিলেন— এখন এটাই জরুরি!
প্রথম: মানে কী? আমরা ধরা দেব? জানান দেব দুনিয়াকে, এই নোংরা লোকটা যিনি দিনের পর দিন অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছেন তাকে আমরা পিটিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছি?
তৃতীয়: প্রস্তাবটা খারাপ না! লাশ নিয়ে বসে থাকা যাক! দুনিয়া জানুক! আমার ব্যাগে কাগজকলম আছে! কাগজে লিখে সেঁটে দিই? লোকটা একজন ধর্ষক!
দ্বিতীয়: দাও! আর টুকরো টুকরো কাগজে লিখে ছড়িয়ে দাও চারপাশে, লোকটার হাতে আক্রান্ত হওয়া নারীদের নাম, বয়স। দুনিয়া দেখুক দৃশ্যত সুশোভন লোকটার আবডালে একটা বর্বর বসবাস করত। যার হাত থেকে বালিকা কিশোরী তরুণী মধ্যবয়সী কেউ রক্ষা পায়নি! একটা জ্যান্ত হিংস্র পার্ভার্ট ছিল জানোয়ারটা!

(কাগজে লিখে লাশটার উপর সেঁটে দেয়। আর টুকরো টুকরো কাগজ ছড়িয়ে দেয় লাশের চারদিকে)

দ্বিতীয়: চলো। আগামীকাল আরও একটা লাশ ফেলতে হবে আমাদের!
প্রথম: কেন, আমরা না বসে থাকব লাশ নিয়ে?
দ্বিতীয়: সে কাজ ওই লেখাতেই হবে! আরও একটা লাশ ফেললে, সবাই টের পাবে আড়ালে একটা আগ্নেয়গিরি জাগছে! সেটাকে এখন জাগাও! তার বিস্ফোরণের শব্দে সব লোভী নখর দাঁতালো ধর্ষকের আত্মায় ভয় ঢুকে যাবে; মৃত্যুর ভয়, শিশ্ন ছিন্ন হবার ভয়, থেঁতলে যাবার ভয়।

[ভোরের পাখিদের কিচিরমিচির স্পষ্ট হয়। প্রথমে তৃতীয় নারী, তার পিছনে দ্বিতীয়, তার পিছনে প্রথম বেরিয়ে যায়। অফট্রাকে পাঠ হয়…]

কোথাও একটা জলের দীঘি শান্ত টলমল,
ইচ্ছে করে পা ডুবিয়ে কাটাই সারাদিন,
ইচ্ছে করে ঝাপিয়ে পড়ে মাছ হয়ে যাই!
কিন্তু কোথায় যাব?
মেয়ে আমি!
পিছন পিছন ফেউ!
তাকিয়ে থাকে লকলকে চোখ, ক্ষুধার্ত নখ!
পায়ে পায়ে গুল্মলতার টান।
দুনিয়া আমার কাছে যেন জীবন্ত শয়তান।

পদ্মে রেখে যতই পুজো দাও,
ধুপধুনোতে আরতি ওঠাও,
আমি চণ্ডী হব।
মাথা কেটে বাঁধব গলার হার!
পদ্ম নয় গো..
জবা আমার চরণ চিহ্ন হোক।
আমি খড়্গচোখে দেখি সবার মুখ!

*

 

৩০ সেপ্টেম্বর ২৪

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...