এক সাংবাদিকের চোখে মনমোহন সিং

শুভাশিস মৈত্র

 


প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৫-এর অগস্টে রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন ইন্দিরা হত্যা-পরবর্তী শিখবিরোধী হিংসার জন্য। মনমোহন শুধু শিখসমাজের কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করেননি, সমগ্র ভারতবাসীর কাছে ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। যদিও ওই ঘটনা যখন ঘটেছিল তখনও তিনি রাজনীতিতে আসেননি। মনমোহন সিংকে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল মৌনমোহন বলে ব্যঙ্গ করতেন। তাঁকে বিজেপি আখ্যা দিয়েছিলেন দুর্বল প্রধানমন্ত্রী বলে। তিনি একবার উত্তরে বলেছিলেন, আমেদাবাদের রাস্তায় অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেও নির্বিকার থাকাটা যদি “শক্তিশালী”-র পরিচয় হয় তবে তিনি তেমন শক্তিশালী হতে চান না

 

আমরা যারা কলকাতায় সাংবাদিকতা করি তাদের স্বাভাবিকভাবেই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের সাংবাদিক সম্মেলন কভার করার সুযোগ কম ঘটে। সেই কম জানা নিয়েই সদ্য-প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর প্রতি একজন সাংবাদিক হিসেবে শ্রদ্ধা জানাতে এই লেখা।

মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দশ বছরে ১১৭টি সংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। গড়ে প্রায় মাসে একটি করে। তাঁর বহু সাংবাদিক সম্মেলন সরাসরি দূরদর্শনে লাইভ সম্প্রচার হত। যে সাহস গত দশ বছরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এখনও একবারের জন্যেও দেখাতে পারেননি। যদিও নরেন্দ্র মোদি এবং অন্য বিজেপি নেতারা মনমোহনের কম কথা বলা নিয়ে প্রচুর ব্যঙ্গ করতেন সেই সময়।

তারিখটা ঠিক মনে নেই, ২০১১ সালে মনমোহন সিং একবার স্থির করলেন তিনি দুটি এমন সংবাদিক সম্মেলন করবেন যার প্রথমটিতে উপস্থিত থাকবেন দেশের সব রাজ্যের অন্তত একজন করে খবরের কাগজের সম্পাদক। দ্বিতীয়টিতে থাকবেন দেশের সব রাজ্যের অন্তত একজন করে টিভি নিউজ চ্যানেলের সম্পাদক। দিল্লির নামী সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকেরা অবশ্য দুটি প্রেস কনফারেন্সেই ছিলেন। দ্বিতীয়টিতে আমি আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সেই অভিজ্ঞতার কথা বললে মনমোহনকে কিছুটা বোঝা যাবে।

সেদিন সকালে নটা নাগাদ দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে এক বিরাট টেবিলে আমাদের সবার বসার ব্যবস্থা হয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক। প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঢুকে সবাইকে নমস্কার করলেন। মনে হয়েছিল এর পর তিনি তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসবেন। তিনি কিন্তু তা করলেন না। যেহেতু আমরা ছিলাম তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রিত, তিনি নিজে আমাদের প্রত্যেকের চেয়ারের সামনে এসে করমর্দন করলেন। কথা বললেন। চেনা সাংবাদিকদের অতিরিক্ত দু-একটা প্রশ্নও করলেন। তবে এত আস্তে কথা বলছিলেন যে প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না। প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করে তিনি গিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। সেটা ছিল এমন একটা সময় যখন কোল ব্লক স্ক্যাম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তুলকালাম চলছে। অভিযোগ শুধু তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নয়, সরাসরি তাঁকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে মিডিয়া এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। যেটা এখন ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, এইরকম একটা সময়ে তাঁর ডাকা ওই সাংবাদিক সম্মেলন কিন্তু সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল দূরদর্শনে। যার যেমন মনে হয়েছিল তিনি তেমনই প্রশ্ন করছেন, কোল ব্লক স্ক্যাম নিয়ে বেশ আক্রমণাত্মক প্রশ্নও ছুড়ে দিচ্ছিলেন কোনও কোনও সাংবাদিক, সব প্রশ্নের জবাব মনমোহন দিচ্ছিলেন অত্যন্ত নিচু গলায় এবং তা দূরদর্শন থেকে নিয়ে একই সঙ্গে দেখানো হচ্ছিল দেশের প্রায় সব নিউজ চ্যানেলে।

যেহেতু সংখ্যায় অনেক সাংবাদিক তাই আমাদের প্রত্যেককে বলা হয়েছিল একটি করে প্রশ্ন করতে। দু-একজন সেলিব্রিটি এডিটর অবশ্য একাধিক প্রশ্নও করেছিলেন। এক ঘণ্টার বেশি চলেছিল প্রেস কনফারেন্স। প্রেস কনফারেন্স শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, নমস্কার করলেন, এর পর তিনি ফের আমাদের প্রত্যেকের চেয়ারের কাছে এসে করমর্দন করে বিদায় নিলেন। এমনই ছিলেন মনমোহন।

এখন এই কথাগুলি বলা আরও বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে কারণ মনমোহন-পরবর্তী সময়ে মোদি-জমানায় ভারতীয় সাংবাদিকতা যে-জায়গায় এসে পৌঁছেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে। এইখানেই মনমোহন সিং-এর সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আকাশ-পাতাল দূরত্ব।

২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষে যখন শেষরাতে নির্ভয়ার মৃতদেহ মালয়েশিয়া থেকে ভারতে এসে পৌঁছেছিল, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দিল্লির সেই শীতের রাতে প্রোটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানাতে। আর এ-বছর জানুয়ারিতে দিল্লিতে যখন অলিম্পিকে পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরেরা নরেন্দ্র মোদির দলেরই এক সাংসদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানিয়ে দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে ধর্নায় বসেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন নির্বিকার। এইখানেই তফাত দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে।

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৫-এর অগস্টে রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন ইন্দিরা হত্যা-পরবর্তী শিখবিরোধী হিংসার জন্য। মনমোহন শুধু শিখ সমাজের কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করেননি, সমগ্র ভারতবাসীর কাছে ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। যদিও ওই ঘটনা যখন ঘটেছিল তখনও তিনি রাজনীতিতে আসেননি। তখন তিনি ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর। অন্য দিকে নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০২ সালে গুজরাতে দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মোদি কিন্তু কখনও এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেননি, ক্ষমাও চাননি গুজরাতবাসীর কাছে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকারে গুজরাত হিংসা-সংক্রান্ত একটি প্রশ্নে সরাসরি জবাব না দিয়ে মোদি বলেছিলেন, যদি কেউ গাড়ি চালানোর সময় আমরা পিছনের আসনে বসে থাকি, আর যদি সেই গাড়ির চাকার নিচে একটা কুকুরের বাচ্চা এসে পড়ে, সেটা কি দুঃখের হবে না, সেটাও তো দুঃখের ঘটনা। আমি তো মুখ্যমন্ত্রী, খারাপ কিছু ঘটলে স্বাভাবিক ঘটনা হল দুঃখ পাওয়া। এই হল দুই প্রধানমন্ত্রীর ভাষার ফারাক।

মনমোহন সিংকে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল মৌনমোহন বলে ব্যঙ্গ করতেন তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। তাঁকে বিজেপি আখ্যা দিয়েছিলেন দুর্বল প্রধানমন্ত্রী বলে। এর একটা জবাব অবশ্য মনমোহন দিয়েছিলেন একবার এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে। তাঁকে সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বিরোধী দলের নেতারা আপনাকে একজন দুর্বল প্রধানমন্ত্রী বলে, আপনার প্রতিক্রিয়া কী? তিনি উত্তরে গুজরাত দাঙ্গা এবং নরেন্দ্র মোদির নাম না করে বলেছিলেন, আমেদাবাদের রাস্তায় অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেও নির্বিকার থাকাটা যদি “শক্তিশালী”-র পরিচয় হয় তবে তিনি তেমন শক্তিশালী হতে চান না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...