বাংলার মুখ

সুমনা সাহা

 

‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’ একটি রাজনৈতিক তথা সামাজিক উপন্যাস। সমাজ ও রাজনীতিকে তো আলাদা করে দেখা যায় না, তা একই মুদ্রার দুই পিঠ। এমনই এক সমাজ, যার আগা-পাশ-তলা দুর্নীতির পাঁকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অজিত সিং-এর স্বপ্নে আসে পিঙ্কির ঝুলন্ত পা-দুটো। তার প্রথম বিয়ে করা বৌ পিঙ্কি, এক অজানা অভিমানে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তারপর থেকে অজিত কত মেয়ে-শরীর ঘেঁটেছে, কিন্তু বিয়ে আর করেনি। পিঙ্কির আত্মহত্যার কারণ তার কাছে দুর্বোধ্য। বাড়ির কাছে একটা পুকুরের সাধ ছিল পিঙ্কির। কিন্তু অজিতের ‘তালাব’ না-পসন্দ। তার মা মরেছে তালাবে ডুবে। আর একটা বড় তালাব বুজিয়ে হাই-রাইজ বানানোর জন্য প্রোমোটার অজিত খুন করিয়েছে আরেক মা-কে। পিঙ্কির ঝুলন্ত পা-দুটো অজিত সিং-এর ঘুমিয়ে থাকা বিবেক, যখনতখন মাথার মধ্যে ঘাই মারে, যেমন বড় তালাবে বড় মাছের ঘাই। ওই শূন্যে লটকানো একজোড়া পা তার বীভৎস পেশা ও কুৎসিত যাপনের মধ্যে ঢুকে পড়ে বারবার, শৈশবের স্বপ্ন আর আদর্শ স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের মৃতপ্রায় বিবেকের গায়ে ধাক্কা দিয়ে, এই ঘুন ধরা সমাজের মুখের উপর পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে আত্মঘাতিনী পিঙ্কির পা-জোড়া— বাঙালির অতীত-গৌরব আর বর্তমান অবনয়নের মাঝে, স্মরণ করিয়ে দেয়, আছে, এখনও সময় আছে, সবকিছু সামলে নেওয়ার, এখনও পথ আছে, আরও একবার ঘুরে দাঁড়াবার।

স্বাধীনতার পর থেকে বিগত সাত দশকে তিল তিল করে বাঙালির গৌরবময় অতীত হারিয়ে গেছে। আমদানি হয়েছে পাঞ্জাবি, বিহারি আর অন্য অন্য প্রাদেশিক সংস্কৃতি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাঁটি গেড়েছে দুর্নীতির কীট। শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সমাজের সর্বস্তরে এই সামগ্রিক অবক্ষয়ের চিত্র অপূর্ব মুনশিয়ানায় লেখক এঁকেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাষার জাদুকাঠিতে— “অজিতের মনে হল, ওপরের দিকে বাঙালি আর তত বাঙালি নেই, যে বাঙ্গালিকে দেখিয়ে তার দাদাজি বিনয় সিং বলত, ওদের মতো বুদ্ধি আর কারো নেই। ওরা ভাত আর মাছ খায় বলেই এত বুদ্ধি নাকি। ছোট্ট অজিত তখন থেকেই চেয়েছে বাঙালিদের মতো হতে। কিন্তু বাঙালিই আর বাঙালি থাকতে চায় না? হায় রে” (পৃষ্ঠা ৯)। আর একেবারে শেষে, “মার্কেজ হাসছে। ‘বুঝলে দোলন এখন আর বিহার থেকে বেশি সুপারি আনতে হয় না। সব এখানকার। গ্রো লোকাল। থিংক গ্লোবাল” (পৃষ্ঠা ৩৬৮)।

এই তীব্র সুরের পাশেই স্বপ্নের মতো পেলব দুটি পংক্তি— “হরশৃঙ্গার মানে শিউলি। শিউলি মানে দুর্গাপুজো। পিংকি পুজো আসার প্রতীক্ষা করছিল” (পৃষ্ঠা ১৫)।

এই লাইনেই লেখক আশার বীজ বুনে দেন অনায়াস দক্ষতায়, পুজো এলেই অসুরনাশিনী ত্রিনয়নী সব অশুভ দমন করবেন। আমরাও যেন পুজো আসার অপেক্ষা করতে থাকি। আবার ১৯ পৃষ্ঠায় লেখেন, “পাশে শুয়ে প্রদীপ্ত নির্বিকারে ঘুমোচ্ছে। ওর মতো ঘুমোচ্ছে এই শহর, এই সময়;” মারণ রোগের মতো ঘাপটি মেরে থাকা অবনয়নের চেহারা দপ করে ফুটে ওঠে মন্থর তালের এই কটি শব্দে।

৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদে এসেছে পদ্মনাভ। এই চরিত্রকে দিয়ে যেন সংসারের পিচ্ছিল রাস্তা আর আদর্শের খাড়া চড়াই অনায়াসে আঁকা হয়ে গেল। “মিলি এরকম কোরো না, আমার যে পার্টির কাজ আছে”— এই করুণ আপাত নিরীহ বাক্যটি যেন ক্ষয়িষ্ণু আদর্শের শেষ সম্বল বাঁচানোর মরিয়া এবং অসহায় আর্তনাদ (পৃ. ২৯-৩০)।

তাজমুল যখন বলে, “সে কথা না, আমি জানতে চাইছি, আমরা কি খুন করেছি? না আমরা খুন হয়েছি? আমরা শালা বেঁচে আছি না মরে গেছি?” আমাদের সত্তা চমকে ওঠে। মাঝে মাঝে এই রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করা পচা-গলা সমাজে বাস করতে করতে, প্রশ্নহীন আনুগত্যে অজস্র অসামঞ্জস্য মেনে নিতে নিতে নিজেকে এই প্রশ্ন করতে থাকি আমরাও, নিজেদের অন্তরাত্মার গভীরে। এ-প্রশ্ন নাড়িয়ে দেয় আমূল।

ছবির মতো এক-একটি ঘটনা, মনে আলোড়ন তোলে, ব্যথা জাগায়। যেমন পদ্মনাভর সেই কোটি যোগিনীর গলিতে গুম হয়ে যাওয়া আর শতরূপার সঙ্গে বারান্দার উপর থেকে দরিদ্র বালিকার টিউকল চেপে জল ভরার দৃশ্য দেখা— “বলতে বলতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। মেয়েটা জামা খুলে কলসির মুখে বাঁধল। হায়, জামা দিয়ে কি বৃষ্টির জল ভেতরে যাবে না? ওর পরনে একটা নীল ইজের এখন, টগরফুলের কুঁড়ির মতো দুটো বুক ভিজছে। দেখতে দেখতে কেঁদে ফেললেন পদ্মনাভ ‘আমি কিচ্ছু করতে পারিনি এদের জন্যে, কিচ্ছু না!’”

মানুষের জীবন অভিজ্ঞতার মালায় গাঁথা। তাই অজস্র চরিত্র গাঁথা হলেও লেখকের আপন অনুভূতি উঠে আসে লেখায়। লেখক কখনও বিদিশা হয়ে ওঠেন, কখনও মোহরমালার খোলসের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন। আবার দোলনচাঁপাও তিনিই। জীবনের বাঁকে বাঁকে যত আনন্দ, যত ব্যর্থতা, যত দুঃস্বপ্নের মতো দিন সব রাখা থাকে লেখকের লেখায়। লেখকের মনটাকে খুঁজতে হলে তাঁর লেখার মধ্যেই খুঁজতে হবে। রোজকার জাগ্রত বাস্তবে তিনি অনেকটা মেক-আপের আড়ালে, কিন্তু লেখায় অন্য চরিত্রের মধ্যে ঢুকে তিনি মনের আগল খুলে দেন। এই উপন্যাস তাই লেখকের, আমার, আপনার, ও আরও অনেক নারী ও পুরুষের। পটার মতো লক্ষ মানুষ তো স্বপ্ন দেখছে, “কলকাতার স্কুলে পড়বে মেয়ে, মনিয়ারার বুটিক হবে, সারাদিন পর একটা সুন্দর ফ্ল্যাটে ফিরবে তারা’— মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, আপামর সাধারণ বাঙালির স্বপ্ন। সন্তানকে দুধে-ভাতে কিংবা মাছে-ভাতে রাখার স্বপ্ন দেখা বাঙালি মায়েরা ছেলেপুলেদের খুব বড় স্বপ্ন দেখতে শেখাননি, তাই ভীরু বঙ্গসন্তান কলমপেষা কেরানি হয়ে সাহেবের জুতো চাটতে চাটতে একসময় বিপ্লব, সংস্কৃতি সব জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মবিস্মৃত হল।

কিন্তু সবই কি কালো? এতই নিঃসীম কালো? কোথাও কি আলোর রেখা নেই? ঘন-কৃষ্ণ সৌদামিনীর বুকেই তো ঝলসে ওঠে ক্ষণপ্রভা বিদ্যুৎশিখা! তাই ‘শেষের পরের কথা’তে লেখক রেখে যান সেই আশার শিখাটি—

কুন্তল আজ জেসিকাকে মার কাছে নিয়ে যাবে।

তাজমুল আজ মি বসুকে নিয়ে মার কাছে যাবে। মুড়িভাজা শেখা বাকি।

শতরূপা আজ দীপুর সঙ্গে মার কাছে যাবেন।

গগন ঘুরতে ঘুরতে একদিন মোহর আর কিঞ্জলের কাছে পৌঁছে যায়।

প্রদীপ্ত ইনস্পেক্টরকে ফোন করে করে ক্লান্ত, সে ভুবনেশ্বরে ফিরে যাচ্ছে।

বিদিশা অক্ষরের জীবনে পাশ ফিরে শোয়। আপাতত তাকে কারও দরকার নেই। আবার কেউ নিজেকে হারিয়ে ফেললে সে আসবে।

মার্কেজ এসে দাঁড়ায় দোলনের কাছে, দোলন বলে ‘চলো’।

চলতেই হয়। চলাই জীবন। থেমে যাওয়াই মৃত্যু। তাই লেখক এই চলার লিপি লিখে দেন— “ওরা হেঁটে চলে। গ্রাম থেকে শহরে। আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে। মরে যায় আবার বেঁচে ওঠে। পড়ে যায় আবার উঠে দাঁড়ায়। ওদের যাত্রা শেষ হবার নয়। ওরা হাঁটতেই থাকে।” (পৃষ্ঠা ৩৬৭)

প্রতিটা নদীকে মোহনায় ফিরতেই হয়। ‘যে নদী মরুপথে হারায় দিশা’, সেও শেষ হয় না। ধ্বংসের স্তূপের মধ্যে থেকেও গজিয়ে ওঠে উদ্ভিদ, কচি কিশলয়ের আশ্বাস নিয়ে। খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গের শেষে, বাস্তব আর অলীকের মুছে যাওয়া সীমান্তরেখা পেরিয়ে হয়তো কেউ খুঁজে পাবে বাংলার হারিয়ে যাওয়া মুখ। চূড়ান্ত অবক্ষয়ের জীবন্ত বর্ণনার পাশাপাশি লেখক এই আশার কথা শোনাতে পেরেছেন— এখানেই এই উপন্যাসের সার্থকতা।

প্রায় মুদ্রণ-প্রমাদহীন বইটির ছাপা, বাঁধাই ও প্রচ্ছদও প্রশংসনীয়।

সমরেশ মজুমদারের অনিমেষ-মাধবীলতা বিখ্যাত ট্রিলজির ‘কালবেলা’ উপন্যাসের শেষের দিক মনে পড়ছে, রাজনৈতিক উপন্যাস হলেও ‘অজিত সিং’-এর সঙ্গে তাকে মেলানো যাবে না। অনিমেষ যখন বলে, “মাধবীলতা রাজনীতি করেনি কখনো, শুধু তাকে ভালবেসে আলোকস্তম্ভের মত একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খরতপ্ত মধ্যাহ্নে যে এক গ্লাস শীতল জলের চেয়ে বেশি কিছু হতে চায় না। বাংলাদেশের এই মেয়ে যে কিনা শুধু ধূপের মত নিজেকে পোড়ায় আগামীকালকে সুন্দর করতে। দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা।” অনিমেষের আদর্শের লড়াই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তার জন্য মাধবীলতার অপেক্ষা ছিল। অজিত সিং আদর্শ খুইয়েছে। তার শৈশবের ‘তিতলি’ ছিল মন-প্রাণ-সত্তা জুড়ে, তিতলিই তার দাদাজির স্বপ্ন দেখানো বাংলা, যার মুখ সে চিরকাল খুঁজেছে। “…এই সেই মুখ যা কোন কালো হাত লেগে ময়লা হয়ে যায়নি। …জলের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, সে চলে যাবে, যাদের হয়ে সে কাজ করেছে, তারাও কেউ থাকবে না, যারা আসছে তারাও কেউ থাকবে না, কিন্তু ওই মুখ থেকে যাবে।” ওই মুখেই থাকে ত্রিনয়ন। মাধবীলতা বা দোলনচাঁপা— ওই মুখই বাংলার মুখ।

‘অজিত সিং’ এ-সময়ের দলিল, তা থেকে যাবে।

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
লেখক- তৃষ্ণা বসাক
প্রকাশক- দে’জ পাবলিশিং (এপ্রিল ২০২৩)
পৃষ্ঠাসংখ্যা- ৩৬৮, দাম- ৪৯৯ টাকা

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...